নাইকো কেলেঙ্কারির হোতা তৌফিক-ই-ইলাহী
কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা ছাড়াই বারবাডোসে নিবন্ধিত অখ্যাত ও অনভিজ্ঞ ক্ষুদ্র কানাডীয় কম্পানি নাইকো রিসোর্সেসের সঙ্গে পেট্রোবাংলা বা বাপেক্সের তথাকথিত জয়েন্ট ভেঞ্চার দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পরিত্যক্ত ও প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের নামে দেশবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে এ দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের ১ দশমিক শূন্য ১৯ ট্রিলিয়ন গ্যাসের নিশ্চিত মজুদের মালিক বনে যায় নাইকো। এতে বাংলাদেশকে এখন নিজস্ব গ্যাসসম্পদ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় কিনতে হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশবিরোধী এই নাইকো চুক্তির 'মূল নায়ক' বা 'হোতা' হলেন সাবেক জ্বালানিসচিব এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। সে সময় তিনি নাইকোর পক্ষে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনের জন্য কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নানা জালজালিয়াতিরও আশ্রয় নেওয়া হয়। তবে বিএনপি সরকারের সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বেলায়ও দায়িত্বে না থাকলেও এই তৌফিক-ই-ইলাহীর ছক অনুযায়ীই সব কিছু হয়। জানা গেছে, শুরু থেকেই নাইকোর পক্ষে কাজ করেন তাঁর ভাগ্নে নাইকোর ভাইস প্রেসিডেন্ট (দক্ষিণ এশিয়া) কাশেম শরীফ।
তৌফিক-ই-ইলাহীর জাতীয় স্বার্থবিরোধী ভূমিকার কারণে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তারও দেখানো হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দাবি করে এ সম্পর্কিত কমিটি তা প্রত্যাহারের সুপারিশ করলেও দুদক প্রত্যাহার করেনি। খালেদা জিয়া ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। তবে দুটি মামলার কার্যক্রমই বর্তমানে স্থগিত আছে।
শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী সরকারের সময় নাইকো রিসোর্সেস তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের সেকেন্ড রাউন্ড বিডিংয়ে অংশ নিলেও ৯ ও ১০ নম্বর ব্লকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া তাল্লো ও শেল/কেয়ার্নের চেয়ে যথাক্রমে ৪২.৯ ও ৫০.৮ নম্বর কম পায়। তাই কোনো ব্লকই বরাদ্দ না পেয়ে নাইকো ভারতে পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে পূর্ব-অভিজ্ঞতার দাবি করে প্রান্তিক ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন ও উৎপাদনের একটি প্রস্তাব ১৯৯৯ সালের ২১ জুন তদানীন্তন জ্বালানিসচিব ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কাছে পেশ করে। পরে ২৮ জুন নাইকো ছাতক, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত ও প্রান্তিক চিহ্নিত করে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার আগ্রহ দেখায়। ১৯৯৯ সালের ১ জুলাই তৌফিক-ই-ইলাহীর সভাপতিত্বে এক সভায় নাইকোর প্রস্তাব গ্রহণ এবং ছাতক, কামতা ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক হিসেবে উন্নয়ন ও উৎপাদন এবং এ জন্য বাপেক্স ও নাইকোর মধ্যে যৌথ অংশীদারি চুক্তির (জেভিএ) সিদ্ধান্ত হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ নাইকোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে ১৯৯৯ সালের ২০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠায়। এতে নাইকোর অযাচিত প্রস্তাব গ্রহণ করে 'সুইস চ্যালেঞ্জ' নামের অননুমোদিত নতুন এক পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়, যাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব পাওয়ার ব্যাপারে দরপত্র আহ্বান এবং প্রাপ্ত প্রস্তাব গ্রহণে নাইকোর অগ্রাধিকার থেকে যায়।
১৯৯১ সালের ২৩ আগস্ট বাপেক্স এবং নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেডের যৌথ সহযোগিতায় ছাতক, ফেনী ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রের মূল্যায়নের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এফওইউ) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যৌথ সমীক্ষাটি গ্যাস মজুদ নিরূপণ, কূপ খনন পরিকল্পনা এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ও ব্যয় প্রাক্কলনে সীমাবদ্ধ বলে দেখানো হয়। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাপেক্স এবং নাইকোর যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদন সম্পন্ন হলে দেখা যায়, সব প্রক্রিয়াই নাইকোর অনুকূলে চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত 'সুইস চ্যালেঞ্জ'-এর কথা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংশ্লিষ্টরা ভুলে যান। তবে এ সময় আলোচ্য গ্যাসক্ষেত্রগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়নি। এমনকি পরিত্যক্ত ঘোষণার নীতিমালাও তৈরি হয়নি। ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর 'প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন নীতিমালা' প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের ৬ জুন অনুমোদন করেন।
পরবর্তীকালে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের আট দিন পর ১৪ জুন এ নীতিমালায় যুক্ত ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯৯৯ সাল থেকে নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত সব কার্যক্রম অনুমোদিত বলে বিবেচিত হবে। পরবর্তীকালে ঊর্ধ্বতন মহলের অভিপ্রায়ে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত/প্রান্তিক ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়টি উপযুক্ত কারিগরি কর্তৃপক্ষ দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়নি বলেও জানা যায়।
২০০১ সালের ৩ জুলাই এক পত্রে নাইকো ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্রকে জয়েন্ট ভেঞ্চারের অন্তর্ভুক্ত করা হলে ওই অংশের জন্য আকর্ষণীয় আর্থিক শর্ত প্রদানের ইঙ্গিত দেয়। অবশ্য এর আগে ২০০১ সালের জুনে সরকার ঘোষিত প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন পদ্ধতিতে আলাদা এলাকা সত্ত্বেও ছাতক (পশ্চিম) ও ছাতক (পূর্ব) এলাকাকে একটি গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু যখন নাইকোকে বলা হলো, ছাতক (পশ্চিম) হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র, ছাতক (পূর্ব) নয়, তখন নাইকো তা মানতে অস্বীকার করে।
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় বাপেক্সের সঙ্গে নাইকোর চুক্তির প্রক্রিয়া নাকচ হয়ে যায়। সরকারের প্রভাবশালী মহল, বিশেষ করে হাওয়া ভবনের গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে ম্যানেজ করা হলে সরকারের সব অঙ্গ একযোগে নাইকোর স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীকেও ম্যানেজ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনিই নাইকোকে কাজ উদ্ধারের পদ্ধতি বাতলে দেন। কানাডীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি ছাড়াও নাইকোর স্বার্থরক্ষায় কানাডীয় এক মন্ত্রী ঢাকা সফর করেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকায় কামাল সিদ্দিকীর নাইকোর পক্ষে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের ওপর দফায় দফায় চাপ প্রয়োগ সম্ভব হয় বলে জানা যায়।
২০০২ সালের ৮ জুলাই বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে লেখা পত্রে নাইকোর ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ ছাতককে (পূর্ব) অন্তর্ভুক্ত করা না হলে তাঁদের পক্ষে জয়েন্ট ভেঞ্চার করা সম্ভব হবে না বলে জানান। বাপেক্স নাইকোর এ হুমকির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে এ বিষয়ে ২০০২ সালের ২৯ জুলাই জ্বালানিসচিব খায়রুজ্জামান চৌধুরী সভা আহ্বান করেন।
এদিকে বাপেক্স-নাইকো জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তির খসড়া সম্পর্কে বাপেক্স ২০০২ সালের ২০ আগস্ট পেট্রোবাংলার কাছে যে মতামত পাঠায় তাতে বলা হয়, জ্বালানি বিভাগের ২০০২ সালের ২৯ জুলাই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে প্রস্তাবিত জয়েন্ট ভেঞ্চারে এখন থেকে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র বলতে ছাতককে (পশ্চিম) বোঝাবে এবং জয়েন্ট ভেঞ্চারের আওতায় ছাতক (পশ্চিম) ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রকে বোঝাবে। নাইকো সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বদলের জন্য প্রচণ্ড চাপ দেয়।
বাপেক্স তথা পেট্রোবাংলার সিদ্ধান্তে নাইকোর চাহিদা পূরণ না হওয়ায় খায়রুজ্জামান চৌধুরীকে বদলি করে প্রথমে খন্দকার শহীদুল ইসলাম ও পরে নজরুল ইসলামকে সচিব করা হয়। পেট্রোবাংলার ওপর প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ থেকে নাইকোর অনুকূলে মতামত দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। নাইকোর অনুকূলে মতামতদানের জন্য বারবার তাগিদ এবং চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা তথা বাপেক্স নাইকোর অভিপ্রায় অনুযায়ী ছাতককে (পূর্ব) ছাতক (পশ্চিম) পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রের আওতাভুক্ত দেখাতে বাধ্য হয়। চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া শুরুর প্রাথমিক অনুমোদন চাওয়া হলে ২০০৩ সালের ১৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদন করেন। এ অনুমোদনের ভিত্তিতে চুক্তির খসড়া ও কাঠামো তৈরির জন্য পেট্রোবাংলা একটি কমিটি গঠন করে। চুক্তির খসড়া প্রথমে বাপেক্সে ও পরে পেট্রোবাংলার বোর্ড সভায় অনুমোদিত হয়। এরপর মতামতের জন্য অর্থ এবং আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। যাওয়া মাত্রই আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তা অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। আইনমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি ছিলেন নাইকোর আইন উপদেষ্টা। আর নাইকোর 'প্রধান পৃষ্ঠপোষক' ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মওদুদ আহমদের ভায়রা।
এরপর চূড়ান্ত চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে সার-সংক্ষেপ তৈরি হয়। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন চুক্তির খসড়াসহ সার-সংক্ষেপ হাতে করে নিয়ে ২০০৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বাপেক্স এবং নাইকোর মধ্যে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি করার জন্য জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী পেট্রোবাংলাকে যে নির্দেশ দেন তার নোটে প্রতিমন্ত্রী লেখেন, ১৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তিনি চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন করেছেন। ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন নোটে দাবি করেন, 'মুখ্য সচিব টেলিফোনে আমাকে এই যৌথ সহযোগিতা চুক্তি (জেভিএ) চূড়ান্তকরণের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন এবং সেই নির্দেশ অনুযায়ী চুক্তি চূড়ান্ত করার অনুরোধ জানান।'
নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে লিখিত চূড়ান্ত অনুমোদন অপরিহার্য। তাছাড়া তিনি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও ছিলেন বলে ফাইল এবং সার-সংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সরকারের কার্যবিধিমালায় (রুলস অব বিজনেস) এ ধরনের চুক্তি করার আগে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশের পর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। ২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর বাপেক্স ও নাইকোর মধ্যে প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না থাকায় নাইকোর সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তিটি তাই বৈধ নয়।
২০০৪ সালের নভেম্বরে গ্যাস অনুসন্ধানের সময় নাইকোর অদক্ষতায় ছাতকের টেংরাটিলায় বিস্ফোরণ হলে গ্যাসসম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। নাইকোর পক্ষ থেকে মোশাররফ হোসেনকে দামি গাড়ি ছাড়াও ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। তবে এ কেলেঙ্কারির স্থপতি তৌফিক-ই-ইলাহী কী 'পুরস্কার' পেয়েছেন তা এখনো অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
তৌফিক-ই-ইলাহীর জাতীয় স্বার্থবিরোধী ভূমিকার কারণে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তারও দেখানো হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দাবি করে এ সম্পর্কিত কমিটি তা প্রত্যাহারের সুপারিশ করলেও দুদক প্রত্যাহার করেনি। খালেদা জিয়া ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। তবে দুটি মামলার কার্যক্রমই বর্তমানে স্থগিত আছে।
শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী সরকারের সময় নাইকো রিসোর্সেস তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের সেকেন্ড রাউন্ড বিডিংয়ে অংশ নিলেও ৯ ও ১০ নম্বর ব্লকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া তাল্লো ও শেল/কেয়ার্নের চেয়ে যথাক্রমে ৪২.৯ ও ৫০.৮ নম্বর কম পায়। তাই কোনো ব্লকই বরাদ্দ না পেয়ে নাইকো ভারতে পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে পূর্ব-অভিজ্ঞতার দাবি করে প্রান্তিক ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন ও উৎপাদনের একটি প্রস্তাব ১৯৯৯ সালের ২১ জুন তদানীন্তন জ্বালানিসচিব ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কাছে পেশ করে। পরে ২৮ জুন নাইকো ছাতক, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত ও প্রান্তিক চিহ্নিত করে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার আগ্রহ দেখায়। ১৯৯৯ সালের ১ জুলাই তৌফিক-ই-ইলাহীর সভাপতিত্বে এক সভায় নাইকোর প্রস্তাব গ্রহণ এবং ছাতক, কামতা ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক হিসেবে উন্নয়ন ও উৎপাদন এবং এ জন্য বাপেক্স ও নাইকোর মধ্যে যৌথ অংশীদারি চুক্তির (জেভিএ) সিদ্ধান্ত হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ নাইকোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে ১৯৯৯ সালের ২০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠায়। এতে নাইকোর অযাচিত প্রস্তাব গ্রহণ করে 'সুইস চ্যালেঞ্জ' নামের অননুমোদিত নতুন এক পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়, যাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব পাওয়ার ব্যাপারে দরপত্র আহ্বান এবং প্রাপ্ত প্রস্তাব গ্রহণে নাইকোর অগ্রাধিকার থেকে যায়।
১৯৯১ সালের ২৩ আগস্ট বাপেক্স এবং নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেডের যৌথ সহযোগিতায় ছাতক, ফেনী ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রের মূল্যায়নের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এফওইউ) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যৌথ সমীক্ষাটি গ্যাস মজুদ নিরূপণ, কূপ খনন পরিকল্পনা এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ও ব্যয় প্রাক্কলনে সীমাবদ্ধ বলে দেখানো হয়। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাপেক্স এবং নাইকোর যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদন সম্পন্ন হলে দেখা যায়, সব প্রক্রিয়াই নাইকোর অনুকূলে চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত 'সুইস চ্যালেঞ্জ'-এর কথা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংশ্লিষ্টরা ভুলে যান। তবে এ সময় আলোচ্য গ্যাসক্ষেত্রগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়নি। এমনকি পরিত্যক্ত ঘোষণার নীতিমালাও তৈরি হয়নি। ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর 'প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন নীতিমালা' প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের ৬ জুন অনুমোদন করেন।
পরবর্তীকালে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের আট দিন পর ১৪ জুন এ নীতিমালায় যুক্ত ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯৯৯ সাল থেকে নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত সব কার্যক্রম অনুমোদিত বলে বিবেচিত হবে। পরবর্তীকালে ঊর্ধ্বতন মহলের অভিপ্রায়ে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত/প্রান্তিক ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়টি উপযুক্ত কারিগরি কর্তৃপক্ষ দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়নি বলেও জানা যায়।
২০০১ সালের ৩ জুলাই এক পত্রে নাইকো ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্রকে জয়েন্ট ভেঞ্চারের অন্তর্ভুক্ত করা হলে ওই অংশের জন্য আকর্ষণীয় আর্থিক শর্ত প্রদানের ইঙ্গিত দেয়। অবশ্য এর আগে ২০০১ সালের জুনে সরকার ঘোষিত প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন পদ্ধতিতে আলাদা এলাকা সত্ত্বেও ছাতক (পশ্চিম) ও ছাতক (পূর্ব) এলাকাকে একটি গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু যখন নাইকোকে বলা হলো, ছাতক (পশ্চিম) হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র, ছাতক (পূর্ব) নয়, তখন নাইকো তা মানতে অস্বীকার করে।
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় বাপেক্সের সঙ্গে নাইকোর চুক্তির প্রক্রিয়া নাকচ হয়ে যায়। সরকারের প্রভাবশালী মহল, বিশেষ করে হাওয়া ভবনের গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে ম্যানেজ করা হলে সরকারের সব অঙ্গ একযোগে নাইকোর স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীকেও ম্যানেজ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনিই নাইকোকে কাজ উদ্ধারের পদ্ধতি বাতলে দেন। কানাডীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি ছাড়াও নাইকোর স্বার্থরক্ষায় কানাডীয় এক মন্ত্রী ঢাকা সফর করেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকায় কামাল সিদ্দিকীর নাইকোর পক্ষে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের ওপর দফায় দফায় চাপ প্রয়োগ সম্ভব হয় বলে জানা যায়।
২০০২ সালের ৮ জুলাই বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে লেখা পত্রে নাইকোর ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ ছাতককে (পূর্ব) অন্তর্ভুক্ত করা না হলে তাঁদের পক্ষে জয়েন্ট ভেঞ্চার করা সম্ভব হবে না বলে জানান। বাপেক্স নাইকোর এ হুমকির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে এ বিষয়ে ২০০২ সালের ২৯ জুলাই জ্বালানিসচিব খায়রুজ্জামান চৌধুরী সভা আহ্বান করেন।
এদিকে বাপেক্স-নাইকো জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তির খসড়া সম্পর্কে বাপেক্স ২০০২ সালের ২০ আগস্ট পেট্রোবাংলার কাছে যে মতামত পাঠায় তাতে বলা হয়, জ্বালানি বিভাগের ২০০২ সালের ২৯ জুলাই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে প্রস্তাবিত জয়েন্ট ভেঞ্চারে এখন থেকে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র বলতে ছাতককে (পশ্চিম) বোঝাবে এবং জয়েন্ট ভেঞ্চারের আওতায় ছাতক (পশ্চিম) ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রকে বোঝাবে। নাইকো সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বদলের জন্য প্রচণ্ড চাপ দেয়।
বাপেক্স তথা পেট্রোবাংলার সিদ্ধান্তে নাইকোর চাহিদা পূরণ না হওয়ায় খায়রুজ্জামান চৌধুরীকে বদলি করে প্রথমে খন্দকার শহীদুল ইসলাম ও পরে নজরুল ইসলামকে সচিব করা হয়। পেট্রোবাংলার ওপর প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ থেকে নাইকোর অনুকূলে মতামত দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। নাইকোর অনুকূলে মতামতদানের জন্য বারবার তাগিদ এবং চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা তথা বাপেক্স নাইকোর অভিপ্রায় অনুযায়ী ছাতককে (পূর্ব) ছাতক (পশ্চিম) পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রের আওতাভুক্ত দেখাতে বাধ্য হয়। চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া শুরুর প্রাথমিক অনুমোদন চাওয়া হলে ২০০৩ সালের ১৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদন করেন। এ অনুমোদনের ভিত্তিতে চুক্তির খসড়া ও কাঠামো তৈরির জন্য পেট্রোবাংলা একটি কমিটি গঠন করে। চুক্তির খসড়া প্রথমে বাপেক্সে ও পরে পেট্রোবাংলার বোর্ড সভায় অনুমোদিত হয়। এরপর মতামতের জন্য অর্থ এবং আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। যাওয়া মাত্রই আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তা অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। আইনমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি ছিলেন নাইকোর আইন উপদেষ্টা। আর নাইকোর 'প্রধান পৃষ্ঠপোষক' ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মওদুদ আহমদের ভায়রা।
এরপর চূড়ান্ত চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে সার-সংক্ষেপ তৈরি হয়। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন চুক্তির খসড়াসহ সার-সংক্ষেপ হাতে করে নিয়ে ২০০৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বাপেক্স এবং নাইকোর মধ্যে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি করার জন্য জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী পেট্রোবাংলাকে যে নির্দেশ দেন তার নোটে প্রতিমন্ত্রী লেখেন, ১৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তিনি চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন করেছেন। ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন নোটে দাবি করেন, 'মুখ্য সচিব টেলিফোনে আমাকে এই যৌথ সহযোগিতা চুক্তি (জেভিএ) চূড়ান্তকরণের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন এবং সেই নির্দেশ অনুযায়ী চুক্তি চূড়ান্ত করার অনুরোধ জানান।'
নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে লিখিত চূড়ান্ত অনুমোদন অপরিহার্য। তাছাড়া তিনি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও ছিলেন বলে ফাইল এবং সার-সংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সরকারের কার্যবিধিমালায় (রুলস অব বিজনেস) এ ধরনের চুক্তি করার আগে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশের পর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। ২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর বাপেক্স ও নাইকোর মধ্যে প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না থাকায় নাইকোর সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তিটি তাই বৈধ নয়।
২০০৪ সালের নভেম্বরে গ্যাস অনুসন্ধানের সময় নাইকোর অদক্ষতায় ছাতকের টেংরাটিলায় বিস্ফোরণ হলে গ্যাসসম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। নাইকোর পক্ষ থেকে মোশাররফ হোসেনকে দামি গাড়ি ছাড়াও ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। তবে এ কেলেঙ্কারির স্থপতি তৌফিক-ই-ইলাহী কী 'পুরস্কার' পেয়েছেন তা এখনো অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
No comments