বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৮৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক সাহসী ও দক্ষ এক মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন নজরুল ইসলাম (এ এন এম নজরুল ইসলাম)।
কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) করাচিতে। জুলাই মাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত ভাটিয়াপাড়ার যুদ্ধে বীরত্ব ও কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তিনি বীরত্বসূচক বীর প্রতীক খেতাব পান। তাঁর সনদ নম্বর ২৮৭। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা জানা যাক তাঁর বয়ানে।‘১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমি করাচি ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতির কারণেই তখন যোগ দিতে পারিনি। জুন মাসের প্রথমার্ধে আমার বাবা স্ট্রোকে মারা যান। তখন কর্তৃপক্ষ আমাকে ছুটি দেয়। আমি বাড়ি আসার পরদিন কাশিয়ানী স্কুলের হেডমাস্টার আবদুর রউফ এসে আমাকে বলেন, “কিছু ছেলেপেলেকে রাজাকারে ভর্তি করেছি, তুমি তাদের ট্রেনিং দেও।” আমি তাঁকে এটা-ওটা বলে বিদায় দিয়ে ওই দিন বিকেলেই ভারতের উদ্দেশে রওনা দিই।
‘ভারতে যাওয়ার পর কে এম ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে ৮ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার কল্যাণীতে পাঠান। ওখানে আমি প্রশাসনিক কাজ করতে থাকি। কিছুদিন পর নতুন সেক্টর কমান্ডার এম এ মঞ্জুর (বীর উত্তম, তখন মেজর, পরে মেজর জেনারেল এবং ১৯৮১ সালে নিহত) বিভিন্ন ক্যাম্পে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য রসদ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাকে দেন।
‘আমি সেক্টর হেডকোয়ার্টার বা ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ নিয়ে যেতাম। এ কাজ করার সময় বয়রা সাব-সেক্টর কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হুদার (বীর বিক্রম, তখন ক্যাপ্টেন, পরে কর্নেল এবং ১৯৭৫ সালে নিহত) সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাঁর কাছে আমি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি সেক্টর কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে আমাকে তাঁর সাব-সেক্টরে রাখেন।
‘কয়েক দিন পর নাজমুল হুদা আমাকে একটা ক্যাম্পের দায়িত্ব দেন। এই ক্যাম্পের মাধ্যমে ভারতে প্রশিক্ষিত বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশাল জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের ইনডাকশন করা হয়। দেশের ভেতরে যাওয়ার আগে তাঁরা এই ক্যাম্পে দু-তিন দিন অবস্থান করেন। তারপর ক্যাম্প থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেশের ভেতরে যান। তাঁদের দেখভাল করার দায়িত্ব আমার ওপর ছিল।
‘অবশেষে নভেম্বর মাসে আমি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাই। এ সময় যশোর জেলার বানগাতি বাজার ও মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানা আক্রমণে সরাসরি অংশ নিই। মোহাম্মদপুর থানা সদরে যুদ্ধের পর আমরা কয়েকজন রাজাকারকে আটক করি। তাদের বিচারের দায়িত্ব স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে দিয়ে আমরা নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানায় যাই। কয়েক স্থানে যুদ্ধ করি।
‘আমাদের দলনেতা ছিলেন মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী (বীর উত্তম), যিনি কমল সিদ্দিকী নামে পরিচিত। লোহাগড়া মুক্ত করার পর সেখানেই ছিলাম। এর মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আমরা জানতে পারি, ভাটিয়াপাড়া (গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত) তখনো মুক্ত হয়নি। সেখানে ওয়্যারলেস স্টেশনে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প।
‘১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করার পরও ভাটিয়াপাড়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করেনি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প ঘেরাও করে রাখেন। দুই পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টির পরও তারা আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায়।
‘আমাদের সাব-সেক্টর কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হুদা এ সময় যশোরে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি একদল মুক্তিযোদ্ধাসহ সেখানে রওনা দেন। আমরাও লোহাগড়া থেকে ভাটিয়াপাড়ার উদ্দেশে রওনা দিই। পথিমধ্যে তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমরা একত্রে ভাটিয়াপাড়ায় গিয়ে আক্রমণ চালাই।
‘তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়। তখন খন্দকার নাজমুল হুদার নির্দেশে তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমি ক্যাম্পে যাই। ভেতরে ঢুকে আমি অবাক হই। পাকিস্তানিরা মজুদ রেখেছিল পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ও রসদ। আর ছিল অনেক রাজাকার, কয়েকজন নারী ও কাশিয়ানী স্কুলের সেই হেডমাস্টার আবদুর রউফ। অবশেষে ৮৫ জন পাকিস্তানি সেনা-মিলিশিয়াসহ তাদের সহযোগী সবাই আত্মসমর্পণ করে। তাদের আমরা বন্দী করে যশোরে পাঠাই।’
নজরুল ইসলাম বর্তমানে আমেরিকার নিউইয়র্কে বসবাস করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার পানাইল গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ মমিনউদ্দীন, মা হাজেরা বেগম। স্ত্রী রওশন আরা বেগম। তাঁদের চার মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: নজরুল ইসলাম বীর প্রতীকের লিখিত বয়ান, নূরুল ইসলাম তালুকদার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments