বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি by অধ্যাপক আবুল বারকাত
সুতরাং বিষয়টি দাঁড়িয়েছে এরকম “স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তার প্রতিপক্ষ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি জানে তারা কি চায়, বিপরীতে আমরা জানি না আমরা কি চাই; ওরা জানে কেমন করে তা অর্জন করবে, বিপরীতে আমরা জানি না; ওরা তাদের লক্ষ্যার্জনে সুসংগঠিত, আমরা অসংগঠিত; লক্ষ্যার্জনে ওদের মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই, বিপরীতে আমাদের
দ্বিধা আছে; ওরা যা করছে তা তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করে, আর আমরা নিজেদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছি বলে মনে হয়; ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, যুব সমাজের বেকারত্ব হতাশাকে ওরা সঙ্কীর্ণ স্বার্থে কাজে লাগাতে সিদ্ধহস্ত, আর আমরা “দরিদ্র মানুষ-যুব বেকার-হতাশা”-র বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম এড়িয়ে চলেছি। আমাদের অস্বচ্ছতা ও অনৈক্য ওদের ভীত শক্তিতে সহায়ক হচ্ছে।”
বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার ‘সীমানা’
ইসলাম ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্ম প্রচারে ঐতিহাসিকভাবে কোথাও যুদ্ধবিগ্রহ, কোথাও শান্তিপূর্ণ পথ আবার কোথাও এ দু’য়ের মিশ্রিত পথের ভূমিকা জানা আছে। লক্ষণীয় যে যেখানেই যুদ্ধ-তরবারিকে ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই হয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নয়ত বা যুদ্ধংদেহী রাষ্ট্র পরিচালন পদ্ধতি জেঁকে বসেছে। কিন্তু যেখানেই অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ পথে দীর্ঘকাল ধর্ম প্রচার এগিয়েছে যেমন আমাদের দেশে ওলি- আওলিয়া-সুফি-সাধকরা (ংঁভরংস)– সেখানে ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কখনও শক্ত ভিত পায়নি। উল্টো ধর্মগুরুরা যখনই ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারে সচেষ্ট হয়েছেন তখনই বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। কারণ শান্তিপূর্ণ পথে ধর্ম প্রচার ও ধর্ম পালনের ফলে মানুষ বংশপরম্পরা ধর্মভীরু হয়েছেন কিন্তু বক-ধার্মিক হননি। অর্থাৎ ধর্মের মূল ধারণাটি (ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ ড়ভ ৎবষরমরড়হ র.ব., ৎবষরমরড়ংরঃু) এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে বহুলাংশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাহন হয়েছে। আর সে কারণেই মৌলবাদের অর্থনীতি এ দেশে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ঐ অর্থনীতির শক্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে তিনটি উদাহরণ বেশ প্রাসঙ্গিক হতে পারে : (১) এ দেশে শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইনে ৫০ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের যে ২১ লাখ একর ভূ-সম্পত্তিসহ অন্যান্য সম্পদ গ্রাস করা হয়েছে তা গ্রাস করেছেন মাত্র ০.৪% মুসলমান (গ্রাসকারীরা সবাই যদি মুসলমান হন) অর্থাৎ ৯৯.৬% মুসলমান ভিন্ন ধর্মের মানুষের সম্পদ জোরদখলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন (অনেকেই এটা হিন্দু-বনাম মুসলমান সমীকরণে রূপান্তরের অপপ্রয়াস চালান); (২) বাগমারায় উগ্র-জঙ্গী মৌলবাদ বাংলাভাইকে রাষ্ট্রযন্ত্র যতই মদত দিক না কেন এলাকার মানুষই কিন্তু জোটবদ্ধভাবে তা মোকাবেলা করেছে মূল ধর্ম-গোষ্ঠীর অসাম্প্রদায়িক সুপ্ত চেতনার এ-এক স্পষ্ট বহির্প্রকাশ; (৩) ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ভেঙ্গে পড়ার পরে ঢাকা মেডিকেলসহ অন্যান্য হাসপাতালে হিন্দু ধর্মাবলম্বী আহত ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে রক্তদানে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তা নিশ্চয়ই অসাম্প্রদায়িক চেতনার অপার শক্তিকেই নির্দেশ করে। (৪) ইসলাম ধর্মের পজিটিভ ডিএনএ-র বাহক এ দেশের একজন সাধারণ মুসলমানও কি সুইসাইড বোমাবাজদের কর্মকা- সমর্থন করেন? নাকি প্রায় সকলেই মনে করেন যে এসবই ধর্মের নামে গভীর ষড়যন্ত্রমূলক অধর্মের কাজ?
এত কিছুর পরেও, ‘আত্মতুষ্ট হয়ে বসে থাকলে বিপদ নেই’ এমনটি ভাববার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। কারণ বিষয়টি গভীরভাবে রাজনৈতিক ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য প্রাগ্রসর পরিবেশ সৃষ্টির। অতএব লড়াইটিও রাজনৈতিক। মৌলবাদের অর্থনৈতিক ভিত যে পরিমাণে বিস্তৃতি লাভ করেছে ও করছে তাতে লড়াইটা হতে হবে সর্বব্যাপী বহুমাত্রিক ও বহুকেন্দ্রিক। এ লড়াইয়ে অনগ্রসর মানস-কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রগতির লড়াই; আর সুফি-সাধক-ওলামাদের জন্য মানবতাবিরোধী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মের উদারনৈতিক মানবতাবাদী ধারা পুনর্স্থাপনের লড়াই। সুতরাং এ লড়াইয়ে একদিকে ইসলাম ধর্মের উগ্র সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ ধারার মোকাবেলায় মাবকল্যাণকামী সুফি-উলামা ধারার প্রবক্তাদের যারা ঐতিহাসিকভাবেই মূল ধারার প্রবক্তা মানবকল্যাণে সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন আর অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার লালন এবং মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীনতার ভিত্তি প্রসার নিমিত্ত জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাই হতে পারে অনাকাক্সিক্ষত মৌলবাদী অর্থনীতির ভিত্তিমূল দুর্বল করার একমাত্র পথ।
মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিকাশমান ভিত্তিতে আমাদের দেশে মৌলবাদী জঙ্গিত্ব আস্তে আস্তে যে রূপ ধারণ করেছে তা থেকে আমি অন্তত নিশ্চিত যে ‘এ মুহূর্তে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে’ এমনটি ভাবলে বাস্তব সত্য অস্বীকার করা হবে, আর তা হতে পারে উচ্ছ্বাস-উদ্ভূত ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিরও কারণ। সুতরাং মহাবিপর্যয় রোধে আশু (স্বল্প মেয়াদী) ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক জঙ্গিত্ব এখনই নির্মূল সম্ভব নয় কারণ যে ভিত্তির ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে তা কয়েকদিনে ভেঙ্গে ফেলা যাবে না। বাস্তবে যা সম্ভব তা হল ‘ক্ষতি হ্রাসের’ কৌশল দ্রুত বাস্তবায়ন করা। স্বল্প মেয়াদী সমাধান হিসেবে ‘ক্ষতি হ্রাস কৌশল’ হতে পারে একই সঙ্গে কয়েকটি কাজ করা : (১) ১৯৭১-এ যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ করেছেন যারাই মৌলবাদী জঙ্গীদের গডফাদার তাদের বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে শাস্তি কার্যকর করা (সম্ভব হলে এ বছরই ২০১২ সালের মধ্যে); (২) জঙ্গীদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে সরকারের যা কিছু জানা আছে তা অতি দ্রুত গণমাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার করা; (৩) জঙ্গীদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎসমুখ বন্ধ করা; (৪) জঙ্গীদের সংশ্লিষ্ট সম্পদ বাজেয়াফত করা; (৫) বাজেয়াফতকৃত এ সম্পদ সরকারের তত্ত্বাবধানে এনে মৌলবাদী জঙ্গিত্বের কারণে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং পঙ্গুত্ববরণসহ আহত হয়েছেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের দেয়া, সেইসঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানব উন্নয়ন কর্মকা-ে তা ব্যয় করা; (৬) জঙ্গী কর্মকা-ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইকে ধরা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া; (৭) সরকারের মধ্যেই যারা জঙ্গিত্ব-প্রমোটার তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া এবং সরকার থেকে তাদের বহিষ্কার করা; (৮) ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করা; এবং (৯) ব্যাপক জনগণের মধ্যে জঙ্গীদের প্রকৃত চেহারা-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উম্মোচনে সিরিয়াস প্রচারমূলক কর্মকা- করা যাতে জনগণই এ প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন ইত্যাদি। আর দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে একটিÑ তা হলো দেশে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্য বিলোপসহ অসাম্প্রদায়িক মানস কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী উভয় লক্ষ্য বাস্তবায়নে অসাম্প্রদায়িক সকল মানুষের সচেতন ঐক্যের কোনোই বিকল্প নেই।
(চলবে)
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
(লেখাটি ২৬ জুন জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা ২০১২-এ পঠিত)
বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার ‘সীমানা’
ইসলাম ধর্মসহ বিভিন্ন ধর্ম প্রচারে ঐতিহাসিকভাবে কোথাও যুদ্ধবিগ্রহ, কোথাও শান্তিপূর্ণ পথ আবার কোথাও এ দু’য়ের মিশ্রিত পথের ভূমিকা জানা আছে। লক্ষণীয় যে যেখানেই যুদ্ধ-তরবারিকে ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই হয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নয়ত বা যুদ্ধংদেহী রাষ্ট্র পরিচালন পদ্ধতি জেঁকে বসেছে। কিন্তু যেখানেই অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ পথে দীর্ঘকাল ধর্ম প্রচার এগিয়েছে যেমন আমাদের দেশে ওলি- আওলিয়া-সুফি-সাধকরা (ংঁভরংস)– সেখানে ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কখনও শক্ত ভিত পায়নি। উল্টো ধর্মগুরুরা যখনই ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারে সচেষ্ট হয়েছেন তখনই বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। কারণ শান্তিপূর্ণ পথে ধর্ম প্রচার ও ধর্ম পালনের ফলে মানুষ বংশপরম্পরা ধর্মভীরু হয়েছেন কিন্তু বক-ধার্মিক হননি। অর্থাৎ ধর্মের মূল ধারণাটি (ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ ড়ভ ৎবষরমরড়হ র.ব., ৎবষরমরড়ংরঃু) এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে বহুলাংশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাহন হয়েছে। আর সে কারণেই মৌলবাদের অর্থনীতি এ দেশে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ঐ অর্থনীতির শক্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে তিনটি উদাহরণ বেশ প্রাসঙ্গিক হতে পারে : (১) এ দেশে শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইনে ৫০ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের যে ২১ লাখ একর ভূ-সম্পত্তিসহ অন্যান্য সম্পদ গ্রাস করা হয়েছে তা গ্রাস করেছেন মাত্র ০.৪% মুসলমান (গ্রাসকারীরা সবাই যদি মুসলমান হন) অর্থাৎ ৯৯.৬% মুসলমান ভিন্ন ধর্মের মানুষের সম্পদ জোরদখলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন (অনেকেই এটা হিন্দু-বনাম মুসলমান সমীকরণে রূপান্তরের অপপ্রয়াস চালান); (২) বাগমারায় উগ্র-জঙ্গী মৌলবাদ বাংলাভাইকে রাষ্ট্রযন্ত্র যতই মদত দিক না কেন এলাকার মানুষই কিন্তু জোটবদ্ধভাবে তা মোকাবেলা করেছে মূল ধর্ম-গোষ্ঠীর অসাম্প্রদায়িক সুপ্ত চেতনার এ-এক স্পষ্ট বহির্প্রকাশ; (৩) ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ভেঙ্গে পড়ার পরে ঢাকা মেডিকেলসহ অন্যান্য হাসপাতালে হিন্দু ধর্মাবলম্বী আহত ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে রক্তদানে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তা নিশ্চয়ই অসাম্প্রদায়িক চেতনার অপার শক্তিকেই নির্দেশ করে। (৪) ইসলাম ধর্মের পজিটিভ ডিএনএ-র বাহক এ দেশের একজন সাধারণ মুসলমানও কি সুইসাইড বোমাবাজদের কর্মকা- সমর্থন করেন? নাকি প্রায় সকলেই মনে করেন যে এসবই ধর্মের নামে গভীর ষড়যন্ত্রমূলক অধর্মের কাজ?
এত কিছুর পরেও, ‘আত্মতুষ্ট হয়ে বসে থাকলে বিপদ নেই’ এমনটি ভাববার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। কারণ বিষয়টি গভীরভাবে রাজনৈতিক ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য প্রাগ্রসর পরিবেশ সৃষ্টির। অতএব লড়াইটিও রাজনৈতিক। মৌলবাদের অর্থনৈতিক ভিত যে পরিমাণে বিস্তৃতি লাভ করেছে ও করছে তাতে লড়াইটা হতে হবে সর্বব্যাপী বহুমাত্রিক ও বহুকেন্দ্রিক। এ লড়াইয়ে অনগ্রসর মানস-কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রগতির লড়াই; আর সুফি-সাধক-ওলামাদের জন্য মানবতাবিরোধী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মের উদারনৈতিক মানবতাবাদী ধারা পুনর্স্থাপনের লড়াই। সুতরাং এ লড়াইয়ে একদিকে ইসলাম ধর্মের উগ্র সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ ধারার মোকাবেলায় মাবকল্যাণকামী সুফি-উলামা ধারার প্রবক্তাদের যারা ঐতিহাসিকভাবেই মূল ধারার প্রবক্তা মানবকল্যাণে সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন আর অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার লালন এবং মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীনতার ভিত্তি প্রসার নিমিত্ত জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাই হতে পারে অনাকাক্সিক্ষত মৌলবাদী অর্থনীতির ভিত্তিমূল দুর্বল করার একমাত্র পথ।
মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিকাশমান ভিত্তিতে আমাদের দেশে মৌলবাদী জঙ্গিত্ব আস্তে আস্তে যে রূপ ধারণ করেছে তা থেকে আমি অন্তত নিশ্চিত যে ‘এ মুহূর্তে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে’ এমনটি ভাবলে বাস্তব সত্য অস্বীকার করা হবে, আর তা হতে পারে উচ্ছ্বাস-উদ্ভূত ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিরও কারণ। সুতরাং মহাবিপর্যয় রোধে আশু (স্বল্প মেয়াদী) ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক জঙ্গিত্ব এখনই নির্মূল সম্ভব নয় কারণ যে ভিত্তির ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে তা কয়েকদিনে ভেঙ্গে ফেলা যাবে না। বাস্তবে যা সম্ভব তা হল ‘ক্ষতি হ্রাসের’ কৌশল দ্রুত বাস্তবায়ন করা। স্বল্প মেয়াদী সমাধান হিসেবে ‘ক্ষতি হ্রাস কৌশল’ হতে পারে একই সঙ্গে কয়েকটি কাজ করা : (১) ১৯৭১-এ যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ করেছেন যারাই মৌলবাদী জঙ্গীদের গডফাদার তাদের বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে শাস্তি কার্যকর করা (সম্ভব হলে এ বছরই ২০১২ সালের মধ্যে); (২) জঙ্গীদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে সরকারের যা কিছু জানা আছে তা অতি দ্রুত গণমাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার করা; (৩) জঙ্গীদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎসমুখ বন্ধ করা; (৪) জঙ্গীদের সংশ্লিষ্ট সম্পদ বাজেয়াফত করা; (৫) বাজেয়াফতকৃত এ সম্পদ সরকারের তত্ত্বাবধানে এনে মৌলবাদী জঙ্গিত্বের কারণে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং পঙ্গুত্ববরণসহ আহত হয়েছেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের দেয়া, সেইসঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানব উন্নয়ন কর্মকা-ে তা ব্যয় করা; (৬) জঙ্গী কর্মকা-ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইকে ধরা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া; (৭) সরকারের মধ্যেই যারা জঙ্গিত্ব-প্রমোটার তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া এবং সরকার থেকে তাদের বহিষ্কার করা; (৮) ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করা; এবং (৯) ব্যাপক জনগণের মধ্যে জঙ্গীদের প্রকৃত চেহারা-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উম্মোচনে সিরিয়াস প্রচারমূলক কর্মকা- করা যাতে জনগণই এ প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন ইত্যাদি। আর দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে একটিÑ তা হলো দেশে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্য বিলোপসহ অসাম্প্রদায়িক মানস কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী উভয় লক্ষ্য বাস্তবায়নে অসাম্প্রদায়িক সকল মানুষের সচেতন ঐক্যের কোনোই বিকল্প নেই।
(চলবে)
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
(লেখাটি ২৬ জুন জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা ২০১২-এ পঠিত)
No comments