নেহার ঘুঘুজোড়া by দীপু মাহমুদ
নেহা মামাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে, ‘ইউ আর অ্যা গ্রেট মামা! আই লাইক ইউ। আই লাভ ইউ। তোমার মতো মামা এই প্ল্যানেটে আর একটিও নেই।’ মেয়ের এমন উচ্ছ্বসিত গলা শুনে মা ঘরের ভেতর থেকে জানতে চান, ‘কী রে কী হয়েছে? মামাকে অমন করে মহাকাশযানে তুলে দিচ্ছিস যে!’
নেহা বলে, ‘দেখো মা কী হয়েছে।
নেহা বলে, ‘দেখো মা কী হয়েছে।
মামা গ্রাম থেকে আমার জন্য একজোড়া ঘুঘু নিয়ে এসেছে। মাই ফেভরিট বার্ড। দ্য ডাভ।’
মা দেখলেন বড় ভাইজান সত্যি খাঁচায় করে একজোড়া ঘুঘু নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘তুমি পারোও বটে ভাইজান।’
মামা বললেন, ‘নেহা গতবার একজোড়া ঘুঘুর জন্য এমন করে বলল। আমার খুব মায়া হলো। কী সামান্য আবদার দেখো মেয়ের। মামা হয়ে সেটুকুও যদি মেটাতে না পারি তাহলে আর কিসের মামা। তাই না নেহা মা?’
নেহার ফাইনাল পরীক্ষা সামনের মাসে। এবার সে ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠবে। মা বলেছেন পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হলে গ্রামে বড় মামার কাছে যেতে দেবে। নেহা তাই মন দিয়ে পড়ালেখা করছে। কারণ, গ্রামে যেতে ওর খুব ভালো লাগে।
নেহা পাখির খাঁচা বারান্দায় নিয়ে রাখে। শহরের মাঝখানে বড় রাস্তার পাশে দশতলা একটা অ্যাপার্টমেন্টের চতুর্থ তলায় নেহাদের ফ্ল্যাট। ঘুঘুজোড়ার মনে হয় এ এক ভারি অদ্ভুত জায়গা। চারদিকে ধুলাবালি, এখানে-সেখানে নোংরা। কেবল দালান আর দালান। বাড়ির পরে সারি সারি বাড়ি। কোথাও গাছ নেই। সবুজ নেই কোনোখানে।
খাঁচায় আটকা পড়ে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে ওদের। নেহা মাঝেমধ্যে এসে খাবার দিয়ে যায়। খাঁচার ভেতরে রাখা ছোট পাত্রের পানি বদলে নতুন পানি দিয়ে যায়। কত গল্প করে তখন। বলে, ‘জানো, আমাদের না একটা বিড়াল ছিল। খুব দুষ্টু ছিল সে। একদম কথা শুনত না।’
মা নেহাকে ডেকে পড়তে বসতে বলেন। নেহা পাখির খাঁচার কাছ থেকে উঠে চলে যায়। আবার একা হয়ে পড়ে ঘুঘুজোড়া।
গ্রামের সেই বাঁশবাগানের কথা মনে পড়ে। সেই সবুজ বটগাছে ছোট ছোট লাল ফল। খেজুরগাছের ওপর বাসা বেঁধে ডিম পাড়া। ঘুঘুজোড়া অনুভব করার চেষ্টা করে শীতের সকালে কুয়াশার ভেতর দিয়ে রোদ্দুরের ছোঁয়া।
ওদের যখন গ্রাম থেকে নিয়ে আসে, তখনই শীত পড়ে গেছে। মাঠে মাঠে কিষানেরা ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। গৃহস্থবাড়িতে পিঠা তৈরির ধুম লেগেছে। আর এই শহরে শীতের কোনো আভাসমাত্র নেই। দূরে ইটভাটার কালো ধোঁয়া গবগব করে আকাশে ছড়িয়ে গিয়ে অন্ধকার করে দিয়েছে। তার সঙ্গে গাড়ির কালো ধোঁয়া মিশে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয়। রাতদিন চারপাশের ঘটাং-ঘটাং, প্যাঁ-পুঁ শব্দে মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে।
