বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৪৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। গিয়াসউদ্দিন, বীর প্রতীক দুঃসাহসী এক গেরিলা দলনেতা ২৬ অক্টোবর ১৯৭১। গিয়াসউদ্দিন খবর পান তাঁদের অবস্থানস্থলের দিকে নদীপথে এগিয়ে আসছে একটি পাকিস্তানি গানবোট।
তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দলের দলনেতা। তাঁদের অবস্থান ছিল মেঘনা-শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনার কলাগাছিয়ায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গানবোট কখনো দিনে, কখনো রাতে ওই এলাকায় টহল দিত। গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে এর আগেও পাকিস্তানি গানবোটে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়ে নদীর তীরে অপেক্ষা করেছেন। ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যার পরও তিনি খাবার-দাবার সেরে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সারা রাত নদীর তীরে অপেক্ষা করেন। কিন্তু গানবোট আসেনি।
ভোরে গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিজেদের গোপন শিবিরে ফিরে যান। বেলা ১১টার দিকে একজন স্থানীয় কৃষক দৌড়ে তাঁদের শিবিরে এসে তাঁকে পাকিস্তানি গানবোট আসার খবর দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী ছিলেন। কৃষক তাঁকে জানান, তিনি নদীতে দূরে গানবোট দেখেছেন। সেটি কলাগাছিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।
গিয়াসউদ্দিনসহ পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা তখন শিবিরে বিশ্রামরত। তাঁদের মধ্যে তিনিসহ ৩০ জন দ্রুত তৈরি হয়ে আরআর (রিকোয়েললেস রাইফেল) গানসহ পুনরায় অবস্থান নেন নদীর তীরের সুবিধাজনক স্থানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গানবোটটি তাঁদের অস্ত্রের আওতার মধ্যে চলে আসে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে তাঁদের আরআর গানসহ অন্যান্য সব অস্ত্র।
গিয়াসউদ্দিন তিনজন সহযোদ্ধার সহযোগিতায় নিখুঁত নিশানায় গানবোট লক্ষ্য করে তিনটি আরআর গোলা নিক্ষেপ করেন। তাতে গানবোটটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে একদিকে হেলে পড়ে। ডেকে থাকা পাকিস্তানি সেনারা ছোটাছুটি শুরু করে। এ সময় তাঁর দুঃসাহসী কয়েকজন সহযোদ্ধা এগিয়ে গিয়ে নিজ নিজ অস্ত্র দিয়ে গুলি করেন। তাঁদের গুলিতে নিহত হয় দুজন পাকিস্তানি সেনা।
এরপর গিয়াসউদ্দিন আরআর গানের আরও কয়েকটি গোলা ছুড়ে গানবোটটি পুরোপুরি ধ্বংসের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু তাঁর সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তুমুল গোলাগুলির শব্দ শুনে মুন্সিগঞ্জ টার্মিনাল থেকে সেখানে আরেকটি গানবোট দ্রুত চলে আসে। ওই গানবোট নদীতে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়ে তাঁদের ওপর বৃষ্টির মতো গোলাগুলি শুরু করে।
এরপর সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান করাটা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। সে জন্য বাধ্য হয়ে গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এটি ছিল তাঁর দলের সফল এক অপারেশন। এ সংবাদ মানুষের মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
গিয়াসউদ্দিন ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। উল্লেখযোগ্য সিদ্দিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (১০ আগস্ট), লাঙ্গলবন্দের সেতু অপারেশন (আগস্টের মাঝামাঝি), ফতুল্লায় আক্রমণ।
নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার অন্তর্গত লাঙ্গলবন্দের সেতু। মুক্তিযুদ্ধকালে চারজন পাকিস্তানি ও দুইজন বাঙালি ইপিআর ওই সেতুতে পাহারা দিতেন। দুই ইপিআর তাঁদের সহযোগিতা করেন। গভীর রাতে গিয়াসউদ্দিন ২২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে সেখানে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানিরা পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। চারজনই নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরক দিয়ে সেতু ধ্বংস করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য গিয়াসউদ্দিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩০৭।
