একাত্তর-ভুলব না হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা by হিলাল ফয়েজী
জটিল পাকিস্তানের একটি সরল এবং নরমশরম বদল প্রয়োজন ছিল। সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়ে হিনা রব্বানি খার, আপনাকে পাকিস্তানের তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত করে দেওয়া হলো।
সত্যিই মাত্র ৩৪ বছরের এমন চোস্ত-চৌকস সুদর্শনা হিসেবে অন্যরকম এক পাকিস্তানের সম্মান পেল বুঝিবা এই ভূগোলক।
সুবিখ্যাত খার পরিবারের সুশিক্ষিতা আপনি। আপনার শব্দচয়ন, আপনার বিশ্লেষণ নয়ন, আপনার বয়ান এবং বাক্যবয়ন_ সবই একথায় অনন্য। হিনা রব্বানি খার, অল্পদিনেই আপনার বক্তব্যের ধার ও ভারে মুগ্ধ হলো দিলি্ল-বেইজিং-ওয়াশিংটনের ত্রিনয়ন। ঝকঝকে তারুণ্যে পাকিস্তানি নেতৃত্ব আধুনিক এবং অলঙ্কৃত-উদ্ভাসিত হলো হিনা আপনার অধিষ্ঠানে।
সেই আপনি এই সেদিন এলেন হঠাৎ বাংলাদেশে, কয়েক ঘণ্টার জন্য, বিশেষ ফ্লাইটে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ইসলামাবাদে 'ডি-এইট মজলিশে' আমন্ত্রণ জানাতে। আপনি এলেন। আমাদেরও একজন নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। ৪ বছর আগে বাংলাদেশ এবং পৃথিবীকে চমকে দেওয়া একজন হঠাৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সী আমাদের সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমাদের খোদ ক্ষমতাসীন প্রান্তর এবং নারী আন্দোলনের 'তারকা'মহলেও তেমন স্বাগতম-সমাদৃত হতে দেখিনি। পৃথিবীকে জ্ঞানের সূচনা-আলোকে উদ্ভাসিত-উজ্জীবিত করার বিশাল দাবিদার আমাদের মিডিয়া টাইকুনদেরও নানা উষ্মা দেখেছি এই নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘিরে, অথচ পূর্ব বাংলার হাজার বছরের পশ্চাৎপদ পটভূমিতে একজন নারীর এমনি পদায়ন ছিল আমাদের বদ্বীপ-সভ্যতার জ্বলজ্বলে আলোকিত ঘটনা। সে কথা থাক।
হিনা রব্বানি খার, আমাদের উপরোক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিনিট পনেরোর সাক্ষাৎকারে কূটনীতির ব্যাকরণ-প্রকরণকে কিঞ্চিৎ উপেক্ষা করে উদ্গিরণ করলেন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের অন্যতম আর্তি এবং একান্ত চাওয়ার কথাটুকু : একাত্তরের গণহত্যা এবং লোমহর্ষক নির্যাতন-ধর্ষণের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা চাইতে হবে। তাৎক্ষণিক চটপট উত্তরে হিনা আপনি ঝটপট বলেই ফেললেন, 'আমাদের অতীত ভুলে সামনে পা ফেলতে হবে।'
হিনা, আপনি বোধকরি বাংলাদেশের চেয়ে ছয় বছরের ছোট। আপনি এবার কয়েক ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশ দেখলেন, আপনি একাত্তর দেখেননি। সেই একাত্তর ভুলে যাওয়ার উপদেশ দিলেন কী সুললিত আপাতসরল ভঙ্গিতে। ইস্স্, আপনার সফরসূচিতে যদি একটি ঘণ্টা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক একটি বেসরকারি জাদুঘরে বরাদ্দ করতেন তাহলে ওই জাদুঘর-বিন্দুতে হয়তোবা দেখতে পেতেন একাত্তরের রক্ত-অশ্রু-যন্ত্রণার মহাসিন্ধুটি। হিনা, জানেন বাংলা শব্দ 'ইতিহাস'-এর উৎপত্তি কথা? ইতিহ+আস অর্থাৎ 'এইরূপ ছিল'। অর্থাৎ অতীতের কথাই ইতিহাস। অতীত ভুলতে বললে পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে 'ইতিহাস' বিষয়টি তুলে দিয়ে ভুলে যাওয়ার প্রস্তাবটুকু দিন। আপনাদের সরকারি টিভি 'পিটিভি' দেখার সুযোগ রয়েছে আমাদের। এই কয়েক বছর পিপিপি সরকারের পিটিভিতে শুধু জুলফিকার আর