আতাউস সামাদঃ গণতন্ত্রে নিষ্ঠাবান এক সৎ ও পরিশ্রমী সাংবাদিক by শফিক রেহমান
সাংবাদিকতায় আতাউস সামাদের গভীর কর্মনিষ্ঠা, প্রচণ্ড পরিশ্রম ও রাজনৈতিক সততার সঙ্গে আমি পরিচিত হই আগস্ট ১৯৮৬-র পরে। সেই সময়ে জেনারেল এরশাদ সরকার কর্তৃক সাপ্তাহিক যায়যায়দিন দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হবার পরে আমাকে লন্ডনে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়।
লন্ডনে আমি স্পেকট্রাম রেডিও নামে একটি প্রাইভেট রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠার কাজে, লন্ডনের বিভিন্ন বাংলা সাপ্তাহিকে লেখালেখিতে এবং বিবিসি বাংলা বিভাগের বিভিন্ন ব্রডকাস্টিংয়ে জড়িয়ে পড়ি।
এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে ঢাকা থেকে আতাউস সামাদের রিপোর্টিয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। সেই সময়ে আতাউস সামাদ বাংলাদেশে জনপ্রিয় হলেও, লন্ডনে তিনি ছিলেন, বিবিসি বাংলা বিভাগের সব সংবাদপাঠকের কাছে এক অদৃশ্য আতংকস্বরূপ।
বাংলাদেশে বিবিসি-র নিয়মিত শ্রোতারা তখন প্রতি সন্ধ্যায় উন্মুখভাবে অপেক্ষা করতেন সাড়ে সাতটার সংবাদের জন্য।
ঢাকা তথা বাংলাদেশে যখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা তখন লন্ডনে দুপুর দেড়টা। বুশ হাউসে এই সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও অনুবাদের কাজ শুরু হয়ে যেত বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে। সংবাদপাঠকরা চেষ্টা করতেন বেলা সোয়া একটার মধ্যে সব লেখালেখি শেষ করে অন্তত একবার চোখ বুলিয়ে দেড়টা বাজার আগেই স্টুডিওতে ঢুকে মাইক্রোফোনের সামনে বসতেন।
বলা যায়, বেলা সোয়া একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত, এই শেষ পনের মিনিট ছিল সংবাদপাঠকের জন্য খুব ক্রুশিয়াল টাইম বা প্রস্ত্ততির ফাইনাল সময়। কোনো সংবাদপাঠকই চাইতেন না এই শেষ মুহূর্তে ডিস্টার্বড হতে। তারা তখন গভীরভাবে ব্যস্ত থাকতেন, অনুবাদ, নাম উচ্চারণ, তারিখ ও স্ট্যাটিসটিকস যেন নির্ভুল হয় সেসব নিশ্চিত করতে। বেলা একটা পচিশের মধ্যে সংবাদপাঠকদের অবশ্যই স্টুডিওতে ঢুকতে হতো।
নিষ্ঠাবান সাংবাদিক
কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে প্রায়ই আতাউস সামাদের ঢাকা থেকে টেলিফোন কল আসতো। তিনি নিশ্চিত করতে চাইতেন ঢাকা থেকে তার পাঠানো রিপোর্টের বিভিন্ন অংশ। তখন সংবাদপাঠক একটা সংকটে পড়ে যেতেন। তিনি স্টুডিওতে চলে যাবেন? নাকি আতাউস সামাদের ফোনকল ধরবেন? সংবাদপাঠককে ভাবতে হতো আতাউস সামাদ কি ঢাকা থেকে কোনো সংশোধনী দিতে চান? অথবা কোনো ব্রেকিং নিউজ দিতে চান? এই গভীর দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে সংবাদপাঠক তার হাতে নিউজ শিটগুলো নিয়ে স্টুডিওতে ঢুকে যেতেন। আর নিউজরুমে বেজে চলতো, টেলিফোন, ক্রিং, ক্রিং.. ক্রিং...।
কিছুটা অস্বস্তির সঙ্গেই সংবাদ পাঠ হলে সংবাদপাঠক নিউজরুমে ফিরে গিয়ে আতাউস সামাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতেন। বিবিসির সবাই বুঝতেন আতাউস সামাদ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সচেষ্ট থাকতেন সংবাদকে আপডেট ও নির্ভুল রাখতে। এমন নিষ্ঠা খুব কম সাংবাদিকের মধ্যে দেখা যায়।
পরিশ্রমী সাংবাদিক
বিবিসি বাংলা বিভাগের সঙ্গে আতাউস সামাদ জড়িত ছিলেন ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত, প্রায় ১২ বছর জুড়ে। প্রথমে তিনি স্টৃংগার, অর্থাৎ, বিবিসির চাহিদা মোতাবেক সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজে। পরে বিবিসির করেসপন্ডেন্ট আতিকুল আলম বিবিসি ছেড়ে রয়টার্সে যোগ দিলে আতাউস সামাদ হন করেসপন্ডেন্ট বা স্থায়ী সংবাদদাতা।
এই দায়িত্বে থাকার সময়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য তিনি গড়ে তোলেন তরুণ রিপোর্টারদের একটি ছোট কিন্তু দক্ষ টিম। এই রিপোর্টাররা আতাউস সামাদের নেতৃত্বের ওপর আস্থাশীল ছিলেন। আতাউস সামাদ যেমন এক দিকে লন্ডনে ঘন ঘন ফোন করতেন তার পাঠানো রিপোর্টের গুণগত মান নিশ্চিত করতে ঠিক তেমনি অন্য দিকে ঘন ঘন ফোন করতেন দেশজুড়ে তার বিভিন্ন রিপোর্টার ও সোর্সকে। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। বার বার ডায়াল করে রিপোর্টার ও সোর্সদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ছিল কষ্টসাধ্য।
আতাউস সামাদ তখন থাকতেন নয়া পল্টনে। রিকশা, স্কুটার অথবা গাড়িতে তিনি দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত থাকতেন চলমান। ছোটাছুটি করতেন সচিবালয় থেকে বিভিন্ন বাণিজ্য আলয়ে, মন্ত্রী ভবন থেকে বিভিন্ন নেতাভবনে, ঢাকা ক্লাব থেকে প্রেস ক্লাবে। তারপর বাড়িতে ফিরে এসে টাইপিং, ফ্যাক্স ও ফোন চলতে থাকতো।
বলা বাহুল্য এই পরিশ্রম করতে গিয়ে তার খাবার ও বিশ্রাম নেয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল অনিয়মিত। ফলে মাঝে মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কথা প্রসঙ্গে তার শারীরিক অসুস্থতার কথা বলতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন খবর সংগ্রহ ও পরিবেশনে অদম্য ও উৎসাহী।
সৎ সাংবাদিক
আতাউস সামাদ সবচেয়ে বেশি অসাধারণ ছিলেন তার সততায়। পেশাদার সাংবাদিক হলেও কখনোই তিনি পেশাদারিত্বের অজুহাতে নিজের আদর্শ ও নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হননি।
বাংলাদেশের কিছু সম্পাদক-সাংবাদিক নিজেদের আদর্শিক অসততা স্খালনের জন্য বলেন, পেশাদারিত্বের কারণে তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন না, সেটা লিখতে বা বলতে বাধ্য হয়েছেন। আতাউস সামাদ এই আচরণের বিরোধী ছিলেন। তিনি নিজে যা বিশ্বাস করতেন সেটা তিনি গোপন করতেন না।
আতাউস সামাদ গণতন্ত্রে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদের শাসন আমলে তিনি খুব ঝুকি নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পূর্ণ ও সঠিক রিপোর্টিং করেছিলেন বিবিসিতে। এর ফলে তাকে কিছু কালের জন্য জেলে বন্দি থাকতে হয়।
জেনারেল এরশাদের প্রায় নয় বছর সামরিক শাসন আমলে আতাউস সামাদের ভূমিকা ছিল অতি অসাধারণ। ওই সময়ে ইত্তেফাক-এর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হলিডে-র এনায়েতউল্লাহ খানসহ অন্ততপক্ষে বারোজন সম্পাদক-সাংবাদিক জেনারেল এরশাদের টোপ গিলেছিলেন এবং তার মন্ত্রী, উপদেষ্টা অথবা রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। অনেকে তথাকথিত নিরপেক্ষ ভূমিকায় থেকে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে যে গুটিকয়েক সাংবাদিক সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ বা ওয়ান-ইলেভেনের পর আবারো আতাউস সামাদ জেনারেল মইন সমর্থিত আধা-সেনা সরকারের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা নিয়ে দৈনিক আমার দেশ এবং এনটিভিকে রক্ষা করেন। আতাউস সামাদ মনেপ্রাণে সামরিক শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সামরিক শাসকদের সহযোগিতাকারী তথাকথিত মাইনাস টু ফর্মুলার উদগাতা ও সমর্থক সম্পাদক-সাংবাদিকদের সঙ্গে আতাউস সামাদের বড় পার্থক্যটা ছিল এখানেই।
বাংলাদেশে এখন দুর্বল হলেও যেটুকু গণতন্ত্র চলছে তার পেছনে আতাউস সামাদের ওই সব সময়ের রিপোর্টিং ও কর্মতৎপরতার সাহসী অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জনপ্রিয় কলাম লেখক
জেনারেল এরশাদের পতনের পর আমি নির্বাসন থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসে ১৯৯২-এ সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পুনঃপ্রকাশ করি। ১৯৯৪-এ আতাউস সামাদ বিবিসি থেকে অবসর নিলে আমি তাকে অনুরোধ করি নিয়মিত কলাম লিখতে। অতি বিনয়ী আতাউস সামাদ প্রথমটায় রাজি হননি। তিনি আমাকে বোঝাতে চান, ইংরেজিতে রিপোর্টিংয়ের তুলনায় বাংলায় কলাম লেখা দুঃসাধ্য হতে পারে।
আতাউস সামাদ ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, ইংরেজি পত্রিকা অবজারভারের সাংবাদিক এবং বিবিসিতে তিনি তার রিপোর্ট ইংরেজিতে ফাইল করতেন। আমি তাকে বোঝাতে পারি যে, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও কলাম লেখা একই সুতায় গাথা মালা হতে পারে। ভাষা কোনো প্রতিবন্ধকতা হবে না। আতাউস সামাদ জড়তা কাটিয়ে উঠে যায়যায়দিনে ‘‘একালের বয়ান’’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করেন। কলামটি খুবই জনপ্রিয় হয়।
এক সময়ে তিনি সপরিবারে আমেরিকায় বেড়াতে যান। তখন ‘‘একালের বয়ান’’ কলামটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ফিরে আসার পর আমি অনুরোধ করি তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে কলাম লিখতে। পরিণতিতে তিনি লেখেন ‘‘আটলান্টিকের দুই তীরে’’ কলামটি এবং এটিও জনপ্রিয় হয়।
গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ভদ্রলোক
১৯৯৫-এ আতাউস সামাদের সফরসঙ্গী হবার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। সেই বছরে বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আমরা দুজন সরকারি সফরদলে ছিলাম।
বেইজিংয়ে গিয়েও খবর সংগ্রহে আতাউস সামাদ ব্যস্ত ছিলেন। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে চায়নার কিছু দর্শনীয় স্থানে তিনি যাননি। কিন্তু এজন্য তার কোনো খেদ ছিল না। তিনি খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন। বেইজিং সফরকালে তাকে দেখেছি নামাজ পড়তে এবং ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ খাবার ও পানীয় পরিহার করে চলতে।
আতাউস সামাদের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় এপৃল ২০১২-র প্রথম সপ্তাহে। সেই সময়ে আমার প্রকাশিতব্য ‘‘চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড লুণ্ঠন’’ নামে বইটি তাকে উৎসর্গ করার জন্য তার সদয় অনুমতি চাই। তিনি সেটা দেন এবং তার স্বভাবসুলভ ভাষায় কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রকাশ করেন। সার্বিকভাবে তিনি ছিলেন একজন ভদ্রলোক।
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র যুদ্ধে গভীরভাবে বিশ্বাসী আতাউস সামাদ ছিলেন, একজন নির্লোভ ও সৎ সাংবাদিক এবং তারই শেষ উক্তি অনুযায়ী পরিবারমুখী একজন সুখী মানুষ।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২
শফিক রেহমান: প্রখ্যাত সাংবাদিক ও টিভি অ্যাংকর।
এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে ঢাকা থেকে আতাউস সামাদের রিপোর্টিয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। সেই সময়ে আতাউস সামাদ বাংলাদেশে জনপ্রিয় হলেও, লন্ডনে তিনি ছিলেন, বিবিসি বাংলা বিভাগের সব সংবাদপাঠকের কাছে এক অদৃশ্য আতংকস্বরূপ।
বাংলাদেশে বিবিসি-র নিয়মিত শ্রোতারা তখন প্রতি সন্ধ্যায় উন্মুখভাবে অপেক্ষা করতেন সাড়ে সাতটার সংবাদের জন্য।
ঢাকা তথা বাংলাদেশে যখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা তখন লন্ডনে দুপুর দেড়টা। বুশ হাউসে এই সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও অনুবাদের কাজ শুরু হয়ে যেত বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে। সংবাদপাঠকরা চেষ্টা করতেন বেলা সোয়া একটার মধ্যে সব লেখালেখি শেষ করে অন্তত একবার চোখ বুলিয়ে দেড়টা বাজার আগেই স্টুডিওতে ঢুকে মাইক্রোফোনের সামনে বসতেন।
বলা যায়, বেলা সোয়া একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত, এই শেষ পনের মিনিট ছিল সংবাদপাঠকের জন্য খুব ক্রুশিয়াল টাইম বা প্রস্ত্ততির ফাইনাল সময়। কোনো সংবাদপাঠকই চাইতেন না এই শেষ মুহূর্তে ডিস্টার্বড হতে। তারা তখন গভীরভাবে ব্যস্ত থাকতেন, অনুবাদ, নাম উচ্চারণ, তারিখ ও স্ট্যাটিসটিকস যেন নির্ভুল হয় সেসব নিশ্চিত করতে। বেলা একটা পচিশের মধ্যে সংবাদপাঠকদের অবশ্যই স্টুডিওতে ঢুকতে হতো।
নিষ্ঠাবান সাংবাদিক
কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে প্রায়ই আতাউস সামাদের ঢাকা থেকে টেলিফোন কল আসতো। তিনি নিশ্চিত করতে চাইতেন ঢাকা থেকে তার পাঠানো রিপোর্টের বিভিন্ন অংশ। তখন সংবাদপাঠক একটা সংকটে পড়ে যেতেন। তিনি স্টুডিওতে চলে যাবেন? নাকি আতাউস সামাদের ফোনকল ধরবেন? সংবাদপাঠককে ভাবতে হতো আতাউস সামাদ কি ঢাকা থেকে কোনো সংশোধনী দিতে চান? অথবা কোনো ব্রেকিং নিউজ দিতে চান? এই গভীর দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে সংবাদপাঠক তার হাতে নিউজ শিটগুলো নিয়ে স্টুডিওতে ঢুকে যেতেন। আর নিউজরুমে বেজে চলতো, টেলিফোন, ক্রিং, ক্রিং.. ক্রিং...।
কিছুটা অস্বস্তির সঙ্গেই সংবাদ পাঠ হলে সংবাদপাঠক নিউজরুমে ফিরে গিয়ে আতাউস সামাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতেন। বিবিসির সবাই বুঝতেন আতাউস সামাদ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সচেষ্ট থাকতেন সংবাদকে আপডেট ও নির্ভুল রাখতে। এমন নিষ্ঠা খুব কম সাংবাদিকের মধ্যে দেখা যায়।
পরিশ্রমী সাংবাদিক
বিবিসি বাংলা বিভাগের সঙ্গে আতাউস সামাদ জড়িত ছিলেন ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত, প্রায় ১২ বছর জুড়ে। প্রথমে তিনি স্টৃংগার, অর্থাৎ, বিবিসির চাহিদা মোতাবেক সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজে। পরে বিবিসির করেসপন্ডেন্ট আতিকুল আলম বিবিসি ছেড়ে রয়টার্সে যোগ দিলে আতাউস সামাদ হন করেসপন্ডেন্ট বা স্থায়ী সংবাদদাতা।
