দূরদেশ- ওবামা-রমনি শেষ বিতর্কের অপেক্ষা by আলী রীয়াজ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই প্রার্থী ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং রিপাবলিকান মিট রমনি যুক্তরাষ্ট্র সময় সোমবার রাতে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকালে) তৃতীয়বারের মতো বিতর্কে মুখোমুখি হবেন।
এটাই তাঁদের মধ্যে শেষ বিতর্ক। এই বিতর্কের বিষয় দেশের পররাষ্ট্রনীতি। নির্বাচন হবে ৬ নভেম্বর। ওবামা প্রথম বিতর্কে ভালো করেননি এটা সবার জানা। তাঁর জন্য তাঁকে যতটা ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে, দ্বিতীয় বিতর্কে ভালো করেও তা থেকে ততটা সুবিধা তিনি পাননি। তবে প্রথম বিতর্কের পর রমনির জনপ্রিয়তা যে হারে বাড়তে শুরু করেছিল দ্বিতীয় বিতর্কের সাফল্যের পর প্রেসিডেন্ট তাঁর গতি কমাতে পেরেছেন, তার চেয়েও বড় বিষয় তাঁর সমর্থকদের মধ্যে আবারও উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। মাস দেড়েক আগে বিশ্লেষক এবং ওবামা-সমর্থকদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা পররাষ্ট্রবিষয়ক বিতর্কে প্রেসিডেন্টের বিজয় নিয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারতেন। কেননা, গত চার বছরে ওবামার সাফল্য যেকোনো প্রার্থীর জন্য যথেষ্ট ছিল। আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুই কেবল নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্ট ভোটারদের চোখে জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে সফল বলেই বিবেচিত হচ্ছিলেন। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন কনসুলেটে হামলা এবং রাষ্ট্রদূত ক্রিস স্টিভেন্সসহ চারজনের মৃত্যুর ঘটনার পর প্রশাসনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রেসিডেন্টকে দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে।
মিট রমনি তা থেকে সুবিধা নিতে যে কুণ্ঠিত হবেন না, তা ওই দিন দেওয়া তাঁর বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিতর্কে এ বিষয়ে সুবিধা নিতে গিয়ে রমনি মারাত্মক ভুল করার কারণে তা তাঁর প্রতিকূলেই গেছে। কিন্তু তৃতীয় বিতর্কে সে রকম ভুলের আশঙ্কা নেই। প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে তিনি কতটা তথ্য বলতে পারবেন। রমনি যেকোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতেই পারেন; কিন্তু প্রেসিডেন্টের জন্য সব গোপনীয় তথ্য বলা সম্ভব নয়। ইরান প্রসঙ্গে ওবামার অনুসৃত নীতি যে কাজ করছে, সেটা বুঝতে হলে এ বিষয়ে যতটা গভীরভাবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা দরকার, তা সাধারণ ভোটাররা করেন না। রমনির জন্য সেটা সুবিধাজনক। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় রাজি আছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সাফল্য। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেও খানিকটা ছাড় দিতে হবে। রমনি কোনো ধরনের ছাড় দিতেই রাজি নন। আলোচনার আগেই ছাড় দেওয়ার কথা বললে ওবামা দুর্বল বিবেচিত হবেন, সেটা কূটনৈতিক বিবেচনায়ও সঠিক হবে না। কিন্তু রমনি সহজেই ইরানের বিরুদ্ধে উত্তেজক কথাবার্তা বলার সুযোগ পাবেন। সিরিয়া বিষয়েও প্রেসিডেন্টকে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের ভারী অস্ত্র সরবরাহের পক্ষে নয় এই আশঙ্কায় যে তা শেষ পর্যন্ত কার হাতে পড়বে, সেটা নিশ্চিত না হয়ে ওবামা প্রশাসন এগোতে চায় না। আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে নেতৃত্বহীনতা বলে রমনি মনে করেন এবং দেখাতে চান। প্রেসিডেন্টের একটা বড় সুবিধা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকেরা আরেকটি যুদ্ধের দামামা শুনতে রাজি নয়। দেশের অর্থনীতিও আরেকটা যুদ্ধের ভার বইতে পারবে না। এসব বিবেচনার মুখে তৃতীয় বিতর্ক হতে চলেছে। প্রেসিডেন্টের জন্য আশার বিষয় হলো, মার্কিনিরা পররাষ্ট্রনীতির বিবেচনায় ভোট দেন না।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে এখন লড়াই এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে কোনো প্রার্থীর পক্ষেই কোনোরকম ভুল করার সুযোগ নেই। নির্বাচনের সর্বশেষ সমীকরণের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কেন এই বিতর্ক এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মার্কিন নির্বাচন যে সাধারণ ভোটারদের সংখ্যাধিক্যের ওপর নির্ভর করে না, সেটা সবারই জানা আছে। দেশের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে ৫৪৩টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে এবং বিজয়ী হতে হলে একজন প্রার্থীকে ২৭০টি ভোট পেতে হয়। ব্যতিক্রমী বছরগুলো বাদ দিলে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের ফলাফল অনুমান করা যায়। ইলেকটোরাল কলেজের বিবেচনায় চারটি বড় অঙ্গরাজ্য হলো: নিউইয়র্ক, টেক্সাস, ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়া। এর মধ্যে নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি, টেক্সাস রিপাবলিকানদের। ফ্লোরিডা সাধারণত রিপাবলিকানদের পক্ষে গেলেও কখনো কখনো ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সে ক্ষেত্রেও ব্যবধান খুব বেশি হয়নি। তার বাইরে বড় সংখ্যার ভোট রয়েছে ইলিনয়, পেনসিলভেনিয়া, ওহাইও, জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে। ফলে সব নির্বাচনেই এসব রাজ্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। সাধারণত ইলিনয় থাকে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। এবার তার আরেক কারণ হলো প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই রাজ্যের একসময়কার সিনেটর এবং ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী একসময় ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর হলেও সেখানে তাঁর দল জনপ্রিয় নয়। ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন সেখানে সব সময়ই বেশি; তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে সেখানে তাঁর জনপ্রিয়তা তৈরি করতে পারেননি। কেবল ম্যাসাচুসেটসই যে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে তা নয়, দেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় যে উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ রাজ্য ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। অন্যদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলো রিপাবলিকানদের ঘাঁটি। দেশের আরেকটি অঞ্চল রিপাবলিকানদের পক্ষে, তা হলো দেশের পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট পার্বত্যপ্রধান রাজ্যগুলো। এগুলোতে লোক কম বলে তাদের হাতে ভোটও কম। সব
মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একপর্যায়ে এসে ধারণা করা যায় যে প্রার্থীদের হাতে কতটা নিশ্চিত ভোট রয়েছে, আর কতটা বাকি। একইভাবে বোঝা যায়, কোন কোন অঙ্গরাজ্য এবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
নির্বাচনের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে আমরা এখন এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। এখন বিভিন্ন গণমাধ্যম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর হিসাব ও জনমত জরিপ অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ওবামার পক্ষে নিশ্চিত বা অনুকূলে রয়েছে ২৩৭টি ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মিট রমনির পক্ষে বা তাঁর অনুকূলে আছে ১৯১টি ভোট। যে ১১০টি ভোটের হিসাব এর মধ্যে নেই তার মধ্য থেকে কে প্রয়োজনীয় ভোট জোগাড় করতে পারবেন, সেটাই এখন অঙ্কের বিষয়।
এই আসনগুলো সব মিলিয়ে নয়টি অঙ্গরাজ্যে ছড়ানো। এর মধ্যে আছে ফ্লোরিডার ২৯টি ভোট, আছে ওহাইওর ১৮টি ভোট। নর্থ ক্যারোলাইনা (১৫) ও ভার্জিনিয়া (১৩) তার পরের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। ওবামার দরকার ৩৩টি ভোট, রমনির দরকার ৭৯টি ভোট। এই হিসাবটা ভালো করে দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে ফ্লোরিডার ২৯টি ভোট ছাড়া মিট রমনির পক্ষে বিজয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। শেষ জনমত জরিপ বলছে যে এখানে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। ওবামার সুবিধা হলো ফ্লোরিডা, যা তিনি খুব কম ব্যবধানে ২০০৮ সালে বিজয়ী হয়েছিলেন, তা হারালেও একেবারে বিপদে পড়ে যাবেন না। কিন্তু তিনি যদি ফ্লোরিডা হারান তবে তাঁর জেতার জন্য ওহাইও জেতা প্রায়-বাধ্যতামূলক হয়ে পড়বে। কেননা, নর্থ ক্যারোলাইনা ও ভার্জিনিয়ার ভোটগুলো ডেমোক্র্যাটদের পাওয়ার সম্ভাবনা এ বছর খুব কম। ওহাইওতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুব তীব্র। সে ক্ষেত্রে কারও পক্ষে এটা তাঁর ব্যাগে বলে দাবি করার মতো অবস্থা নির্বাচনের আগের দিনেও হবে না। কেবল ফলাফলই তা বলতে পারবে। ওবামা যদি ওহাইওতে জেতেন, তবে তাঁর জেতার পথ মসৃণ হয়ে যাবে। এবং বলা যায় যে তাঁর বিজয় রোধ করা রমনির জন্য হবে প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু ওবামা যদি এই চারটি রাজ্য: নর্থ ক্যারোলাইনা (১৫) এবং ভার্জিনিয়া (১৩), ফ্লোরিডা (২৯) ও ওহাইও (১৮) হারান, তা হলেই কি মিট রমনি বিজয়ী হবেন? উত্তর হলো না। বরং ঠিক উল্টোটা। প্রেসিডেন্ট যদি এখন যেসব রাজ্য তাঁর অনুকূল অবস্থানে রয়েছে তা ধরে রাখেন এবং কেবল এই চারটি রাজ্য হারান কিন্তু অন্য সব দোদুল্যমান রাজ্য নেভাদা (৬), কলোরাডো (৯), আইওয়া (৬), উইসকনসিন (১০), নিউ হ্যাম্পশায়ার (৪) তাঁর সঙ্গে রাখতে পারেন তা হলেও তিনিই বিজয়ী হবেন। তার অর্থ হলো, মিট রমনিকে বিজয়ী হতে হলে একটি বড়, তিনটি মাঝারি এবং একটা ছোট অঙ্গরাজ্য জিততেই হবে।
তার মানে এখন পর্যন্ত ফলাফলের তিনটি সম্ভাব্য চিত্র দেখতে পাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে সেটা বলা অসম্ভব। তার আগে অবস্থার অন্যান্য পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব বলেও অনুমান করা যায়। শেষ বিতর্কের প্রভাব কতটা পড়বে, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। বিতর্কের কারণে এই সমীকরণে কোনো বদল হয় কি না সেটা আমরা দেখতে পাব বুধবার নাগাদ। অন্যথায় টান টান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচনের রাত পর্যন্ত।
ইলিনয়, ২০ অক্টোবর
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
মিট রমনি তা থেকে সুবিধা নিতে যে কুণ্ঠিত হবেন না, তা ওই দিন দেওয়া তাঁর বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিতর্কে এ বিষয়ে সুবিধা নিতে গিয়ে রমনি মারাত্মক ভুল করার কারণে তা তাঁর প্রতিকূলেই গেছে। কিন্তু তৃতীয় বিতর্কে সে রকম ভুলের আশঙ্কা নেই। প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে তিনি কতটা তথ্য বলতে পারবেন। রমনি যেকোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতেই পারেন; কিন্তু প্রেসিডেন্টের জন্য সব গোপনীয় তথ্য বলা সম্ভব নয়। ইরান প্রসঙ্গে ওবামার অনুসৃত নীতি যে কাজ করছে, সেটা বুঝতে হলে এ বিষয়ে যতটা গভীরভাবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা দরকার, তা সাধারণ ভোটাররা করেন না। রমনির জন্য সেটা সুবিধাজনক। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় রাজি আছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সাফল্য। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেও খানিকটা ছাড় দিতে হবে। রমনি কোনো ধরনের ছাড় দিতেই রাজি নন। আলোচনার আগেই ছাড় দেওয়ার কথা বললে ওবামা দুর্বল বিবেচিত হবেন, সেটা কূটনৈতিক বিবেচনায়ও সঠিক হবে না। কিন্তু রমনি সহজেই ইরানের বিরুদ্ধে উত্তেজক কথাবার্তা বলার সুযোগ পাবেন। সিরিয়া বিষয়েও প্রেসিডেন্টকে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের ভারী অস্ত্র সরবরাহের পক্ষে নয় এই আশঙ্কায় যে তা শেষ পর্যন্ত কার হাতে পড়বে, সেটা নিশ্চিত না হয়ে ওবামা প্রশাসন এগোতে চায় না। আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে নেতৃত্বহীনতা বলে রমনি মনে করেন এবং দেখাতে চান। প্রেসিডেন্টের একটা বড় সুবিধা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকেরা আরেকটি যুদ্ধের দামামা শুনতে রাজি নয়। দেশের অর্থনীতিও আরেকটা যুদ্ধের ভার বইতে পারবে না। এসব বিবেচনার মুখে তৃতীয় বিতর্ক হতে চলেছে। প্রেসিডেন্টের জন্য আশার বিষয় হলো, মার্কিনিরা পররাষ্ট্রনীতির বিবেচনায় ভোট দেন না।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে এখন লড়াই এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে কোনো প্রার্থীর পক্ষেই কোনোরকম ভুল করার সুযোগ নেই। নির্বাচনের সর্বশেষ সমীকরণের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কেন এই বিতর্ক এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মার্কিন নির্বাচন যে সাধারণ ভোটারদের সংখ্যাধিক্যের ওপর নির্ভর করে না, সেটা সবারই জানা আছে। দেশের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে ৫৪৩টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে এবং বিজয়ী হতে হলে একজন প্রার্থীকে ২৭০টি ভোট পেতে হয়। ব্যতিক্রমী বছরগুলো বাদ দিলে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের ফলাফল অনুমান করা যায়। ইলেকটোরাল কলেজের বিবেচনায় চারটি বড় অঙ্গরাজ্য হলো: নিউইয়র্ক, টেক্সাস, ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়া। এর মধ্যে নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি, টেক্সাস রিপাবলিকানদের। ফ্লোরিডা সাধারণত রিপাবলিকানদের পক্ষে গেলেও কখনো কখনো ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সে ক্ষেত্রেও ব্যবধান খুব বেশি হয়নি। তার বাইরে বড় সংখ্যার ভোট রয়েছে ইলিনয়, পেনসিলভেনিয়া, ওহাইও, জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে। ফলে সব নির্বাচনেই এসব রাজ্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। সাধারণত ইলিনয় থাকে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। এবার তার আরেক কারণ হলো প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই রাজ্যের একসময়কার সিনেটর এবং ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী একসময় ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর হলেও সেখানে তাঁর দল জনপ্রিয় নয়। ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন সেখানে সব সময়ই বেশি; তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে সেখানে তাঁর জনপ্রিয়তা তৈরি করতে পারেননি। কেবল ম্যাসাচুসেটসই যে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে তা নয়, দেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় যে উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ রাজ্য ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। অন্যদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলো রিপাবলিকানদের ঘাঁটি। দেশের আরেকটি অঞ্চল রিপাবলিকানদের পক্ষে, তা হলো দেশের পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট পার্বত্যপ্রধান রাজ্যগুলো। এগুলোতে লোক কম বলে তাদের হাতে ভোটও কম। সব
মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একপর্যায়ে এসে ধারণা করা যায় যে প্রার্থীদের হাতে কতটা নিশ্চিত ভোট রয়েছে, আর কতটা বাকি। একইভাবে বোঝা যায়, কোন কোন অঙ্গরাজ্য এবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
নির্বাচনের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে আমরা এখন এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। এখন বিভিন্ন গণমাধ্যম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর হিসাব ও জনমত জরিপ অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ওবামার পক্ষে নিশ্চিত বা অনুকূলে রয়েছে ২৩৭টি ভোট, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মিট রমনির পক্ষে বা তাঁর অনুকূলে আছে ১৯১টি ভোট। যে ১১০টি ভোটের হিসাব এর মধ্যে নেই তার মধ্য থেকে কে প্রয়োজনীয় ভোট জোগাড় করতে পারবেন, সেটাই এখন অঙ্কের বিষয়।
এই আসনগুলো সব মিলিয়ে নয়টি অঙ্গরাজ্যে ছড়ানো। এর মধ্যে আছে ফ্লোরিডার ২৯টি ভোট, আছে ওহাইওর ১৮টি ভোট। নর্থ ক্যারোলাইনা (১৫) ও ভার্জিনিয়া (১৩) তার পরের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। ওবামার দরকার ৩৩টি ভোট, রমনির দরকার ৭৯টি ভোট। এই হিসাবটা ভালো করে দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে ফ্লোরিডার ২৯টি ভোট ছাড়া মিট রমনির পক্ষে বিজয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। শেষ জনমত জরিপ বলছে যে এখানে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। ওবামার সুবিধা হলো ফ্লোরিডা, যা তিনি খুব কম ব্যবধানে ২০০৮ সালে বিজয়ী হয়েছিলেন, তা হারালেও একেবারে বিপদে পড়ে যাবেন না। কিন্তু তিনি যদি ফ্লোরিডা হারান তবে তাঁর জেতার জন্য ওহাইও জেতা প্রায়-বাধ্যতামূলক হয়ে পড়বে। কেননা, নর্থ ক্যারোলাইনা ও ভার্জিনিয়ার ভোটগুলো ডেমোক্র্যাটদের পাওয়ার সম্ভাবনা এ বছর খুব কম। ওহাইওতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুব তীব্র। সে ক্ষেত্রে কারও পক্ষে এটা তাঁর ব্যাগে বলে দাবি করার মতো অবস্থা নির্বাচনের আগের দিনেও হবে না। কেবল ফলাফলই তা বলতে পারবে। ওবামা যদি ওহাইওতে জেতেন, তবে তাঁর জেতার পথ মসৃণ হয়ে যাবে। এবং বলা যায় যে তাঁর বিজয় রোধ করা রমনির জন্য হবে প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু ওবামা যদি এই চারটি রাজ্য: নর্থ ক্যারোলাইনা (১৫) এবং ভার্জিনিয়া (১৩), ফ্লোরিডা (২৯) ও ওহাইও (১৮) হারান, তা হলেই কি মিট রমনি বিজয়ী হবেন? উত্তর হলো না। বরং ঠিক উল্টোটা। প্রেসিডেন্ট যদি এখন যেসব রাজ্য তাঁর অনুকূল অবস্থানে রয়েছে তা ধরে রাখেন এবং কেবল এই চারটি রাজ্য হারান কিন্তু অন্য সব দোদুল্যমান রাজ্য নেভাদা (৬), কলোরাডো (৯), আইওয়া (৬), উইসকনসিন (১০), নিউ হ্যাম্পশায়ার (৪) তাঁর সঙ্গে রাখতে পারেন তা হলেও তিনিই বিজয়ী হবেন। তার অর্থ হলো, মিট রমনিকে বিজয়ী হতে হলে একটি বড়, তিনটি মাঝারি এবং একটা ছোট অঙ্গরাজ্য জিততেই হবে।
তার মানে এখন পর্যন্ত ফলাফলের তিনটি সম্ভাব্য চিত্র দেখতে পাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে সেটা বলা অসম্ভব। তার আগে অবস্থার অন্যান্য পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব বলেও অনুমান করা যায়। শেষ বিতর্কের প্রভাব কতটা পড়বে, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। বিতর্কের কারণে এই সমীকরণে কোনো বদল হয় কি না সেটা আমরা দেখতে পাব বুধবার নাগাদ। অন্যথায় টান টান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচনের রাত পর্যন্ত।
ইলিনয়, ২০ অক্টোবর
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments