স্বাগত প্রত্যাশার ২০১০ by উত্তম চক্রবতর্ী
এটি শুধুই একটি নতুন বছর নয়, বিদায়ী বছরের অনেক অমীমাংসিত ইসু্য নিষ্পত্তির বছর। অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েই দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করছে বর্তমান সরকার। নতুন বছরে এবার... স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের বিচারের রায় কার্যকর হবেছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত-আঘাতে/ উড়ে
হোক ৰয়/ ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত/ নিষ্ফল সঞ্চয়" বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই নববর্ষকে আবাহন করেছেন তাঁর কবিতায়।
'আজি এ ঊষার পুণ্য লগনে, উদিছে নবীন সূর্য গগনে।' পুব আকাশের তমসা আর ঘন কুয়াশা সরিয়ে উদ্ভাসিত নতুন সূর্য সব জরাজীর্ণতাকে পেছনে ফেলে আরও একটি নতুন বছরের সূচনা করল। অনেক হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ এবং আনন্দ-বেদনায় মেশানো ঘটনাবহুল ২০০৯ সালের শেষ সূর্য অসত্ম গেছে কাল। লাখো প্রত্যাশার ঝাঁপি খুলে এবং সরকারের কাছে সুশাসনের প্রত্যাশায় আজ ভোরে কুয়াশাঢাকা পূর্বাকাশে উদয় হয়েছে নতুন বছরের লাল সূর্য। আর এই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শুরম্ন হচ্ছে ২০১০ সাল। জাতির অনেক আশা-আকাঙ্ৰা পূরণ হবার বছর। নতুন বছরকে স্বাগতম_ সুখ-সমৃদ্ধির প্রত্যাশায়।
খ্রিস্টীয় নববর্ষের প্রথম দিন আজ। হ্যাপি নিউ ইয়ার। থার্টিফার্স্টে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পরমানন্দে ২০১০ সালকে বরণ করেছে। আজ নতুন দিনের নতুন সূর্যালোকে স্নান করে সিক্ত হবে জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। বিগত বছরের সব কালিমা ধুয়ে-মুছে নতুন কেতন উড়িয়ে এগিয়ে যাবে সময়, সভ্যতা, হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানিমুক্ত রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতি। অনাবিল স্বপ্ন আর অফুরনত্ম প্রাণোন্মাদনা নিয়ে নতুন সূর্যের আলোয় অগ্রসর হবে মানুষ। বিগত সময়ের সব ভুল শুধরে নেবার সময় এসেছে আজ।
গতরাত ১২টার পর পরই সারা বিশ্বে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। বর্ষবরণের আনন্দোৎসব করেছে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরম্ন করে সাধারণ মানুষ। হিসেবের খাতায় ব্যর্থতার গস্নানি মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে সবাই। তবে বাংলাদেশে বিদায়ী বছরের শেষ দিনটা ছিল ২৫ ঘণ্টার। ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়ায় নতুন বছরকে স্বাগতম জানাতে দেশের মানুষকে পড়তে হয়েছে কিছুটা বিভ্রাটে। নতুন ও পুরনো সময় অনুযায়ী দু'বার ১২টা ১ মিনিটে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে হয়েছে দেশের মানুষকে।
ঘড়ির কাঁটা এগোনো-পিছানো নিয়ে কিছুটা বিভ্রাট বা বিড়ম্বনা সৃষ্টি হলেও বর্ষবরণের আনন্দোৎসবের কমতি ছিল না কোথাও। নতুন বছরে শানত্মিকামী মানুষের ছিল প্রার্থনা_ আর কোন সহিংসতা নয়, কোন হত্যা, খুন কিংবা হানাহানির রাজনীতি নয়। ২০১০ হবে শানত্মির বীজ বপনের সাল। অস্ত্র বা হানাহানির মহড়া হবে না, থেমে যাবে সব যুদ্ধ-সন্ত্রাস। সবার প্রত্যাশা অনুযায়ী ৰমতাসীন সরকার নতুন বছরে একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ উপহার দেবে জাতিকে।
এটি শুধুই একটি নতুন বছর নয়, বিদায়ী বছরের অনেক অমীমাংসিত ইসু্য নিষ্পত্তিরও বছর। অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েই দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করছে বর্তমান সরকার। নতুন বছরে এবার স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীরা কিছুটা ম্রিয়মাণ। আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জনতার জোরালো দাবি। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত থেকে মুক্তিও নতুন বছরের অন্যতম প্রত্যাশা। নতুন বছর ২০১০ সালেই ৩৪ বছর ধরে জাতির ললাটে থাকা কলঙ্কের তিলক মুছে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের বিচারের রায় কার্যকর হবে। ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলবে ঘৃণ্য মৃতু্যদ-াদেশপ্রাপ্ত খুনীরা।
