প্রথম ও শেষ মহাকাশযাত্রা by দিবাকর আচার্য্য

কাকা বলেছিলেন, ‘ভয় পাসনে। বিমান উড়বেই।’ আমি তখনো বুঝতে পারছিলাম না, কাকা এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে! কাকা মুখটা আরও কালো করে বললেন, ‘শোন, রানওয়ে ধরে বিমান যে দৌড়টা দেবে, তাতে যেকোনো জিনিস উড়ে যেতে বাধ্য।


তুই যদি কোনোভাবে একটা গাধাকেও অত জোরে দৌড় করাতে পারিস, সে দিব্যি ম্যা ম্যা করে উড়ে যাবে।’
গাধা ম্যা ম্যা করুক আর না-ই করুক, আমি ‘মা মা’ করে উঠলাম। যেই না সত্যি সত্যি ওই বিমান রানওয়ে ধরে ছুট দিল, আমি ছিটকে মিশে গেলাম সিটের সঙ্গে। মনে হলো, হূৎপিণ্ডটা এখন পিঠ ফুটো হয়ে বের হয়ে যাবে। একমাত্র উপায় এখন ‘মা মা’ করে ওঠা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, প্রবল আতঙ্কে আমি ‘কাকা কাকা’ করে চিৎকার করে উঠলাম!
এই ‘কাকা’ হলেন পান্থ রহমান। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। জগদ্বিখ্যাত কূটনৈতিক সাংবাদিক, সাবেক ক্রীড়া সাংবাদিক, আদি ও অকৃত্রিম পান্থ। তিনি এক বিশেষ সম্পর্কে আমার ‘কাকা’। সম্পর্কটা প্রকাশ্যে আলোচনাযোগ্য নয়।
আমার এই কাকা প্রায়ই বিমানে চড়েন। ‘চড়েন’ বলা ভুল হলো; আসলে তিনি প্রায়ই বিমানে থাকেন। আজ বসনিয়া, কাল হনুলুলু, পরশু নিকারাগুয়া, তার পরদিন ইথিওপিয়া ঘুরে বেড়ান। ফলে কাকাই বিমান নিয়ে কথা বলার সেরা মানুষ।
আমার যখন আর কিছু করার রইল না, যখন বুঝলাম এই ভয়ানক, বীভৎস ও প্রাণঘাতী যন্ত্রে আমাকে চড়তেই হবে, তখন কাকার কাছে গেলাম। এর আগ পর্যন্ত নানা অজুহাত দিয়ে নিজেকে রক্ষা করে এসেছি। বিমানে চড়ার প্রসঙ্গ এলেই, আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় মারা যায়, আমার জন্ডিস ধরা পড়ে। কিন্তু এবার আর শেষ রক্ষা হলো না—প্রথমবারের মতো বিমানে চড়তেই হবে আমাকে।
তাই প্রাণটা বুকপকেটে পুরে ছুটলাম আমার নভোচারী কাকার কাছে। কাকা আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘বিমানে চড়া কোনো ব্যাপারই না।’ তিনি দেখেছেন, অনেক গরু-ছাগলও বিমানে চড়ে এবং নেমে আসে। তিনি আমাকেও যেহেতু ওই পদবাচ্য মনে করেন, তাই বললেন, ‘তুই পারবি।’
মরিয়া হয়ে কাকা আমাকে বিমানের খুঁটিনাটি বোঝালেন। কত সামান্য এই যন্ত্র বিকল হয়ে যেতে পারে, বিমানে কিছু একটা হলেই যে আর ত্রাণ নেই, প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ এই করে মরে, জিনিসটা সাগরে-পাহাড়ে যেকোনো সময় আছড়ে পড়তে পারে—এসব বুঝিয়ে তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। সবশেষে গলার স্বর একটু নামিয়ে বললেন, ‘কী আর হবে! যাওয়ার সময় শুধু বাসার সবার কাছ থেকে ভালো করে বিদায় নিয়ে যাস।’
বন্ধু সিমু নাসের তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে এলেন, ‘শোনেন দিবাকর, দুই দিনের দুনিয়া। এ নিয়ে এত ভাবছেন কেন। ওপরওয়ালার নাম নিয়ে ঝুলে পড়েন। আর ভালো-মন্দ কিছু খেতে ইচ্ছা করলে খেয়ে নিন।’
রাজীব হাসান বললেন, ‘বিপদ মুক্তির কোনো মন্ত্রটন্ত্র জানেন না? না জানলে সেটা শিখে ফেলেন, কোনো ব্যাপার না।’
রবি ভাই বললেন, ‘দিবাদা। আমি জানি, আপনার ফেরার চান্স খুব কম। তার পরও ফিরতে পারলে বুঝবেন, কানাডার দুয়ার খুলে গেছে।’
শেষমেশ লাখ কথার এক কথা বললেন নওরোজ ইমতিয়াজ। অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘কত মানুষ সাধ করে এভারেস্টে ওঠে, টিভিতে টক শো করে, নিজের হাতে বিষ খায়; আপনি না হয় বিমানে উঠলেন। ভয় পাবেন না। শুধু মনে মনে বলবেন, “আমিও পারব।”’
‘আমিও পারব, আমিও পারব’ করতে করতে আমি ইমিগ্রেশনে পৌঁছালাম। কর্মকর্তারা হেসে বিদায় দিলেন। হাসিতে লুকানো করুণা আর বেদনার ছায়া পরিষ্কার। গেটের মুখে শ্রীলঙ্কান এক বিমানবালা ‘আয়ুভবন’ বলে স্বাগত জানালেন। আমার মনে হলো, দাঁত বের করে তিনি বলছেন, ‘আসো, এত দিনে পাইছি তোমারে! টের পাবা মজা।’
মজাটা টের পেলাম আসলে টানেলে ঢোকার সঙ্গেই। আমি এতকাল টিভিতে দেখেছি, সুন্দর সিঁড়ি বেয়ে বিমানে উঠতে হয়। কিন্তু ও হরি! কোথায় কিসের সিঁড়ি?
দুনিয়া আধুনিক হয়েছে। তাই এয়ারপোর্ট বিল্ডিং থেকে সরাসরি টানেল, মানে গুহার ভেতর দিয়ে বিমানে উঠতে হবে। ওই টানেলের ভেতর ঢোকামাত্র পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। বুঝলাম, আর ফিরিবার পথ নাহি। আটকে গেছি। একবার মনে হলো, ফিরে দৌড় দিই। ততক্ষণে পেছনে লম্বা লাইন; ঘুরে দৌড় দেওয়ার আর উপায় নেই!
লোকদের ধাক্কায় অবশ শরীর নিয়ে কীভাবে যেন আমার সিটে গিয়ে বসলাম। সময় যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, বুঝি না। একসময় টের পেলাম, বিমান চলছে। আমাদের আটতলা বাসার চেয়েও বিশাল বিমানটা আদনান সামির মতো আস্তে আস্তে করে নিজেকে টেনে নিয়ে চলতে লাগল। গতি রিকশার চেয়ে সামান্য কম।
বিমান এভাবে চলছেই, চলছেই। ভয়টা কেটে গেল। ওহ্! ও ও... এই তা হলে বিমানযাত্রা! এভাবে শ্রীলঙ্কা কেন, সাইবেরিয়া গেলেও আমার আপত্তি নেই। নানা কারণেই ততক্ষণে বিমানটা আপন মনে হচ্ছে। সিনেমায় দেখেছি, বিমানের সিটের সামনে সিনেমা হয়, গান হয়; এখানে সেসব আপদ নেই। শুনেছি, বিমানে উঠলে দফায় দফায় খাওয়া দেয়, পানি ও পানীয় দেয়; এখানে সে বালাই নেই। ফলে নিতান্তই আমাদের গাবতলী-যাত্রাবাড়ী বাসের মতো আপন মনে হলো; ভয় নেই।
কিন্তু হায়! সুখ আমার পোড়া কপালে সয় না। একটু পরেই ভীষণদর্শন বিমানবালা এসে সিটবেল্ট পরার হুমকি দিয়ে গেল; পরলাম। তারপর লাল-নীল কী সব বাতি জ্বলে উঠল, বিমানজুড়ে হুস হুস করে ধোঁয়া বের হতে থাকল; আর কার যেন একটা গলা শোনা গেল, ‘আই অ্যাম ইওর ক্যাপ্টেন... ভয় পাবেন না... সিটবেল্ট শক্ত করে বাঁধুন... কেবিন ক্রু নিজেদের জান বাঁচান! ডোন্ট প্যানিক, ডোন্ট প্যানিক!’
অত্যন্ত আতঙ্কিত কণ্ঠে ক্যাপ্টেনের এই কাঁপা কাঁপা ‘ডোন্ট প্যানিক’ শুনে বোঝা গেল, কিছু একটা হতে যাচ্ছে; এবার প্যানিকড হতেই হবে! তার পরই, তার পরই, তার পরই রানওয়ে ধরে সেই ছুট এবং হঠাৎ রোলার কোস্টারের অনুভূতি।
এর পরের কথা আর কিছু গুছিয়ে মনে নেই রে ভাই। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমি তখন অবশ, নিথর হয়ে পড়ে আছি। মাঝেমধ্যে সন্দেহ হচ্ছে, আমি মরে না গেলেও কোমায় চলে গেছি অন্তত। শুধু মাঝেমধ্যে টের পাচ্ছি, ছয় নম্বর বাসের মতো ঝাঁকি খাচ্ছে এই মহাকাশযান। শুধু বুঝি, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মধ্যে কোনো এক স্থানে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে আছি। আর কিছু বুঝি না। আর বুঝলাম শুধু প্রবল একটা ঝাঁকি; কলম্বো বন্দরনায়েকে বিমানবন্দর।
আহা! শ্রী লঙ্কা, শ্রীলঙ্কা। ২৪ দিনের সফরজুড়ে সবাই রিপোর্ট, সাইড স্টোরি, প্রেস কনফারেন্স নিয়ে ব্যস্ত রইল। আমি শুধু চুপচাপ। কিচ্ছু লিখতে পারি না, বলতে পারি না; এমনকি প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের নেমন্তন্নতেও যাই না। সহকর্মীরা বলেন, ‘কী হয়েছে! বাসায় সমস্যা?’ আমি জবাব দিই না। শুধু একমনে ইন্টারনেট ঘেঁটে চললাম, আকাশপথ ছাড়া ঢাকা ফেরার আর কোনো উপায় আছে কি না!
কপালে মিলল না। তবে এত দিনে একটা সুখবর পেয়েছি, কলকাতা থেকে এখনো লন্ডনের উদ্দেশে জাহাজ ছাড়ে। ওই জাহাজের ঠিকুজি জোগাড় করছি এখন। লন্ডন যেতে হবে। তবে বিমানে আর নয়।
আমি নির্বোধ; তাই বলে নিজের প্রাণ নিয়ে বারবার ছেলেখেলা করার মতো পাষণ্ড নই।

No comments

Powered by Blogger.