সময়ের প্রেক্ষিত- রাজনীতির অনিশ্চিত পথে জাপান by মনজুরুল হক
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিকো নোদা সংসদের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ নতুন নির্বাচন আহ্বান করেছেন। জাপানের সংবিধানে বর্ণিত ধারায় নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার ৪০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতার উল্লেখ রয়েছে।
সেই অনুযায়ী সরকার আগাম নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য এখন দায়িত্বে আসীন হয়েছে। সংবিধানে দেওয়া ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন সংসদ প্রথমবারের মতো অধিবেশনে মিলিত হওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে পদত্যাগ করতে হয়। অধিবেশনে মিলিত হওয়ার পর প্রথম দায়িত্ব হিসেবে নতুন সংসদ একজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে এবং সেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম সংসদীয় দায়িত্ব হিসেবে নতুন একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে নেন। নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আহ্বান করতে হয়। ফলে বলা যায়, চলতি বছরের শেষ দিকে কিংবা দেরিতে হলে আগামী বছরের শুরুতে জাপানে নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁর নিজস্ব নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে নেবেন। সাংবিধানিক ধারাকে সামনে রেখে দিন-তারিখ গণনার এই হিসাব খুব সহজ মনে হলেও, জাপানে রাজনীতির আগামী হিসাব-নিকাশ ততটা সহজ না-ও হয়ে উঠতে পারে বলে রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
জাপানের এই আসন্ন নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের প্রায় আট মাস আগে ডাকা হয়েছে। ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দলের সরকারের পক্ষে আগামী বছরের জুলাই মাসের শেষ দিক নাগাদ দায়িত্ব পালন করে যাওয়া তত্ত্বগত দিক থেকে সম্ভব ছিল। দলের সাংসদদের মধ্যে অনেকেই সে রকম প্রত্যাশাও করেছিলেন। তবে সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় বিভিন্ন বিল পাস করিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় দেখা দেওয়া সমস্যা শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে এবং নিজের ও দলের জন্য অনিশ্চিত সম্ভাবনার নির্বাচন তাঁকে ডাকতে হয়।
জাপানের বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তিনবার প্রধানমন্ত্রী বদল হওয়া সত্ত্বেও নিম্নকক্ষে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকায় গণতন্ত্রী দলকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়নি। তবে তার পরও দলের ‘মধুচন্দ্রিমা’ বা ব্যাপক জনসমর্থনের ধারা অব্যাহত থাকার সময়ের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র প্রায় নয় মাস, যে সময়ের পর থেকে দলকে ক্রমাগত চাপের মুখে থাকতে হয়। জাপানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা ক্ষমতাসীন দলের জন্য এ কারণে আবশ্যকীয় হয়ে দেখা দেয় যে উচ্চকক্ষের সমর্থন ছাড়া বিল পাস করিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন। নিম্নকক্ষের অনুমোদিত বিল উচ্চকক্ষ বাতিল করে দিলে তা আবারও নিম্নকক্ষে ফিরে আসে এবং সে রকম অবস্থায় শুধু বাজেট বিল ছাড়া অন্যান্য বিল নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনেই কেবল অনুমোদিত হতে পারে। গণতান্ত্রিক দলের সরকারের সূচনার দিনগুলোতে উভয় কক্ষে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিল উচ্চকক্ষের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিপর্যয় সেই হিসাব পাল্টে দেয় এবং এর পর থেকে দলকে আইন প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় ক্রমেই বিরোধী শিবিরের কাছে ধরনা দিয়ে নানা রকম ছাড় বিরোধীদের দিয়ে বিল পাস করিয়ে নিতে হয়েছে। সে রকম ছাড় দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীনেরা শেষ পর্যন্ত তাদের তিন বছর আগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে এতটাই দূরে সরে এসেছে যে প্রধান বিরোধী উদার গণতন্ত্রী দলের সঙ্গে গণতন্ত্রীদের নীতিগত পার্থক্য খুঁজে পাওয়া এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সে রকম অবস্থায় আসন্ন নির্বাচনে আবারও ক্ষমতার হাতবদল এখন খুবই প্রত্যাশিত বলে জাপানের সংবাদমাধ্যম মনে করছে। তবে ক্ষমতার সেই হাতবদলের প্রক্রিয়া যে মসৃণ এক প্রক্রিয়া হবে, তা কিন্তু রাজনীতির বিশেষজ্ঞ কিংবা সংবাদমাধ্যম—কেউই বলছে না। অনেকেরই ধারণা, মধ্য ডিসেম্বরের নির্বাচনে উদার গণতন্ত্রীদের পালে হাওয়া বইলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ফায়দা লুটে নিতে পারে। আর সেই সম্ভাব্য তৃতীয় শক্তি নিয়েই অনেকের মধ্যে এখন উৎকণ্ঠা বিরাজমান।