বেনজির ভুট্টোরই ছবিগাথা। পিপিপি তার প্রধান দুই তারকার স্মৃতিকে কেন্দ্র করেই 'কেউ যেন অতীত না ভোলে' সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছে। এ তো পাকিস্তানের আপনাদের দলের কথা; কিন্তু আমরা বলছি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মযন্ত্রণার কথা। কী ভুলতে হবে আমাদের হিনা রব্বানি? মেহেরবানি করে বাংলাদেশে তসরিফ এনে আপনি যে মহান বাণী বিতরণ করেছেন, সে কথা শ্রবণ করলে তো আমাদের ভুলে যেতে হয় বিবেক-বিবেচনা আর মানবিকতার অ, আ, ক, খ-কেই। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা একদিন ভেবেছিল উপমহাদেশে মুসলমানদের স্বতন্ত্র দেশ হলেই বুঝি সুখের নহর বইবে শত দরিয়া থেকে। কিন্তু সেই সাধারণ গাঁও-গেরামের চাষি-মজুররা ভাবতে পারেননি পাঞ্জাবের জোতদার-আমলা-পুঁজিপতি-সেনা জেনারেল মুসলমান আর সাধারণ মুসলমানের মধ্যে কত সহস্র আলোকবর্ষ ব্যবধান! হিনা, আপনি কি কখনও ১৯৫২ আর অমর একুশের কথা শুনেছেন? আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি নেকাব পরে গোপনে বাংলাদেশের রাজধানী শহর আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা সফর করে যাবেন কি? আপনাদের কায়েদে আজম ঢাকায় এসে বক্তৃতা করেছিলেন ১৯৪৮ সালের ২১ এবং ২৪ মার্চ। তিনি বলেছিলেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। আমাদের তরুণরা আপনাদের কায়েদে আজমকে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিলেন_ না, না, না। তারপর ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা মিছিলে পুলিশের গুলিতে বরকতদের প্রাণদান। হিনা, একুশের মধ্যরজনী থেকে দিবাভাগ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের কণ্ঠে একুশের শোকগান 'আমি কি ভুলিতে পারি' যদি শুনতেন একবার। ১৯৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান, আসাদ, মতিউরদের আমরা ভুলব না। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড (১৯৫০), টঙ্ক-তেভাগা-নানকা আন্দোলনের শহীদদের আমরা ভুলব না হিনা এবং ভুলব না ইতিহাস কাঁপানো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। ক্ষুদিরাম-তিতুমীর-সূর্যসেন-ভগৎ সিং-মঙ্গল পাণ্ডে-নূরুল দীন-ঝাঁসির রানী কাউকেই আমরা ভুলব না, বরং স্মরণ করবে তাদের ইতিহাস অনাদি-অনন্তকাল।
হিনা, আপনি কি জানেন এই পূর্ব পাকিস্তানে একজন শেখ মুজিব কীভাবে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির জনকে উত্তরিত হলেন ইতিহাসের অভাবিত-পূর্ব গতিতে। আপনি কি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতের 'অপারেশন সার্চলাইট' নামক কুখ্যাত ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের কাহিনী সবিস্তারে জানেন? সেই রাতে এবং দীর্ঘ ৯ মাসজুড়ে বর্বরতা ও নৃশংসতার পাকিস্তানি বাহিনীর কৃতকর্মের কাহিনী জানেন? মানুষকে কতভাবে নির্যাতন এবং খুন করতে হয় একাত্তরের অধিকৃত বাংলাদেশ প্রান্তরে, তা ইতিহাসকে প্রদর্শন করেছে টিক্কা খান-নিয়াজি-ফরমান বাহিনী। এই রাও ফরমান আলি বাঙালি বদনের উগ্র-নিষ্ঠুর কিছু প্রাণীকে নিয়ে আলবদর বাহিনী বানিয়ে বাংলাদেশের অগ্রণী বুদ্ধিজীবীদের বেয়নেটে চোখ উপড়ে, নির্যাতনের ক্রূরতায় যেভাবে হত্যা করেছে, আমরা যদি তা ভুলে যাই, তাহলে হিনা, ইতিহাস যে আমাদেরই ক্ষমা করবে না।
তবে আজ হোক কাল হোক ক্ষমা আপনাদের চাইতেই হবে। ইতিহাসের বুকে কলঙ্ক এবং অপরাধ রয়েছে আপনাদের পিপিপি প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলি ভুট্টোরও। পাকিস্তানি জেনারেলদের সিভিলিয়ান সাঙাৎ হিসেবে, ২৫ মার্চ রাতের অপারেশন এবং খুনি বাহিনীর সবটুকু নির্যাতনের পরিকল্পনার অন্যতম 'মস্তিষ্ক' হিসেবে ভুট্টোও মহাকালের কাছে চিরায়ত 'অপরাধী'। পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং পিপিপিকে তাই আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে হবেই, যদি দক্ষিণ এশিয়াকে, এই পৃথিবীকে একসঙ্গে এক কদম মানবিক পদক্ষেপ ফেলতে হয়। হিনা, আহা যদি আপনাকে এখনও বেঁচে থাকা এ দেশের কোনো শহীদ জননী কিংবা শহীদ জায়া, শহীদ ভগিনী-ভ্রাতা লাখো মানুষের কারও সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়া যেত, গজদন্ত মিনার থেকে সাধারণ কুটিরে নেমে এসে দেখতেন হাজার হাজার যৌন সহিংসতার শিকার একাত্তরের সেই নারীদের, তাহলে কি বলতে পারতেন_ অতীত ভুলে যান, অতীত ভুলে যান আপনারা সবাই!
পৃথিবীতে কোনো জাতিই তার অতীত ভোলে না। সিন্ধি-বেলুচ-পাঠান-পাঞ্জাবি কেউ ভুলতে পারে না। পাকিস্তানের জেনারেল-প্রেসিডেন্ট মোশাররফ দিলি্লতে খোঁজেন তার জন্মডেরা। ভারতের মনমোহন সিং আর আদভানি খোঁজেন বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তানের তাদের জন্মপ্রান্তর। হিনা, আমাদের বাংলাদেশ কখনোই তার অতীত ভুলবে না। অতীত মনে রেখে, অতীতের দেনা-পাওনা চুকানোর সংগ্রাম বজায় রেখেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং পৃথিবীতে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে শামিল থাকবে। সেই দুপুরে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে আমাদের নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার, আপনাকে সে লক্ষ্যেই একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার দাবিটি জানিয়েছেন।
হিলাল ফয়েজী :কলাম লেখক
সুবিখ্যাত খার পরিবারের সুশিক্ষিতা আপনি। আপনার শব্দচয়ন, আপনার বিশ্লেষণ নয়ন, আপনার বয়ান এবং বাক্যবয়ন_ সবই একথায় অনন্য। হিনা রব্বানি খার, অল্পদিনেই আপনার বক্তব্যের ধার ও ভারে মুগ্ধ হলো দিলি্ল-বেইজিং-ওয়াশিংটনের ত্রিনয়ন। ঝকঝকে তারুণ্যে পাকিস্তানি নেতৃত্ব আধুনিক এবং অলঙ্কৃত-উদ্ভাসিত হলো হিনা আপনার অধিষ্ঠানে।
সেই আপনি এই সেদিন এলেন হঠাৎ বাংলাদেশে, কয়েক ঘণ্টার জন্য, বিশেষ ফ্লাইটে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ইসলামাবাদে 'ডি-এইট মজলিশে' আমন্ত্রণ জানাতে। আপনি এলেন। আমাদেরও একজন নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। ৪ বছর আগে বাংলাদেশ এবং পৃথিবীকে চমকে দেওয়া একজন হঠাৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সী আমাদের সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমাদের খোদ ক্ষমতাসীন প্রান্তর এবং নারী আন্দোলনের 'তারকা'মহলেও তেমন স্বাগতম-সমাদৃত হতে দেখিনি। পৃথিবীকে জ্ঞানের সূচনা-আলোকে উদ্ভাসিত-উজ্জীবিত করার বিশাল দাবিদার আমাদের মিডিয়া টাইকুনদেরও নানা উষ্মা দেখেছি এই নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘিরে, অথচ পূর্ব বাংলার হাজার বছরের পশ্চাৎপদ পটভূমিতে একজন নারীর এমনি পদায়ন ছিল আমাদের বদ্বীপ-সভ্যতার জ্বলজ্বলে আলোকিত ঘটনা। সে কথা থাক।
হিনা রব্বানি খার, আমাদের উপরোক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিনিট পনেরোর সাক্ষাৎকারে কূটনীতির ব্যাকরণ-প্রকরণকে কিঞ্চিৎ উপেক্ষা করে উদ্গিরণ করলেন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের অন্যতম আর্তি এবং একান্ত চাওয়ার কথাটুকু : একাত্তরের গণহত্যা এবং লোমহর্ষক নির্যাতন-ধর্ষণের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমতা চাইতে হবে। তাৎক্ষণিক চটপট উত্তরে হিনা আপনি ঝটপট বলেই ফেললেন, 'আমাদের অতীত ভুলে সামনে পা ফেলতে হবে।'
হিনা, আপনি বোধকরি বাংলাদেশের চেয়ে ছয় বছরের ছোট। আপনি এবার কয়েক ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশ দেখলেন, আপনি একাত্তর দেখেননি। সেই একাত্তর ভুলে যাওয়ার উপদেশ দিলেন কী সুললিত আপাতসরল ভঙ্গিতে। ইস্স্, আপনার সফরসূচিতে যদি একটি ঘণ্টা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক একটি বেসরকারি জাদুঘরে বরাদ্দ করতেন তাহলে ওই জাদুঘর-বিন্দুতে হয়তোবা দেখতে পেতেন একাত্তরের রক্ত-অশ্রু-যন্ত্রণার মহাসিন্ধুটি। হিনা, জানেন বাংলা শব্দ 'ইতিহাস'-এর উৎপত্তি কথা? ইতিহ+আস অর্থাৎ 'এইরূপ ছিল'। অর্থাৎ অতীতের কথাই ইতিহাস। অতীত ভুলতে বললে পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে 'ইতিহাস' বিষয়টি তুলে দিয়ে ভুলে যাওয়ার প্রস্তাবটুকু দিন। আপনাদের সরকারি টিভি 'পিটিভি' দেখার সুযোগ রয়েছে আমাদের। এই কয়েক বছর পিপিপি সরকারের পিটিভিতে শুধু জুলফিকার আর বেনজির ভুট্টোরই ছবিগাথা। পিপিপি তার প্রধান দুই তারকার স্মৃতিকে কেন্দ্র করেই 'কেউ যেন অতীত না ভোলে' সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছে। এ তো পাকিস্তানের আপনাদের দলের কথা; কিন্তু আমরা বলছি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মযন্ত্রণার কথা। কী ভুলতে হবে আমাদের হিনা রব্বানি? মেহেরবানি করে বাংলাদেশে তসরিফ এনে আপনি যে মহান বাণী বিতরণ করেছেন, সে কথা শ্রবণ করলে তো আমাদের ভুলে যেতে হয় বিবেক-বিবেচনা আর মানবিকতার অ, আ, ক, খ-কেই। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা একদিন ভেবেছিল উপমহাদেশে মুসলমানদের স্বতন্ত্র দেশ হলেই বুঝি সুখের নহর বইবে শত দরিয়া থেকে। কিন্তু সেই সাধারণ গাঁও-গেরামের চাষি-মজুররা ভাবতে পারেননি পাঞ্জাবের জোতদার-আমলা-পুঁজিপতি-সেনা জেনারেল মুসলমান আর সাধারণ মুসলমানের মধ্যে কত সহস্র আলোকবর্ষ ব্যবধান! হিনা, আপনি কি কখনও ১৯৫২ আর অমর একুশের কথা শুনেছেন? আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি নেকাব পরে গোপনে বাংলাদেশের রাজধানী শহর আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা সফর করে যাবেন কি? আপনাদের কায়েদে আজম ঢাকায় এসে বক্তৃতা করেছিলেন ১৯৪৮ সালের ২১ এবং ২৪ মার্চ। তিনি বলেছিলেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। আমাদের তরুণরা আপনাদের কায়েদে আজমকে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিলেন_ না, না, না। তারপর ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা মিছিলে পুলিশের গুলিতে বরকতদের প্রাণদান। হিনা, একুশের মধ্যরজনী থেকে দিবাভাগ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের কণ্ঠে একুশের শোকগান 'আমি কি ভুলিতে পারি' যদি শুনতেন একবার। ১৯৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান, আসাদ, মতিউরদের আমরা ভুলব না। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড (১৯৫০), টঙ্ক-তেভাগা-নানকা আন্দোলনের শহীদদের আমরা ভুলব না হিনা এবং ভুলব না ইতিহাস কাঁপানো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। ক্ষুদিরাম-তিতুমীর-সূর্যসেন-ভগৎ সিং-মঙ্গল পাণ্ডে-নূরুল দীন-ঝাঁসির রানী কাউকেই আমরা ভুলব না, বরং স্মরণ করবে তাদের ইতিহাস অনাদি-অনন্তকাল।
হিনা, আপনি কি জানেন এই পূর্ব পাকিস্তানে একজন শেখ মুজিব কীভাবে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির জনকে উত্তরিত হলেন ইতিহাসের অভাবিত-পূর্ব গতিতে। আপনি কি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতের 'অপারেশন সার্চলাইট' নামক কুখ্যাত ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের কাহিনী সবিস্তারে জানেন? সেই রাতে এবং দীর্ঘ ৯ মাসজুড়ে বর্বরতা ও নৃশংসতার পাকিস্তানি বাহিনীর কৃতকর্মের কাহিনী জানেন? মানুষকে কতভাবে নির্যাতন এবং খুন করতে হয় একাত্তরের অধিকৃত বাংলাদেশ প্রান্তরে, তা ইতিহাসকে প্রদর্শন করেছে টিক্কা খান-নিয়াজি-ফরমান বাহিনী। এই রাও ফরমান আলি বাঙালি বদনের উগ্র-নিষ্ঠুর কিছু প্রাণীকে নিয়ে আলবদর বাহিনী বানিয়ে বাংলাদেশের অগ্রণী বুদ্ধিজীবীদের বেয়নেটে চোখ উপড়ে, নির্যাতনের ক্রূরতায় যেভাবে হত্যা করেছে, আমরা যদি তা ভুলে যাই, তাহলে হিনা, ইতিহাস যে আমাদেরই ক্ষমা করবে না।
তবে আজ হোক কাল হোক ক্ষমা আপনাদের চাইতেই হবে। ইতিহাসের বুকে কলঙ্ক এবং অপরাধ রয়েছে আপনাদের পিপিপি প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলি ভুট্টোরও। পাকিস্তানি জেনারেলদের সিভিলিয়ান সাঙাৎ হিসেবে, ২৫ মার্চ রাতের অপারেশন এবং খুনি বাহিনীর সবটুকু নির্যাতনের পরিকল্পনার অন্যতম 'মস্তিষ্ক' হিসেবে ভুট্টোও মহাকালের কাছে চিরায়ত 'অপরাধী'। পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং পিপিপিকে তাই আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে হবেই, যদি দক্ষিণ এশিয়াকে, এই পৃথিবীকে একসঙ্গে এক কদম মানবিক পদক্ষেপ ফেলতে হয়। হিনা, আহা যদি আপনাকে এখনও বেঁচে থাকা এ দেশের কোনো শহীদ জননী কিংবা শহীদ জায়া, শহীদ ভগিনী-ভ্রাতা লাখো মানুষের কারও সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়া যেত, গজদন্ত মিনার থেকে সাধারণ কুটিরে নেমে এসে দেখতেন হাজার হাজার যৌন সহিংসতার শিকার একাত্তরের সেই নারীদের, তাহলে কি বলতে পারতেন_ অতীত ভুলে যান, অতীত ভুলে যান আপনারা সবাই!
পৃথিবীতে কোনো জাতিই তার অতীত ভোলে না। সিন্ধি-বেলুচ-পাঠান-পাঞ্জাবি কেউ ভুলতে পারে না। পাকিস্তানের জেনারেল-প্রেসিডেন্ট মোশাররফ দিলি্লতে খোঁজেন তার জন্মডেরা। ভারতের মনমোহন সিং আর আদভানি খোঁজেন বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তানের তাদের জন্মপ্রান্তর। হিনা, আমাদের বাংলাদেশ কখনোই তার অতীত ভুলবে না। অতীত মনে রেখে, অতীতের দেনা-পাওনা চুকানোর সংগ্রাম বজায় রেখেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং পৃথিবীতে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে শামিল থাকবে। সেই দুপুরে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে আমাদের নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার, আপনাকে সে লক্ষ্যেই একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার দাবিটি জানিয়েছেন।
হিলাল ফয়েজী :কলাম লেখক
No comments