এ ছাড়া নতুন এ বছরে বেশ কিছু জ্বলনত্ম ইসু্যর সমাধান করতে হবে। জাতির প্রত্যাশা ও সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরম্ন হবে নতুন এ বছরে। দেশকে অস্থিতিশীল ও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িতদের বিচার সম্পন্ন হবে। অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিশ্রম্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে গৃহীত প্রকল্পগুলো বাসত্মবায়ন, বিদু্যত ও গ্যাস সঙ্কট নিরসন, বিশ্বমন্দা কাটিয়ে দেশের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করা, বেকারত্ব দূরীকরণ, বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সংসদকে কার্যকর করে নতুন বছরে একটি শানত্মিময় সমৃদ্ধিশালী দেশ উপহার দিতে ২০১০ সাল সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই এসেছে।
গত এক বছরে অনেক কিছু্ই পাল্টে গেছে। দু'বছরের অগণতান্ত্রিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চাকা সচল ছিল এই এক বছরে। গণতান্ত্রিক সরকারের এই এক বছরে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অভ্যসত্ম মানুষ ভুলে ছিল হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও কিংবা হানাহানি থেকে। বিতর্কের ঝড় ওঠেনি শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতন্ত্র চর্চার প্রাণকেন্দ্র জাতীয় সংসদে। তবে সংসদ বর্জনের অতীত সংস্কৃতি ও পঙ্কিল পথ থেকে বের হতে পারেনি বিরোধী দলগুলো। ঠুনকো অজুহাতে তারা সংসদ বর্জন করলেও সংসদীয় কমিটিসহ অন্য সব কর্মকা-ে বিরোধী দলের উপস্থিতি ছিল বছরজুড়েই। দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ভুলে মানুষ একটি বছর দেখেছে, শুনেছে এবং বোঝার চেষ্টা করেছে।
তবে নতুন বছরে রাজনীতির মাঠ গরম করার ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী দল। নির্বাচনে শোচনীয় ভরাডুবির পর প্রায় ভেঙ্গেপড়া সাংগঠনিক শক্তিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে। অতীত দুনর্ীতি, সন্ত্রাস ও অপরাজনীতির বলয় থেকে বের না হওয়া কিংবা জাতির প্রত্যাশাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ করে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে বন্ধন অটুট রেখে বিএনপির আন্দোলনের প্রস্তুতিতে সচেতন দেশের মানুষ কতটুকু সম্পৃক্ত হবে, এ ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় থাকলেও নতুন বছরে তারা যে রাজপথ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করবে, তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধী ইসু্যতে নিজেদের রৰায় সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলো নতুন করে দেশকে অস্থিতিশীল ও নাশকতা চালানোর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের অশনি সংকেত দিচ্ছে।
কিন্তু এ ব্যাপারে অনেকটাই সতর্ক অবস্থানে সরকার। বিগত একটি বছরে সাফল্যের সঙ্গে দেশ পরিচালনায় আন্দোলনে মাঠে নামার সুযোগ পায়নি বিরোধী দলগুলো। বিশ্বের সবচেয়ে দুনর্ীতিগ্রসত্ম দেশ হিসেবে এবার পরিচয় পায়নি বাংলাদেশ। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে বিশ্বের তালিকা থেকেও বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলতে সৰম হয়েছে বর্তমান সরকার। জঙ্গীবাদ ও আনত্মর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ শক্তহাতে দমনে দেশের গ-ি ছাড়িয়ে আনত্মর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে বিদায়ী বছরে মধুচন্দ্রিমা কাটালেও ৰমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মাঠে নামবে নতুন বছরের প্রথম থেকেই। লৰ্য, সারাদেশে সংগঠনকে তারম্নণ্যনির্ভর শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। সরকার থেকে দলকে আলাদা সত্তায় ফিরিয়ে এনে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে ঢেলে সাজিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলকে মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তোলা। এ চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন বছরের প্রথম থেকেই সারাদেশে ছুটে বেরিয়ে দল গোছাতে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে ৰমতাসীন দলটি। শুধু দল গোছানোই নয়, মহাজোটকে আরও শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করারও উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। উগ্র জঙ্গীবাদকে শক্ত হাতে মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন পরিকল্পনায় মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ।
তাই বিপুল প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ নিয়েই আজ থেকে যাত্রা শুরম্ন করল আরও একটি নতুন বছর। নতুন খ্রিস্টাব্দের সূচনামুহূর্ত নিয়ে উচ্ছ্বাস-উলস্নাস বাঙালী সংস্কৃতির নিজস্ব কোন অঙ্গ না হলেও পাশ্চাত্য প্রভাবে শহরাঞ্চলে এর ব্যাপ্তি ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে তরম্নণ সমাজের মধ্যে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর যারা অংশ, তারা জীবিকার কঠোর সংগ্রামে, সমস্যার ভারে এতই কিষ্ট-বিড়ম্বিত যে, এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামানোর কোন অবকাশ নেই তাদের জীবনে।
তারপরও কালপরিক্রমায় নববর্ষ আসে, নতুন আশায়, স্বপ্নে উদ্দীপিত হয় মানুষ। বছরটি সাফল্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, মুছে যাবে ব্যর্থতার যাবতীয় গস্নানি_ এ রকম প্রত্যাশায় মানুষ উজ্জীবিত । বৈশ্বিক পটভূমিতে খ্রিস্টীয় নববর্ষের গুরম্নত্ব এবং তাৎপর্য উপেৰা করার মতো নয় মোটেও। নতুন বছরে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বৃহস্পতিবার পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিকেল পাঁচটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর সরকারী বাসভবন যমুনায় নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।
নববর্ষ উপলৰে রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে দেশবাসী ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের শুভেচ্ছা এবং সবার আনন্দ ও কল্যাণ কামনা করে বলেছেন, নববর্ষ উদযাপন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির একটি উলেস্নখযোগ্য দিক। পুরনো বছরের ব্যর্থতা ও গস্নানিকে পেছনে ফেলে নব উদ্যমে আমরা সোনালী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাব_ এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীসহ বিশ্বের সকল নাগরিককে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বিদায়ী ২০০৯ সাল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পুনর্প্রবর্তন, সুষম উন্নয়নের নবযাত্রা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করার ৰেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে। বিদায়ী বছরে ৭ বছরের অপশাসন এবং দুনর্ীতি অপসারণের মাধ্যমে প্রতিশ্রম্নত উন্নয়নের ভিত্তিমূল রচিত হয়েছে। সমাপ্ত হয়েছে বহু আকাঙ্ৰিত ও প্রতীৰিত বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকা-ের বিচার। নতুন বছরে এ ধারাবাহিকতা রৰা করে তাকে আরও গতিশীল ও বেগবান করার দৃঢ় প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি সমগ্র দেশবাসীকে উদাত্ত আহ্বান জানান।
খ্রিস্টীয় নববর্ষ উপলৰে দেশবাসীর অব্যাহত সুখ, শানত্মি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর বাণীতে বলেছেন, নতুন বছরটিকে শানত্মি ও অগ্রগতির বছরে পরিণত করতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণে তৎপর হতে পারলে নতুন বছরটি হয়ে উঠতে পারে সাফল্যময়।
'আজি এ ঊষার পুণ্য লগনে, উদিছে নবীন সূর্য গগনে।' পুব আকাশের তমসা আর ঘন কুয়াশা সরিয়ে উদ্ভাসিত নতুন সূর্য সব জরাজীর্ণতাকে পেছনে ফেলে আরও একটি নতুন বছরের সূচনা করল। অনেক হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ এবং আনন্দ-বেদনায় মেশানো ঘটনাবহুল ২০০৯ সালের শেষ সূর্য অসত্ম গেছে কাল। লাখো প্রত্যাশার ঝাঁপি খুলে এবং সরকারের কাছে সুশাসনের প্রত্যাশায় আজ ভোরে কুয়াশাঢাকা পূর্বাকাশে উদয় হয়েছে নতুন বছরের লাল সূর্য। আর এই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শুরম্ন হচ্ছে ২০১০ সাল। জাতির অনেক আশা-আকাঙ্ৰা পূরণ হবার বছর। নতুন বছরকে স্বাগতম_ সুখ-সমৃদ্ধির প্রত্যাশায়।
খ্রিস্টীয় নববর্ষের প্রথম দিন আজ। হ্যাপি নিউ ইয়ার। থার্টিফার্স্টে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পরমানন্দে ২০১০ সালকে বরণ করেছে। আজ নতুন দিনের নতুন সূর্যালোকে স্নান করে সিক্ত হবে জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। বিগত বছরের সব কালিমা ধুয়ে-মুছে নতুন কেতন উড়িয়ে এগিয়ে যাবে সময়, সভ্যতা, হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানিমুক্ত রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতি। অনাবিল স্বপ্ন আর অফুরনত্ম প্রাণোন্মাদনা নিয়ে নতুন সূর্যের আলোয় অগ্রসর হবে মানুষ। বিগত সময়ের সব ভুল শুধরে নেবার সময় এসেছে আজ।
গতরাত ১২টার পর পরই সারা বিশ্বে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। বর্ষবরণের আনন্দোৎসব করেছে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরম্ন করে সাধারণ মানুষ। হিসেবের খাতায় ব্যর্থতার গস্নানি মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে সবাই। তবে বাংলাদেশে বিদায়ী বছরের শেষ দিনটা ছিল ২৫ ঘণ্টার। ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়ায় নতুন বছরকে স্বাগতম জানাতে দেশের মানুষকে পড়তে হয়েছে কিছুটা বিভ্রাটে। নতুন ও পুরনো সময় অনুযায়ী দু'বার ১২টা ১ মিনিটে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে হয়েছে দেশের মানুষকে।
ঘড়ির কাঁটা এগোনো-পিছানো নিয়ে কিছুটা বিভ্রাট বা বিড়ম্বনা সৃষ্টি হলেও বর্ষবরণের আনন্দোৎসবের কমতি ছিল না কোথাও। নতুন বছরে শানত্মিকামী মানুষের ছিল প্রার্থনা_ আর কোন সহিংসতা নয়, কোন হত্যা, খুন কিংবা হানাহানির রাজনীতি নয়। ২০১০ হবে শানত্মির বীজ বপনের সাল। অস্ত্র বা হানাহানির মহড়া হবে না, থেমে যাবে সব যুদ্ধ-সন্ত্রাস। সবার প্রত্যাশা অনুযায়ী ৰমতাসীন সরকার নতুন বছরে একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ উপহার দেবে জাতিকে।
এটি শুধুই একটি নতুন বছর নয়, বিদায়ী বছরের অনেক অমীমাংসিত ইসু্য নিষ্পত্তিরও বছর। অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েই দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করছে বর্তমান সরকার। নতুন বছরে এবার স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীরা কিছুটা ম্রিয়মাণ। আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জনতার জোরালো দাবি। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত থেকে মুক্তিও নতুন বছরের অন্যতম প্রত্যাশা। নতুন বছর ২০১০ সালেই ৩৪ বছর ধরে জাতির ললাটে থাকা কলঙ্কের তিলক মুছে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের বিচারের রায় কার্যকর হবে। ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলবে ঘৃণ্য মৃতু্যদ-াদেশপ্রাপ্ত খুনীরা।
এ ছাড়া নতুন এ বছরে বেশ কিছু জ্বলনত্ম ইসু্যর সমাধান করতে হবে। জাতির প্রত্যাশা ও সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরম্ন হবে নতুন এ বছরে। দেশকে অস্থিতিশীল ও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িতদের বিচার সম্পন্ন হবে। অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিশ্রম্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে গৃহীত প্রকল্পগুলো বাসত্মবায়ন, বিদু্যত ও গ্যাস সঙ্কট নিরসন, বিশ্বমন্দা কাটিয়ে দেশের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করা, বেকারত্ব দূরীকরণ, বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সংসদকে কার্যকর করে নতুন বছরে একটি শানত্মিময় সমৃদ্ধিশালী দেশ উপহার দিতে ২০১০ সাল সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই এসেছে।
গত এক বছরে অনেক কিছু্ই পাল্টে গেছে। দু'বছরের অগণতান্ত্রিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চাকা সচল ছিল এই এক বছরে। গণতান্ত্রিক সরকারের এই এক বছরে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অভ্যসত্ম মানুষ ভুলে ছিল হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও কিংবা হানাহানি থেকে। বিতর্কের ঝড় ওঠেনি শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতন্ত্র চর্চার প্রাণকেন্দ্র জাতীয় সংসদে। তবে সংসদ বর্জনের অতীত সংস্কৃতি ও পঙ্কিল পথ থেকে বের হতে পারেনি বিরোধী দলগুলো। ঠুনকো অজুহাতে তারা সংসদ বর্জন করলেও সংসদীয় কমিটিসহ অন্য সব কর্মকা-ে বিরোধী দলের উপস্থিতি ছিল বছরজুড়েই। দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ভুলে মানুষ একটি বছর দেখেছে, শুনেছে এবং বোঝার চেষ্টা করেছে।
তবে নতুন বছরে রাজনীতির মাঠ গরম করার ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী দল। নির্বাচনে শোচনীয় ভরাডুবির পর প্রায় ভেঙ্গেপড়া সাংগঠনিক শক্তিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে। অতীত দুনর্ীতি, সন্ত্রাস ও অপরাজনীতির বলয় থেকে বের না হওয়া কিংবা জাতির প্রত্যাশাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ করে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে বন্ধন অটুট রেখে বিএনপির আন্দোলনের প্রস্তুতিতে সচেতন দেশের মানুষ কতটুকু সম্পৃক্ত হবে, এ ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় থাকলেও নতুন বছরে তারা যে রাজপথ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করবে, তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধী ইসু্যতে নিজেদের রৰায় সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলো নতুন করে দেশকে অস্থিতিশীল ও নাশকতা চালানোর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের অশনি সংকেত দিচ্ছে।
কিন্তু এ ব্যাপারে অনেকটাই সতর্ক অবস্থানে সরকার। বিগত একটি বছরে সাফল্যের সঙ্গে দেশ পরিচালনায় আন্দোলনে মাঠে নামার সুযোগ পায়নি বিরোধী দলগুলো। বিশ্বের সবচেয়ে দুনর্ীতিগ্রসত্ম দেশ হিসেবে এবার পরিচয় পায়নি বাংলাদেশ। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে বিশ্বের তালিকা থেকেও বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলতে সৰম হয়েছে বর্তমান সরকার। জঙ্গীবাদ ও আনত্মর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ শক্তহাতে দমনে দেশের গ-ি ছাড়িয়ে আনত্মর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে বিদায়ী বছরে মধুচন্দ্রিমা কাটালেও ৰমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মাঠে নামবে নতুন বছরের প্রথম থেকেই। লৰ্য, সারাদেশে সংগঠনকে তারম্নণ্যনির্ভর শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। সরকার থেকে দলকে আলাদা সত্তায় ফিরিয়ে এনে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে ঢেলে সাজিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলকে মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তোলা। এ চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন বছরের প্রথম থেকেই সারাদেশে ছুটে বেরিয়ে দল গোছাতে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে ৰমতাসীন দলটি। শুধু দল গোছানোই নয়, মহাজোটকে আরও শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করারও উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। উগ্র জঙ্গীবাদকে শক্ত হাতে মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন পরিকল্পনায় মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ।
তাই বিপুল প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ নিয়েই আজ থেকে যাত্রা শুরম্ন করল আরও একটি নতুন বছর। নতুন খ্রিস্টাব্দের সূচনামুহূর্ত নিয়ে উচ্ছ্বাস-উলস্নাস বাঙালী সংস্কৃতির নিজস্ব কোন অঙ্গ না হলেও পাশ্চাত্য প্রভাবে শহরাঞ্চলে এর ব্যাপ্তি ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে তরম্নণ সমাজের মধ্যে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর যারা অংশ, তারা জীবিকার কঠোর সংগ্রামে, সমস্যার ভারে এতই কিষ্ট-বিড়ম্বিত যে, এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামানোর কোন অবকাশ নেই তাদের জীবনে।
তারপরও কালপরিক্রমায় নববর্ষ আসে, নতুন আশায়, স্বপ্নে উদ্দীপিত হয় মানুষ। বছরটি সাফল্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, মুছে যাবে ব্যর্থতার যাবতীয় গস্নানি_ এ রকম প্রত্যাশায় মানুষ উজ্জীবিত । বৈশ্বিক পটভূমিতে খ্রিস্টীয় নববর্ষের গুরম্নত্ব এবং তাৎপর্য উপেৰা করার মতো নয় মোটেও। নতুন বছরে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বৃহস্পতিবার পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিকেল পাঁচটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর সরকারী বাসভবন যমুনায় নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।
নববর্ষ উপলৰে রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে দেশবাসী ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের শুভেচ্ছা এবং সবার আনন্দ ও কল্যাণ কামনা করে বলেছেন, নববর্ষ উদযাপন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির একটি উলেস্নখযোগ্য দিক। পুরনো বছরের ব্যর্থতা ও গস্নানিকে পেছনে ফেলে নব উদ্যমে আমরা সোনালী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাব_ এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীসহ বিশ্বের সকল নাগরিককে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বিদায়ী ২০০৯ সাল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পুনর্প্রবর্তন, সুষম উন্নয়নের নবযাত্রা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করার ৰেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে। বিদায়ী বছরে ৭ বছরের অপশাসন এবং দুনর্ীতি অপসারণের মাধ্যমে প্রতিশ্রম্নত উন্নয়নের ভিত্তিমূল রচিত হয়েছে। সমাপ্ত হয়েছে বহু আকাঙ্ৰিত ও প্রতীৰিত বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকা-ের বিচার। নতুন বছরে এ ধারাবাহিকতা রৰা করে তাকে আরও গতিশীল ও বেগবান করার দৃঢ় প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি সমগ্র দেশবাসীকে উদাত্ত আহ্বান জানান।
খ্রিস্টীয় নববর্ষ উপলৰে দেশবাসীর অব্যাহত সুখ, শানত্মি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর বাণীতে বলেছেন, নতুন বছরটিকে শানত্মি ও অগ্রগতির বছরে পরিণত করতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণে তৎপর হতে পারলে নতুন বছরটি হয়ে উঠতে পারে সাফল্যময়।
No comments