এই দায়িত্বে থাকার সময়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য তিনি গড়ে তোলেন তরুণ রিপোর্টারদের একটি ছোট কিন্তু দক্ষ টিম। এই রিপোর্টাররা আতাউস সামাদের নেতৃত্বের ওপর আস্থাশীল ছিলেন। আতাউস সামাদ যেমন এক দিকে লন্ডনে ঘন ঘন ফোন করতেন তার পাঠানো রিপোর্টের গুণগত মান নিশ্চিত করতে ঠিক তেমনি অন্য দিকে ঘন ঘন ফোন করতেন দেশজুড়ে তার বিভিন্ন রিপোর্টার ও সোর্সকে। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। বার বার ডায়াল করে রিপোর্টার ও সোর্সদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ছিল কষ্টসাধ্য।
আতাউস সামাদ তখন থাকতেন নয়া পল্টনে। রিকশা, স্কুটার অথবা গাড়িতে তিনি দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত থাকতেন চলমান। ছোটাছুটি করতেন সচিবালয় থেকে বিভিন্ন বাণিজ্য আলয়ে, মন্ত্রী ভবন থেকে বিভিন্ন নেতাভবনে, ঢাকা ক্লাব থেকে প্রেস ক্লাবে। তারপর বাড়িতে ফিরে এসে টাইপিং, ফ্যাক্স ও ফোন চলতে থাকতো।
বলা বাহুল্য এই পরিশ্রম করতে গিয়ে তার খাবার ও বিশ্রাম নেয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল অনিয়মিত। ফলে মাঝে মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কথা প্রসঙ্গে তার শারীরিক অসুস্থতার কথা বলতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন খবর সংগ্রহ ও পরিবেশনে অদম্য ও উৎসাহী।
সৎ সাংবাদিক
আতাউস সামাদ সবচেয়ে বেশি অসাধারণ ছিলেন তার সততায়। পেশাদার সাংবাদিক হলেও কখনোই তিনি পেশাদারিত্বের অজুহাতে নিজের আদর্শ ও নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হননি।
বাংলাদেশের কিছু সম্পাদক-সাংবাদিক নিজেদের আদর্শিক অসততা স্খালনের জন্য বলেন, পেশাদারিত্বের কারণে তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন না, সেটা লিখতে বা বলতে বাধ্য হয়েছেন। আতাউস সামাদ এই আচরণের বিরোধী ছিলেন। তিনি নিজে যা বিশ্বাস করতেন সেটা তিনি গোপন করতেন না।
আতাউস সামাদ গণতন্ত্রে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদের শাসন আমলে তিনি খুব ঝুকি নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পূর্ণ ও সঠিক রিপোর্টিং করেছিলেন বিবিসিতে। এর ফলে তাকে কিছু কালের জন্য জেলে বন্দি থাকতে হয়।
জেনারেল এরশাদের প্রায় নয় বছর সামরিক শাসন আমলে আতাউস সামাদের ভূমিকা ছিল অতি অসাধারণ। ওই সময়ে ইত্তেফাক-এর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হলিডে-র এনায়েতউল্লাহ খানসহ অন্ততপক্ষে বারোজন সম্পাদক-সাংবাদিক জেনারেল এরশাদের টোপ গিলেছিলেন এবং তার মন্ত্রী, উপদেষ্টা অথবা রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। অনেকে তথাকথিত নিরপেক্ষ ভূমিকায় থেকে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে যে গুটিকয়েক সাংবাদিক সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ বা ওয়ান-ইলেভেনের পর আবারো আতাউস সামাদ জেনারেল মইন সমর্থিত আধা-সেনা সরকারের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা নিয়ে দৈনিক আমার দেশ এবং এনটিভিকে রক্ষা করেন। আতাউস সামাদ মনেপ্রাণে সামরিক শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সামরিক শাসকদের সহযোগিতাকারী তথাকথিত মাইনাস টু ফর্মুলার উদগাতা ও সমর্থক সম্পাদক-সাংবাদিকদের সঙ্গে আতাউস সামাদের বড় পার্থক্যটা ছিল এখানেই।
বাংলাদেশে এখন দুর্বল হলেও যেটুকু গণতন্ত্র চলছে তার পেছনে আতাউস সামাদের ওই সব সময়ের রিপোর্টিং ও কর্মতৎপরতার সাহসী অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জনপ্রিয় কলাম লেখক
জেনারেল এরশাদের পতনের পর আমি নির্বাসন থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসে ১৯৯২-এ সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পুনঃপ্রকাশ করি। ১৯৯৪-এ আতাউস সামাদ বিবিসি থেকে অবসর নিলে আমি তাকে অনুরোধ করি নিয়মিত কলাম লিখতে। অতি বিনয়ী আতাউস সামাদ প্রথমটায় রাজি হননি। তিনি আমাকে বোঝাতে চান, ইংরেজিতে রিপোর্টিংয়ের তুলনায় বাংলায় কলাম লেখা দুঃসাধ্য হতে পারে।
আতাউস সামাদ ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, ইংরেজি পত্রিকা অবজারভারের সাংবাদিক এবং বিবিসিতে তিনি তার রিপোর্ট ইংরেজিতে ফাইল করতেন। আমি তাকে বোঝাতে পারি যে, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও কলাম লেখা একই সুতায় গাথা মালা হতে পারে। ভাষা কোনো প্রতিবন্ধকতা হবে না। আতাউস সামাদ জড়তা কাটিয়ে উঠে যায়যায়দিনে ‘‘একালের বয়ান’’ শিরোনামে নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করেন। কলামটি খুবই জনপ্রিয় হয়।
এক সময়ে তিনি সপরিবারে আমেরিকায় বেড়াতে যান। তখন ‘‘একালের বয়ান’’ কলামটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ফিরে আসার পর আমি অনুরোধ করি তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে কলাম লিখতে। পরিণতিতে তিনি লেখেন ‘‘আটলান্টিকের দুই তীরে’’ কলামটি এবং এটিও জনপ্রিয় হয়।
গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ভদ্রলোক
১৯৯৫-এ আতাউস সামাদের সফরসঙ্গী হবার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। সেই বছরে বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আমরা দুজন সরকারি সফরদলে ছিলাম।
বেইজিংয়ে গিয়েও খবর সংগ্রহে আতাউস সামাদ ব্যস্ত ছিলেন। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে চায়নার কিছু দর্শনীয় স্থানে তিনি যাননি। কিন্তু এজন্য তার কোনো খেদ ছিল না। তিনি খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন। বেইজিং সফরকালে তাকে দেখেছি নামাজ পড়তে এবং ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ খাবার ও পানীয় পরিহার করে চলতে।
আতাউস সামাদের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় এপৃল ২০১২-র প্রথম সপ্তাহে। সেই সময়ে আমার প্রকাশিতব্য ‘‘চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড লুণ্ঠন’’ নামে বইটি তাকে উৎসর্গ করার জন্য তার সদয় অনুমতি চাই। তিনি সেটা দেন এবং তার স্বভাবসুলভ ভাষায় কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রকাশ করেন। সার্বিকভাবে তিনি ছিলেন একজন ভদ্রলোক।
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র যুদ্ধে গভীরভাবে বিশ্বাসী আতাউস সামাদ ছিলেন, একজন নির্লোভ ও সৎ সাংবাদিক এবং তারই শেষ উক্তি অনুযায়ী পরিবারমুখী একজন সুখী মানুষ।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২
শফিক রেহমান: প্রখ্যাত সাংবাদিক ও টিভি অ্যাংকর।
No comments