স্মরণ-কবি জীবনানন্দ দাশ by ফাহমিদা আক্তার রিম্পি

'তোমরা যেখানে সাধ চ'লে যাও/আমি রয়ে যাব এই বাংলার পারে।' বাংলার রূপ ও সৌন্দর্যে এমন বুঁদ হয়ে বাংলাকে ভালোবাসার অনন্য কবি জীবনানন্দ দাশের আজ মৃত্যু দিবস। আর্থিক দুঃখকষ্টে কেটেছে কবির সারাটা


জীবন। জনপ্রিয়তার স্বাদ তিনি জীবদ্দশায় পাননি; বরং সমালোচনার কঠিন বেদনা নিয়ে কবিকে পথ চলতে হয়েছে। জীবিকার জন্য শিক্ষকতাই ছিল তাঁর প্রধান পেশা। কিন্তু পাশাপাশি ইনস্যুরেন্স কম্পানির এজেন্ট হিসেবেও চাকরির চেষ্টা করেন। এমনকি ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টাও করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বিয়ে করেছিলেন, দুই সন্তানের জনকও হয়েছিলেন। কিন্তু সংসারে সুখ কতটা পেয়েছিলেন, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ কবি যখন মৃত্যুশয্যায়, তখনো পাশে তাঁর সহধর্মিণীকে তেমন একটা দেখা যায়নি। তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন টালিগঞ্জে সিনেমায় অভিনয়ে। ভাবতে কষ্ট হয়, যে মানুষটার কবিতা এখন বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম কবিতা, সে মানুষটাই তা দেখতে পেলেন না। এই কবি তাঁর সব জনপ্রিয়তা পেয়েছেন মৃত্যুর পরে।
১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জীবনানন্দ জন্মগ্রহণ করেন বরিশালে। বাবা সত্যানন্দ দাশ ও মা কুসুমকুমারী দাশ। জীবনানন্দের ডাকনাম ছিল মিলু। তিনি আশৈশব লাজুক ও স্বল্পভাষী ছিলেন। ছোটবেলায়ই একবার কঠিন অসুখে পড়েন। তখন হাস্যরসের কবি চন্দ্রনাথের সঙ্গে মা ও মাতামহসহ তিনি লক্ষ্নৌ, আগ্রা, দিল্লি প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেন। বাবা কম বয়সে স্কুলে যাওয়া পছন্দ করতেন না। তাই তাঁর শিক্ষা শুরু হয় ঘরে মায়ের কাছে। ১৯০৮ সালে ব্রজমোহন স্কুলে সরাসরি তাঁকে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। ১৯১৫ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করেন। পরে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেন। ১৯২২ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। ১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক' প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরই তিনি সিটি কলেজ থেকে চাকরি হারান। কলকাতার সাহিত্যচক্রে কবির কবিতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। সে সময়কারর বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাশ তাঁর শনিবারের চিঠি পত্রিকায় কবি জীবনানন্দের নির্মম সমালোচনা করেন।
কবির 'বনলতা সেন' নামের মাত্র ১৮ লাইনের কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক পঠিত ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কবিতা। 'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে', 'আবার আসিব ফিরে', 'সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি/বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে' ইত্যাদি কবিতা বাংলা সাহিত্যের প্রাণ।
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এই কবি ট্রাম দুর্ঘটনার শিকার হন। শত বছরের মধ্যে কলকাতায় মাত্র একটিই ট্রাম দুর্ঘটনা ঘটে। আর এই একটিমাত্র দুর্ঘটনাই ঘটে কবি জীবনানন্দের জীবনে। কবি জীবনানন্দ অনেক উপন্যাস, ছোটগল্পও লিখেছিলেন; কিন্তু জীবদ্দশায় তা প্রকাশ করেননি। জীবনজুড়ে কিছুই না পাওয়া কবি মৃত্যুর পর এতটাই জনপ্রিয়তা পেলেন, যার উদাহরণ দুনিয়ায় বিরল।
ফাহমিদা আক্তার রিম্পি

No comments

Powered by Blogger.