বাজেট বাস্তবায়ন ॥ সরকারের করণীয় by মোঃ আরিফুর রহমান
মহান জাতীয় সংসদে অনেক যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে কিছু প্রস্তাব গ্রহণ ও কিছু কাটছাঁট করার মাধ্যমে অবশেষে অনুমোদন পেল বাজেট ২০১২-১৩। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে এই বাজেটটি বাস্তবায়ন করে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করা যায়।
প্রতিবছরই বাজেট ও অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনায় যে সকল আশাবাদের কথা বলা হয় তাতে মানুষ আশায় বুক বেঁেধ স্বপ্ন বুনতে থাকে। প্রত্যাশার বাণী শুনে মনে হয়, বাংলাদেশ আর কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, আশার গুঁড়েবালি। বিভিন্ন রকম প্রতিকূলতা ও সমস্যার কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনার পরি উড়ে যায় আর পড়ে থাকে শুধুই কল্পনা। কিন্তু জনগণ এখন সচেতন হচ্ছে তাই আশার বাণী শুনিয়ে আর জনগণকে ভোলানো যাবে না, করতে হবে পরিকল্পনা ও বাজেটের বাস্তবায়ন। মহাজোট সরকারে এসেছিল জনগণের বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে; তাই তাদের নির্বাচনী ইশতেহার যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা যদি পূরণ করতে হয় তবে ঘোষিত বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই এই বাজেটের বাস্তবায়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরী ।
প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে এডিপি বাস্তবায়নের দিকে। এডিপিতে দেখা যায় প্রতিবছরই বিশাল আকারের বরাদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এর অনেকটুকুই বাস্তবায়ন হয় না। অনেক প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন করা হলেও এগুলো বেশিরভাগ সময়ই ফাইলবন্দী কর্মসূচী হিসেবেই থেকে যায়। আবার কিছু কিছু প্রকল্প পরবর্তী বাজেট ঘোষণার আগে তড়িঘড়ি করে শুরু হয় যা শুধু অর্থের অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে এডিপি বাস্তবায়িত হয় না। ১৯৭১-৭২ সালে যেখানে এডিপির আকার ছিল মাত্র ২১৭.৮৪ কোটি টাকা সেখানে বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এডিপির আকার দিন দিন বেড়েই চলছে কিন্তু উন্নয়নের নামে বেশিরভাগ সময় শুধু ডামাডোলই বাজতে থাকে। বাস্তবে দেখা যায়, প্রকল্পগুলো থেকে কিছু নির্দিষ্ট মানুষের পকেট ভারি হয় কিন্তু সেগুলো আলোর মুখ দেখে না। তাই এবার নির্বাচনী অঙ্গীকার মাথায় রেখে এডিপি যাতে বাস্তবায়িত হয় সেদিকে সরকারকে পূর্র্ণ মনোযোগ দিতে হবে। এডিপি বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ,পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় এবং উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। এর জন্য সরকারের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া লাল ফিতার দৌরাতœ্য, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা সৃষ্টি, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাজেট বাস্তবায়নের জন্য রাজস্ব খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই সরকারকে রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এনবিআর-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ৪ হাজার ৪৬৭ ব্যক্তি দুই কোটি বা তদুর্ধ সম্পত্তির মালিক হিসেবে চিহ্নিত যা কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঢাকা শহরের প্রাসাদোপম অট্টালিকা ও জমির দাম বিবেচনা করলেই বোঝা যায় এই সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতার জন্য দেশ বিশাল আকারের রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া যায়, এই দুর্নীতির সঙ্গে অনেক সময় অনেক সরকারী কর্মকর্তারাও জড়িত থাকে। তাই সকল সম্পদশালী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার জন্য শক্তিশালী মনিটরিং সেল যেমন গঠন করতে হবে তেমনি রাজস্ব আদায়েও স্বচ্ছতা সৃষ্টি করতে হবে। দেশের অডিট ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। কর প্রশাসনকে উপজেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য; তবে একে খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
গত তিন বছরে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির গড় হয়েছে ৯.৮ শতাংশ। এ বছরও রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত বছরের রেমিট্যান্সের প্রবাহ ছিল ১০.৪ শতাংশ এবং জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৫.৬ লাখ। কিন্তু এর সংখ্যা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। কেননা এখনও বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা অনেক। তাই বহির্বিশ্বে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির লক্ষ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা প্রয়োজন; যাতে এসব বেকার যুবক বিদেশে গিয়ে নিজেদের কর্মসংস্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। সেই সঙ্গে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স যাতে উৎপাদন খাতে বেশি বিনিয়োগ করা হয় সেজন্য সরকারকে প্রবাসীদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৯.৫ বিলিয়ন ডলার । এর পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য গার্মেন্টস শিল্পসহ বিভিন্ন সম্ভাবনাময় শিল্পদ্রব্য ও পণ্যের রফতানি যেন বৃদ্ধি পায় সেজন্য সরকারকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যুত ও জ্বালানিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমেই শিল্পপণ্য উৎপাদন, নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো যেতে পারে। বাস্তবিক পক্ষে দেখা যায়, একটি রাস্তা একবার নির্মাণ করলে এক বছরও টেকে না যার মূল কারণ ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসাধুতা। এর ফলে সরকারের ব্যয় যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুধু কথার কথাই থেকে যায়। তাই সরকারকে এই ব্যাপারে যতœবান হতে হবে। অবকাঠামো খাতে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারীত্বের কথা বলা হলেও এর বাস্তবায়নের তেমন প্রয়াস এখন পর্যন্ত তেমনভাবে দেখা যায় না। পিপিপির মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতি জোর দেয়া প্রয়োজন।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা না গেলে সরকার যতই চেষ্টা করুক বাজেটে প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারকে নজরদারি জোরদার করতে হবে। এবং টিসিবিকে নামমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে না রেখে একে শক্তিশালী করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের পরিধি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ফটকা কারবারী ও মজুতদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যুত ও জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানো অত্যন্ত জরুরী। তাই রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের প্রতি জোর দিতে হবে।
সরকার বিশাল ঘাটতি বাজেটের জন্য ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ ঋণ নেয়ার কথা বলেছে। এতে ব্যাংকগুলোতে তারল্যর সঙ্কট যেমন বাড়বে তেমনি দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাবে, তাই সরকারকে বিকল্প অর্থায়নের কথা ভাবতে হবে। এছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য মুদ্রা সরবরাহ সংযত করা আবশ্যক এবং এর সঙ্গে বিনিময় হারের যথাযথ পুনর্বিন্যাসও প্রয়োজন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে বিদেশে অর্থ পাচার না হয় এবং পাচারকৃত অর্থ যাতে দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যায়।
প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সাহায্যর দ্রুত অবমুক্তি ও সদ্ব্যবহার দক্ষতার সঙ্গে করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে সভরিন বন্ড ইস্যু করা যেতে পারে; যেখান থেকে আহৃত অর্থ জাতীয় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বৃহৎ প্রকল্পে ব্যয় করা যাবে। ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আগামী পাঁচ বছর ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই থাকবে। সরকারকে এই বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে বিভিন্নরকম প্রণোদনা সৃষ্টির মাধ্যমে কিন্তু আবার এটাও নিশ্চিত করতে হবে যাতে যে সকল কোম্পানি এ দেশে বিনিয়োগ করবে তাদের মুনাফার একটা অংশ এদেশেই পুনর্বিনিয়োগ করা হয়। তাছাড়া এই বিনিয়োগ যাতে সেবা খাতের তুলনায় উৎপাদনমুখী খাতে বেশি হয় সে বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
পুঁজি গঠন, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে পুঁজিবাজারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের পুঁজিবাজারে ভগ্নদশা বিরাজ করছে। তাই পুঁজিবাজারে স্থিতিশীল করার জন্য একে নিয়ে কারসাজিকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সিকিউরিটিজ একচেঞ্জ কমিশনের কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, এটি খুবই ভাল কথা কিন্তু বাস্তবায়ন না করলে আইন সংশোধন অর্থহীন হয়ে পড়বে। পুঁজিবাজারে অহেতুক অস্থিতিশীলতা দূর করার জন্য ডিমিউচুয়ালাইজেশন কার্যক্রম অতিশীঘ্র চালু করতে হবে। এবং বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কেননা দক্ষ জনশক্তিই আমাদের মূল সম্পদ। দক্ষ জনশক্তি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করার প্রতি সরকারকে জোর দিতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তির উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় বাজেটে উল্লেখিত জনকল্যাণকর প্রকল্পগুলো কার্যকর করা যায় না। তাছাড়া বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সঠিক জায়গায় সঠিক লোক নিয়োগ করতে হবে। ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম প্রতিটি সেক্টরে ভালভাবে চলছে কিনা তার জন্য সুপারভিশন ও মনিটরিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।
বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন। আর এর জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে দন্তহীন বাঘ থেকে একে প্রকৃত বাঘে পরিণত করতে হবে। স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনার যে প্রচলিত রীতি চালু আছে তা থেকে বেরিয়ে আসা যেমন জরুরী তেমনি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা সৃষ্টি করাও অত্যন্ত জরুরী। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে প্রয়োজনে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। আর তা না হলে বাজেট বাস্তবায়নে যে আশাবাদের কথা বলা হয়েছে তা আশাবাদ হিসেবে ভবিষ্যতেও থেকে যাবে। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাজেট বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সরকার এবারের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যদি এ সকল বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তবে কিছুটা হলেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে এডিপি বাস্তবায়নের দিকে। এডিপিতে দেখা যায় প্রতিবছরই বিশাল আকারের বরাদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এর অনেকটুকুই বাস্তবায়ন হয় না। অনেক প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন করা হলেও এগুলো বেশিরভাগ সময়ই ফাইলবন্দী কর্মসূচী হিসেবেই থেকে যায়। আবার কিছু কিছু প্রকল্প পরবর্তী বাজেট ঘোষণার আগে তড়িঘড়ি করে শুরু হয় যা শুধু অর্থের অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে এডিপি বাস্তবায়িত হয় না। ১৯৭১-৭২ সালে যেখানে এডিপির আকার ছিল মাত্র ২১৭.৮৪ কোটি টাকা সেখানে বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এডিপির আকার দিন দিন বেড়েই চলছে কিন্তু উন্নয়নের নামে বেশিরভাগ সময় শুধু ডামাডোলই বাজতে থাকে। বাস্তবে দেখা যায়, প্রকল্পগুলো থেকে কিছু নির্দিষ্ট মানুষের পকেট ভারি হয় কিন্তু সেগুলো আলোর মুখ দেখে না। তাই এবার নির্বাচনী অঙ্গীকার মাথায় রেখে এডিপি যাতে বাস্তবায়িত হয় সেদিকে সরকারকে পূর্র্ণ মনোযোগ দিতে হবে। এডিপি বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ,পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় এবং উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। এর জন্য সরকারের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া লাল ফিতার দৌরাতœ্য, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা সৃষ্টি, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাজেট বাস্তবায়নের জন্য রাজস্ব খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই সরকারকে রাজস্ব বোর্ড শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এনবিআর-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ৪ হাজার ৪৬৭ ব্যক্তি দুই কোটি বা তদুর্ধ সম্পত্তির মালিক হিসেবে চিহ্নিত যা কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঢাকা শহরের প্রাসাদোপম অট্টালিকা ও জমির দাম বিবেচনা করলেই বোঝা যায় এই সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতার জন্য দেশ বিশাল আকারের রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া যায়, এই দুর্নীতির সঙ্গে অনেক সময় অনেক সরকারী কর্মকর্তারাও জড়িত থাকে। তাই সকল সম্পদশালী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার জন্য শক্তিশালী মনিটরিং সেল যেমন গঠন করতে হবে তেমনি রাজস্ব আদায়েও স্বচ্ছতা সৃষ্টি করতে হবে। দেশের অডিট ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। কর প্রশাসনকে উপজেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য; তবে একে খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
গত তিন বছরে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির গড় হয়েছে ৯.৮ শতাংশ। এ বছরও রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত বছরের রেমিট্যান্সের প্রবাহ ছিল ১০.৪ শতাংশ এবং জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৫.৬ লাখ। কিন্তু এর সংখ্যা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। কেননা এখনও বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা অনেক। তাই বহির্বিশ্বে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির লক্ষ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা প্রয়োজন; যাতে এসব বেকার যুবক বিদেশে গিয়ে নিজেদের কর্মসংস্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। সেই সঙ্গে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স যাতে উৎপাদন খাতে বেশি বিনিয়োগ করা হয় সেজন্য সরকারকে প্রবাসীদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৯.৫ বিলিয়ন ডলার । এর পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য গার্মেন্টস শিল্পসহ বিভিন্ন সম্ভাবনাময় শিল্পদ্রব্য ও পণ্যের রফতানি যেন বৃদ্ধি পায় সেজন্য সরকারকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যুত ও জ্বালানিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমেই শিল্পপণ্য উৎপাদন, নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো যেতে পারে। বাস্তবিক পক্ষে দেখা যায়, একটি রাস্তা একবার নির্মাণ করলে এক বছরও টেকে না যার মূল কারণ ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসাধুতা। এর ফলে সরকারের ব্যয় যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুধু কথার কথাই থেকে যায়। তাই সরকারকে এই ব্যাপারে যতœবান হতে হবে। অবকাঠামো খাতে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারীত্বের কথা বলা হলেও এর বাস্তবায়নের তেমন প্রয়াস এখন পর্যন্ত তেমনভাবে দেখা যায় না। পিপিপির মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতি জোর দেয়া প্রয়োজন।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা না গেলে সরকার যতই চেষ্টা করুক বাজেটে প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারকে নজরদারি জোরদার করতে হবে। এবং টিসিবিকে নামমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে না রেখে একে শক্তিশালী করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের পরিধি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ফটকা কারবারী ও মজুতদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যুত ও জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানো অত্যন্ত জরুরী। তাই রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের প্রতি জোর দিতে হবে।
সরকার বিশাল ঘাটতি বাজেটের জন্য ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ ঋণ নেয়ার কথা বলেছে। এতে ব্যাংকগুলোতে তারল্যর সঙ্কট যেমন বাড়বে তেমনি দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাবে, তাই সরকারকে বিকল্প অর্থায়নের কথা ভাবতে হবে। এছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য মুদ্রা সরবরাহ সংযত করা আবশ্যক এবং এর সঙ্গে বিনিময় হারের যথাযথ পুনর্বিন্যাসও প্রয়োজন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে বিদেশে অর্থ পাচার না হয় এবং পাচারকৃত অর্থ যাতে দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যায়।
প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সাহায্যর দ্রুত অবমুক্তি ও সদ্ব্যবহার দক্ষতার সঙ্গে করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে সভরিন বন্ড ইস্যু করা যেতে পারে; যেখান থেকে আহৃত অর্থ জাতীয় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বৃহৎ প্রকল্পে ব্যয় করা যাবে। ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আগামী পাঁচ বছর ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই থাকবে। সরকারকে এই বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে বিভিন্নরকম প্রণোদনা সৃষ্টির মাধ্যমে কিন্তু আবার এটাও নিশ্চিত করতে হবে যাতে যে সকল কোম্পানি এ দেশে বিনিয়োগ করবে তাদের মুনাফার একটা অংশ এদেশেই পুনর্বিনিয়োগ করা হয়। তাছাড়া এই বিনিয়োগ যাতে সেবা খাতের তুলনায় উৎপাদনমুখী খাতে বেশি হয় সে বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
পুঁজি গঠন, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে পুঁজিবাজারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের পুঁজিবাজারে ভগ্নদশা বিরাজ করছে। তাই পুঁজিবাজারে স্থিতিশীল করার জন্য একে নিয়ে কারসাজিকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সিকিউরিটিজ একচেঞ্জ কমিশনের কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, এটি খুবই ভাল কথা কিন্তু বাস্তবায়ন না করলে আইন সংশোধন অর্থহীন হয়ে পড়বে। পুঁজিবাজারে অহেতুক অস্থিতিশীলতা দূর করার জন্য ডিমিউচুয়ালাইজেশন কার্যক্রম অতিশীঘ্র চালু করতে হবে। এবং বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কেননা দক্ষ জনশক্তিই আমাদের মূল সম্পদ। দক্ষ জনশক্তি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করার প্রতি সরকারকে জোর দিতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তির উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় বাজেটে উল্লেখিত জনকল্যাণকর প্রকল্পগুলো কার্যকর করা যায় না। তাছাড়া বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সঠিক জায়গায় সঠিক লোক নিয়োগ করতে হবে। ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম প্রতিটি সেক্টরে ভালভাবে চলছে কিনা তার জন্য সুপারভিশন ও মনিটরিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।
বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন। আর এর জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে দন্তহীন বাঘ থেকে একে প্রকৃত বাঘে পরিণত করতে হবে। স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনার যে প্রচলিত রীতি চালু আছে তা থেকে বেরিয়ে আসা যেমন জরুরী তেমনি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা সৃষ্টি করাও অত্যন্ত জরুরী। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে প্রয়োজনে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। আর তা না হলে বাজেট বাস্তবায়নে যে আশাবাদের কথা বলা হয়েছে তা আশাবাদ হিসেবে ভবিষ্যতেও থেকে যাবে। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাজেট বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সরকার এবারের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যদি এ সকল বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তবে কিছুটা হলেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
No comments