ভালোবাসার দিন by শাইখ সিরাজ
আজ ভালোবাসার দিন। পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের ভ্যালেন্টাইন ডে নামের একটি দিবস দিলেও আমরা আসলে তা গ্রহণ করেছি ভালোবাসা দিবস হিসেবে। কারণ ভালোবাসার নিদর্শন থেকেই এসেছে এ দিবস। এখন আমরা এ ভালোবাসাকে শুধুই প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব, নাকি ভালোবাসার চৌহদ্দি ছড়িয়ে দেব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে_সেটিই বিবেচ্য।
গত কয়েক বছর আমি চ্যানেল আইতে আমার হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ফসলের প্রতি ভালোবাসা ও মাটির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে প্রতিবেদন করেছি। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তথা কৃষকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, ভালোবাসেন কাকে? মাটিকে? ফসলকে? কেন ভালোবাসেন? তাঁরা বলেছেন, তাঁদের প্রাণের কথা। বলেছেন, এ মাটি ফসলের মা। এ মাটি আমাদের খাদ্য দেয়। মাটি আমাদের বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়, মাটি আমাদের বিচরণ ক্ষেত্র। এ মাটিকে ছাড়া ভালোবাসব কাকে? সত্যিই বড় মমত্বের কথা। ওই গ্রামীণ মানুষের কাছ থেকেই আসলে ভালোবাসার ব্যাপক অর্থ শেখার আছে আমাদের। শুধু শহরে ভালোবাসা দিবসে কোটি কোটি টাকার উপহারসামগ্রী লেনদেন করে ভালোবাসার যে গভীরতায় পেঁৗছানো যায় না, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ফসলের মাঠে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার আরো বড় অর্থ বের করতে পারে, ওদের এই ভালোবাসা সত্যিই মূল্যায়নের দাবি রাখে। সেখানেই আমাদের জানার ও শেখার জায়গা।
সম্প্রতি আমি শুরু করেছি 'ফিরে চলো মাটির টানে' নামের একটি কার্যক্রম। হৃদয়ে মাটি ও মানুষের নিয়মিত অনুষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত করেছি এ কার্যক্রম। টেলিভিশন দর্শকরা দেখেছেন শহরে বসবাসকারী চারজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গ্রামে নিয়ে গিয়ে তাদের কয়েক দিনের কৃষিজীবন ধারণের ব্যবস্থা করেছি। তাদের দিয়ে কৃষকের মতো কাজ করিয়েছি। উদ্দেশ্য একটাই, ভালোবাসা শব্দটাকে নতুন প্রজন্মের কাছে ব্যাপক করে তোলা। এ কথা ঠিক, দেশের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর মতো জীবন ধারণের এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বর্তমান কৃষি পরিস্থিতি সম্পর্কে আগামী নেতৃত্বের কাছে একটি সম্যক চিত্র পেঁৗছে দিতে চাইছি। ওদের নিশ্চিত করেই বোঝা দরকার, কৃষির ব্যাপকতা কতখানি। এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা মানে শেকড় ভুলে থাকা। আর শেকড় ভুলে থাকা মানে ভালোবাসার চৌহদ্দির বাইরে চলে যাওয়া। কাজটি যদিও দীর্ঘমেয়াদি, তার পরও এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এসে আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এর একটি সাফল্য এসেছে। ওই চার শিক্ষার্থী কয়েক দিন আগেও মুখ দিয়ে যে কথা বলতে পারত না, অন্তর দিয়ে যে কথা উপলব্ধি করতে পারত না, তা এখন পারছে। ওরা এখন অবলীলায় বলছে, কৃষিকে আড়ালে রেখে, এ মাটিকে দূরে রেখে, এ ফসলের কথা না ভেবে আমরা শুধু যে দেশকে এগিয়ে নিতে পারব না, তা-ই নয়, আমরা পারব না নিজেদেরও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে।
ভালোবাসা দিতে ও নিতে ব্যাকুল গোটা প্রকৃতি। শুধু মানুষ কেন, প্রকৃতির সব উপকরণ বা উপাদানই ভালোবাসার প্রশ্নে সমান। ফেব্রুয়ারি এলেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার গান। আমাদের ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এ মাসের মাঝামাঝিতে এসে যায় ভালোবাসার মৌসুম। এসে যায় ভালোবাসার ঋতু 'বসন্ত'। ভালোবাসা শব্দটিই যেন দ্বিমুখী সমান এক টানের নাম। ভালোবাসা যখন একতরফা হয় তখন তা হয়ে যায় অনেকটাই অপূর্ণ। মানুষ পর্যায়ে এমন অপূর্ণ ভালোবাসার অসংখ্য উদাহরণ মিললেও সামগ্রিকভাবে আমরা যে অপূর্ণ ভালোবাসার দায় নিয়ে ঘুরছি, এমন তথ্য কি কারো কাছে আছে? কেউ কি ভেবেছেন, আমরা যতটুকু ভালোবাসা পাই, ঠিক ততটুকু দিতে জানি না? হ্যাঁ, আমি বলতে চাইছি মাটির ভালোবাসার কথা।
উত্তপ্ত পৃথিবী শান্ত হওয়ার পর একসময় শিলাচূর্ণ, জৈব পানিসহ নানা প্রাকৃতিক উপকরণের সমন্বয়ে কোটি কোটি বছর ধরে তৈরি হয় বিশালাকার পৃষ্ঠ, যা জমিন। এ জমিনই হচ্ছে মাটি। এ মাটি ধারণ করে বাতাস, ধারণ করে পানিসহ জীবনের সব দরকারি উপকরণ। যেখানে বীজ থেকে একটি বৃক্ষের বেড়ে ওঠার মতোই বেড়ে ওঠে প্রাণের সব উপকরণ। পৃথিবীতে ভালোবাসার জন্ম হয়েছে মাটি থেকে। এ মাটি তার বুক দিয়ে শিখিয়েছে কাছে টানার মূলমন্ত্র। আমরা যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা জানি, তা মূলত একটি টানকে ঘিরে। তীব্র আকর্ষণে সব কিছু কাছে টানার রহস্যের জননী হচ্ছে মাটি। আমরা মাটির মানুষ। পশুপাখি, বৃক্ষরাজি সব মাটির অনুগামী। মাটি থেকে উদ্গত আর মাটিতে ফিরে যাওয়ার অভিযানেই নিয়ত ব্যস্ত এই সভ্যতা। মাটি শুধু সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু বা মূল ক্ষেত্র নয়, মাটি হচ্ছে দাঁড়ানোর জায়গা। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা অনন্য পৃথিবীর রূপ দেখি, ভোগ করি ব্রহ্মাণ্ডের সব বৈচিত্র্য।
মহান সৃষ্টিকর্তা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করছেন, 'জমিন যখন সৌন্দর্য-সুষমায় ভরে উঠল, আর জমিনের অধিকর্তারা ভাবতে লাগল, এগুলো আমাদের হাতে আসবে।' সৃষ্টির শুরুতে প্রাণীর মধ্যে সর্বপ্রথম আশা জাগিয়েছিল এ মাটি। এ মাটিই ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ। প্রাণের প্রতিটি স্পন্দন তাই মাটিমুখী।
মাটির চেয়ে সহনক্ষমতা আর কার আছে? মাটি আমাদের কর্ষণের জায়গা। মাটি আমাদের মাথার ওপর আচ্ছাদন তোলার জায়গা। আমরা বলি আবাসভূমি। মাটি আমাদের সভ্যতার বিকাশ ঘটানোর এক অসীম ক্ষেত্র। আমরা বলি মানবজমিন। মাটি আমাদের ফসলের 'মা'। তাই আমরা বলি আবাদি ভূমি। এ পৃথিবীতে সর্বপ্রথম দখল ও মালিকানার স্বপ্নও এসেছে মাটি থেকে। মানুষ প্রথম নিজের বলতে যেই বিষয়টিকে সবচেয়ে আপন রাখতে চেয়েছে তা হচ্ছে মাটি। এই মৃত্তিকা। এই আপন করার নেশা থেকেই এসেছে ভূভাগে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। জন্ম নিয়েছে পৃথক জাতিসত্তা, রাষ্ট্রসহ দলবদ্ধ হয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুর।
এ পৃথিবীতে রঙের উৎপত্তিও মাটি থেকে। প্রাকৃতিক কারণেই একেক এলাকায় মাটি ধারণ করেছে একেক রং। কোথাও লাল, কোথাও সাদা, আবার কোথাও কালো। এর বাইরেও অসংখ্য রঙের ছড়াছড়ি এ মাটিতে। আমরা রং দেখি উদ্ভিদে। ফলে-ফসলে। যার জননী একটাই, তা হচ্ছে মাটি। জাপানের টোকিও নোকো বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে দেখেছিলাম বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সুজুকি মাটির গভীর স্তর নিয়ে গবেষণা করছিলেন। বলছিলেন, মাটির রং ও সহনশীলতার ওপর মানুষের আগ্রাসন নিয়ে। তিনি বলছিলেন, 'আমরা মাটির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে প্রতিনিয়তই পাল্টে দিচ্ছি। পৃথিবীপৃষ্ঠে মাটি যেভাবে তার প্রতিটি স্তরের শক্তি দিয়ে আমাদের লালন করে আসছে, তার বিনিময়ে আমরা মাটিকে তেমন কিছুই দিচ্ছি না। মাটির এ শক্তিহীনতা আমাদের জন্য বয়ে আনতে পারে কঠিন বিপদ।' বাংলাদেশের কথাই বলি, এখানে মাটি তার পাঁচটি জৈব উপাদানের সবটুকু নিঃশেষ করে দিয়েছে উচ্চ ফলনশীল ফসল আবাদের পেছনে। দেশের অনেক এলাকারই মাটি উর্বরাশক্তির প্রশ্নে বন্ধ্যত্ববরণ করতে চলেছে। আমাদের কৃষিনির্ভর জীবনব্যবস্থার জন্য, যা জানান দেয় এক কঠিন সংকেতের।
যদিও মাটি নিজেই নবায়নযোগ্য এক শক্তি, পৃথিবীর আদি থেকেই মাটি তার নিজস্ব জীবন দিয়েই বিতরণ করে চলেছে জীবনীশক্তি। কিন্তু মাটিকে কি আমরা সুযোগ দিচ্ছি তার শক্তি নবায়নের? অথচ মাটির শক্তিবলেই আমি আপনি সবাই শক্তিমান। এ শক্তিবলেই আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আছে। আর ভালোবাসা আছে বলেই সংগ্রাম আছে। সংগ্রাম থেকেই এসেছে জয়-পরাজয় ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার গৌরব।
আজ আমাদের নিজস্ব ভূমি আছে। এখানেই আমাদের গর্ব। আমাদের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু স্বাধীন এই ভূমি। এটি অর্জন করতেই আমাদের ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু। পৃথিবীর মধ্যে আরেক পৃথিবী হিসেবে জন্ম নিয়েছে আমাদের নিজস্ব স্বদেশ। প্রিয় বাংলাদেশ। যেটি আমাদের ভালোবাসার ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রটির মূল প্রতিনিধি হচ্ছে ভূমি বা জমিন। চিরন্তন ভালোবাসার শেকড় যেখানে, সেই মাটিতেই আমাদের ষড়ঋতু, সেই মাটিই আমাদের সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামল প্রকৃতির আদিমাতা। শত প্রতিকূলতা, ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আমরা মাটির আয়নায় দেখি নিজের মুখ। সব তছনছ হয়ে গেলে আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন যেটি থাকে, তা এই মাটি। মানুষের চোখ বেয়ে নেমে আসা কষ্টের জল মুছিয়ে দেয় এ মাটিই। সর্বস্ব হারিয়ে যাওয়ার পরও মাটির মানুষগুলোর মুখে কোনো একদিন ঠিকই ফুটে ওঠে হাসি। যার উৎস মাটি নামক জননীর গর্ভ থেকে উৎসারিত ফসল। আমাদের খাদ্য। আমাদের প্রাণের মূল শক্তি। আমি দেখেছি সিডর যখন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার প্রান্তিক মানুষের জীবন কাঠামো। কিছুদিন পরই তারা মাটির ওপর ভর করে আবার দাঁড়িয়েছে কোমর শক্ত করে। যে মানুষগুলোর আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে তাদের মুখের হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে মাটি আর মাটির ফসল। এ হাসির গভীর মর্মার্থ ঠিকই জানে মাটির মানুষগুলো, যাদের সর্বাঙ্গে প্রতিদিন গভীর স্পর্শ থাকে মাটির।
মাটি আছে বলেই কৃষি আছে, কৃষক আছে। আর কৃষি ও কৃষক আছে বলেই আমরা আছি। যাঁরা মাটির স্পন্দন টের পান, তাঁদের দুহাত ফল-ফসলে ভরিয়ে দেয় এ মাটি। মাটি আছে বলেই সাহিত্য আছে, কবিতা আছে, গান আছে, চলচ্চিত্র আছে। জীবনের প্রধান এ ভিত্তিভূমি আমাদের সব কিছুর সঙ্গে কেমন মমতায় রেখে চলেছে তার সরব স্বাক্ষর। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা প্রাণের সবচেয়ে গভীর থেকে টেনে আনছি 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি/চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি...'
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির ভেতর দিয়ে একদিন ঠিকই আবিষ্কার করেছিলেন, এ মাটি আমাদের প্রাণের সবচেয়ে গভীর স্পন্দন। তাই তিনি বারবার ফিরে গিয়েছিলেন মাটির টানে। কিন্তু এ আহ্বানে আমরা কতখানি ফিরে যেতে পেরেছি মাটির কাছে? শুরুতেই বলেছিলাম, এই মাটির সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা অনেক আগেই একতরফা হয়ে গেছে। আমরা মাটির গভীরতা শুষে শুধু নিয়েই চলেছি, যা নিচ্ছি তার আর কতখানি দিতে পারছি? মাটি একতরফা ফসল ফলাতে ফলাতে তার সমস্ত শক্তি এই আমাদের জন্য নিঃশেষ করে চলেছে। কোথাও নিঃশেষ হয়েও গেছে। মাটির মমতার সঙ্গে মিশে থাকা মানুষ এ কথা ঠিকই টের পায়। তাদের বুকটাও হাহাকার করে ওঠে।
মাটিই হচ্ছে মায়ার ঠিকানা। শত প্রতিবন্ধকতার ভেতর তার এ ঠিকানা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে পরিশ্রম করে চলেছে জমিনে। তার পাশাপাশি নগর সভ্যতার স্বপ্নে বিভোর একটি শ্রেণীর 'পা পড়ছে না মাটিতে'। তারা জানে না মাটিকে দূরে রেখে আমাদের সব চিন্তাই মাটি হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের একজন কৃষক তার সারাটি জীবন মাটি করে দিচ্ছে যে সভ্যতার জন্য, যে গণমানুষের জন্য তার কাছে এ মাটির যে ভালোবাসা, মাটির যে মূল্য তা আমরা প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি কোনো দিনই উপলব্ধি করতে পারিনি। সামন্ত জমিদার যুগে কৃষক ছিল সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। তারা ফসল ফলাত, জমিদার নিয়ে নিত সিংহভাগ। মাটি তাদের কাছে ছিল শুধু আধিপত্য বিস্তারের জায়গা। সেই যুগ পেরিয়েছে। সভ্যতার পালাবদলে প্রান্তিক মানুষও পেয়েছে নিজস্ব মাটির অধিকার। কিন্তু মাটির কাছাকাছি কি আমরা সবাই পেঁৗছাতে পেরেছি? পারিনি।
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আজ পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে। আর সে জন্যই ভালোবাসার এ গল্প। মাটির ভাড়ারে যত ভালোবাসা আছে, তার সামান্য একটি কণাও নেই আমাদের। তার পরও আমাদের ভালোবাসা থেকে সামান্য কণা যদি আমরা মাটির জন্য উৎসর্গ করতে পারি, তাহলে এ মাটি ঠিক ঠিকই টিকিয়ে রাখবে আমাদের মুখের হাসি। আসুন, আজ আমাদের সব ভালোবাসা বিলিয়ে দিই এ মাটিকে।
লেখক : কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
সম্প্রতি আমি শুরু করেছি 'ফিরে চলো মাটির টানে' নামের একটি কার্যক্রম। হৃদয়ে মাটি ও মানুষের নিয়মিত অনুষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত করেছি এ কার্যক্রম। টেলিভিশন দর্শকরা দেখেছেন শহরে বসবাসকারী চারজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গ্রামে নিয়ে গিয়ে তাদের কয়েক দিনের কৃষিজীবন ধারণের ব্যবস্থা করেছি। তাদের দিয়ে কৃষকের মতো কাজ করিয়েছি। উদ্দেশ্য একটাই, ভালোবাসা শব্দটাকে নতুন প্রজন্মের কাছে ব্যাপক করে তোলা। এ কথা ঠিক, দেশের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর মতো জীবন ধারণের এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বর্তমান কৃষি পরিস্থিতি সম্পর্কে আগামী নেতৃত্বের কাছে একটি সম্যক চিত্র পেঁৗছে দিতে চাইছি। ওদের নিশ্চিত করেই বোঝা দরকার, কৃষির ব্যাপকতা কতখানি। এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা মানে শেকড় ভুলে থাকা। আর শেকড় ভুলে থাকা মানে ভালোবাসার চৌহদ্দির বাইরে চলে যাওয়া। কাজটি যদিও দীর্ঘমেয়াদি, তার পরও এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এসে আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এর একটি সাফল্য এসেছে। ওই চার শিক্ষার্থী কয়েক দিন আগেও মুখ দিয়ে যে কথা বলতে পারত না, অন্তর দিয়ে যে কথা উপলব্ধি করতে পারত না, তা এখন পারছে। ওরা এখন অবলীলায় বলছে, কৃষিকে আড়ালে রেখে, এ মাটিকে দূরে রেখে, এ ফসলের কথা না ভেবে আমরা শুধু যে দেশকে এগিয়ে নিতে পারব না, তা-ই নয়, আমরা পারব না নিজেদেরও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে।
ভালোবাসা দিতে ও নিতে ব্যাকুল গোটা প্রকৃতি। শুধু মানুষ কেন, প্রকৃতির সব উপকরণ বা উপাদানই ভালোবাসার প্রশ্নে সমান। ফেব্রুয়ারি এলেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার গান। আমাদের ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এ মাসের মাঝামাঝিতে এসে যায় ভালোবাসার মৌসুম। এসে যায় ভালোবাসার ঋতু 'বসন্ত'। ভালোবাসা শব্দটিই যেন দ্বিমুখী সমান এক টানের নাম। ভালোবাসা যখন একতরফা হয় তখন তা হয়ে যায় অনেকটাই অপূর্ণ। মানুষ পর্যায়ে এমন অপূর্ণ ভালোবাসার অসংখ্য উদাহরণ মিললেও সামগ্রিকভাবে আমরা যে অপূর্ণ ভালোবাসার দায় নিয়ে ঘুরছি, এমন তথ্য কি কারো কাছে আছে? কেউ কি ভেবেছেন, আমরা যতটুকু ভালোবাসা পাই, ঠিক ততটুকু দিতে জানি না? হ্যাঁ, আমি বলতে চাইছি মাটির ভালোবাসার কথা।
উত্তপ্ত পৃথিবী শান্ত হওয়ার পর একসময় শিলাচূর্ণ, জৈব পানিসহ নানা প্রাকৃতিক উপকরণের সমন্বয়ে কোটি কোটি বছর ধরে তৈরি হয় বিশালাকার পৃষ্ঠ, যা জমিন। এ জমিনই হচ্ছে মাটি। এ মাটি ধারণ করে বাতাস, ধারণ করে পানিসহ জীবনের সব দরকারি উপকরণ। যেখানে বীজ থেকে একটি বৃক্ষের বেড়ে ওঠার মতোই বেড়ে ওঠে প্রাণের সব উপকরণ। পৃথিবীতে ভালোবাসার জন্ম হয়েছে মাটি থেকে। এ মাটি তার বুক দিয়ে শিখিয়েছে কাছে টানার মূলমন্ত্র। আমরা যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা জানি, তা মূলত একটি টানকে ঘিরে। তীব্র আকর্ষণে সব কিছু কাছে টানার রহস্যের জননী হচ্ছে মাটি। আমরা মাটির মানুষ। পশুপাখি, বৃক্ষরাজি সব মাটির অনুগামী। মাটি থেকে উদ্গত আর মাটিতে ফিরে যাওয়ার অভিযানেই নিয়ত ব্যস্ত এই সভ্যতা। মাটি শুধু সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু বা মূল ক্ষেত্র নয়, মাটি হচ্ছে দাঁড়ানোর জায়গা। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা অনন্য পৃথিবীর রূপ দেখি, ভোগ করি ব্রহ্মাণ্ডের সব বৈচিত্র্য।
মহান সৃষ্টিকর্তা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করছেন, 'জমিন যখন সৌন্দর্য-সুষমায় ভরে উঠল, আর জমিনের অধিকর্তারা ভাবতে লাগল, এগুলো আমাদের হাতে আসবে।' সৃষ্টির শুরুতে প্রাণীর মধ্যে সর্বপ্রথম আশা জাগিয়েছিল এ মাটি। এ মাটিই ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ। প্রাণের প্রতিটি স্পন্দন তাই মাটিমুখী।
মাটির চেয়ে সহনক্ষমতা আর কার আছে? মাটি আমাদের কর্ষণের জায়গা। মাটি আমাদের মাথার ওপর আচ্ছাদন তোলার জায়গা। আমরা বলি আবাসভূমি। মাটি আমাদের সভ্যতার বিকাশ ঘটানোর এক অসীম ক্ষেত্র। আমরা বলি মানবজমিন। মাটি আমাদের ফসলের 'মা'। তাই আমরা বলি আবাদি ভূমি। এ পৃথিবীতে সর্বপ্রথম দখল ও মালিকানার স্বপ্নও এসেছে মাটি থেকে। মানুষ প্রথম নিজের বলতে যেই বিষয়টিকে সবচেয়ে আপন রাখতে চেয়েছে তা হচ্ছে মাটি। এই মৃত্তিকা। এই আপন করার নেশা থেকেই এসেছে ভূভাগে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। জন্ম নিয়েছে পৃথক জাতিসত্তা, রাষ্ট্রসহ দলবদ্ধ হয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুর।
এ পৃথিবীতে রঙের উৎপত্তিও মাটি থেকে। প্রাকৃতিক কারণেই একেক এলাকায় মাটি ধারণ করেছে একেক রং। কোথাও লাল, কোথাও সাদা, আবার কোথাও কালো। এর বাইরেও অসংখ্য রঙের ছড়াছড়ি এ মাটিতে। আমরা রং দেখি উদ্ভিদে। ফলে-ফসলে। যার জননী একটাই, তা হচ্ছে মাটি। জাপানের টোকিও নোকো বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে দেখেছিলাম বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সুজুকি মাটির গভীর স্তর নিয়ে গবেষণা করছিলেন। বলছিলেন, মাটির রং ও সহনশীলতার ওপর মানুষের আগ্রাসন নিয়ে। তিনি বলছিলেন, 'আমরা মাটির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে প্রতিনিয়তই পাল্টে দিচ্ছি। পৃথিবীপৃষ্ঠে মাটি যেভাবে তার প্রতিটি স্তরের শক্তি দিয়ে আমাদের লালন করে আসছে, তার বিনিময়ে আমরা মাটিকে তেমন কিছুই দিচ্ছি না। মাটির এ শক্তিহীনতা আমাদের জন্য বয়ে আনতে পারে কঠিন বিপদ।' বাংলাদেশের কথাই বলি, এখানে মাটি তার পাঁচটি জৈব উপাদানের সবটুকু নিঃশেষ করে দিয়েছে উচ্চ ফলনশীল ফসল আবাদের পেছনে। দেশের অনেক এলাকারই মাটি উর্বরাশক্তির প্রশ্নে বন্ধ্যত্ববরণ করতে চলেছে। আমাদের কৃষিনির্ভর জীবনব্যবস্থার জন্য, যা জানান দেয় এক কঠিন সংকেতের।
যদিও মাটি নিজেই নবায়নযোগ্য এক শক্তি, পৃথিবীর আদি থেকেই মাটি তার নিজস্ব জীবন দিয়েই বিতরণ করে চলেছে জীবনীশক্তি। কিন্তু মাটিকে কি আমরা সুযোগ দিচ্ছি তার শক্তি নবায়নের? অথচ মাটির শক্তিবলেই আমি আপনি সবাই শক্তিমান। এ শক্তিবলেই আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আছে। আর ভালোবাসা আছে বলেই সংগ্রাম আছে। সংগ্রাম থেকেই এসেছে জয়-পরাজয় ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার গৌরব।
আজ আমাদের নিজস্ব ভূমি আছে। এখানেই আমাদের গর্ব। আমাদের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু স্বাধীন এই ভূমি। এটি অর্জন করতেই আমাদের ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু। পৃথিবীর মধ্যে আরেক পৃথিবী হিসেবে জন্ম নিয়েছে আমাদের নিজস্ব স্বদেশ। প্রিয় বাংলাদেশ। যেটি আমাদের ভালোবাসার ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রটির মূল প্রতিনিধি হচ্ছে ভূমি বা জমিন। চিরন্তন ভালোবাসার শেকড় যেখানে, সেই মাটিতেই আমাদের ষড়ঋতু, সেই মাটিই আমাদের সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামল প্রকৃতির আদিমাতা। শত প্রতিকূলতা, ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আমরা মাটির আয়নায় দেখি নিজের মুখ। সব তছনছ হয়ে গেলে আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন যেটি থাকে, তা এই মাটি। মানুষের চোখ বেয়ে নেমে আসা কষ্টের জল মুছিয়ে দেয় এ মাটিই। সর্বস্ব হারিয়ে যাওয়ার পরও মাটির মানুষগুলোর মুখে কোনো একদিন ঠিকই ফুটে ওঠে হাসি। যার উৎস মাটি নামক জননীর গর্ভ থেকে উৎসারিত ফসল। আমাদের খাদ্য। আমাদের প্রাণের মূল শক্তি। আমি দেখেছি সিডর যখন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার প্রান্তিক মানুষের জীবন কাঠামো। কিছুদিন পরই তারা মাটির ওপর ভর করে আবার দাঁড়িয়েছে কোমর শক্ত করে। যে মানুষগুলোর আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে তাদের মুখের হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে মাটি আর মাটির ফসল। এ হাসির গভীর মর্মার্থ ঠিকই জানে মাটির মানুষগুলো, যাদের সর্বাঙ্গে প্রতিদিন গভীর স্পর্শ থাকে মাটির।
মাটি আছে বলেই কৃষি আছে, কৃষক আছে। আর কৃষি ও কৃষক আছে বলেই আমরা আছি। যাঁরা মাটির স্পন্দন টের পান, তাঁদের দুহাত ফল-ফসলে ভরিয়ে দেয় এ মাটি। মাটি আছে বলেই সাহিত্য আছে, কবিতা আছে, গান আছে, চলচ্চিত্র আছে। জীবনের প্রধান এ ভিত্তিভূমি আমাদের সব কিছুর সঙ্গে কেমন মমতায় রেখে চলেছে তার সরব স্বাক্ষর। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা প্রাণের সবচেয়ে গভীর থেকে টেনে আনছি 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি/চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি...'
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির ভেতর দিয়ে একদিন ঠিকই আবিষ্কার করেছিলেন, এ মাটি আমাদের প্রাণের সবচেয়ে গভীর স্পন্দন। তাই তিনি বারবার ফিরে গিয়েছিলেন মাটির টানে। কিন্তু এ আহ্বানে আমরা কতখানি ফিরে যেতে পেরেছি মাটির কাছে? শুরুতেই বলেছিলাম, এই মাটির সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা অনেক আগেই একতরফা হয়ে গেছে। আমরা মাটির গভীরতা শুষে শুধু নিয়েই চলেছি, যা নিচ্ছি তার আর কতখানি দিতে পারছি? মাটি একতরফা ফসল ফলাতে ফলাতে তার সমস্ত শক্তি এই আমাদের জন্য নিঃশেষ করে চলেছে। কোথাও নিঃশেষ হয়েও গেছে। মাটির মমতার সঙ্গে মিশে থাকা মানুষ এ কথা ঠিকই টের পায়। তাদের বুকটাও হাহাকার করে ওঠে।
মাটিই হচ্ছে মায়ার ঠিকানা। শত প্রতিবন্ধকতার ভেতর তার এ ঠিকানা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে পরিশ্রম করে চলেছে জমিনে। তার পাশাপাশি নগর সভ্যতার স্বপ্নে বিভোর একটি শ্রেণীর 'পা পড়ছে না মাটিতে'। তারা জানে না মাটিকে দূরে রেখে আমাদের সব চিন্তাই মাটি হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের একজন কৃষক তার সারাটি জীবন মাটি করে দিচ্ছে যে সভ্যতার জন্য, যে গণমানুষের জন্য তার কাছে এ মাটির যে ভালোবাসা, মাটির যে মূল্য তা আমরা প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি কোনো দিনই উপলব্ধি করতে পারিনি। সামন্ত জমিদার যুগে কৃষক ছিল সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। তারা ফসল ফলাত, জমিদার নিয়ে নিত সিংহভাগ। মাটি তাদের কাছে ছিল শুধু আধিপত্য বিস্তারের জায়গা। সেই যুগ পেরিয়েছে। সভ্যতার পালাবদলে প্রান্তিক মানুষও পেয়েছে নিজস্ব মাটির অধিকার। কিন্তু মাটির কাছাকাছি কি আমরা সবাই পেঁৗছাতে পেরেছি? পারিনি।
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আজ পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে। আর সে জন্যই ভালোবাসার এ গল্প। মাটির ভাড়ারে যত ভালোবাসা আছে, তার সামান্য একটি কণাও নেই আমাদের। তার পরও আমাদের ভালোবাসা থেকে সামান্য কণা যদি আমরা মাটির জন্য উৎসর্গ করতে পারি, তাহলে এ মাটি ঠিক ঠিকই টিকিয়ে রাখবে আমাদের মুখের হাসি। আসুন, আজ আমাদের সব ভালোবাসা বিলিয়ে দিই এ মাটিকে।
লেখক : কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
No comments