গিয়াসউদ্দিন ২০০৪ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার (বীর প্রতীক ভবন, ৩৬/১ তল্লা রোড, তল্লা, ফতুল্লা) সিটি করপোরেশন এলাকায়। তাঁর বাবার নাম সামসুদ্দীন আহমেদ, মা আম্বিয়া খাতুন। স্ত্রী খুরশিদা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: খুরশিদ আহমেদ (গিয়াসউদ্দিন বীর প্রতীকের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর-২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গানবোট কখনো দিনে, কখনো রাতে ওই এলাকায় টহল দিত। গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে এর আগেও পাকিস্তানি গানবোটে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়ে নদীর তীরে অপেক্ষা করেছেন। ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যার পরও তিনি খাবার-দাবার সেরে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সারা রাত নদীর তীরে অপেক্ষা করেন। কিন্তু গানবোট আসেনি।
ভোরে গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিজেদের গোপন শিবিরে ফিরে যান। বেলা ১১টার দিকে একজন স্থানীয় কৃষক দৌড়ে তাঁদের শিবিরে এসে তাঁকে পাকিস্তানি গানবোট আসার খবর দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী ছিলেন। কৃষক তাঁকে জানান, তিনি নদীতে দূরে গানবোট দেখেছেন। সেটি কলাগাছিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।
গিয়াসউদ্দিনসহ পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা তখন শিবিরে বিশ্রামরত। তাঁদের মধ্যে তিনিসহ ৩০ জন দ্রুত তৈরি হয়ে আরআর (রিকোয়েললেস রাইফেল) গানসহ পুনরায় অবস্থান নেন নদীর তীরের সুবিধাজনক স্থানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গানবোটটি তাঁদের অস্ত্রের আওতার মধ্যে চলে আসে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে তাঁদের আরআর গানসহ অন্যান্য সব অস্ত্র।
গিয়াসউদ্দিন তিনজন সহযোদ্ধার সহযোগিতায় নিখুঁত নিশানায় গানবোট লক্ষ্য করে তিনটি আরআর গোলা নিক্ষেপ করেন। তাতে গানবোটটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে একদিকে হেলে পড়ে। ডেকে থাকা পাকিস্তানি সেনারা ছোটাছুটি শুরু করে। এ সময় তাঁর দুঃসাহসী কয়েকজন সহযোদ্ধা এগিয়ে গিয়ে নিজ নিজ অস্ত্র দিয়ে গুলি করেন। তাঁদের গুলিতে নিহত হয় দুজন পাকিস্তানি সেনা।
এরপর গিয়াসউদ্দিন আরআর গানের আরও কয়েকটি গোলা ছুড়ে গানবোটটি পুরোপুরি ধ্বংসের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু তাঁর সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তুমুল গোলাগুলির শব্দ শুনে মুন্সিগঞ্জ টার্মিনাল থেকে সেখানে আরেকটি গানবোট দ্রুত চলে আসে। ওই গানবোট নদীতে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়ে তাঁদের ওপর বৃষ্টির মতো গোলাগুলি শুরু করে।
এরপর সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান করাটা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। সে জন্য বাধ্য হয়ে গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এটি ছিল তাঁর দলের সফল এক অপারেশন। এ সংবাদ মানুষের মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
গিয়াসউদ্দিন ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। উল্লেখযোগ্য সিদ্দিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (১০ আগস্ট), লাঙ্গলবন্দের সেতু অপারেশন (আগস্টের মাঝামাঝি), ফতুল্লায় আক্রমণ।
নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার অন্তর্গত লাঙ্গলবন্দের সেতু। মুক্তিযুদ্ধকালে চারজন পাকিস্তানি ও দুইজন বাঙালি ইপিআর ওই সেতুতে পাহারা দিতেন। দুই ইপিআর তাঁদের সহযোগিতা করেন। গভীর রাতে গিয়াসউদ্দিন ২২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে সেখানে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানিরা পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। চারজনই নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরক দিয়ে সেতু ধ্বংস করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য গিয়াসউদ্দিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩০৭।
গিয়াসউদ্দিন ২০০৪ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার (বীর প্রতীক ভবন, ৩৬/১ তল্লা রোড, তল্লা, ফতুল্লা) সিটি করপোরেশন এলাকায়। তাঁর বাবার নাম সামসুদ্দীন আহমেদ, মা আম্বিয়া খাতুন। স্ত্রী খুরশিদা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: খুরশিদ আহমেদ (গিয়াসউদ্দিন বীর প্রতীকের ছেলে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর-২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
No comments