যেকোনো কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ থাকছে! by ফখরুল ইসলাম

বিদ্যমান কোম্পানি আইনে নতুন একটি ধারা সংযোজনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে যেকোনো সময় যেকোনো বেসরকারি কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার জন্য সরকারের আইনি এখতিয়ার তৈরি হবে। মূলত ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের জন্য কোম্পানি আইন,


১৯৯৪-এ প্রশাসক নিয়োগের একটি ধারা সংযোজন করা হচ্ছে। সংসদ অধিবেশন না থাকায় এখন অধ্যাদেশ জারি করে তা করা হবে। এই ধারায় নিযুক্ত প্রশাসকের কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি আদালতে যাওয়ারও অধিকার পাবেন না।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধারাটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর রাজনৈতিক অপব্যবহারের আশঙ্কাও থাকছে। কারণ, এই ধারায় সরকার চাইলে যেকোনো কোম্পানিতে প্রশাসক বসিয়ে দিতে পারবে।
তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, কোম্পানি আইনে নতুন ধারাটি সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সদুদ্দেশে। এই ধারাটির অপব্যবহার হবে কি না, এখনই তা বলা যাবে না। তিনি বলেন, ‘ডেসটিনির মতো কিছু প্রতিষ্ঠানে অনেক মানুষ জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করাই সরকারের উদ্দেশ্য।’
মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য তৈরি করা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক বসানোর জন্য মূলত কোম্পানি আইনে এ সংযোজনটি করা হচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় ‘কোম্পানি আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০১২’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংবিধানের ৯৩(১) এ দেওয়া ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি এ অধ্যাদেশ জারি করবেন।
ওই সারসংক্ষেপে বলা হয়, কোম্পানি আইনের ২০২ ধারার মধ্যে ‘সরকার কর্তৃক প্রশাসক নিয়োগ’ নামে একটি ধারা সংযোজন করা হবে। আইনের ধারা ও অধ্যাদেশের খসড়া গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আজ সোমবার অনুষ্ঠেয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা উপস্থাপিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের গতকাল তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘মন্ত্রিসভায় একটি প্রস্তাব যাচ্ছে। অনুমোদিত হলে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা কোম্পানি আইনে সংযোজিত হবে। এখনই বলার মতো সময় আসেনি।’
তবে বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, খসড়াটি যেভাবে তৈরি হয়েছে, তিনি নিজেও তাতে একমত নন।
অধ্যাদেশের খসড়ায় প্রশাসকের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসক বা তাঁর অধীনস্থ কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত হয়েছে এরূপ কোনো কার্যের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে দেশের প্রচলিত আইনে তা আমলযোগ্য হবে না।’
এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন আইনজীবী শাহ্দীন মালিক। প্রশাসকের দায়মুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকুরিজীবীরা যেহেতু সরকারি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি ঠিক আছে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে প্রশাসককে মিলিয়ে দেখলে হবে না। এ ধরনের দায়মুক্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তির আইনি অর্থাৎ সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ চ্যালেঞ্জ করলে আদালতে এটি আইন হিসেবে বৈধতা পাবে কি না, আমি সন্দিহান।’
শাহ্দীন মালিক বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৪, ৫১, ৫২, ৫৩, ৬৬ এবং ৬৭ ধারা অনুযায়ী ব্যাংক না হওয়া সত্ত্বেও যেকোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, সংযোজিত ধারার বলে যেকোনো কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে এক বা একাধিক প্রশাসক বসাতে পারবে সরকার। এ ক্ষেত্রে অবশ্য শর্ত রয়েছে কয়েকটি। সরকারের কাছে যদি এ রকম মনে হয় যে, কোনো কোম্পানির ব্যবসা, পাওনাদার, শেয়ারহোল্ডার বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রতারণার জন্য পরিচালিত হচ্ছে, অথবা এর প্রশাসনিক কার্যক্রম প্রতারণা, অবৈধ উদ্দেশ্য বা কাউকে হয়রানির উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে, তখনই প্রশাসক বসানো হবে।
শর্তগুলো হচ্ছে: জনস্বার্থ এবং শেয়ারহোল্ডার ও পাওনাদারদের স্বার্থ সুরক্ষা করা। তবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে কোম্পানির কার্যক্রম বিষয়ে কারণ দর্শানোর সুযোগ না দিয়ে কোনো প্রশাসক নিয়োগ করা যাবে না। প্রশাসক, উপ-প্রশাসক বা সহকারী প্রশাসক প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী (পাবলিক সার্ভেন্ট) হিসেবে গণ্য হবেন। তাঁদের যোগ্যতা, মেয়াদকাল, কর্মপরিধি, অপসারণ ইত্যাদি সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে নির্ধারণ করবে।
শাহ্দীন মালিক বলেন, একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে মাথায় রেখে আইনে কোনো ধারা সংযোজন করার মানে হলো তার অপপ্রয়োগ অবধারিত এবং সব সময়ের জন্যই তা বিপজ্জনক।
তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, তিনি প্রশাসকের দায়মুক্তির পক্ষে। নইলে প্রশাসক কাজ করতে পারবেন না।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ তানজিব-উল আলম বলেন, কোম্পানি আইনের প্রস্তাবিত এই ধারা সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। কারণ, কোম্পানি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কারও সম্পদ নিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ধারা অনুযায়ী এই কোম্পানি যদি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তাহলে প্রশাসকের বিরুদ্ধে কোনো আইনি সুরক্ষা পাওয়া যাবে না। শুধু এই কারণেও আইনটি সংবিধান পরিপন্থী।
তানজিব-উল আলম বলেন, বর্তমান আইনেই আদালতের মাধ্যমে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ আছে। এর জন্য নতুন আইন করার দরকার নেই।

No comments

Powered by Blogger.