প্রেস ক্লাব এপিসোড ও আমার অভিজ্ঞতা by এলাহী নেওয়াজ খান
বিষয়টি অতো গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমার জন্য ছিল ব্যতিক্রমী। কারণ আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে কিম্বা ৩০ বছর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হিসেবে ঠিক প্রেস ক্লাবের গেটেই এরকম বিব্রতকর অবস্থায় আর কখনো পড়িনি।
সদস্য হিসেবে আমরা যারা নিয়মিত প্রেস ক্লাবে যাতায়াত করি তাদের কাছে এই ক্লাবটি নিজের বাড়ি-ঘরের মতোই আপন মনে হয়। নিজের বাড়িকে মানুষ যেমন সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে, আমাদের কাছে প্রেস ক্লাবও তাই। তবুও বাংলাদেশের সংঘাত-ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুবার প্রেস ক্লাবের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। সব সরকারর আমলেই তা ঘটেছে।
কখনো পুলিশ ঢুকেছে। কখনো পুলিশের তাড়া খাওয়া মানুষ ঢুকেছে। পুলিশ ঢুকেছে পিটাতে। তাড়া খাওয়া মানুষ ঢুকেছে নিরাপত্তা পেতে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ক্লাবের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শংকাই তৈরি হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যেদিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, সে দিন কোনো উস্কানি ছাড়াই স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশ প্রেস ক্লাবের কেন্টিনে ঢুকে সাংবাদিকদের পিটিয়েছিল। অভিযোগ ছিল যে, আন্দোলনকারী ছাত্রদের অনেকে প্রেস ক্লাবে আশ্রয় নিয়েছেন। সেদিন অনেক সিনিয়র সাংবাদিক পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন। তখন ছিল সামরিক শাসন। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক শাসনামলেও অনেকবার প্রেস ক্লাবের সামনের সংঘাতের জের প্রেস ক্লাবের ওপর এসে পড়েছে। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝে অস্থির হয়েছেন সদস্যরা বহুবার।
গত পরশু শনিবার সে রকমই একটি দিন ছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে ইসলামী দলগুলোর শত শত সদস্য ঢুকে পড়ে প্রেস ক্লাবে। ক্লাবের ক্ষুদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। পুরো ক্লাব চত্ত্বর ইসলামী নেতা-কর্মীদের দখল চলে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলে গোটা প্রেস ক্লাব। এ অবস্থায় প্রেস ক্লাবে উপস্থিত সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়েন।
আমি যখন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আসি, তখন প্রেস ক্লাবের অঙ্গন শত শত লোকে ঠাসা। পুলিশের ভয়ে তারা বের হতে পারছে না। এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি। পুলিশের মারমুখি অবস্থার কারণে উত্তেজনার মাত্রা সময়ের পরিক্রমায় বাড়তে থাকে।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনের সময়, সামনের রাস্তা ও প্রেস ক্লাব চত্ত্বর হাজার হাজার মানুষের ভারে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তখনো ক্লাব কর্তৃপক্ষের কিছুই করার ছিল না। শনিবারও তাই হয়েছিল। ক্লাবের গুটিকয়েক নিরাপত্তা কর্মী ও কর্মচারী অসহায়ের মতো ছুটাছুটি করছিল। কিন্তু প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিতরে শত শত মানুষ, বাইরে মারমুখী পুলিশ। অবরুদ্ধ প্রেস ক্লাব। সময় যত গড়াতে লাগলো উত্তেজনা তত বাড়তে থাকলো। ঠিক ১২টার দিকে অবরুদ্ধ মানুষরা বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। এক পর্যায়ে তারা দলবলসহ বের হওয়ার চেষ্টা করলে শুরু হয়ে যায় সংঘর্ষ। পুলিশ পেটাচ্ছে, গ্রেফতার করছে, নিক্ষেপ করছে টিয়ার সেল। প্রেস ক্লাবের ভিতরে অবস্থিত ইসলামী দলগুলোর কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে ঢিল ছুড়ছে ডালপালা ভাঙছে। প্রেস ক্লাবের তরুণ সদস্য হেলাল বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীরা গাছের ডাল দিয়ে তাকে কয়েকটি বাড়ি মেরে বসলো। এখানেই তারা ক্ষ্যান্ত থাকলো না, দৈনিক নয়া দিগন্তের এক তরুণ ফটোসাংবাদিক পিপলের মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দিল। এ ঘটনা অসহনীয় ছিল। ভয়ে রাজপথ ছেড়ে একটি ক্লাবের চত্ত্বরে ঢুকে এ ধরনের বীরত্ব(!) প্রদর্শন কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল, তার জবাব আন্দোলনকারীদের নেতারা দেবেন।
মুহুর্মুহু টিয়ার সেলের গ্যাসে তখন প্রেস ক্লাবের অভ্যন্তরে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সদস্যদর অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একজন তরুণ সাংবাদিক অসুস্থ হয়ে কেন্টিনের ভিতরে এসে শুয়ে পড়লেন। যুগান্তরের সিনিয়ার রিপোর্টার মান্নান শ্বাস কষ্টে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। গোটা প্রেস ক্লাবে তখন হুড়োহুড়ি অবস্থা।
বেলা ৩টার দিকে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তখন আরেক ধরনের পরিস্থিতি উদ্ভব হয়। অনেকে গ্রেফতার হলেও অধিকাংশ মানুষ বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু শত খানেক মানুষ গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ক্লাবের অভ্যন্তরে থেকে যায়। ফলে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ক্লাবের প্রধান গেটের সামনে শতাধিক পুলিশ অবশিষ্টদের গ্রেফতারের জন্য অবস্থান নিয়ে আছে। আর ভিতরে শতাধিক মানুষ নিরাপদে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। শুরু হয়ে যায় ইঁদুর বিড়াল খেলা। ইতোমধ্যে এসবি, ডিবির লোকেরা প্রেস ক্লাবের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তারা ওয়াকিটকি হাতে প্রতিটি রুমে, বারান্দায় শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর খবর দিচ্ছে গেটে অবস্থানরত পুলিশদের। গেট দিয়ে বের হলেই গ্রেফতার নির্ঘাত। অনেক রাত অবদি এ অবস্থা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ৫২ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
সন্ধ্যার একটু আগে আমি দু’বন্ধুসহ ক্লাব থেকে বের হই। খুব অবাক কাণ্ড যে আমি গেট দিয়ে বের হতেই সাদা পোশাকধারী এক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা আমার হাত ধরে ফেলে জিজ্ঞাসা করলো আপনি কি করেন। আমি বললাম- সাংবাদিক। পরক্ষণেই সে আমার আইডেন্টিকার্ড দেখতে চাইলো। আমি কিছুটা হতবিহব্বল হয়ে পড়লাম। পিছন থেকে প্রেস ক্লাবের সদস্য গোলাম আজাদের কণ্ঠ শুনলাম। তিনি বললেন- আরে ভাই কি করছেন, উনি তো আমাদের ক্লাবের সদস্য। তখন তরুণ অফিসারটি আমার হাত ছেড়ে দিল।
প্রেস ক্লাবের একজন পুরানো সদস্য হিসেবে অতীতে আর কখনো আমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। আমি শুধু তরুণ অফিসারটিকে বললাম, আপনার বয়সের চেয়ে বেশি সময় ধরে আমি প্রেস ক্লাবের সদস্য। ওই তরুণ অফিসারটির মধ্যে কোনো সৌজন্যবোধ ছিল না। একজন সিনিয়র মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়, তা তার ধারণায় ছিল না। আমার মনে হয়েছে, আমার মুখে দাঁড়ি থাকার কারণে সে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অপরাধী ধরার মতো আমার হাত ধরে ফেলে। সত্যি যদি দাঁড়ি কারণ হয়ে থাকে, তাহলে বাংলা সাহিত্যের পুরোধা পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থেকে যদি এ দেশের নাগরিক থাকেতেন, তাহলে তাকেও হয়তো এ ধরনের বিপত্তিতে পড়তে হতো।
সম্ভবত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ পুলিশে এমন অনেক তরুণ তুর্কি নিয়োগ পেয়েছে, যাদের কাছে বীরত্ব মানে মানুষ পেটানো কিম্বা হেনস্থা করা। আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে বহু সংঘাতময় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ কভার করেছি। গুলি ও টিয়ার গ্যাসের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু আগে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, পুলিশ পারতপক্ষে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চাইতো না। সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে তারা শক্তি প্রয়োগ করতো। তারা যেকোনো বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রশিক্ষত ছিল। কিন্তু এখন পুলিশ ছোটখাট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেও শক্তি পয়োগ করে।
শনিবারের প্রেস ক্লাবের ঘটনা দেখে মনে হয়েছে, পুলিশের তরুণ তুর্কিদের অতি উৎসাহের কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং একটি অনাহুত হরতাল আহ্বানের অজুহাত তৈরি হয়। গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, যে লোকগুলো ক্লাবের ভিতরে আটকা পড়ে গিয়েছিল, তারা নিরাপদে অতি দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব ছিল। পুলিশ কর্মকর্তারা যদি এ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সক্ষম হতেন, তাহলে তাদের পক্ষে উচিত ছিল শান্তিপূর্ণভাবে লোকগুলোকে চলে যাওয়ার পথ করে দেয়া।
আর পুলিশের প্রাথমিক কাজ সেটাই। আর শেষ পর্যন্ত তা যদি সম্ভব না হতো, তাহলেই কেবলমাত্র শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়া যৌক্তিক ছিল। কিন্তু তা হয়নি। পুলিশ আগাগোড়া মারমুখি ছিল। আর পুলিশ সেটা দেখিয়েছেও।
আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে যে, পুলিশ যদি ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতো তাহলে সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হতো এবং আরেকটি হরতাল ডাকার সুযোগ সংগঠকরা পেত না। তাই এ ক্ষেত্রে হরতাল ডাকার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব পুলিশ বাহিনীর।
এলাহী নেওয়াজ খান: বিশিষ্ট সাংবাদিক
কখনো পুলিশ ঢুকেছে। কখনো পুলিশের তাড়া খাওয়া মানুষ ঢুকেছে। পুলিশ ঢুকেছে পিটাতে। তাড়া খাওয়া মানুষ ঢুকেছে নিরাপত্তা পেতে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ক্লাবের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শংকাই তৈরি হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যেদিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, সে দিন কোনো উস্কানি ছাড়াই স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশ প্রেস ক্লাবের কেন্টিনে ঢুকে সাংবাদিকদের পিটিয়েছিল। অভিযোগ ছিল যে, আন্দোলনকারী ছাত্রদের অনেকে প্রেস ক্লাবে আশ্রয় নিয়েছেন। সেদিন অনেক সিনিয়র সাংবাদিক পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন। তখন ছিল সামরিক শাসন। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক শাসনামলেও অনেকবার প্রেস ক্লাবের সামনের সংঘাতের জের প্রেস ক্লাবের ওপর এসে পড়েছে। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝে অস্থির হয়েছেন সদস্যরা বহুবার।
গত পরশু শনিবার সে রকমই একটি দিন ছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে ইসলামী দলগুলোর শত শত সদস্য ঢুকে পড়ে প্রেস ক্লাবে। ক্লাবের ক্ষুদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। পুরো ক্লাব চত্ত্বর ইসলামী নেতা-কর্মীদের দখল চলে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলে গোটা প্রেস ক্লাব। এ অবস্থায় প্রেস ক্লাবে উপস্থিত সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়েন।
আমি যখন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আসি, তখন প্রেস ক্লাবের অঙ্গন শত শত লোকে ঠাসা। পুলিশের ভয়ে তারা বের হতে পারছে না। এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি। পুলিশের মারমুখি অবস্থার কারণে উত্তেজনার মাত্রা সময়ের পরিক্রমায় বাড়তে থাকে।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনের সময়, সামনের রাস্তা ও প্রেস ক্লাব চত্ত্বর হাজার হাজার মানুষের ভারে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তখনো ক্লাব কর্তৃপক্ষের কিছুই করার ছিল না। শনিবারও তাই হয়েছিল। ক্লাবের গুটিকয়েক নিরাপত্তা কর্মী ও কর্মচারী অসহায়ের মতো ছুটাছুটি করছিল। কিন্তু প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিতরে শত শত মানুষ, বাইরে মারমুখী পুলিশ। অবরুদ্ধ প্রেস ক্লাব। সময় যত গড়াতে লাগলো উত্তেজনা তত বাড়তে থাকলো। ঠিক ১২টার দিকে অবরুদ্ধ মানুষরা বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। এক পর্যায়ে তারা দলবলসহ বের হওয়ার চেষ্টা করলে শুরু হয়ে যায় সংঘর্ষ। পুলিশ পেটাচ্ছে, গ্রেফতার করছে, নিক্ষেপ করছে টিয়ার সেল। প্রেস ক্লাবের ভিতরে অবস্থিত ইসলামী দলগুলোর কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে ঢিল ছুড়ছে ডালপালা ভাঙছে। প্রেস ক্লাবের তরুণ সদস্য হেলাল বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীরা গাছের ডাল দিয়ে তাকে কয়েকটি বাড়ি মেরে বসলো। এখানেই তারা ক্ষ্যান্ত থাকলো না, দৈনিক নয়া দিগন্তের এক তরুণ ফটোসাংবাদিক পিপলের মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দিল। এ ঘটনা অসহনীয় ছিল। ভয়ে রাজপথ ছেড়ে একটি ক্লাবের চত্ত্বরে ঢুকে এ ধরনের বীরত্ব(!) প্রদর্শন কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল, তার জবাব আন্দোলনকারীদের নেতারা দেবেন।
মুহুর্মুহু টিয়ার সেলের গ্যাসে তখন প্রেস ক্লাবের অভ্যন্তরে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সদস্যদর অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একজন তরুণ সাংবাদিক অসুস্থ হয়ে কেন্টিনের ভিতরে এসে শুয়ে পড়লেন। যুগান্তরের সিনিয়ার রিপোর্টার মান্নান শ্বাস কষ্টে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। গোটা প্রেস ক্লাবে তখন হুড়োহুড়ি অবস্থা।
বেলা ৩টার দিকে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তখন আরেক ধরনের পরিস্থিতি উদ্ভব হয়। অনেকে গ্রেফতার হলেও অধিকাংশ মানুষ বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু শত খানেক মানুষ গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ক্লাবের অভ্যন্তরে থেকে যায়। ফলে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ক্লাবের প্রধান গেটের সামনে শতাধিক পুলিশ অবশিষ্টদের গ্রেফতারের জন্য অবস্থান নিয়ে আছে। আর ভিতরে শতাধিক মানুষ নিরাপদে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। শুরু হয়ে যায় ইঁদুর বিড়াল খেলা। ইতোমধ্যে এসবি, ডিবির লোকেরা প্রেস ক্লাবের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তারা ওয়াকিটকি হাতে প্রতিটি রুমে, বারান্দায় শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর খবর দিচ্ছে গেটে অবস্থানরত পুলিশদের। গেট দিয়ে বের হলেই গ্রেফতার নির্ঘাত। অনেক রাত অবদি এ অবস্থা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ৫২ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
সন্ধ্যার একটু আগে আমি দু’বন্ধুসহ ক্লাব থেকে বের হই। খুব অবাক কাণ্ড যে আমি গেট দিয়ে বের হতেই সাদা পোশাকধারী এক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা আমার হাত ধরে ফেলে জিজ্ঞাসা করলো আপনি কি করেন। আমি বললাম- সাংবাদিক। পরক্ষণেই সে আমার আইডেন্টিকার্ড দেখতে চাইলো। আমি কিছুটা হতবিহব্বল হয়ে পড়লাম। পিছন থেকে প্রেস ক্লাবের সদস্য গোলাম আজাদের কণ্ঠ শুনলাম। তিনি বললেন- আরে ভাই কি করছেন, উনি তো আমাদের ক্লাবের সদস্য। তখন তরুণ অফিসারটি আমার হাত ছেড়ে দিল।
প্রেস ক্লাবের একজন পুরানো সদস্য হিসেবে অতীতে আর কখনো আমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। আমি শুধু তরুণ অফিসারটিকে বললাম, আপনার বয়সের চেয়ে বেশি সময় ধরে আমি প্রেস ক্লাবের সদস্য। ওই তরুণ অফিসারটির মধ্যে কোনো সৌজন্যবোধ ছিল না। একজন সিনিয়র মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়, তা তার ধারণায় ছিল না। আমার মনে হয়েছে, আমার মুখে দাঁড়ি থাকার কারণে সে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অপরাধী ধরার মতো আমার হাত ধরে ফেলে। সত্যি যদি দাঁড়ি কারণ হয়ে থাকে, তাহলে বাংলা সাহিত্যের পুরোধা পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থেকে যদি এ দেশের নাগরিক থাকেতেন, তাহলে তাকেও হয়তো এ ধরনের বিপত্তিতে পড়তে হতো।
সম্ভবত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ পুলিশে এমন অনেক তরুণ তুর্কি নিয়োগ পেয়েছে, যাদের কাছে বীরত্ব মানে মানুষ পেটানো কিম্বা হেনস্থা করা। আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে বহু সংঘাতময় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ কভার করেছি। গুলি ও টিয়ার গ্যাসের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু আগে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, পুলিশ পারতপক্ষে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চাইতো না। সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে তারা শক্তি প্রয়োগ করতো। তারা যেকোনো বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রশিক্ষত ছিল। কিন্তু এখন পুলিশ ছোটখাট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেও শক্তি পয়োগ করে।
শনিবারের প্রেস ক্লাবের ঘটনা দেখে মনে হয়েছে, পুলিশের তরুণ তুর্কিদের অতি উৎসাহের কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং একটি অনাহুত হরতাল আহ্বানের অজুহাত তৈরি হয়। গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, যে লোকগুলো ক্লাবের ভিতরে আটকা পড়ে গিয়েছিল, তারা নিরাপদে অতি দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব ছিল। পুলিশ কর্মকর্তারা যদি এ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সক্ষম হতেন, তাহলে তাদের পক্ষে উচিত ছিল শান্তিপূর্ণভাবে লোকগুলোকে চলে যাওয়ার পথ করে দেয়া।
আর পুলিশের প্রাথমিক কাজ সেটাই। আর শেষ পর্যন্ত তা যদি সম্ভব না হতো, তাহলেই কেবলমাত্র শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়া যৌক্তিক ছিল। কিন্তু তা হয়নি। পুলিশ আগাগোড়া মারমুখি ছিল। আর পুলিশ সেটা দেখিয়েছেও।
আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে যে, পুলিশ যদি ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতো তাহলে সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হতো এবং আরেকটি হরতাল ডাকার সুযোগ সংগঠকরা পেত না। তাই এ ক্ষেত্রে হরতাল ডাকার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব পুলিশ বাহিনীর।
এলাহী নেওয়াজ খান: বিশিষ্ট সাংবাদিক
No comments