পরমাপ্রকৃতি by কাবেরী গায়েন
দেবীপূজার দুটি ধারা। একদিকে, তিনি অতি সৌম্য মাতৃরূপ। স্নেহে বাৎসল্যে জগৎ পালন করেন। আশ্রিত, ভক্ত ও সাধক সন্তানকে দান করেন ভয় ও অভয়। অন্যদিকে, তাঁর ভীষণা মূর্তিতে হয় সংহার লীলা—আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে কালান্তক অভিযান।
রাজা সুরথ, রামচন্দ্র, অর্জুন, শিবাজি, রানা প্রতাপ ও গোবিন্দ সিংদের মতো রাজন্যবর্গ করেছেন দেবীর ভীষণা মূর্তির সাধনা—বীর্য, ঐশ্বর্য, রাজ্য, শত্রুবধ, বিজয় ও স্বাধীনতা লাভের জন্য। অন্যদিকে, সমাধি বৈশ্য, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত ও রামকৃষ্ণের মতো ভাবসাধকেরা দেবীর করুণাময়, সৌম্য মাতৃমূর্তির সাধনা করেছেন প্রেম, ভক্তি, জ্ঞান, বৈরাগ্য ও মহামুক্তির জন্য। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য, দুই ঘরানার সাধকই পূজা করেছেন উত্তরায়ণের বসন্তকালে। রামচন্দ্র করেছিলেন শরৎকালে। পৃথিবীর ছয় মাস দিন আর ছয় মাস রাত্রিতে দেবলোকের এক দিন। শ্রাবণ থেকে পৌষ দেবলোকের রাত আর মাঘ থেকে আষাঢ় দেবলোকের দিন। শারদীয় দুর্গোৎসবের সময়, অর্থাৎ শ্রাবণ থেকে পৌষ দেবলোকের রাত্রি বলে বোধন করতে হয়। এই সময়কে দক্ষিণায়ন বা পিতৃপক্ষ বলে। বাঙালি হিন্দুর যে দুর্গাপূজা, সেখানে এই দুই ধারাই মিলেমিশে একাকার। কৈলাস থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন পিতৃগৃহে যে উমা বা পার্বতী, তিনি বাড়ির মেয়ে আর তাই এই পৃথিবীর কন্যা। বাবার বাড়ি সাধ্যমতো আদর-যত্নে ভরিয়ে রাখে চার সন্তানসহ কন্যাটিকে। বাঙালির পিতৃগৃহে মেয়ে মা-ও বটে। ফের সেই মেয়ে কিংবা মা যে আদ্যাশক্তি, তার কাছেই মর্ত্যের সন্তানেরা রূপ, যশ, ধন, জয় ও জ্ঞান প্রার্থনা করে।
পৃথিবী সংকেতময়। মানুষ নানা সংকেতে অর্থ আরোপ করেছে; আবার সেসব সংকেত উন্মোচন করে অর্থ উদ্ধার করেছে। আমি শুধু দেবী দুর্গার এই দুই রূপের সঙ্গেই প্রাকৃতিক অভেদকে বোঝার খানিকটা চেষ্টা করব দুর্গা-ধারণা এবং দুর্গাপূজার দুই-একটি রীতির সংকেত ধরে।
‘অহং রাষ্ট্রী’: আমিই অধিশ্বরী
মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবতেজঃসম্ভবা যে চণ্ডী, বামন পুরাণে তিনিই কাত্যায়নী, কালী, দুর্গা, চামুণ্ডা ও পার্বতী। দেবী চামুণ্ডারূপে চণ্ডমুণ্ড বধ করেছেন, দুর্গারূপে বধ করেছেন দুর্গাসুর, কালীরূপে পান করেছেন রক্তবীজের রক্ত, বধ করেছেন বরাহ পুরাণের বেত্রাসুর, বধ করেছেন কলিঙ্গদৈত্য, অন্ধকাসুর, মহিষাসুর এবং অন্যান্য দানব। এই ভীষণ রূপের প্রতিটিতেই তাঁর যে অবয়ব, তা তিনি পেয়েছেন সেরা দেবতাদের তেজ থেকে। শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রতেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও ঊরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পা, বসুগণের তেজে আঙুল, কুবেরের তেজে নাক, প্রজাপতির তেজে দাঁত, সন্ধ্যার তেজে ভ্রু এবং পবনের তেজে কান। অর্থাৎ সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশের ধারক তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের সঙ্গে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাতাস, সূর্য, সন্ধ্যাকাল, জল, মেঘ, অন্ধকার, পৃথিবী ও বজ্র—এসব নানা প্রাকৃতিক