আরো কেলেঙ্কারি সোনালী ব্যাংকের by আবুল কাশেম

সোনালী ব্যাংকের একটি শাখায় সর্বকালের বৃহত্তম অর্থ কেলেঙ্কারির (হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক) উত্তাপ কাটতে না কাটতে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকেই আরেক দুর্নীতির ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। এবার বেরিয়েছে, সোনালী ব্যাংকের মূল দুই শাখা- প্রধান কার্যালয় ও স্থানীয় কার্যালয়ে বসেই কিছু অসাধু কর্মকর্তা কারসাজি করেছেন।


জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরের ১২ মাসে জাল-জালিয়াতি ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে লোপাট হয়েছে ৪৪১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাসে গড়ে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা করে লোপাট হয়েছে। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কখনো এককভাবে, কখনো গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছেন। এর মধ্যে আত্মসাৎ ও অবৈধ লেনদেনের কারণে ব্যাংকের ক্ষতির পরিমাণ স্থানীয় কার্যালয়ে ৩৩০ কোটি ২৬ লাখ আর প্রধান কার্যালয়ে ১১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এবার এ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়।
সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের শাখা দুটিতে নিরীক্ষা চালিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনটি গতকাল রবিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যাংকটির ওই দুই শাখার কিছু কর্মকর্তা হলমার্কের মতোই ভুয়া রপ্তানি বিল কেনা, একই কাজে দুইবার বিল পরিশোধ করা, কেনা আইবিপি (ইনল্যান্ড বিল পারচেজ) বিলের টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও আদায় না করা, এক শাখার ইস্যু করা চেক জালিয়াতি করে নানা শাখা থেকে অর্থ উত্তোলনের পর আত্মসাৎ এবং গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ভুয়া সম্পত্তির দলিল ব্যাংকে বন্ধক রাখার মাধ্যমে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন।
এসব অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির গত পরিচালনা পর্ষদের সময়। ওই পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলাম বর্তমান পরিচালনা পর্ষদেরও চেয়ারম্যান। এসব অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির বিষয়ে কাজী বাহারুল ইসলামের মোবাইলে ফোন করে পরিচয় দিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে ফোন কেটে দেন। চেয়ারম্যানকে ফোন দেওয়ার আগে ও পরে এমডি প্রদীপ কুমার দত্তের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়। এ ছাড়া এসএমএস করেও ফোন ধরার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি বা কোনো সাড়াও দেননি। মহাহিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় ও প্রধান কার্যালয়ে এক বছরেই ঋণ জালিয়াতি ও অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা। অন্যান্য বছরের আর্থিক লেনদেনের কার্যক্রমের ওপর নিরীক্ষা চালালে এ ধরনের দুর্নীতি আরো ধরা পড়বে।
মহাহিসাব নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখার ইস্যু করা কিছু চেক ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের ক্লিয়ারিংয়ের পর জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখার কিছু কর্মকর্তা ও গ্রাহক যোগসাজশ করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ভুয়া সম্পত্তির দলিল ব্যাংকে বন্ধক রেখে দুই কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ বিতরণের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। আবার স্থানীয়ভাবে কেনা আইবিপি বিলের টাকা মেয়াদোত্তীর্ণের পরও আদায় না করায় ব্যাংকের লোকসান হয়েছে ৮৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। আরেক ক্ষেত্রে আইবিপি বিলের নির্দিষ্ট সময়সীমার অতিরিক্ত সময়ের সুদ মার্জিন বাদে অনাদায়ি রাখায় ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ২৪ কোটি ১১ লাখ টাকা।
আবার সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ লঙ্ঘন করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ওপর দেওয়া আয়কর নিজেদের আয় থেকে পরিশোধ না করে ব্যাংকের তহবিল থেকে নেওয়ার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে আট কোটি ৩২ লাখ টাকা। ব্যাংকটির স্টাফ কলেজের একই নির্মাণকাজের বিল দুইবার পরিশোধ করে আত্মসাৎ করা হয়েছে ৭৩ লাখ টাকা। ভুয়া ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে ভুয়া রপ্তানি বিল কেনা ও ভুয়া রপ্তানি এলসির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। আবার মেয়াদোত্তীর্ণের পরও নতুন করে এলটিআর ঋণ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে শাখাটির কর্মকর্তারা ব্যাংকের লোকসান করেছেন ৪৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে রপ্তানি ব্যর্থতার কারণে গ্রাহকের ফোর্সড লোনের দায়সহ প্রকল্প ঋণের দায়ও পুনঃ তফসিল সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও ঋণের দায় আদায় করেননি শাখাটির কর্মকর্তারা। উল্টো ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপনের সুযোগ দেওয়ায় নতুন করে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করা হয়েছে। এত কিছু যে প্রতিষ্ঠানটির জন্য, তা এখন বন্ধ রয়েছে। ফলে ব্যাংকটির ২৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আদায় অনিশ্চিত বলে মনে করছে মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রপ্তানি মূল্যের ওপর উৎসে আয়কর পরিশোধের বিধান লঙ্ঘন করে রপ্তানিকারকদের অবৈধ সুবিধা দিয়েছে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়। এ-সংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা অমান্য করে রপ্তানি মূল্যের ওপর দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা কর্তন করে না রেখে গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে অবৈধভাবে লাভবান হয়েছেন ব্যাংকটির স্থানীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। শাখাটি ভুয়া সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ দিয়েছে এক কোটি ৭৭ লাখ টাকা, যা আদায় করা সম্ভব নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার প্রকল্প ঋণ হিসাব নিম্নমানে শ্রেণীকরণ করা সত্ত্বেও ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপন সুবিধা দেওয়া, রপ্তানি করতে ব্যর্থ হওয়ায় ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে আমদানি বিলের দাম পরিশোধ করার মাধ্যমে শাখাটি তছরুপ করেছে ১২ কোটি ২২ লাখ টাকা।
আবার একজন গ্রাহকের বন্ধকি সম্পত্তির মূল্যের চেয়ে ব্যাংকের পাওনা অর্থের পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। আবার ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানিও বন্ধ। কারখানাটিও বন্ধ। তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈধভাবে ফোর্সড লোন দেওয়ার মাধ্যমে স্থানীয় কার্যালয় শাখা ব্যাংকের ক্ষতি করেছে ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আরেক গ্রাহকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁর ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা যাচাই না করেই তাঁর চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দেয় সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়। ঋণগ্রহীতা ব্যবসা পরিচালনায় ব্যর্থ হলেও শাখাটি ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপন করে দায় বাড়িয়েছে ১৪ কোটি টাকা। আবার একজন গ্রাহক তাঁর নেওয়া ঋণের প্রথম কিস্তিও পরিশোধ করেননি, অথচ তাঁকেও নতুন করে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে কর্মকর্তারা লাভবান হলেও ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ছয় কোটি ৮২ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট শাখা দুটির মধ্যে স্থানীয় কার্যালয়ের ডিজিএম প্রদীপ কুমার শর্মা ও এজিএম ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে শাখাটির টেলিফোন নম্বরে ফোন করলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.