নেহার বন্ধুরা একদিন এসেছিল ঘুঘুজোড়া দেখতে। ওরা বলেছিল, ‘কেমন শান্ত আর চুপচাপ দেখ পাখি দুটো।’
ঘুঘুজোড়ার মনের কথা কেউ বোঝে না। ওরা বলে, ‘আমরা উড়তে পারি না কত দিন। উড়তে না পারলে তো আমরা মরে যাব। আমাদের আনন্দ সব তোমরা জোর করে আটকে রেখেছ। তাই আমরা এমন চুপচাপ।’
ওদের কথা কেউ শুনতে পায় না। ওদের দুঃখ কেউ অনুভব করে না। নেহা হয়তো করবে। ঘুঘুজোড়া ঠিক করে ওরা ওদের কষ্টের কথা নেহাকে বলবে।
একদিন ভোরবেলা একটা টিয়া এসে বসে নেহাদের ফ্ল্যাটের বারান্দার গ্রিলে। ঘুঘুজোড়া টিয়াকে ডেকে বলে, ‘সুবর্ণচর চেন? সেখানে আমাদের বাড়ি।’
টিয়া বলে, ‘খুব চিনি। শিমুলগাছের ডালে আমার একটা সুন্দর ঘর ছিল। সেখান থেকে ধরে এনেছিল আমাকে এই শহরে। ঠোঁট দিয়ে খাঁচা কেটে আজ উড়াল দিয়েছি।’
ঘুঘুজোড়া বলে, ‘যদি যাও সুবর্ণচরে, তাহলে আমাদের দুজনার খবর পৌঁছে দিয়ো। ওখানে আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই আছে। তাদের বোলো, মরিনি আমরা, বেঁচে আছি।’
টিয়া বলে, ‘মনে থাকবে তোমাদের কথা। নিশ্চয় তোমাদের আপনজনের কাছে পৌঁছে দেব তোমাদের খবর।’ বলেই ডানা মেলে উড়ে যায়।
নেহার পরীক্ষা শেষ হয়, আবার ঘুঘুজোড়ার সঙ্গে গল্পে মেতে ওঠে সে। একদিন যেন স্পষ্ট শুনতে পায় ঘুঘুজোড়া বলছে, ‘আমাদের নিয়ে চলো গ্রামে। কুয়াশাভেজা সকালে আমরা ডানা মেলে রোদ্দুর মাখব।’
নেহা বলে, ‘নিশ্চয় নিয়ে যাব।’
ছটফট করতে থাকে ঘুঘুজোড়া খাঁচার ভেতর, কখন নেহা নিয়ে যাবে তাদের গ্রামে সেই আশায়।
নেহা বায়না ধরে মায়ের কাছে, এবার সে বড় মামার কাছে যাবে বেড়াতে। পরীক্ষা শেষ। মা না করেন না।
একদিন সকালে ওরা রওনা হয় সুবর্ণচরের পথে। নেহা কোলের ওপর ঘুঘুজোড়ার খাঁচা আগলে বসে থাকে পুরো পথ।
সুবর্ণচরে পৌঁছে বড় মামার হাত ধরে নেহা যায় দিগন্ত বিস্তৃত ধানের মাঠের পাশে ওদের বাগানে। যেখানে বাঁশের কঞ্চি বাতাসে দোল খায়, গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে ধরে বটের লাল টকটকে ফল। যেখানে খেজুরগাছের শাখে ঘুঘুরা বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
খাঁচার দরজা খুলে দেয় নেহা। ঘুঘুজোড়া প্রথমে মাথা বের করে বাইরের দিকে তাকায়। তারপর খাঁচা থেকে উড়ে গিয়ে বসে হিজলের ডালে।
আনন্দে হাতে তালি দিতে দিতে কেঁদে ফেলে নেহা। ঘুঘুজোড়ার সঙ্গে আর দেখা হবে না ভেবে কষ্ট হয়। বড় মামা চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুমি খুব ভালো মেয়ে নেহা। লক্ষ্মী মেয়ে। আই লাইক ইউ। আই লাভ ইউ।’
হেসে ওঠে নেহা। ঘুঘুজোড়া ডানা মেলে উড়ে যায় মুক্ত আকাশে।
মা দেখলেন বড় ভাইজান সত্যি খাঁচায় করে একজোড়া ঘুঘু নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘তুমি পারোও বটে ভাইজান।’
মামা বললেন, ‘নেহা গতবার একজোড়া ঘুঘুর জন্য এমন করে বলল। আমার খুব মায়া হলো। কী সামান্য আবদার দেখো মেয়ের। মামা হয়ে সেটুকুও যদি মেটাতে না পারি তাহলে আর কিসের মামা। তাই না নেহা মা?’
নেহার ফাইনাল পরীক্ষা সামনের মাসে। এবার সে ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠবে। মা বলেছেন পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হলে গ্রামে বড় মামার কাছে যেতে দেবে। নেহা তাই মন দিয়ে পড়ালেখা করছে। কারণ, গ্রামে যেতে ওর খুব ভালো লাগে।
নেহা পাখির খাঁচা বারান্দায় নিয়ে রাখে। শহরের মাঝখানে বড় রাস্তার পাশে দশতলা একটা অ্যাপার্টমেন্টের চতুর্থ তলায় নেহাদের ফ্ল্যাট। ঘুঘুজোড়ার মনে হয় এ এক ভারি অদ্ভুত জায়গা। চারদিকে ধুলাবালি, এখানে-সেখানে নোংরা। কেবল দালান আর দালান। বাড়ির পরে সারি সারি বাড়ি। কোথাও গাছ নেই। সবুজ নেই কোনোখানে।
খাঁচায় আটকা পড়ে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে ওদের। নেহা মাঝেমধ্যে এসে খাবার দিয়ে যায়। খাঁচার ভেতরে রাখা ছোট পাত্রের পানি বদলে নতুন পানি দিয়ে যায়। কত গল্প করে তখন। বলে, ‘জানো, আমাদের না একটা বিড়াল ছিল। খুব দুষ্টু ছিল সে। একদম কথা শুনত না।’
মা নেহাকে ডেকে পড়তে বসতে বলেন। নেহা পাখির খাঁচার কাছ থেকে উঠে চলে যায়। আবার একা হয়ে পড়ে ঘুঘুজোড়া।
গ্রামের সেই বাঁশবাগানের কথা মনে পড়ে। সেই সবুজ বটগাছে ছোট ছোট লাল ফল। খেজুরগাছের ওপর বাসা বেঁধে ডিম পাড়া। ঘুঘুজোড়া অনুভব করার চেষ্টা করে শীতের সকালে কুয়াশার ভেতর দিয়ে রোদ্দুরের ছোঁয়া।
ওদের যখন গ্রাম থেকে নিয়ে আসে, তখনই শীত পড়ে গেছে। মাঠে মাঠে কিষানেরা ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। গৃহস্থবাড়িতে পিঠা তৈরির ধুম লেগেছে। আর এই শহরে শীতের কোনো আভাসমাত্র নেই। দূরে ইটভাটার কালো ধোঁয়া গবগব করে আকাশে ছড়িয়ে গিয়ে অন্ধকার করে দিয়েছে। তার সঙ্গে গাড়ির কালো ধোঁয়া মিশে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয়। রাতদিন চারপাশের ঘটাং-ঘটাং, প্যাঁ-পুঁ শব্দে মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে।
নেহার বন্ধুরা একদিন এসেছিল ঘুঘুজোড়া দেখতে। ওরা বলেছিল, ‘কেমন শান্ত আর চুপচাপ দেখ পাখি দুটো।’
ঘুঘুজোড়ার মনের কথা কেউ বোঝে না। ওরা বলে, ‘আমরা উড়তে পারি না কত দিন। উড়তে না পারলে তো আমরা মরে যাব। আমাদের আনন্দ সব তোমরা জোর করে আটকে রেখেছ। তাই আমরা এমন চুপচাপ।’
ওদের কথা কেউ শুনতে পায় না। ওদের দুঃখ কেউ অনুভব করে না। নেহা হয়তো করবে। ঘুঘুজোড়া ঠিক করে ওরা ওদের কষ্টের কথা নেহাকে বলবে।
একদিন ভোরবেলা একটা টিয়া এসে বসে নেহাদের ফ্ল্যাটের বারান্দার গ্রিলে। ঘুঘুজোড়া টিয়াকে ডেকে বলে, ‘সুবর্ণচর চেন? সেখানে আমাদের বাড়ি।’
টিয়া বলে, ‘খুব চিনি। শিমুলগাছের ডালে আমার একটা সুন্দর ঘর ছিল। সেখান থেকে ধরে এনেছিল আমাকে এই শহরে। ঠোঁট দিয়ে খাঁচা কেটে আজ উড়াল দিয়েছি।’
ঘুঘুজোড়া বলে, ‘যদি যাও সুবর্ণচরে, তাহলে আমাদের দুজনার খবর পৌঁছে দিয়ো। ওখানে আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই আছে। তাদের বোলো, মরিনি আমরা, বেঁচে আছি।’
টিয়া বলে, ‘মনে থাকবে তোমাদের কথা। নিশ্চয় তোমাদের আপনজনের কাছে পৌঁছে দেব তোমাদের খবর।’ বলেই ডানা মেলে উড়ে যায়।
নেহার পরীক্ষা শেষ হয়, আবার ঘুঘুজোড়ার সঙ্গে গল্পে মেতে ওঠে সে। একদিন যেন স্পষ্ট শুনতে পায় ঘুঘুজোড়া বলছে, ‘আমাদের নিয়ে চলো গ্রামে। কুয়াশাভেজা সকালে আমরা ডানা মেলে রোদ্দুর মাখব।’
নেহা বলে, ‘নিশ্চয় নিয়ে যাব।’
ছটফট করতে থাকে ঘুঘুজোড়া খাঁচার ভেতর, কখন নেহা নিয়ে যাবে তাদের গ্রামে সেই আশায়।
নেহা বায়না ধরে মায়ের কাছে, এবার সে বড় মামার কাছে যাবে বেড়াতে। পরীক্ষা শেষ। মা না করেন না।
একদিন সকালে ওরা রওনা হয় সুবর্ণচরের পথে। নেহা কোলের ওপর ঘুঘুজোড়ার খাঁচা আগলে বসে থাকে পুরো পথ।
সুবর্ণচরে পৌঁছে বড় মামার হাত ধরে নেহা যায় দিগন্ত বিস্তৃত ধানের মাঠের পাশে ওদের বাগানে। যেখানে বাঁশের কঞ্চি বাতাসে দোল খায়, গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে ধরে বটের লাল টকটকে ফল। যেখানে খেজুরগাছের শাখে ঘুঘুরা বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
খাঁচার দরজা খুলে দেয় নেহা। ঘুঘুজোড়া প্রথমে মাথা বের করে বাইরের দিকে তাকায়। তারপর খাঁচা থেকে উড়ে গিয়ে বসে হিজলের ডালে।
আনন্দে হাতে তালি দিতে দিতে কেঁদে ফেলে নেহা। ঘুঘুজোড়ার সঙ্গে আর দেখা হবে না ভেবে কষ্ট হয়। বড় মামা চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুমি খুব ভালো মেয়ে নেহা। লক্ষ্মী মেয়ে। আই লাইক ইউ। আই লাভ ইউ।’
হেসে ওঠে নেহা। ঘুঘুজোড়া ডানা মেলে উড়ে যায় মুক্ত আকাশে।
No comments