রেকর্ড-কন্যা নাজমা

জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে যা আগে কেউ কখনো করেনি, এবার সেটাই করে দেখিয়েছে নাজমা। আমলার এই কিশোরী সাঁতারুকে নিয়ে লিখেছেন বদিউজ্জামান হাতে ধরা পদকগুলো যেন পদ্মফুলের পাপড়ি। নেড়েচেড়ে দেখছে আর নিজেই অবাক হচ্ছে।


কী কীর্তিই না গড়েছে আমলার মেয়ে নাজমা খাতুন! বাংলাদেশের সাঁতারের ইতিহাসে আগে যা হয়নি, গত সপ্তাহে শেষ হওয়া বয়সভিত্তিক সাঁতারে সেটাই করে দেখিয়েছে ১৬ বছরের কিশোরী। ১১টি ইভেন্টে সাঁতরে সব কটিতেই সোনা! তাও কি না জাতীয় রেকর্ড গড়ে!!
এখন রেকর্ড-কন্যা তাকে বলাই যায়। রেকর্ড ভেঙে ভেঙে তার সামনে এগোনো। ২০০৬ সালে ঢাকায় প্রথম বয়সভিত্তিক সাঁতারেই সবার নজর কাড়ে নাজমা। সেবার পাঁচটা ইভেন্টে অংশ নিয়ে চারটিতেই রেকর্ড। পরের বছরই তাকে দলভুক্ত করে আনসার। আনসারের কোচ ইমদাদুল হক ও কামাল হোসেনের নিবিড় তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে অনুশীলন। তার পরের বছর পাঁচটা সোনা জিতলেও নতুন জাতীয় রেকর্ড হয় দুটি ইভেন্টে। ২০০৮ সালে তিনটি রেকর্ড গড়ে ছয়টি সোনা। ২০০৯ সালে পাঁচটি রেকর্ড গড়ে সাতটি সোনা। ২০১০ সালে নয়টা সোনা জেতা নাজমা রেকর্ড গড়ে আটটাতে। পারফরম্যান্সের গ্রাফটা গত বছরই ছিল নিম্নমুখী। পাঁচটি রেকর্ডসহ আট সোনা। কারণটা এটাই কি না, নাজমা স্বপ্নেও ভাবেনি এবার পারফরম্যান্স এতটা ভালো হবে, ‘আমি আসলে এতটা ভালো ফলাফলের প্রত্যাশা করে পুলে নামিনি। তবে লক্ষ্য আমার যে মেইন ইভেন্ট (১০০ ও ২০০ মিটার), সেগুলোতে রেকর্ড গড়ব।’ কিন্তু পুলের পারফরম্যান্সটা হলো স্বপ্নের মতো, ‘এত ভালো রেজাল্ট করে আমি নিজেই অবাক। শুনেছি আমাদের সুইমিংপুলে এমন রেকর্ড নাকি এর আগে কেউ করেনি।’
১১ ইভেন্টে রেকর্ডসহ ১১টি সোনা জিতে ইতিহাসই গড়েছে নাজমা। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফেডারেশন বা আনসার থেকে কোনো উৎসাহব্যঞ্জক পুরস্কারের ঘোষণা আসেনি। আনসারের পক্ষ থেকে প্রতিবছরই রেকর্ড গড়া সাঁতারুদের জন্য বরাদ্দ থাকে আর্থিক পুরস্কার। একটি ইভেন্টে রেকর্ড গড়ার জন্য দেওয়া হয় ১৪ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ১১টি ইভেন্টে নাজমা পাবে এক লাখ ৫৪ হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকাটা নাজমার কাছে দূর আকাশের চাঁদ। আনসার থেকে পাওয়া রেশন আর সামান্য ভাতাই জীবিকার বড় মাধ্যম নাজমাদের পরিবারের। তাই এই টাকাটা তার ও তার পরিবারের অনেক কাজে আসত। কিন্তু এই টাকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এসব নিয়ে কথা বলতেই মন খারাপ হয়ে গেল নাজমার, ‘খুবই খারাপ লাগে, যখন শুনি আমাদের টাকা দেওয়া হবে না। এই টাকা পেলে আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে আরও বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনা আসত। এবার আনসারের ফলাফল খারাপ হওয়ার পেছনেও এই একই কারণ।’
নাজমার ১১ ইভেন্টে সমান রেকর্ড ও সোনার সাফল্যের পেছনে কিন্তু আনসারের চেয়ে বেশি অবদান ফেডারেশনের। এসএ গেমসের ক্যাম্পে থেকে রুবেল রানা, মাহফুজা আক্তার (শিলা), জুয়েলদের সঙ্গে অনুশীলন করেছে নাজমা। ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মোস্তফার তত্ত্বাবধানে এই অনুশীলন খুবই কাজে দিয়েছে তার। সেটা নিজেই স্বীকার করল নাজমা, ‘আমাকে এই এসএ গেমসের ক্যাম্পে সুযোগ দেওয়ায় আজকের এই সাফল্য। মোস্তফা স্যার আমাকে অনেক আদর করেন। আমি কখনো অনুশীলনে ফাঁকি দিই না। এ জন্যই আমাকে বেশি আদর করেন। আমি ক্যাম্পের সবচেয়ে ছোট সাঁতারু। সবার আদর পাওয়ার এটাও একটা কারণ।’
টানা ছয় মাস ক্যাম্পে থেকে গত সপ্তাহে বয়সভিত্তিক সাঁতার শেষে বাড়িতে ফিরেছে নাজমা। মায়ের হাতের ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস খুবই প্রিয় নাজমার। ক্যাম্পে থাকলে কি বাড়ির কথা মনে পড়ে না? ‘তা তো মনে পড়েই। দুপুরবেলা যখন অনুশীলন থাকে না তখন শুধু বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে।’
ছুটি শেষে আর কদিন পরই আবার ফিরতে হবে ক্যাম্পে। এখানকার রুটিন বাঁধা জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে নাজমা। কুষ্টিয়া জাহানারা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী নাজমার সাঁতারে আসা আমলার কোচ ইমদাদুল হকের হাত ধরে। বাড়ির পাশের পুকুরে অনুশীলন নাজমার অনুশীলন শুরু তাঁর তাগিদেই। সেখানে পচা কাদায়, শামুকে কত দিন যে পা কেটে ফেলেছে তাঁর হিসাব নেই। আমলার কলেজ পুলেও পরে নিয়মিত অনুশীলন করেছে নাজমা। তবে এখন মিরপুর সুইমিংপুলের নীল জলে দাপাদাপিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য তার। প্রিয় সাঁতারু আমলারই সবুরা খাতুন। মাইকেল ফেলপেসর নামই সে শুনেছে গত মাসে! ভারতের কোচ রাজীব দে ফেলপেসর সাঁতারের ভিডিও দেখানোর পর বুঝেছে তিনি কত বড় মাপের সাঁতারু। গত বেইজিং অলিম্পিকে আটটি ইভেন্টের সবগুলোতেই রেকর্ড গড়েছিলেন আমেরিকান এই সাঁতারু। বয়সভিত্তিক সাঁতারে নাজমাও সব ইভেন্টে রেকর্ড গড়েছে। ফেলপেসর সঙ্গে তুলনা করতেই হেসে ফেলে নাজমা। কার সঙ্গে কার তুলনা!—হাসিতে এমন একটা ভাব থাকলেও চোখমুখে ফুটে ওঠে বড় সাঁতারু হওয়ার প্রতিজ্ঞা। সে প্রতিজ্ঞার পথেই এসএ গেমস সাঁতারে সোনা জিততে চান নাজমা। দেশের পতাকা গায় জড়িয়ে দাঁড়াতে চায় বিজয়মঞ্চে।

No comments

Powered by Blogger.