নিউইয়র্কে গোয়েন্দা ফাঁদে বাংলাদেশি যুবক- রেজওয়ানুলের ভরসা এখন গ্র্যান্ড জুরি
কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের বিরুদ্ধে মামলা চলবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অভিযোগপত্র গ্র্যান্ড জুরিতে পাঠানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সন্ত্রাসবাদী হামলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গত বুধবার এই বাংলাদেশি যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
মার্কিন আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী, আগামী ৩০ দিনের মধ্যে রেজওয়ানুলের মামলা গ্র্যান্ড জুরির কাছে উঠবে। জুরির অভিমত সাপেক্ষে অভিশংসকেরা এরপর আদালতে অভিযোগ উত্থাপন করবেন। রেজওয়ানুল তখন নিজেকে নির্দোষ ঘোষণা বা দোষ স্বীকারের সুযোগ পাবেন।
নিউইয়র্ক থেকে আমাদের প্রতিনিধি ইব্রাহীম চৌধুরী গতকাল রোববার রাতে এ তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশি কনস্যুলারের কর্মকর্তারা আজ সোমবার অফিস খোলার পর রেজওয়ানুলের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে কাজ করবেন। তিনি এখন ব্রুকলিন কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে রেজওয়ানুলের ব্যাপারে বাংলাদেশেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অনুসন্ধান শুরু করেছে। তবে এখন পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদে তাঁর জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি এখনো অনুসন্ধান পর্যায়েই আছে।
রেজওয়ানুলের বাবা কাজী আহসানউল্লাহ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাফিসের ব্যাপারে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, আমরা তার দিকে তাকিয়ে আছি। সরকারের বাইরে কোনো কিছু করার সামর্থ্য আমাদের নেই। তাই সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছি।’ তিনি বলেন, ২০০৯ সালে রেজওয়ানুল ঢাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকম প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আট সেমিস্টার সম্পন্ন করেন। এরপর বিদেশে যান। দেশে থাকার সময় তিনি কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাঁকে যেকোনোভাবে ফাঁসানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের গত শুক্রবার রেজওয়ানুলের বিষয়ে মার্কিন উপসহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রুস সি সোয়ার্টজের সঙ্গে বৈঠক করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সে দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া এবং কনস্যুলার বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রেজওয়ানুলকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো (এফবিআই) কিসের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করেছে, তা রাষ্ট্রদূত জানতে চান। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, তাঁর জন্য কনস্যুলার-সুবিধা, আইনজীবী নিয়োগ—এসব বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেন।
ওয়াশিংটনে গত শুক্রবারের ওই বৈঠকে ব্রুস সি সোয়ার্টজ ১৭ অক্টোবর এফবিআই রেজওয়ানুলকে কেন গ্রেপ্তার করেছে, তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। রেজওয়ানুল যে বাংলাদেশের নাগরিক, এর সমর্থনে তাঁর পাসপোর্টের (এ এ ৩৮১০০৫১) অনুলিপি রাষ্ট্রদূতকে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে মার্কিন উপসহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে জানান, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার রেজওয়ানুলের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করেছে।
জানতে চাইলে আকরামুল কাদের গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাফিসের বিষয়ে কনস্যুলার-সুবিধা পেতে যুক্তরাষ্ট্রকে শুক্রবারের বৈঠকে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছি। এ সময় কনস্যুলার-বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের উল্লেখ করে মার্কিন কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন।’
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, রেজওয়ানুলের জন্য আইনজীবী নিয়োগের ব্যাপারে দূতাবাস ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
শুক্রবারের বৈঠকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে পুনর্ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। সেই সঙ্গে তিনি এটিও উল্লেখ করেছেন, রেজওয়ানুলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, আইনের স্বার্থে তাঁর অধিকার যাতে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কার বিষয়টিও আকরামুল কাদের উল্লেখ করেন। এ সময় ব্রুস সি সোয়ার্টজ তাঁকে এটা বলে আশ্বস্ত করেছেন, ওই ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। রেজওয়ানুলের গ্রেপ্তারের পর প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হলে তা মার্কিন কর্মকর্তাদের জানাতে তিনি রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন। বিচার চলাকালে রেজওয়ানুলের অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করা হবে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন।
আমাদের নিউইয়র্ক প্রতিনিধি জানান, রেজওয়ানুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। বিশেষ করে শিক্ষা ভিসায় যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আতঙ্ক বেশি।
ভরসা গ্র্যান্ড জুরি: জানা গেছে, ২১ বছর বয়সী রেজওয়ানুলের একমাত্র ভরসা এখন গ্র্যান্ড জুরি। গ্র্যান্ড জুরিরা যদি রেজওয়ানুলকে নির্দোষ রায় দেন, তবেই কেবল তিনি মুক্ত হতে পারবেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপকবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার ও জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
সাধারণত বড় ধরনের বা চাঞ্চল্যকর মামলা পাঠানো হয় গ্র্যান্ড জুরিতে। গ্র্যান্ড জুরিরা তদন্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনে এবং প্রমাণ দেখে জানাবেন, মামলা চলবে কি না। সাধারণত ১৬ থেকে ২৩ জন থাকেন গ্র্যান্ড জুরিতে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১২ জনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।
এপির দেওয়া তথ্য: বার্তা সংস্থা এপি জানায়, রেজওয়ানুলের সঙ্গে দেশীয় কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা আছে কি না, সে বিষয় তদন্ত করতে বাংলাদেশের পুলিশের সদস্যরা গত শনিবার তাঁর সাবেক শিক্ষক ও সহপাঠীদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
বার্তা সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এর আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, শনিবার গোয়েন্দা সদস্যরা রাজধানী ঢাকার বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, কর্মকর্তা ও রেজওয়ানুলের সহপাঠীদের সাক্ষাৎকার নেবেন।
গোয়েন্দা সদস্যরা ইতিমধ্যে রেজওয়ানুলের গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। তবে সেখানে তাঁরা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাননি।
এপির খবরে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, রেজওয়ানুল হামলার ব্যাপারে গ্রীষ্মকালে প্রথম পদক্ষেপ নেন। হামলার কাজে সহযোগিতার জন্য তিনি সহযোগী খোঁজেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি এমন একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি কার্যত একজন সরকারি তথ্যদাতা। এই তথ্যদাতাই পরে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে ওই ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করেন।
মার্কিন তদন্ত কর্মকর্তারা আরও জানান, রেজওয়ানুল তাঁর হামলার লক্ষ্যস্থল নির্দিষ্ট করে নকল বিস্ফোরকভর্তি ভ্যান ওই ব্যাংকের একেবারে প্রবেশদ্বার পর্যন্ত নিয়ে যান। পরে একটি হোটেলকক্ষ থেকে মুঠোফোনের মাধ্যমে এই গাড়িবোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা চালান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার তদন্ত চলাকালে রেজওয়ানুল ফেসবুক, অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম ও মুঠোফোনে ওই তথ্যদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা দুজন হোটেলকক্ষটিতে দেখাও করেন।
তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ জানায়, রেজওয়ানুল তথ্যদাতার সঙ্গে আলোচনা ও যোগাযোগকালে আল-কায়েদার সাবেক প্রধান ওসামা বিন লাদেনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধের কথা জানান। এ ছাড়া তিনি তাঁর (নাফিস) হামলার ষড়যন্ত্র নিয়ে আল-কায়েদা-সমর্থিত কোনো সাময়িকীতে একটি নিবন্ধ লেখারও আগ্রহ প্রকাশ করেন। রেজওয়ানুল তাঁকে বলেন, তিনি শহীদ হতে চান। তবে এই হামলা চালানোর পর তিনি দেশে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে হত্যা ও নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ উড়িয়ে দেওয়ার বিষয়েও তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।
বিতর্কিত স্টিং অপারেশন: রেজওয়ানুলকে ধরা হয় স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই এই অপারেশনটি পরিচালনা করে। মূলত ফাঁদ পেতে অপরাধ করতে সহযোগিতা ও উৎসাহ জুগিয়ে অপকর্ম সংঘটনের ঠিক আগমুহূর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধরার নাম ‘স্টিং অপারেশন’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি পরিচালিত হলেও সুইডেন ও নেদারল্যান্ডে তা নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে এটি বেশি ব্যবহূত হচ্ছে। নিউইয়র্কে ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আল-কায়েদার হামলার পর থেকে এফবিআই এটি বেশি ব্যবহার করছে।
কয়েক দিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্টিং অপারেশন নিয়ে সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। ৯/১১-পরবর্তী সময় থেকেই এফবিআইয়ের ‘স্টিংস’ অভিযান নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনাকারী প্রশ্ন তুলেছেন, ছদ্মাবরণে পরিচালিত এ ধরনের অভিযান কি আসলেই সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনের জন্য, নাকি ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে ফাঁদে ফেলতে নিজেদের সাজানো নাটকের শিকারে পরিণত করাই এফবিআইয়ের উদ্দেশ্য?
ফ্রান্সের একটি বার্তা সংস্থা ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে এফবিআইয়ের গোপন তথ্যদাতাদের মসজিদে যত্রতত্র অনুপ্রবেশের সমালোচনা করা হয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারাও অভিযোগ করেছেন, গোপন তথ্যদাতাদের মুসলমান সাজিয়ে মসজিদে প্রবেশ করানো হয়। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে মামলাও হয়েছিল।
‘স্টিংস’-এর সমালোচকেরা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ টানছেন ২০০৯ সালের বিতর্কিত ‘দ্য নিউবার্গ ফোর’ মামলাটির। সে বছর নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৬০ মাইল উত্তরের শহর নিউবার্গের চার কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম তরুণকে দুটি গির্জা বোমা হামলায় উড়িয়ে দেওয়া এবং জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করার অপরাধে ২৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে অবশ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এফবিআইয়ের বিতর্কিত ভূমিকা। কারণ, কারাদণ্ড পাওয়া ওই চার তরুণের বিরুদ্ধে ছোটখাটো অপরাধ—মাদক ব্যবহারের অভিযোগ ছিল।
নিউইয়র্ক থেকে আমাদের প্রতিনিধি ইব্রাহীম চৌধুরী গতকাল রোববার রাতে এ তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশি কনস্যুলারের কর্মকর্তারা আজ সোমবার অফিস খোলার পর রেজওয়ানুলের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে কাজ করবেন। তিনি এখন ব্রুকলিন কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে রেজওয়ানুলের ব্যাপারে বাংলাদেশেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অনুসন্ধান শুরু করেছে। তবে এখন পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদে তাঁর জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি এখনো অনুসন্ধান পর্যায়েই আছে।
রেজওয়ানুলের বাবা কাজী আহসানউল্লাহ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাফিসের ব্যাপারে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, আমরা তার দিকে তাকিয়ে আছি। সরকারের বাইরে কোনো কিছু করার সামর্থ্য আমাদের নেই। তাই সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছি।’ তিনি বলেন, ২০০৯ সালে রেজওয়ানুল ঢাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকম প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আট সেমিস্টার সম্পন্ন করেন। এরপর বিদেশে যান। দেশে থাকার সময় তিনি কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাঁকে যেকোনোভাবে ফাঁসানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের গত শুক্রবার রেজওয়ানুলের বিষয়ে মার্কিন উপসহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রুস সি সোয়ার্টজের সঙ্গে বৈঠক করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সে দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া এবং কনস্যুলার বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রেজওয়ানুলকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো (এফবিআই) কিসের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করেছে, তা রাষ্ট্রদূত জানতে চান। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, তাঁর জন্য কনস্যুলার-সুবিধা, আইনজীবী নিয়োগ—এসব বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেন।
ওয়াশিংটনে গত শুক্রবারের ওই বৈঠকে ব্রুস সি সোয়ার্টজ ১৭ অক্টোবর এফবিআই রেজওয়ানুলকে কেন গ্রেপ্তার করেছে, তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। রেজওয়ানুল যে বাংলাদেশের নাগরিক, এর সমর্থনে তাঁর পাসপোর্টের (এ এ ৩৮১০০৫১) অনুলিপি রাষ্ট্রদূতকে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে মার্কিন উপসহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে জানান, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার রেজওয়ানুলের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করেছে।
জানতে চাইলে আকরামুল কাদের গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাফিসের বিষয়ে কনস্যুলার-সুবিধা পেতে যুক্তরাষ্ট্রকে শুক্রবারের বৈঠকে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছি। এ সময় কনস্যুলার-বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের উল্লেখ করে মার্কিন কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন।’
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, রেজওয়ানুলের জন্য আইনজীবী নিয়োগের ব্যাপারে দূতাবাস ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
শুক্রবারের বৈঠকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে পুনর্ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। সেই সঙ্গে তিনি এটিও উল্লেখ করেছেন, রেজওয়ানুলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, আইনের স্বার্থে তাঁর অধিকার যাতে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কার বিষয়টিও আকরামুল কাদের উল্লেখ করেন। এ সময় ব্রুস সি সোয়ার্টজ তাঁকে এটা বলে আশ্বস্ত করেছেন, ওই ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। রেজওয়ানুলের গ্রেপ্তারের পর প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হলে তা মার্কিন কর্মকর্তাদের জানাতে তিনি রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন। বিচার চলাকালে রেজওয়ানুলের অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করা হবে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন।
আমাদের নিউইয়র্ক প্রতিনিধি জানান, রেজওয়ানুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। বিশেষ করে শিক্ষা ভিসায় যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আতঙ্ক বেশি।
ভরসা গ্র্যান্ড জুরি: জানা গেছে, ২১ বছর বয়সী রেজওয়ানুলের একমাত্র ভরসা এখন গ্র্যান্ড জুরি। গ্র্যান্ড জুরিরা যদি রেজওয়ানুলকে নির্দোষ রায় দেন, তবেই কেবল তিনি মুক্ত হতে পারবেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপকবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার ও জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
সাধারণত বড় ধরনের বা চাঞ্চল্যকর মামলা পাঠানো হয় গ্র্যান্ড জুরিতে। গ্র্যান্ড জুরিরা তদন্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনে এবং প্রমাণ দেখে জানাবেন, মামলা চলবে কি না। সাধারণত ১৬ থেকে ২৩ জন থাকেন গ্র্যান্ড জুরিতে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১২ জনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।
এপির দেওয়া তথ্য: বার্তা সংস্থা এপি জানায়, রেজওয়ানুলের সঙ্গে দেশীয় কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা আছে কি না, সে বিষয় তদন্ত করতে বাংলাদেশের পুলিশের সদস্যরা গত শনিবার তাঁর সাবেক শিক্ষক ও সহপাঠীদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
বার্তা সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এর আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, শনিবার গোয়েন্দা সদস্যরা রাজধানী ঢাকার বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, কর্মকর্তা ও রেজওয়ানুলের সহপাঠীদের সাক্ষাৎকার নেবেন।
গোয়েন্দা সদস্যরা ইতিমধ্যে রেজওয়ানুলের গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। তবে সেখানে তাঁরা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাননি।
এপির খবরে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, রেজওয়ানুল হামলার ব্যাপারে গ্রীষ্মকালে প্রথম পদক্ষেপ নেন। হামলার কাজে সহযোগিতার জন্য তিনি সহযোগী খোঁজেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি এমন একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি কার্যত একজন সরকারি তথ্যদাতা। এই তথ্যদাতাই পরে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে ওই ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করেন।
মার্কিন তদন্ত কর্মকর্তারা আরও জানান, রেজওয়ানুল তাঁর হামলার লক্ষ্যস্থল নির্দিষ্ট করে নকল বিস্ফোরকভর্তি ভ্যান ওই ব্যাংকের একেবারে প্রবেশদ্বার পর্যন্ত নিয়ে যান। পরে একটি হোটেলকক্ষ থেকে মুঠোফোনের মাধ্যমে এই গাড়িবোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা চালান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার তদন্ত চলাকালে রেজওয়ানুল ফেসবুক, অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম ও মুঠোফোনে ওই তথ্যদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা দুজন হোটেলকক্ষটিতে দেখাও করেন।
তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ জানায়, রেজওয়ানুল তথ্যদাতার সঙ্গে আলোচনা ও যোগাযোগকালে আল-কায়েদার সাবেক প্রধান ওসামা বিন লাদেনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধের কথা জানান। এ ছাড়া তিনি তাঁর (নাফিস) হামলার ষড়যন্ত্র নিয়ে আল-কায়েদা-সমর্থিত কোনো সাময়িকীতে একটি নিবন্ধ লেখারও আগ্রহ প্রকাশ করেন। রেজওয়ানুল তাঁকে বলেন, তিনি শহীদ হতে চান। তবে এই হামলা চালানোর পর তিনি দেশে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে হত্যা ও নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ উড়িয়ে দেওয়ার বিষয়েও তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।
বিতর্কিত স্টিং অপারেশন: রেজওয়ানুলকে ধরা হয় স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই এই অপারেশনটি পরিচালনা করে। মূলত ফাঁদ পেতে অপরাধ করতে সহযোগিতা ও উৎসাহ জুগিয়ে অপকর্ম সংঘটনের ঠিক আগমুহূর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধরার নাম ‘স্টিং অপারেশন’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি পরিচালিত হলেও সুইডেন ও নেদারল্যান্ডে তা নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে এটি বেশি ব্যবহূত হচ্ছে। নিউইয়র্কে ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আল-কায়েদার হামলার পর থেকে এফবিআই এটি বেশি ব্যবহার করছে।
কয়েক দিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্টিং অপারেশন নিয়ে সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। ৯/১১-পরবর্তী সময় থেকেই এফবিআইয়ের ‘স্টিংস’ অভিযান নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনাকারী প্রশ্ন তুলেছেন, ছদ্মাবরণে পরিচালিত এ ধরনের অভিযান কি আসলেই সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনের জন্য, নাকি ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে ফাঁদে ফেলতে নিজেদের সাজানো নাটকের শিকারে পরিণত করাই এফবিআইয়ের উদ্দেশ্য?
ফ্রান্সের একটি বার্তা সংস্থা ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে এফবিআইয়ের গোপন তথ্যদাতাদের মসজিদে যত্রতত্র অনুপ্রবেশের সমালোচনা করা হয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারাও অভিযোগ করেছেন, গোপন তথ্যদাতাদের মুসলমান সাজিয়ে মসজিদে প্রবেশ করানো হয়। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে মামলাও হয়েছিল।
‘স্টিংস’-এর সমালোচকেরা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ টানছেন ২০০৯ সালের বিতর্কিত ‘দ্য নিউবার্গ ফোর’ মামলাটির। সে বছর নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৬০ মাইল উত্তরের শহর নিউবার্গের চার কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম তরুণকে দুটি গির্জা বোমা হামলায় উড়িয়ে দেওয়া এবং জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করার অপরাধে ২৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে অবশ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এফবিআইয়ের বিতর্কিত ভূমিকা। কারণ, কারাদণ্ড পাওয়া ওই চার তরুণের বিরুদ্ধে ছোটখাটো অপরাধ—মাদক ব্যবহারের অভিযোগ ছিল।
No comments