চারদিক- ঢাকার বুকে ‘মিনি সোভিয়েত’ by সুপ্রীতি ধর

বনি এম, অ্যাবা, রক অ্যান্ড রোল—এগুলো কোন দশকের? প্রশ্নটা নিজেকেই করা আসলে। কিন্তু এগুলোর আবেদন কি পুরোনো হয়? শুক্রবার রাতে এই মিউজিকই নাচতে বাধ্য করেছিল পঞ্চাশোর্ধ্বদেরও। সেই আগের সময়, আগের আবেগ। মানুষগুলোই কেবল কালের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া।


তাল মিলুক আর না-ইবা মিলুক, মন তো মিলল! পেরিয়ে যাওয়া বছরগুলোকে কিছুটা ঊহ্য রেখেই সংগঠনটির ৩০ বছর পূর্তিতে শামিল হয়েছিলেন সোভিয়েত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। এ উপলক্ষে ধানমন্ডির রুশ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি হয়ে উঠেছিল ‘মিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন’। সোভিয়েত এ কারণেই যে এই মিলনমেলায় এসেছিলেন সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতে পড়াশোনা করা সবাই। এসেছিলেন সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ের শিক্ষার্থীরাও।
করিডর থেকে শুরু করে হলরুম পর্যন্ত টাঙানো ছবিগুলো থেকে চোখ সরছিল না কারও। ছবিগুলো কত স্মৃতি-বিস্মৃতির ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল সবাইকে। বেলবটম ফ্যাশনের প্যান্টের ছবি থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের ছবিও আছে। চোখ আটকে গেল একটি ছবিতে। বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করছেন দিলরুবা আপা (বুয়েটের শিক্ষক), আর তিনিও পরম স্নেহে হাতটি রেখেছেন আপার মাথায়। এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, আত্মিক মেলবন্ধন। দেশ স্বাধীনের পরপর যাঁরাই উচ্চশিক্ষার্থে সোভিয়েত ইউনিয়নে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশই এমন সান্নিধ্য পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর।
মুক্তিযুদ্ধে শুধু স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হননি তৎকালীন সোভিয়েত নেতারা, হাত লাগিয়েছিলেন বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশটির পুনর্গঠনেও। তারই অংশ হিসেবে সুশিক্ষিত একটি জাতি গঠনেও দেশটির ভূমিকা তাই স্মর্তব্য। ৩০ বছর পূর্তির আনুষ্ঠানিকতায় তাই তো উপস্থিত সুধীজনেরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, উচ্চশিক্ষার অন্তরালে যথোপযুক্ত শিক্ষার কারণেই আজ দেশের অনেক খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সোভিয়েত-ফেরতরা। অথচ একসময় কী অবহেলাই না করা হতো রাশিয়ার নাম শুনলে।
প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির ভাষায়, ‘সেই অবজ্ঞার কাল কেটে গেছে’। বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান নূরও বলেন, ‘সেদিনের অবহেলিত “ব্রাত্যজনেরাই” আজ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। কোথায় নেই তাঁরা? গবেষণা, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইন কমিশন, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব জায়গাতেই তাঁদের সদর্প উপস্থিতি।’
১৯৮২ সালে যাত্রা শুরু করা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন পূর্ণ করল একে একে ৩০টি বছর। কম কথা নয়। বিশেষ অতিথি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান বলেই ফেললেন, এই দেশে একটি সংগঠন এত বছর ধরে পথ চলছে, এটা একটা দৃষ্টান্ত। এটাও সম্ভব হয়েছে সোভিয়েত শিক্ষার কারণেই। এই শিক্ষার কারণেই শিক্ষার্থীদের মনে দেশপ্রেমের চেতনা তাই অনেকের চেয়ে বেশি জাগ্রত। এই দেশে, এই সমাজে থেকেও এই অ্যাসোসিয়েশন অনেকটাই আলাদা। সংগঠনটির সদস্য সংস্থা মাত্র তিন হাজার হলেও গুণগত দিক দিয়ে এটা অগণিত। সোভিয়েত প্রত্যাগতরাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবচেয়ে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য বলে জানান তিনি। নিজের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি এ-ও বলেন, যত দিন একজন মুক্তিযোদ্ধাও বেঁচে থাকবেন, রাশিয়ার অবদানের কথাও তত দিন মনে রাখবেন।
রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দর আলেক্সিয়েভিচ নিকোলায়েভ আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, এই দেশে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দূত এই শিক্ষার্থীরাই।
দিনটি উদ্যাপন করতে গিয়ে এবার বিশেষ আকর্ষণ ছিল সংগঠনটির পেছনে অবদানের জন্য স্বীকৃতি প্রদান। মোট ১০ জনকে ক্রেস্ট দেওয়া হয়। অধ্যাপক তাজুল ইসলাম ও তিমির নন্দী—এই দুজনকে দেওয়া হয় বিশেষ সম্মাননা। রুশ রাষ্ট্রদূত এবং রুশ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক আলেক্সান্দর পেত্রোভিচ দেমিন এবং ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তা অজয় শ্রীবাস্তবকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানানো হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুরো মঞ্চ আলোকিত করেছিল বর্ণিল পোশাকের রুশ শিশুরা। কূটনীতিকদের সন্তানেরা রুশ গানের সঙ্গে চমৎকার নাচ দিয়ে আসর মাতিয়ে ফেলে। বাঙালিদের পাশাপাশি গান গেয়ে শোনান তরুণ রুশ কর্মকর্তারাও। জনপ্রিয় রুশ গান ‘কাতিউশা’ পুরো হলেই গীত হয়, নড়েচড়ে বসেন সবাই, উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। আমি নিশ্চিত, এই তারুণ্য শরীরের যেকোনো জরাকে কাবু করতে সক্ষম।
পুরো আয়োজনটি ছিল রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সৌজন্যে। বিদায়ের সময় কেন্দ্রটির কর্ণধার আলেক্সান্দর পেত্রোভিচ ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে যখন বলেন, ‘ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য, এটা তোমাদেরই বাড়ি’, তখন মনটা উড়াল দেয়। বাইরে এসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
সুপ্রীতি ধর

No comments

Powered by Blogger.