কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার জীবনের প্রথম দূরযাত্রার দেশ মিসর। প্রথম প্রেমের মতো তাই মিসরের প্রতি গোপন ভালোলাগা আছে আমার। এই ভালোলাগার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তবু বিদেশ ভ্রমণের লিস্টি লিখতে আমি মিসরের নামটাকেই আগে লিখি। তারপর অন্য দেশগুলোর নাম।


পাঁচ-ছয় হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার দেশ, পিরামিড স্ফিংসের দেশ, ফারাওদের দেশ, নীলনদের দেশ মিসর। রানি নেফারতিতি, সুন্দরী ক্লিওপেট্রা আর প্যাপিরাস কাগজের দেশ মিসর। নেহেরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাসেরের দেশ, হলিউডের নায়ক ওমর শরিফের দেশ মিসর। ছাবি্বশ-সাতাশ বছর আগে মিসরে যাওয়ার সময় এটুকুই ছিল মিসর সম্পর্কে আমার জ্ঞান। নাম জানতাম কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, পোর্ট সাঈদ আর সুয়েজ খালের। মিসরে গিয়ে জেনেছি গিজা, সাকারা, লুঙ্ার, আসোয়ানের নাম। আর একটা বস্তুর নামও আগে থেকে জানতাম, সেটি হলো মমি। ইংরেজি সিনেমা 'ক্লিওপেট্রা', 'আলেকজান্ডার' এবং 'মামি' দেখে মিসর সম্পর্কে একটা রহস্যময় কাল্পনিক ধারণাও ছিল আমার। কিন্তু জানতাম না যে মিসরের মানুষ কত অতিথিপরায়ণ এবং বন্ধুবৎসল। জানতাম না যে ভারতীয় সিনেমা এবং অমিতাভ বচ্চনকে তারা পাগলের মতো ভালোবাসে। জানতাম না, সারাক্ষণ মাথার চুল ঢেকে রেখেও মিসরীয় মেয়েরা ভীষণ সুন্দর। 'মামি' সিনেমাতে এক ধরনের ভয়ংকর কালো পোকা দেখেছিলাম। মিসরে গিয়ে জানলাম এই পোকার নাম 'স্ক্যারাব' এবং এটি মিসরীয়দের সৌভাগ্যের প্রতীক। মিসরের সর্বত্রই বিভিন্ন আয়তনের, বিভিন্ন রঙের পাথরের এই পোকা প্রায় প্রতিটি দোকানেই কিনতে পাওয়া যায়। রাজধানী কায়রোকে দ্বিখণ্ডিত করেছে শান্ত, গভীর, অচঞ্চল নীলনদ। দ্বিখণ্ডিত কায়রোর এক পাড়ের একটি পরিচিত জায়গার নাম তাহরির স্কয়ার। রাস্তার চৌমাথার মোড়ের স্কয়ারটি গ্রানাইট পাথরে বাঁধানো। মস্কো, লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, কলকাতার মতো পুরনো শহরগুলোতেও এ রকম পাথরে বাঁধানো স্থান দেখতে পাওয়া যায়। তাহরির স্কয়ারে সাজুগুজু যুবক-যুবতী যেমন বসে থাকে, তেমনি অনেকে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সন্ধ্যাবেলা আয়েশ করে বেড়াতেও আসে।
তিন সপ্তাহ ধরে কায়রোর এই তাহরির স্কয়ার বিশ্ববাসীর কাছে অত্যন্ত পরিচিত এক নাম। যেমন আশির দশকের শেষভাগে পরিচিত হয়েছিল বেইজিংয়ের তিয়ানমেন স্কয়ার। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে তিন সপ্তাহ ধরে জ্বলেছে প্রেসিডেন্ট মুবারকবিরোধী বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিবাদী আগুন। আগুন জ্বলেছে আলেকজান্দ্রিয়া, পোর্ট সাঈদসহ মিসরের প্রায় সর্বত্র। লক্ষ্য একটাই, তিন দশক ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা তিরাশি বছর বয়সী লৌহমানব হোসনি মুবারককে সরে যেতে হবে। আমাদের ঢাকার তোপখানা সড়ক জুড়েও নব্বইয়ের গণআন্দোলনে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ দিনরাত বিক্ষোভ করেছে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের দাবিতে। তখন নভেম্বরের দ্বিতীয় ভাগ থেকে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে এক মুহূর্তের জন্য সংগ্রামী জনতা তোপখানার চৌরাস্তা, প্রেসক্লাব ও জিরো পয়েন্ট স্কয়ার থেকে সরে যায়নি। শেষমেশ ডিসেম্বরের ছয় তারিখে স্বৈরাচারী এরশাদের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দিন তো লক্ষাধিক উৎফুল্ল মানুষ আনন্দে মেতেছিল। কায়রোর তাহরির স্কয়ারের দৃশ্য পত্রিকা এবং টিভিতে দেখে ঢাকার তোপখানা এলাকার কথাই বারবার মনে পড়ে। তাহরির স্কয়ারে সামরিক বাহিনীর ট্যাংক থমকে গেছে মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধে। মুবারকের লেলিয়ে দেওয়া নেশাখোর পালিত গুণ্ডাদের উন্মত্ত আক্রমণ প্রতিহত হয়েছে নারী-পুরুষের ঐক্যবদ্ধ দৃঢ় অবস্থানে। তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনে শরিক হয়েছেন নোবেল লোরেট থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের নারী-পুরুষ। তবু স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ কিন্তু সহজ নয়। গণ-আন্দোলন নিয়ে প্রেসিডেন্ট মুবারক এবং পশ্চিমা শাসকরা ইতিমধ্যে যা বলেছেন এবং যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা বিশ্ববাসীকে মাঝেমধ্যে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে। এটা সত্য যে মিসর পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে এবং গবেষক-বিশ্লেষকদের বিশেষ ভাবনায় ফেলেছে। ভাবনায় ফেলেছে আরব বিশ্বের রাজনীতি যাঁরা নিত্য পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের। ইসরায়েলের সঙ্গে আরব বিশ্বের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে অথবা সুয়েজ খাল ব্যবহারের ব্যবস্থা নিয়েও নানাবিধ ভাবনা শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। ইসলামিক ব্রাদারহুডের বিষয়টি কি সত্যিই আতঙ্কের নাকি কেবলই গণমাধ্যমে সৃষ্ট জুজু, সেটাও এখন আলোচনার বিষয়। রাজপথের গণআন্দোলন আর প্রাসাদ রাজনীতিকে এক তারে বাঁধা খুব সহজ নয়। স্বৈরতন্ত্র সব সময়ই প্রাসাদ রাজনীতির খেলা ভালো বোঝে এবং এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে সাংবিধানিক বিধিবিধান, নিজ সৃষ্ট কিছু আইনকানুনের মধ্য দিয়ে। হোসনি মুবারক সৃষ্ট স্বৈরতন্ত্র ব্যবস্থাটি দীর্ঘ তিরিশ বছর বেশ শক্তিশালী হয়ে অনেক গভীরে শেকড় গেঁড়ে ছিল। তার ওপর আবার বিদেশি প্রভুদের সিদ্ধান্তেও তো অনেক কিছু নির্ভর করে। সব মিলিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা, আত্মদান, আন্দোলন অনেক সময় স্বৈরতন্ত্র সৃষ্ট ব্যবস্থার কানাগলিতে ঘুরপাক খায়। কখনো কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পথও হারিয়ে ফেলে। মিসরের জনগণ যখন স্বৈরাচারী মুবারককে দুর্নীতিবাজ, অত্যাচারী, ক্ষমতার অপপ্রয়োগকারী গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তখন আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রচালকরা কি মুবারককে অন্য চোখে দেখেননি! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তো তাঁকে 'একজন মর্যাদাবান মানুষ, একজন মহান দেশপ্রেমিক' হিসেবে বিবেচনা করেছেন। থাক এসব কথা, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা দক্ষ রাজনীতি বিশ্লেষক নই। সামান্য একজন চেতনাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে অল্পবিস্তর যা মনে এসেছে তা-ই বলার চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া ওই যে লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, প্রথম প্রেমের মতো মিসরের ব্যাপারে একটু আলাদা ভালোলাগা আছে। তাই আমার দেখা সুন্দর সেই দেশটি এবং অতিথিবৎসল মিসরীয় মানুষগুলোর পরিস্থিতি নিত্যদিন গণমাধ্যমে দেখে দেখে সামান্য হলেও দুশ্চিন্তা হয়েছে। দেশটি যদি ক্রমেই গভীর রাজনৈতিক সংকটের ভেতর চলতে থাকত, তবে তো বড় ক্ষতি হতো পাঁচ-ছয় হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার। যে সভ্যতার ঐতিহ্যিক নিদর্শন অবলোকন করতে সারা পৃথিবী থেকে ছুটে যায় অজস্র মানুষ। তা ছাড়া যতদূর দেখেছি এবং জেনেছি, মিসরের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা আহামরি কিছু নয়। আঠারো দিনের আন্দোলন মিসর এবং মিসরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর অর্থনীতির আকাশে কালো মেঘের ছায়া ফেলেছে। সব শঙ্কা আর দুশ্চিন্তার সমাপ্তি ঘটিয়ে অবশেষে লৌহমানব মুবারক জনরোষের কাছে হার মেনে সটকে পড়েছেন। ক্ষমতা ছেড়েছেন সেনাবাহিনীর হাতে। মিসরের সংবিধান সম্পর্কে যাঁরা কিছু জানেন তাঁরা বলছেন এটা সাংবিধানিক হয়নি। মিসরবাসীর প্রত্যাশিত গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে পাকা খেলোয়াড়রা খেলেছেন নতুন খেলা। সাপও মরেছে, লাঠিও ভাঙেনি। পত্রিকায় এবং টিভিতে দেখছি সামরিক সদস্যদের হাসিমুখ। এই হাসিমুখ মিসরবাসীর কাছে যেন আতঙ্কের না হয়ে দাঁড়ায়! আমাদের দেশে তো এ জাতীয় জিনিস আগেই দেখেছি।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.