জাপানের সংবাদমাধ্যমে তৃতীয় সেই শক্তি হিসেবে যেটাকে দেখা হচ্ছে, তা হলো নতুন গড়ে ওঠা উগ্র জাতীয়তাবাদী ও চরম দক্ষিণপন্থীদের এক জোট, মূল নেতৃত্বে যেখানে রয়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই প্রজন্ম ও বলয়ের দুই নেতা—টোকিওর সাবেক গভর্নর ও বর্ষীয়ান ডানপন্থী রাজনীতিবিদ শিনতারো ইশিহারা এবং ওসাকার তরুণ মেয়র ও জাপানকে সংকটমুক্ত করায় বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা রাজনীতিবিদ তোরু হাশিমোতো। চল্লিশের শুরুর ঘরে বয়সের হাশিমোতোর সঙ্গে ইশিহারার বয়সগত ব্যবধান হচ্ছে প্রায় ৪০ বছর। তবে নীতিগত দিক থেকে বড় দাগের অনেক মিল তাঁদের দুজনের মধ্যে রয়ে গেছে এবং সে কারণেই নির্বাচন সামনে রেখে জোটবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা তাঁরা দিয়েছেন।
ইশিহারা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে উদার গণতন্ত্রী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিজের নতুন রাজনৈতিক দল ‘সূর্যোদয় জোট’ গঠনের ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন। অনেকটা একই সময়ে ওসাকার মেয়র ‘পুনর্জাগরণ দল’ নাম দিয়ে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেন। তবে অল্পদিনের মধ্যেই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তে তাঁরা উপনীত হন এবং দলের নাম পুনর্জাগরণ অপরিবর্তিত রেখে ইশিহারাকে দলের সভাপতির দায়িত্ব দিতে তাঁরা দুজনেই সম্মত হন। ফলে অনেকটা দ্বৈত নেতৃত্বের সেই দল এখন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলা জাপানি ভোটারদের সমর্থন লাভের চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যায়, নতুন এই জোট প্রায় ১৫ শতাংশের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হবে। ভোটের সার্বিক হিসাবে এই সংখ্যা তেমন আশাব্যঞ্জক না শোনালেও বড় দুটি দলের প্রতি সমর্থনের হার ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মাত্রায় বিরাজমান হওয়ায় নতুন জোটের ‘কিং মেকারে’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ছাড়া উদার গণতন্ত্রীদের প্রতি জনসমর্থনের পাল্লা সবচেয়ে ভারী হওয়ায় অন্য যে দিকটির ওপরও দৃষ্টি দেওয়া দরকার, তা হলো উদার গণতন্ত্রী দলের নবনির্বাচিত নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে নতুন জোটের নেতাদের চিন্তাভাবনাগত বড় ব্যবধান না থাকা। আর তাই অনেকেই ধারণা করছেন, মধ্য ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল জাপানকে হয়তো আঞ্চলিক রাজনীতিতে দেখা দেওয়া অস্থির এই সময়ে আরও কিছুটা দক্ষিণপন্থী দিকে নিয়ে যাবে, যা কিনা শেষ পর্যন্ত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
শিনতারো ইশিহারা কট্টর চীনবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তোরু হাশিমোতোও চীনের প্রতি নরম মনোভাব পোষণকারী কোনো অবস্থাতেই নন। অন্যদিকে শিনজো আবেও সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি করে চীনের বিরোধিতার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে এই ত্রিমুখী বলয় জাপানের অর্থনীতিতে দেখা দেওয়া অনিশ্চিত এই সময়ে দেশকে কোন পথে নিয়ে যায়, তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। যদিও এঁরা মনে করছেন, বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে সে রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ এঁরা হয়তো শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যাবেন। জাপানের ব্যবসায়ী মহল চাইছে, চীনসংক্রান্ত কট্টর অবস্থান থেকে জাপান যেন কিছুটা হলেও সরে আসে। জাপানে অর্থনীতির আরও ক্ষতি হওয়া দেখতে চান না বলেই সেই অবস্থান ব্যবসায়ী নেতৃত্ব গ্রহণ করছেন। ফলে সেই চাপ নতুন যেকোনো সরকারের ওপর বজায় থাকবে।
আসন্ন নির্বাচনে সবচেয়ে ক্ষতি যে দলটির হবে বলে জনমত জরিপ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, সেটা হলো ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দল। মাত্র তিন বছর আগে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন একটি দলের জন্য এই পরিণতি অবশ্যই হচ্ছে মর্মান্তিক। তবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে চরম ব্যর্থতা এবং দলের ভেতরের কোন্দল সেই পরিণতির দিকে দলকে নিয়ে যাচ্ছে, যা কিনা জাপানের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ধারায় মস্ত বড় এক ক্ষত হিসেবে বিরাজমান থাকবে, যে ক্ষত উদার গণতন্ত্রীদের জন্যও আবারও ক্ষমতায় ফিরে যাওয়ার পথ তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে যে অনিশ্চয়তা থেকে বের হয়ে আসার প্রত্যাশা নিয়ে জাপানের ভোটদাতারা সাড়ে তিন বছর আগে উদার গণতন্ত্রীদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন, অনিশ্চিত সেই পথেই জাপান হয়তো এখন আবারও ফিরে যাচ্ছে।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
জাপানের এই আসন্ন নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের প্রায় আট মাস আগে ডাকা হয়েছে। ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দলের সরকারের পক্ষে আগামী বছরের জুলাই মাসের শেষ দিক নাগাদ দায়িত্ব পালন করে যাওয়া তত্ত্বগত দিক থেকে সম্ভব ছিল। দলের সাংসদদের মধ্যে অনেকেই সে রকম প্রত্যাশাও করেছিলেন। তবে সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় বিভিন্ন বিল পাস করিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় দেখা দেওয়া সমস্যা শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে এবং নিজের ও দলের জন্য অনিশ্চিত সম্ভাবনার নির্বাচন তাঁকে ডাকতে হয়।
জাপানের বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তিনবার প্রধানমন্ত্রী বদল হওয়া সত্ত্বেও নিম্নকক্ষে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকায় গণতন্ত্রী দলকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়নি। তবে তার পরও দলের ‘মধুচন্দ্রিমা’ বা ব্যাপক জনসমর্থনের ধারা অব্যাহত থাকার সময়ের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র প্রায় নয় মাস, যে সময়ের পর থেকে দলকে ক্রমাগত চাপের মুখে থাকতে হয়। জাপানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা ক্ষমতাসীন দলের জন্য এ কারণে আবশ্যকীয় হয়ে দেখা দেয় যে উচ্চকক্ষের সমর্থন ছাড়া বিল পাস করিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন। নিম্নকক্ষের অনুমোদিত বিল উচ্চকক্ষ বাতিল করে দিলে তা আবারও নিম্নকক্ষে ফিরে আসে এবং সে রকম অবস্থায় শুধু বাজেট বিল ছাড়া অন্যান্য বিল নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনেই কেবল অনুমোদিত হতে পারে। গণতান্ত্রিক দলের সরকারের সূচনার দিনগুলোতে উভয় কক্ষে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিল উচ্চকক্ষের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিপর্যয় সেই হিসাব পাল্টে দেয় এবং এর পর থেকে দলকে আইন প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় ক্রমেই বিরোধী শিবিরের কাছে ধরনা দিয়ে নানা রকম ছাড় বিরোধীদের দিয়ে বিল পাস করিয়ে নিতে হয়েছে। সে রকম ছাড় দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীনেরা শেষ পর্যন্ত তাদের তিন বছর আগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে এতটাই দূরে সরে এসেছে যে প্রধান বিরোধী উদার গণতন্ত্রী দলের সঙ্গে গণতন্ত্রীদের নীতিগত পার্থক্য খুঁজে পাওয়া এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সে রকম অবস্থায় আসন্ন নির্বাচনে আবারও ক্ষমতার হাতবদল এখন খুবই প্রত্যাশিত বলে জাপানের সংবাদমাধ্যম মনে করছে। তবে ক্ষমতার সেই হাতবদলের প্রক্রিয়া যে মসৃণ এক প্রক্রিয়া হবে, তা কিন্তু রাজনীতির বিশেষজ্ঞ কিংবা সংবাদমাধ্যম—কেউই বলছে না। অনেকেরই ধারণা, মধ্য ডিসেম্বরের নির্বাচনে উদার গণতন্ত্রীদের পালে হাওয়া বইলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ফায়দা লুটে নিতে পারে। আর সেই সম্ভাব্য তৃতীয় শক্তি নিয়েই অনেকের মধ্যে এখন উৎকণ্ঠা বিরাজমান।
জাপানের সংবাদমাধ্যমে তৃতীয় সেই শক্তি হিসেবে যেটাকে দেখা হচ্ছে, তা হলো নতুন গড়ে ওঠা উগ্র জাতীয়তাবাদী ও চরম দক্ষিণপন্থীদের এক জোট, মূল নেতৃত্বে যেখানে রয়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই প্রজন্ম ও বলয়ের দুই নেতা—টোকিওর সাবেক গভর্নর ও বর্ষীয়ান ডানপন্থী রাজনীতিবিদ শিনতারো ইশিহারা এবং ওসাকার তরুণ মেয়র ও জাপানকে সংকটমুক্ত করায় বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা রাজনীতিবিদ তোরু হাশিমোতো। চল্লিশের শুরুর ঘরে বয়সের হাশিমোতোর সঙ্গে ইশিহারার বয়সগত ব্যবধান হচ্ছে প্রায় ৪০ বছর। তবে নীতিগত দিক থেকে বড় দাগের অনেক মিল তাঁদের দুজনের মধ্যে রয়ে গেছে এবং সে কারণেই নির্বাচন সামনে রেখে জোটবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা তাঁরা দিয়েছেন।