তেজ থেকেই তাঁর অবয়ব। তিনি চারপাশের প্রকৃতির সব তেজকেই ধারণ করেছেন তাঁর অবয়বে। তাই তিনি প্রকৃতিসম্ভূতা। আর এসব দেবতার বা প্রাকৃতিক শক্তিসূত্রের যা যা অস্ত্র, সব অস্ত্রকে তিনি ধারণ করেছেন ১০ হাতে। প্রকৃতির সব শক্তিকে ধারণ করে হয়ে উঠেছেন মহাশক্তি। সংহতি যেমন জাতি বা রাষ্ট্র গঠনের মূল প্রেরণা, এই সংহতিকে জাতির কল্যাণে সার্থক প্রয়োগেই রাষ্ট্র নির্মাণ পূর্ণাঙ্গ হয়। বৈদিক সূক্তে দেবী নিজেই বলেছেন, ‘অহং রাষ্ট্রী’ বা আমিই অধিশ্বরী। প্রতিটি রাষ্ট্রে চার শ্রেণীর মানুষ দেখা যায়—বুদ্ধিজীবী, বীর্যজীবী, বৃত্তিজীবী ও শ্রমজীবী। দেবীর ডানে লক্ষ্মী ও গণেশ এবং বাঁয়ে সরস্বতী ও কার্তিকেয়। লক্ষ্মী ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তি। গণেশ জনশক্তি বা শ্রমশক্তি। সরস্বতী জ্ঞানশক্তি এবং দেবসেনাপতি কার্তিকেয় ক্ষাত্রশক্তির দেবতা। দেবী দুর্গা যখন মর্ত্যে আসেন, তখন তিনি একা আসেন না, পুত্র-কন্যাস্বরূপ এই চার শক্তিকে নিয়ে আসেন। সেদিক থেকে দেবীর এ বিগ্রহ দর্শনে অর্জিত জ্ঞান রাষ্ট্রীয় জ্ঞান। আর হাত কাজের প্রতীক। আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা, নির্বীর্যতার মহাপাপ দূর করে জাতির মধ্যে সর্বতোপ্রসারী কর্মশক্তি জাগিয়ে তোলার জন্যই তিনি দশভুজা। তাঁর বাহন সিংহ। তিনি নিখিল বিশ্বের সম্রাজ্ঞী, সিংহ পশুরাজ্যের সম্রাট। তিনি মহিষাসুরমর্দিনী, সিংহ মহিষের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী। স্বত্ত্বগুণময়ী মা রজোগুণময় সিংহ বাহনকে নিয়ন্ত্রণ করে লোকস্থিতি রক্ষা করছেন। রজোগুণের সঙ্গে তমোগুণের সমন্বয় ঘটলে লোককল্যাণ না হয়ে হবে লোকসংহার। তাই দেবী স্বত্ত্বগুণময়ী হয়ে রজোগুণাত্মক সিংহকে করেছেন বাহন, অর্থাৎ অনুগত আজ্ঞাবহ ভৃত্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই প্রতীকের মর্ম বুঝবেন বলেই ধারণা করি।
‘নবপত্রিকা’ পূজা: দুর্গা কি তবে শস্যদেবী?
দুর্গাপূজায় নবপত্রিকার পূজা অপরিহার্য। নবপত্রিকা আসলে নয়টি গাছের কিংবা উদ্ভিদের পাতা—কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান। একটি পাতাসহ কলাগাছে বাকি আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ বা সপত্র শাখা একত্র করে এক জোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে দেবীর ডান দিকে গণেশের পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। প্রচলিত নাম যার কলাবউ। প্রথম পূজা তিনিই পান। এই নবপত্রিকা নবদুর্গা নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে পূজিত। উদ্ভিদগুলো দেবীর প্রতিরূপ হিসেবে গণ্য। পণ্ডিতেরা প্রায় সমস্বরে অভিমত দিয়েছেন যে নবপত্রিকা আসলে শস্যদেবীর পূজা। পণ্ডিত রমাপ্রসাদ চন্দ লিখেছেন, ‘দুর্গাপূজার একটি গুরূত্বপূর্ণ অংশ নবপত্রিকা বা নয়টি উদ্ভিদের পূজা পরিষ্কারভাবে দেখায় যে দেবী আসলে শস্য-ধারণার মূর্তরূপ।’ শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়। তাহার কারণ, শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্যদেবীরই পূজা।’ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, নবপত্রিকা পূজা আসলে বাংলায় দুর্গার হৈমন্তিক পূজা। দেবীর অপর এক মূর্তি শাকম্ভরীকেও শস্যদেবী বা পৃথিবীদেবী বলে ব্যাখ্যা করা হয়। যে দেবী নিজের দেহে উৎপাদিত শাক দিয়ে পৃথিবী পূর্ণ করে সব জীবের প্রাণ ধারণের আয়োজন করেন, তাঁকে শস্যদেবী, কৃষিদেবী বা পৃথিবীদেবী মনে করা চলে। শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে, এই শাকম্ভরী দেবী পৃথিবী বা বসুন্ধরাই পরে হয়েছেন অন্নদা, অন্নপূর্ণা।
দুর্গার শক্তিরূপ কিংবা অন্নপূর্ণা অবয়ব শেষ পর্যন্ত কি আমাদের পরমাপ্রকৃতির ধারণাকেই তবে জোরদার করে? পরমাপ্রকৃতি অন্নপূর্ণা কিংবা সর্বময় ক্ষমতার সংহতিরূপে দুর্গাকে পূজা করা হয় যে সমাজে, সেখানে আজও মেয়েদের সম্পত্তিতে অধিকার নেই, শিক্ষা-সম্পদ-ক্ষমতায় প্রবেশাধিকার খুবই সীমিত। ছিন্নমস্তা তথাগত দিনে পরমাপ্রকৃতি তাঁর সন্তানদের ধারণ করুন।
ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পৃথিবী সংকেতময়। মানুষ নানা সংকেতে অর্থ আরোপ করেছে; আবার সেসব সংকেত উন্মোচন করে অর্থ উদ্ধার করেছে। আমি শুধু দেবী দুর্গার এই দুই রূপের সঙ্গেই প্রাকৃতিক অভেদকে বোঝার খানিকটা চেষ্টা করব দুর্গা-ধারণা এবং দুর্গাপূজার দুই-একটি রীতির সংকেত ধরে।
‘অহং রাষ্ট্রী’: আমিই অধিশ্বরী
মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবতেজঃসম্ভবা যে চণ্ডী, বামন পুরাণে তিনিই কাত্যায়নী, কালী, দুর্গা, চামুণ্ডা ও পার্বতী। দেবী চামুণ্ডারূপে চণ্ডমুণ্ড বধ করেছেন, দুর্গারূপে বধ করেছেন দুর্গাসুর, কালীরূপে পান করেছেন রক্তবীজের রক্ত, বধ করেছেন বরাহ পুরাণের বেত্রাসুর, বধ করেছেন কলিঙ্গদৈত্য, অন্ধকাসুর, মহিষাসুর এবং অন্যান্য দানব। এই ভীষণ রূপের প্রতিটিতেই তাঁর যে অবয়ব, তা তিনি পেয়েছেন সেরা দেবতাদের তেজ থেকে। শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রতেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও ঊরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পা, বসুগণের তেজে আঙুল, কুবেরের তেজে নাক, প্রজাপতির তেজে দাঁত, সন্ধ্যার তেজে ভ্রু এবং পবনের তেজে কান। অর্থাৎ সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশের ধারক তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের সঙ্গে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাতাস, সূর্য, সন্ধ্যাকাল, জল, মেঘ, অন্ধকার, পৃথিবী ও বজ্র—এসব নানা প্রাকৃতিক তেজ থেকেই তাঁর অবয়ব। তিনি চারপাশের প্রকৃতির সব তেজকেই ধারণ করেছেন তাঁর অবয়বে। তাই তিনি প্রকৃতিসম্ভূতা। আর এসব দেবতার বা প্রাকৃতিক শক্তিসূত্রের যা যা অস্ত্র, সব অস্ত্রকে তিনি ধারণ করেছেন ১০ হাতে। প্রকৃতির সব শক্তিকে ধারণ করে হয়ে উঠেছেন মহাশক্তি। সংহতি যেমন জাতি বা রাষ্ট্র গঠনের মূল প্রেরণা, এই সংহতিকে জাতির কল্যাণে সার্থক প্রয়োগেই রাষ্ট্র নির্মাণ পূর্ণাঙ্গ হয়। বৈদিক সূক্তে দেবী নিজেই বলেছেন, ‘অহং রাষ্ট্রী’ বা আমিই অধিশ্বরী। প্রতিটি রাষ্ট্রে চার শ্রেণীর মানুষ দেখা যায়—বুদ্ধিজীবী, বীর্যজীবী, বৃত্তিজীবী ও শ্রমজীবী। দেবীর ডানে লক্ষ্মী ও গণেশ এবং বাঁয়ে সরস্বতী ও কার্তিকেয়। লক্ষ্মী ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তি। গণেশ জনশক্তি বা শ্রমশক্তি। সরস্বতী জ্ঞানশক্তি এবং দেবসেনাপতি কার্তিকেয় ক্ষাত্রশক্তির দেবতা। দেবী দুর্গা যখন মর্ত্যে আসেন, তখন তিনি একা আসেন না, পুত্র-কন্যাস্বরূপ এই চার শক্তিকে নিয়ে আসেন। সেদিক থেকে দেবীর এ বিগ্রহ দর্শনে অর্জিত জ্ঞান রাষ্ট্রীয় জ্ঞান। আর হাত কাজের প্রতীক। আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা, নির্বীর্যতার মহাপাপ দূর করে জাতির মধ্যে সর্বতোপ্রসারী কর্মশক্তি জাগিয়ে তোলার জন্যই তিনি দশভুজা। তাঁর বাহন সিংহ। তিনি নিখিল বিশ্বের সম্রাজ্ঞী, সিংহ পশুরাজ্যের সম্রাট। তিনি মহিষাসুরমর্দিনী, সিংহ মহিষের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী। স্বত্ত্বগুণময়ী মা রজোগুণময় সিংহ বাহনকে নিয়ন্ত্রণ করে লোকস্থিতি রক্ষা করছেন। রজোগুণের সঙ্গে তমোগুণের সমন্বয় ঘটলে লোককল্যাণ না হয়ে হবে লোকসংহার। তাই দেবী স্বত্ত্বগুণময়ী হয়ে রজোগুণাত্মক সিংহকে করেছেন বাহন, অর্থাৎ অনুগত আজ্ঞাবহ ভৃত্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই প্রতীকের মর্ম বুঝবেন বলেই ধারণা করি।
‘নবপত্রিকা’ পূজা: দুর্গা কি তবে শস্যদেবী?
দুর্গাপূজায় নবপত্রিকার পূজা অপরিহার্য। নবপত্রিকা আসলে নয়টি গাছের কিংবা উদ্ভিদের পাতা—কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান। একটি পাতাসহ কলাগাছে বাকি আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ বা সপত্র শাখা একত্র করে এক জোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে দেবীর ডান দিকে গণেশের পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। প্রচলিত নাম যার কলাবউ। প্রথম পূজা তিনিই পান। এই নবপত্রিকা নবদুর্গা নামে ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে পূজিত। উদ্ভিদগুলো দেবীর প্রতিরূপ হিসেবে গণ্য। পণ্ডিতেরা প্রায় সমস্বরে অভিমত দিয়েছেন যে নবপত্রিকা আসলে শস্যদেবীর পূজা। পণ্ডিত রমাপ্রসাদ চন্দ লিখেছেন, ‘দুর্গাপূজার একটি গুরূত্বপূর্ণ অংশ নবপত্রিকা বা নয়টি উদ্ভিদের পূজা পরিষ্কারভাবে দেখায় যে দেবী আসলে শস্য-ধারণার মূর্তরূপ।’ শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়। তাহার কারণ, শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্যদেবীরই পূজা।’ জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, নবপত্রিকা পূজা আসলে বাংলায় দুর্গার হৈমন্তিক পূজা। দেবীর অপর এক মূর্তি শাকম্ভরীকেও শস্যদেবী বা পৃথিবীদেবী বলে ব্যাখ্যা করা হয়। যে দেবী নিজের দেহে উৎপাদিত শাক দিয়ে পৃথিবী পূর্ণ করে সব জীবের প্রাণ ধারণের আয়োজন করেন, তাঁকে শস্যদেবী, কৃষিদেবী বা পৃথিবীদেবী মনে করা চলে। শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে, এই শাকম্ভরী দেবী পৃথিবী বা বসুন্ধরাই পরে হয়েছেন অন্নদা, অন্নপূর্ণা।
দুর্গার শক্তিরূপ কিংবা অন্নপূর্ণা অবয়ব শেষ পর্যন্ত কি আমাদের পরমাপ্রকৃতির ধারণাকেই তবে জোরদার করে? পরমাপ্রকৃতি অন্নপূর্ণা কিংবা সর্বময় ক্ষমতার সংহতিরূপে দুর্গাকে পূজা করা হয় যে সমাজে, সেখানে আজও মেয়েদের সম্পত্তিতে অধিকার নেই, শিক্ষা-সম্পদ-ক্ষমতায় প্রবেশাধিকার খুবই সীমিত। ছিন্নমস্তা তথাগত দিনে পরমাপ্রকৃতি তাঁর সন্তানদের ধারণ করুন।
ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments