স্মরণের আবরণে মরণেরে ঢাকি by মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
বিশিষ্ট অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষ দত্তের (১৯৩১-২০১২) তিরোধান এ বছরে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির, বিশেষ করে চলচ্চিত্র শিল্পের সৃজনশীল মানুষের মৃত্যুর মিছিল হয়েছে আরও বড় ও বেদনার্ত।
৮২ বছর বয়সে প্রয়াত সুভাষ দত্ত পা থেকে মাথা পর্যন্ত কুশলী, কৃতবিদ, কর্মতৎপর, সৎ ও স্বচ্ছ মনের অধিকারী ছিলেন।
অনন্য সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী সুভাষ দত্তের শিল্পভাবনার শর্ত ও মূল্যবোধ ছিল_ জীবন-সংগ্রামে মুখর তুখোড় তৎপরতা শেষে শিকড়ের কাছে প্রত্যাবর্তন, নিজের উপলব্ধির কাছে ফিরে আসা। নিজে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সুদূর বোম্বেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে 'অনেক কিছু' করার পর দেশে ফিরেছিলেন। সিনেমার প্রচারপত্র ও আর্ট ডিরেকশন এবং বাংলা উর্দু ছবিতে কৌতুকপ্রদ চরিত্রে অভিনয় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েও সেই অভিনয় সুনামের সুবাদে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের শ্রদ্ধা ও সমীহবোধের কারণে মুক্তি পেয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' নির্মাণশৈলীর অনুরক্ত ভক্ত বনে যান। নিজে চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। তার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মর্মবাণী হলো শিকড়ের কাছে ফিরে আসা। 'সুতরাং' ছবিতে তার নিজের অভিনীত চরিত্র সিপাহি জব্বার শহরে ব্যস্ত সব কর্মজীবন ছেড়ে 'ওরে মন ছুটে চল মধুমতি গায়' গাইতে গাইতে ফিরেছে গ্রামে। 'কত ঘুরে এলাম কত দেখে এলাম অশান্ত মনে আমি ছুটে এলাম... আমার গায়ের মতো কভু দেখিনি, সে যে আমার জন্মভূমি...।' 'আলিঙ্গন'-এর সাধু বাবার মতো সুভাষ দত্ত তার শিল্পকর্মে, 'বসুন্ধরা'য় সেই মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি প্রকাশ করেছেন। দেশিকোত্তম এই ব্যক্তিত্ব নিজের দেশ, মাটি ও মানুষকে সর্বোচ্চ মহিমায় দেখিয়েছেন। 'অরুণোদয়ের অগি্নসাক্ষী'তে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসনে রেখেছেন মানবীয় দর্শনের ব্যাখ্যা ও সমাধানের প্রেরণা। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকীর 'গলির ধারের ছেলেটি'র চলচ্চিত্রায়নে (ডুমুরের ফুল) একই সঙ্গে শিশু মনস্তত্ত্বের ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির এমন কাব্যিক শোকগাথা নির্মাণ করেন, যা একটি ধ্রুপদী শিল্পকর্মে উন্নীত হয়। 'আবির্ভাব' ও 'বসুন্ধরা' ছবিতে সন্তানময়ী মায়ের আবেগ ও আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষাকে শৈল্পিক তুলিতে বিমূর্ত করেছেন। তার তাবৎ চলচ্চিত্রেই মানবিক মূল্যবোধের, সমাজ দর্শনের এবং নিবিষ্ট চিন্তা-চেতনার ভাষ্যে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। 'মনরে চল নিজের নিকেতনে' স্বামী বিবেকানন্দের এই ভূয়োদর্শনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি।
নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার ওপর সরকারি অনুদানে তার নির্মীয়মাণ শেষ ছবি শেষ করার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী ছিলেন_ এ ছবিতে তিনি বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকাকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকে 'বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকা' শীর্ষক আমার একটি প্রবন্ধ পড়ে এ ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহবোধ করেছিলেন। সামাজিক গবেষণার প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল, প্রচুর পড়াশোনা করতেন। দুর্ভাগ্য, অলঙ্ঘনীয় জটিলতার আবর্ত ও অবগুণ্ঠন থেকে বেগম রোকেয়ার ওপর ছবিটি নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা সুনিশ্চিত করা যায়নি। এ নিয়ে তিনি প্রায়ই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতেন। কালজয়ী এক সৃজনশীল কাজের অপ্রকাশের এই অব্যক্ত বেদনাবোধ নিয়েই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ হিসেবে চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। দত্ত বাবুর ছোট বোন শ্রীমতী ঝর্ণা দত্ত ও আমি যৌথভাবে একটি চিত্রনাট্য দাখিল করি, সেটি গৃহীত হয়, আমরা পুরস্কৃত হই। দাদার পরিচালনায় সেটি সেলুলয়েডে বাঙ্ময় হয়ে উঠবে, এমন প্রত্যাশা তার ও আমাদের ছিল। আমাদের সে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে গেল। খুব কাছ থেকে দেখার এবং তার কিছু কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সুবাদে এ কথা বলতে পারি, সুভাষ দত্ত একজন মহৎপ্রাণ শিল্পী ছিলেন। চলচ্চিত্রকে শিল্প মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে তার প্রয়াসের যেমন অন্ত ছিল না আবার তার হাতেই বাংলা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগের সার্থকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নাবালকত্ব থেকে সাবালকত্বে, উর্দু ছবির ভববন্ধন থেকে বাংলা ছবিকে রক্তমাংসসহ সবল, সতেজ ও শিল্প বিনিয়োগ উপযোগী করে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুরো ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। তার তিরোধান একটি যুগের সমাপ্তি, অপূরণীয় ক্ষতি দেশ ও জাতির, শিল্প জগতের এবং দর্শকনন্দিত বিনিয়োগবান্ধব সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণের।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
অনন্য সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী সুভাষ দত্তের শিল্পভাবনার শর্ত ও মূল্যবোধ ছিল_ জীবন-সংগ্রামে মুখর তুখোড় তৎপরতা শেষে শিকড়ের কাছে প্রত্যাবর্তন, নিজের উপলব্ধির কাছে ফিরে আসা। নিজে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সুদূর বোম্বেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে 'অনেক কিছু' করার পর দেশে ফিরেছিলেন। সিনেমার প্রচারপত্র ও আর্ট ডিরেকশন এবং বাংলা উর্দু ছবিতে কৌতুকপ্রদ চরিত্রে অভিনয় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েও সেই অভিনয় সুনামের সুবাদে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের শ্রদ্ধা ও সমীহবোধের কারণে মুক্তি পেয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' নির্মাণশৈলীর অনুরক্ত ভক্ত বনে যান। নিজে চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। তার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মর্মবাণী হলো শিকড়ের কাছে ফিরে আসা। 'সুতরাং' ছবিতে তার নিজের অভিনীত চরিত্র সিপাহি জব্বার শহরে ব্যস্ত সব কর্মজীবন ছেড়ে 'ওরে মন ছুটে চল মধুমতি গায়' গাইতে গাইতে ফিরেছে গ্রামে। 'কত ঘুরে এলাম কত দেখে এলাম অশান্ত মনে আমি ছুটে এলাম... আমার গায়ের মতো কভু দেখিনি, সে যে আমার জন্মভূমি...।' 'আলিঙ্গন'-এর সাধু বাবার মতো সুভাষ দত্ত তার শিল্পকর্মে, 'বসুন্ধরা'য় সেই মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি প্রকাশ করেছেন। দেশিকোত্তম এই ব্যক্তিত্ব নিজের দেশ, মাটি ও মানুষকে সর্বোচ্চ মহিমায় দেখিয়েছেন। 'অরুণোদয়ের অগি্নসাক্ষী'তে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের সামাজিক পুনর্বাসনে রেখেছেন মানবীয় দর্শনের ব্যাখ্যা ও সমাধানের প্রেরণা। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকীর 'গলির ধারের ছেলেটি'র চলচ্চিত্রায়নে (ডুমুরের ফুল) একই সঙ্গে শিশু মনস্তত্ত্বের ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির এমন কাব্যিক শোকগাথা নির্মাণ করেন, যা একটি ধ্রুপদী শিল্পকর্মে উন্নীত হয়। 'আবির্ভাব' ও 'বসুন্ধরা' ছবিতে সন্তানময়ী মায়ের আবেগ ও আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষাকে শৈল্পিক তুলিতে বিমূর্ত করেছেন। তার তাবৎ চলচ্চিত্রেই মানবিক মূল্যবোধের, সমাজ দর্শনের এবং নিবিষ্ট চিন্তা-চেতনার ভাষ্যে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। 'মনরে চল নিজের নিকেতনে' স্বামী বিবেকানন্দের এই ভূয়োদর্শনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি।
নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার ওপর সরকারি অনুদানে তার নির্মীয়মাণ শেষ ছবি শেষ করার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী ছিলেন_ এ ছবিতে তিনি বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকাকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকে 'বেগম রোকেয়ার সামাজিক ভূমিকা' শীর্ষক আমার একটি প্রবন্ধ পড়ে এ ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহবোধ করেছিলেন। সামাজিক গবেষণার প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল, প্রচুর পড়াশোনা করতেন। দুর্ভাগ্য, অলঙ্ঘনীয় জটিলতার আবর্ত ও অবগুণ্ঠন থেকে বেগম রোকেয়ার ওপর ছবিটি নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা সুনিশ্চিত করা যায়নি। এ নিয়ে তিনি প্রায়ই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতেন। কালজয়ী এক সৃজনশীল কাজের অপ্রকাশের এই অব্যক্ত বেদনাবোধ নিয়েই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ হিসেবে চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। দত্ত বাবুর ছোট বোন শ্রীমতী ঝর্ণা দত্ত ও আমি যৌথভাবে একটি চিত্রনাট্য দাখিল করি, সেটি গৃহীত হয়, আমরা পুরস্কৃত হই। দাদার পরিচালনায় সেটি সেলুলয়েডে বাঙ্ময় হয়ে উঠবে, এমন প্রত্যাশা তার ও আমাদের ছিল। আমাদের সে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে গেল। খুব কাছ থেকে দেখার এবং তার কিছু কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সুবাদে এ কথা বলতে পারি, সুভাষ দত্ত একজন মহৎপ্রাণ শিল্পী ছিলেন। চলচ্চিত্রকে শিল্প মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে তার প্রয়াসের যেমন অন্ত ছিল না আবার তার হাতেই বাংলা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগের সার্থকতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নাবালকত্ব থেকে সাবালকত্বে, উর্দু ছবির ভববন্ধন থেকে বাংলা ছবিকে রক্তমাংসসহ সবল, সতেজ ও শিল্প বিনিয়োগ উপযোগী করে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পুরো ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। তার তিরোধান একটি যুগের সমাপ্তি, অপূরণীয় ক্ষতি দেশ ও জাতির, শিল্প জগতের এবং দর্শকনন্দিত বিনিয়োগবান্ধব সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণের।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments