ধীরেন দত্ত স্মারক চাই by প্রবীর বিকাশ সরকার
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রায় বিস্মৃত একটি নাম। অথচ পাঠ্যগ্রন্থে তার ইতিহাস শিক্ষামূলক বিষয় হিসেবে গ্রন্থিত হওয়ার দাবি রাখে নানা কারণেই। তিনি শুধু রাজনীতিজ্ঞই ছিলেন না, একজন দরিদ্র, দরদি সমাজসেবকও ছিলেন।
মানুষ গড়ার শিক্ষক বা কারিগর হওয়ার মতো গুণাগুণও তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের তিনি ছিলেন একজন নির্ভেজাল আদর্শ। যে কারণে ভারত ভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে অনুষ্ঠিত সংসদীয় অধিবেশনে তিনি অকুতোভয় কণ্ঠে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের আরও দুটি রাষ্ট্রীয় ভাষা উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের নেতা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
তখনকার পাকিস্তান প্রতিনিধি সভার অন্যতম বাঙালি হিন্দু সদস্য আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে সাহসী আহ্বান জানিয়েছিলেন সেটা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে যুগপৎ বিস্মিত ও শঙ্কিত করে তুলেছিল। তার ভাষাতেই জানা যাক : 'তারপর মার্চ মাসে আবার বাজেট অধিবেশনের সময়ে ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু-র এক অধিবেশনে আমিই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ হইতে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে উচ্চারণ করি। কারণ, পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বাংলা ভাষাভাষীই বেশি। এই দাবিতে বিস্ময়ের সৃষ্টি হইয়াছিল। তারপর যখন আমি ঢাকায় ফিরিয়া আসি, এয়ারপোর্টে কতক লোক দেখিতে পাইলাম। আমার আশঙ্কা হইল_ আমি বুঝি গ্রেফতার হইব। নামিয়া দেখি, একদল যুবক-ছাত্র ফুলের মালা নিয়া আমাকে অভ্যর্থনা করিতে আসিয়াছে। তাহারা বলিল, আপনি আমাদের মুখ রক্ষা করিয়াছেন, বাংলা ভাষার দাবি আপনিই প্রথম উত্থাপন করিলেন' (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, পৃষ্ঠা ৯৯)। বাঙালি জাতীয়তাবাদ সত্তার উত্থান বা চেতনা সম্পর্কে পাকিস্তানিরা সজাগ হয়ে গিয়েছিল এই একটি মাত্র কারণে বললে অত্যুক্তি হবে না।
অন্যায়ের কাছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কোনোদিন মাথানত করেননি। সেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন। ইচ্ছা করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই ভারতে চলে যেতে পারতেন। এমনকি একাত্তরের ২৫ মার্চের পর কলকাতা থেকে দু'জন তরুণ সাংবাদিক_ একজন যুগান্তর পত্রিকার সুরজিৎ ঘোষাল এবং অন্যজন অমৃতবাজার পত্রিকার দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় কুমিল্লায় তার বাসভবনে এসে তাকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন বলে বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার, নাট্যকার এবং লেখক শাহজাহান চৌধুরীর সাম্প্রতিক নাটক 'মুক্তিযুদ্ধ এবং একজন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত' থেকে জানা যায়, কিন্তু তিনি এই প্রস্তাবে রাজি হননি। আরও জানা যায়, তার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মনে মনে প্রতীজ্ঞা করেছিলেন যে, স্বদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। এখানে তার খাঁটি স্বদেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। তার আত্মত্যাগ এবং অবদানকে মূল্যায়নস্বরূপ কোনো বড় ও শিক্ষণীয় পদক্ষেপই আজ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারিভাবে গৃহীত হয়নি। তার বাড়ির সামনের নাতিদীর্ঘ রাস্তাটি 'শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক', ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে 'শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চত্বর' মুক্তমঞ্চ এবং সম্প্রতি কুমিল্লা স্টেডিয়ামকে 'শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম' নামে নামকরণ করার প্রয়াস তার প্রকৃত মূল্যায়ন নয়। আরও পরিতাপের বিষয়, তার বাড়িটি আজকে এমন এক কদাকার রূপ পরিগ্রহ করে আছে যা দেখলে যে কোনো রুচিসম্পন্ন সুস্থ মানুষের বিবেক বেদনার্দ্র হবে! ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই বাড়িটি এ দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
ত্রিপুরা রাজ্যের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে জন্ম (১৮৮৬) নেওয়া ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সারাজীবন কুমিল্লা শহরে কাটিয়েছেন। এই বাড়িতে তার জীবিতকালে শেরেবাংলা ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নেতা ও বিশিষ্টজনের পদধূলি পড়েছে, সেই ইতিহাসও আজ তরুণ প্রজন্মের জানা নেই। উপরন্তু বিধ্বস্ত বাড়িটির সামনে পরিচিতিমূলক একটি বিজ্ঞপ্তির বিসদৃশ ভাষা ও ভুল বানান ভাষাসৈনিক ধীরেন দত্তের ভাবমূর্তিকেই নগ্নভাবে কটাক্ষ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। অথচ সে সম্পর্কে এই শহরের মানুষ ও প্রশাসনের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই! আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের স্বার্থে সকল শঙ্কা ও সমস্যাকে মোকাবেলা করেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের একটি স্মারক মূর্তি অনতিবিলম্বে কুমিল্লা শহরে স্থাপনের জন্য দলমত নির্বিশেষে আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত। তার নামে জাতীয়ভাবে একটি পদকও সৃষ্টি করতে পারে বাংলা একাডেমী বা শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তার অশেষ অবদানের জন্যই। মাতৃভাষার মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য যার অকাতর জীবন তিলে তিলে নির্বাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারদের নির্মম অমানুষিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে। তার এই আত্মদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতিকে এগিয়ে আসতে হবে এখনই।
প্রবীর বিকাশ সরকার : জাপান প্রবাসী
লেখক ও গবেষক
তখনকার পাকিস্তান প্রতিনিধি সভার অন্যতম বাঙালি হিন্দু সদস্য আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে সাহসী আহ্বান জানিয়েছিলেন সেটা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে যুগপৎ বিস্মিত ও শঙ্কিত করে তুলেছিল। তার ভাষাতেই জানা যাক : 'তারপর মার্চ মাসে আবার বাজেট অধিবেশনের সময়ে ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু-র এক অধিবেশনে আমিই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ হইতে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে উচ্চারণ করি। কারণ, পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বাংলা ভাষাভাষীই বেশি। এই দাবিতে বিস্ময়ের সৃষ্টি হইয়াছিল। তারপর যখন আমি ঢাকায় ফিরিয়া আসি, এয়ারপোর্টে কতক লোক দেখিতে পাইলাম। আমার আশঙ্কা হইল_ আমি বুঝি গ্রেফতার হইব। নামিয়া দেখি, একদল যুবক-ছাত্র ফুলের মালা নিয়া আমাকে অভ্যর্থনা করিতে আসিয়াছে। তাহারা বলিল, আপনি আমাদের মুখ রক্ষা করিয়াছেন, বাংলা ভাষার দাবি আপনিই প্রথম উত্থাপন করিলেন' (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, পৃষ্ঠা ৯৯)। বাঙালি জাতীয়তাবাদ সত্তার উত্থান বা চেতনা সম্পর্কে পাকিস্তানিরা সজাগ হয়ে গিয়েছিল এই একটি মাত্র কারণে বললে অত্যুক্তি হবে না।
অন্যায়ের কাছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কোনোদিন মাথানত করেননি। সেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন। ইচ্ছা করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই ভারতে চলে যেতে পারতেন। এমনকি একাত্তরের ২৫ মার্চের পর কলকাতা থেকে দু'জন তরুণ সাংবাদিক_ একজন যুগান্তর পত্রিকার সুরজিৎ ঘোষাল এবং অন্যজন অমৃতবাজার পত্রিকার দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় কুমিল্লায় তার বাসভবনে এসে তাকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন বলে বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার, নাট্যকার এবং লেখক শাহজাহান চৌধুরীর সাম্প্রতিক নাটক 'মুক্তিযুদ্ধ এবং একজন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত' থেকে জানা যায়, কিন্তু তিনি এই প্রস্তাবে রাজি হননি। আরও জানা যায়, তার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মনে মনে প্রতীজ্ঞা করেছিলেন যে, স্বদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। এখানে তার খাঁটি স্বদেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। তার আত্মত্যাগ এবং অবদানকে মূল্যায়নস্বরূপ কোনো বড় ও শিক্ষণীয় পদক্ষেপই আজ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারিভাবে গৃহীত হয়নি। তার বাড়ির সামনের নাতিদীর্ঘ রাস্তাটি 'শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক', ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে 'শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চত্বর' মুক্তমঞ্চ এবং সম্প্রতি কুমিল্লা স্টেডিয়ামকে 'শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম' নামে নামকরণ করার প্রয়াস তার প্রকৃত মূল্যায়ন নয়। আরও পরিতাপের বিষয়, তার বাড়িটি আজকে এমন এক কদাকার রূপ পরিগ্রহ করে আছে যা দেখলে যে কোনো রুচিসম্পন্ন সুস্থ মানুষের বিবেক বেদনার্দ্র হবে! ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই বাড়িটি এ দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
ত্রিপুরা রাজ্যের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে জন্ম (১৮৮৬) নেওয়া ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সারাজীবন কুমিল্লা শহরে কাটিয়েছেন। এই বাড়িতে তার জীবিতকালে শেরেবাংলা ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নেতা ও বিশিষ্টজনের পদধূলি পড়েছে, সেই ইতিহাসও আজ তরুণ প্রজন্মের জানা নেই। উপরন্তু বিধ্বস্ত বাড়িটির সামনে পরিচিতিমূলক একটি বিজ্ঞপ্তির বিসদৃশ ভাষা ও ভুল বানান ভাষাসৈনিক ধীরেন দত্তের ভাবমূর্তিকেই নগ্নভাবে কটাক্ষ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। অথচ সে সম্পর্কে এই শহরের মানুষ ও প্রশাসনের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই! আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের স্বার্থে সকল শঙ্কা ও সমস্যাকে মোকাবেলা করেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের একটি স্মারক মূর্তি অনতিবিলম্বে কুমিল্লা শহরে স্থাপনের জন্য দলমত নির্বিশেষে আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত। তার নামে জাতীয়ভাবে একটি পদকও সৃষ্টি করতে পারে বাংলা একাডেমী বা শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তার অশেষ অবদানের জন্যই। মাতৃভাষার মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য যার অকাতর জীবন তিলে তিলে নির্বাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারদের নির্মম অমানুষিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে। তার এই আত্মদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতিকে এগিয়ে আসতে হবে এখনই।
প্রবীর বিকাশ সরকার : জাপান প্রবাসী
লেখক ও গবেষক
No comments