ইশিহারা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে উদার গণতন্ত্রী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিজের নতুন রাজনৈতিক দল ‘সূর্যোদয় জোট’ গঠনের ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন। অনেকটা একই সময়ে ওসাকার মেয়র ‘পুনর্জাগরণ দল’ নাম দিয়ে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেন। তবে অল্পদিনের মধ্যেই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তে তাঁরা উপনীত হন এবং দলের নাম পুনর্জাগরণ অপরিবর্তিত রেখে ইশিহারাকে দলের সভাপতির দায়িত্ব দিতে তাঁরা দুজনেই সম্মত হন। ফলে অনেকটা দ্বৈত নেতৃত্বের সেই দল এখন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলা জাপানি ভোটারদের সমর্থন লাভের চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যায়, নতুন এই জোট প্রায় ১৫ শতাংশের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হবে। ভোটের সার্বিক হিসাবে এই সংখ্যা তেমন আশাব্যঞ্জক না শোনালেও বড় দুটি দলের প্রতি সমর্থনের হার ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মাত্রায় বিরাজমান হওয়ায় নতুন জোটের ‘কিং মেকারে’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ছাড়া উদার গণতন্ত্রীদের প্রতি জনসমর্থনের পাল্লা সবচেয়ে ভারী হওয়ায় অন্য যে দিকটির ওপরও দৃষ্টি দেওয়া দরকার, তা হলো উদার গণতন্ত্রী দলের নবনির্বাচিত নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে নতুন জোটের নেতাদের চিন্তাভাবনাগত বড় ব্যবধান না থাকা। আর তাই অনেকেই ধারণা করছেন, মধ্য ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল জাপানকে হয়তো আঞ্চলিক রাজনীতিতে দেখা দেওয়া অস্থির এই সময়ে আরও কিছুটা দক্ষিণপন্থী দিকে নিয়ে যাবে, যা কিনা শেষ পর্যন্ত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
শিনতারো ইশিহারা কট্টর চীনবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তোরু হাশিমোতোও চীনের প্রতি নরম মনোভাব পোষণকারী কোনো অবস্থাতেই নন। অন্যদিকে শিনজো আবেও সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি করে চীনের বিরোধিতার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে এই ত্রিমুখী বলয় জাপানের অর্থনীতিতে দেখা দেওয়া অনিশ্চিত এই সময়ে দেশকে কোন পথে নিয়ে যায়, তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। যদিও এঁরা মনে করছেন, বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে সে রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ এঁরা হয়তো শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যাবেন। জাপানের ব্যবসায়ী মহল চাইছে, চীনসংক্রান্ত কট্টর অবস্থান থেকে জাপান যেন কিছুটা হলেও সরে আসে। জাপানে অর্থনীতির আরও ক্ষতি হওয়া দেখতে চান না বলেই সেই অবস্থান ব্যবসায়ী নেতৃত্ব গ্রহণ করছেন। ফলে সেই চাপ নতুন যেকোনো সরকারের ওপর বজায় থাকবে।
আসন্ন নির্বাচনে সবচেয়ে ক্ষতি যে দলটির হবে বলে জনমত জরিপ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, সেটা হলো ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দল। মাত্র তিন বছর আগে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন একটি দলের জন্য এই পরিণতি অবশ্যই হচ্ছে মর্মান্তিক। তবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে চরম ব্যর্থতা এবং দলের ভেতরের কোন্দল সেই পরিণতির দিকে দলকে নিয়ে যাচ্ছে, যা কিনা জাপানের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ধারায় মস্ত বড় এক ক্ষত হিসেবে বিরাজমান থাকবে, যে ক্ষত উদার গণতন্ত্রীদের জন্যও আবারও ক্ষমতায় ফিরে যাওয়ার পথ তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে যে অনিশ্চয়তা থেকে বের হয়ে আসার প্রত্যাশা নিয়ে জাপানের ভোটদাতারা সাড়ে তিন বছর আগে উদার গণতন্ত্রীদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন, অনিশ্চিত সেই পথেই জাপান হয়তো এখন আবারও ফিরে যাচ্ছে।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments