প্রশ্ন ফাসের নতুন কৌশল এটি। হাত ঘড়ির মাধ্যমে প্রশ্ন বাইরে পাঠানো। ঘড়িতেই ফিরে আসছে সমাধান। অভিনব এই কৌশলে প্রশ্ন ফাস ও পরীক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেয়ার নামে মাঠে তৎপর নতুন এক চক্র। এরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবার কেউ সরকারি চাকরি করেন।
মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তা এ ধরনের সহযোগিতা করছেন বিসিএসসহ সব প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায়। এ চক্র ২০০৯ সাল থেকে সক্রিয়। তারা কেবল প্রশ্নপত্র ফাস করেই বসে থাকছে না। পরীক্ষাচলাকালীন সময়ে ঘরিসদৃশ মোবাইলে ম্যাসেজের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নের উত্তর পাঠিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায়ও এ তত্ত্ব ব্যবহার করা হচ্ছে। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত তেজগাঁও সরকারী বিজ্ঞান কলেজের একজন শিক্ষিকা এবং পিএসসি, দুদক ও বিজি প্রেসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। চক্রের সদস্যরা পরীক্ষার্থীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এ চক্রের মূল হোতা, সক্রিয় সদস্য ও অপহরণকারীসহ ১০জনকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদের অধিকাংশই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের কাছ থেকে ২০টি ঘরিসদৃশ মোবাইল ও সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে। আজ ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- দুদকের সহকারী পরিদর্শক মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ (৩৫), আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র কফিল উদ্দিন মাহমুদ (৩০), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র রেফায়েত সানি (২৪), ফিন্যান্স বিভাগের সন্ধ্যাকালীন এমবিএর ছাত্র অমিতাভ চৌধুরী (২১), বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন (২৪), সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র হাবিবুর রহমান হাবিব (২৪), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র নুরুল হুদা ওরফে ডলার মাহমুদ (২৩), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র রুবেল বিশ্বাস (২৩), একই বিশ্বদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্র ইসতিয়াক আহমেদ পরশ (২২), ও সাজ্জাদ হোসেন (২২)। গ্রেপ্তারকৃতদের দুপরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- গত ২১শে অক্টোবর সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত সময়ে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান ও সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন একটি টিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও খিলগাঁও থানাধীন তালতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভর্তি পরীক্ষা ও নিয়োগ প্রশ্নের ফাসকারী চক্রের মূল হোতা দুদক কর্মকর্তা মফিজুর রহমান ওরফে মফিজসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তরকৃতরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ও পিএসসির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মশিউর রহমান জানান, গত ১৯শে অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা অংশগ্রহণ করতে আসে সাভারের একটি কলেজের ছাত্র হারুন উর-রশিদ ওরফে হীরা (১৯)। ভর্তি পরীক্ষার পরপরই সে নিঁেখাজ হয়ে যায়। ঘটনার দিন রাতে হারুন-উর-রশিদ হীরার মোবাইল থেকে তার বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট এমাজ উদ্দিনের মোবাইলে ফোন আসে।
অপর প্রান্ত থেকে একজন জানায়- হীরাকে তারা অপহরণ করেছে। ১ লাখ ২০ হাজার টাকা না দিলে তাকে হত্যা করা হবে। এরপর হীরার বাবা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাশাপাশি এসএ পরিবহন শান্তিনগর শাখার মাধ্যমে দাবিকৃত টাকা দিতে রাজি হন। অপহরণকারীরা একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে এসএ পরিবহণের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বলে। টাকা পাঠানোর পর এসএ পরিবহণ শান্তিনগর শাখায় ওঁৎ পাতে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। এসএ পরিবহণ থেকে টাকা নিতে আসা রুবেল বিশ্বাস ও হাবিবুর রহমানকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের ২০৮ নম্বর কক্ষ থেকে অপহরণকারী সাজ্জাদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। হারুন উর-রশিদ ওরফে হীরাকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ৩ জন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা সংঘবদ্ধ প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়ার শর্তে হীরার সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। ভর্তি পরীক্ষার দিন ভিকটিম হীরা মৌখিক চুক্তি ভঙ্গ করে নিজেই পরীক্ষা দেয়। তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয় না। পরে অপহরণকারীরা কৌশলে ভিকটিম হীরাকে ডেকে নিয়ে জিয়া হলে আটকে রেখে চাঁদা দাবি করে। এর ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, তারা প্রশ্নপত্র ফসের সিন্ডিকেটের মূল হোতা মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ও কফিল উদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে কাজ করে। রুবেল ও হাবিবের দেয়া তথ্য অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে মফিজ ও কফিলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে মফিজ ও কফিলকে দিয়ে কৌশলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ডেকে এনে সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম জানান, সিন্ডিকেটের মূল হোতা হচ্ছে মফিজ এবং কফিল ১ থেকে দেড় লাখ টাকায় পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করে। গ্রেপ্তারকৃত পরশ, রুবেল, সাজ্জাত ও হাবিব পরীক্ষার্থীদেরকে সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। বিনিময়ে তারা কমিশন পায়। গ্রেপ্তারকৃত সানি, মামুন, ডলার মাহমুদ, অমিতাভ এক্সপার্ট গ্রুপের সদস্য। তারা প্রশ্ন পত্রের সমাধান করে দেয়ার বিনিময়ে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকে। এ সিন্ডিকেট তাদের কার্যক্রম চালানোর জন্য ঢাকা কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, ইডেন কলেজ, সিটি কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ এবং বদরুন্নেসা কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর যোগসাজশে পরীক্ষার আসন পরিবর্তন করে সুবিধাজনক স্থানে বসার ব্যবস্থা করে।
No comments