পল স্যামুয়েলসন জীবনান্তিকা by ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর
পল এন্থনী স্যামুয়েলসন, বিংশ শতাব্দীর অর্থনীতি চর্চার শুরু, বস্টনের কাছে বেলমন্টে ২০০৯-এর ডিসেম্বরের ১৩ তে মৃতু্যবরণ করেন। এই সময়ে আমি বস্টনের কাছে তাঁর প্রিয় দুই বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভাড ও এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) নিবাস শহর ক্যামব্রিজে ছিলাম।
সন্ধ্যায় অর্থনীতির পৃথিবী বরেণ্য এই অধ্যাপকের মৃতু্যর খবর যখন টিভিতে ভেসে আসল তখন বস্টনে শীতের বরফ পড়া শুরু হয়েছে।
১৯৭৪-এর তেমনি এক বরফ মোড়া শীতে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ও আমার স্ত্রী পড়তে এসেছিলাম অর্থনীতি। চার্লস নদীর এ পারে বস্টনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। ঠিক ওপারে ক্যামব্রিজে অবস্থান এমআইটির। তার অদূরে হার্ভাড। তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে অর্থনীতি শিার স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পারস্পরিক নিবন্ধনের সুযোগ ছিল। সেই সুযোগ ধরে ওপারে এমআইটিতে স্যামুয়েলসনের কয়েকটি কাসে গিয়েছিলাম। অর্থনীতির মূলতত্ত্ব শিক ও তাত্তি্বক হিসাবে এত চমৎকার সাবলীল ভাষায় এবং বোধগম্য অবয়বে অন্য কাউকে উপস্থাপন করতে দেখিনি আমি। ব্যাষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতির মেলবন্ধন, মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং সরকারের ভূমিকা বিষয়ে এ যাবত কাল খণ্ড খণ্ড পাঠ ও অনুধাবনের বিপরীতে স্যামুয়েলসন নিয়ে এসেছিলেন স্বচ্ছ ও পারস্পরিক কার্যকরণ সূত্রে বাঁধা অর্থনীতির গতি প্রকৃতির বাস্তবমুখী চিত্র।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ১৯৬৩ থেকে '৬৫-তে অর্থনীতিতে শিকতা করেছি, সে সময় ড. আখলাকুর রহমান (পরে অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) ফিরেছিলেন এমআইটি থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট নিয়ে। যদ্দুর জানি, এমআইটি থেকে অর্থনীতিতে প্রথম বাঙালী ডক্টরেট তিনি। স্যামুয়েলসনের ছাত্র ছিলেন ড. আখলাক। তিনি বললেন, ওখানে এবং হার্ভাডে অর্থনীতিতে ডক্টরেট করতে গেলে করার যোগ্যতা নিরুপিত হয় স্যামুয়েলসনের লেখা স্নাতকপূর্ব পর্যায়ে পাঠ্য হিসেবে লেখা 'অর্থনীতি' (ইকোনমিক্স) বইয়ের সার সংপে অনুধাবন ও উপস্থানপনার সমতায়। তখন পর্যন্ত আমাদের অর্থনীতি পড়ার বিস্তৃতি ছিল বেনহ্যাম, শুমপেটার, মার্শাল, (জোয়ান) রবিনসন, স্টিগলার, কেইনস ও লুইসকে ঘিরে। এদের বইগুলো ভারি, উপস্থাপনা গম্ভীর, বিষয়ের প্রতি সহজ আকর্ষণে এবং অর্থনীতির সকল উপবিষয় সমন্বিত করণে এবং দৃষ্ট আর্থ-সামাজিক সমস্যাদির সমাধান আনয়নে প্রায় অম। তারপর পড়লাম স্যামুয়েলসনের 'অর্থনীতি'- বিশ্ববিখ্যাত ইকোনমিক্স। দেখলাম, সোজা, সরল কথকতায় সুবিন্যস্ত ও সমন্বিতভাবে অর্থনীতি সূত্রগুলো তথাকথিত বিষাদ-বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে কেমন করে বোধগম্য এবং সমাজের কার্যক্রমে প্রযোজ্য হাতিয়ার হিসেবে জ্বল জ্বল করে ফুটে উঠেছে। দেখলাম কবিতা, উপন্যাস, অন্যান্য বিষয়ের নির্যাসমূলক কথাগুলো পরিপার্শি্বকতার আলোকে এবং আর্থ-সামজিক সমস্যাদি সমাধান ও জনগণের উন্নয়নে কিরূপ সুচারু ও বাস্তবায়নীয় অবয়বে অর্থ ও সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে। ১৯৬২ তে হার্ভাড থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করে সদ্য ফেরত ড. আনিসুর রহমান (বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য) অন্যান্য বিষয়ে অনুশীলনের আপেকিতায় অর্থনীতির চর্চায় অবিচল এবং অনেকটা পপাতিত্বের অভিযোগ স্বীকার করে বিষয়-প্রেম প্রতিফলনে অর্থনীতিতে হার্ভাড থেকে প্রথম বাঙালী পিএইচডি ড. নুরুল ইসলামের (বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান) অবাক স্মিত হাসির মুখে বলে ফেললেন : হঁ্যা আমরা সমাজকে অন্যদের চেয়ে বেশি চিনি, ভাল জানি, কেননা আমরা অর্থনীতি পড়েছি। অর্থনীতিতে স্যামুয়েলসনের মতো বই, জানার ভিত্তি, অন্যকোন বিষয়ে আছে কি? উঠতি অর্থনীতিবিদ মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ (সাবেক রাষ্ট্রদূত, এখন সাংসদ), শামসুল আলম (সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব) ও আমি ডা. আনিসুর রহমানসহ তখনকার দিনে প্রায় প্রতি রোববারে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় মিলিত হতাম। একদিন অর্থনীতির এক জার্নালে এক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদের মৃতু্যতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয়ীদের তরফ হতে স্যামুয়েলসনের লেখা জীবনান্তিকা পড়তে যেয়ে ড. আনিস ও আমরা উপলব্ধিতে অবাক হয়ে গেলাম। সেই অর্থনীতিবিদ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। স্যামুয়েলসন লিখেছেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একমাত্র অবদান : আগ্রাসন ও হত্যার ঐ মহাযজ্ঞ তাকে জীবিত অবস্থায় নিরাপদে ফিরিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধ ধ্বংস ও হিংসার এরূপ বৈশিষ্ট্যায়ন অন্যকোন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ করেছেন কিনা আমার জানা নেই।
স্যামুয়েলসনের অর্থনীতি ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। স্যামুয়েলসন তখন এমআইটিতে অর্থনীতির অধ্যাপক। পৃথিবীব্যাপী অর্থনীতি শেখার মৌলপাঠ হিসাবে প্রায় প্রতি বছর মুদ্রনের বাইরে ১৯৯২ পর্যন্ত পরপর ১৪ বার তিনি এর সংস্করণ বের করেছেন। প্রতি সংস্করণেই বিজ্ঞান হিসাবে অর্থনীতির বিবর্তনের আলোকে তিনি পাঠ সংশোধন ও পরিবর্তন করেছেন। ৪০টি ভাষায় স্যামুয়েলসনের অর্থনীতির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হওয়ার ৫০ বছর পরেও প্রতি বছর এক যুক্তরাষ্ট্রেই ৫০ হাজারেরও বেশি এই পাঠ্যপুস্তকটি বিক্রি হয়েছে। ধর্মগ্রন্থ ছাড়া পাঠ্যপুস্তক হিসাবে এর চেয়ে বেশি সংখ্যায় অন্য কোন বই ছাপা বা বিক্রি হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। স্যামুয়েলসনের এই পাঠ্যপুস্তকের জাপানী অনুবাদক শিগতো তসুরু তাঁর অনুবাদের পারিতোষিক দিয়েই অর্থনীতিতে কৃতবিদ্যদের বাসের জন্য টোকিওর মতো দুমর্ূল্য নগরে অতিথি ভবন বানাতে পেরেছিলেন। শোনা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের যোশেফ স্টালিনও অর্থনীতির েেত্র সমাজতান্ত্রিক সফলতার প্রচারের রথে থেকেও স্যামুয়েলসনের অর্থনীতি সে দেশের গণগ্রন্থাগারসমূহে অনুমোদিত পাঠকদের জ্ঞান আহরণের ল্যে সরকারী কার্যক্রমকে সহায়ক শক্তিরূপে মুক্তবাজার ব্যবস্থার প্রয়োগের তাত্তি্বক সারথী হিসাবে এই পাঠ্যপুস্তকটি রাখতে বলেছিলেন। উল্লেখ্য, অর্থনীতির প্রথম পর্যায়ের সংস্করণে স্যামুয়েলসন অর্থনৈতিক চিন্তার বিবর্তনের ইতিহাসে কাল মার্কসকে কালো মেষ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবতর্ী পর্যায়ের সংস্করণে এই কট্টর অবস্থান থেকে তিনি সরে এসে তাঁকে অর্থনীতির বিশাল পুরুষ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৯২ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, এমআইটির পিএইচডি এবং তাঁর ছাত্র উইলিয়াম নর্ডহাউসের সাথে যুগ্মভাবে অর্থনীতি প্রকাশ করে স্যামুয়েলসন যোগ্য নবীনকে কৃতবিদ্য প্রবীণের যৌক্তিক উত্তরাধিকারী হিসাবে সম্মানিত করেছেন।
স্যামুয়েলসন ১৯৭০ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। অর্থনীতিতে তিনিই প্রথম আমেরিকান নোবেল বিজয়ী। নোবেল তাঁকে দেয়া হয়েছিল ১৯৪০ সালে তাঁর লেখা পিএইচডি অভিসন্দর্ভ (থিসিস), অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের বুনিয়াদ (ফাউন্ডেশন অব ইকোনমিক এনালাইসিস) এর জন্য। নোবেল কমিটি তাঁকে এই সম্মান দেয়ার সময়ে উল্লেখ করেছিলেন যে স্যামুয়েলসন মূলত এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে অংকের শৃক্মখলা ও সুস্পষ্টতা দিয়ে অর্থনীতিকে কেবল অর্থনৈতিক ইসু্যর আলোচনা থেকে সমাজের সামনে দাঁড়ানো সমস্যা সমাধানে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। গত ৬০ বছরের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও চিন্তার বিবর্তনের আলোকে তাঁর মৃতু্যর পর তর্কাতীতভাবে একথা আমরা তাঁর গুণগ্রাহীরা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করেছি এই অর্ধশতাব্দী ধরে অর্থনীতিকে জ্ঞান চর্চা ও প্রয়োগের বিষয় ও মাধ্যম হিসাবে গড়ে তোলার েেত্র ও ল্যে স্যামুয়েলসনের মতো বিস্তৃত ও গভীর অবদান অন্য কোন অর্থনীতিবিদ রাখতে সম হননি। ১৯৩০ দশকের জেএম কেইনসের পর কেইনসীয় দর্শনের অনুসারী হয়েও মুক্তবাজার ও উদ্যমের এত সাবলীল ও সম প্রবক্তা হিসাবে অন্যকোন অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসনের চেয়ে অধিকতর দীপ্তমান ও সফল হতে পারেননি। নব্য ধ্রপদী অর্থনীতির মিশ্রণে (নিউ কাসিকাল সিনথেসিস) এর মাধ্যমে স্যামুয়েলসন রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বিশ্লেষণকে নতুন রূপ, পরিচিতি ও দীপ্ত প্রযুক্ততা দিয়েছেন। অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে বলতে দ্বিধা নেই, স্যামুয়েলসনের অবিসংবাদিত পাঠ অর্থনীতি ও অসংখ্য বিভিন্ন লেখা থেকে যা শিখেছি ও জেনেছি তা অন্য কোন একক অর্থনীতিবিদের পাঠ ও লেখা থেকে শিখতে ও জানতে পারিনি। স্যামুয়েলসনের জন্ম ১৯১৫ সালের ১৫ মে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার গ্যারি শহরে এক ইহুদি পরিবারে। পূর্ব পুরুষগণ পোল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন। শিকাগোর হাইড উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। অংকের প্রতি তাঁর আগ্রহ তখন থেকেই দেখা দিয়েছিল। টমাস মালথ্যাসের জনসংখ্যা ও দারিদ্র্য বিষয়ক চিন্তা তাঁকে অর্থনীতির শিা ও চর্চার দিকে আকৃষ্ট করে। শিকাগো থেকে স্নাতক হয়ে ১৯৩৫ সালে তিনি হার্ভাডে চলে আসেন। হার্ভাডে পড়ার সময়ে অধ্যাপক আলভিন হানসেন ১৯৩০-এর মহামন্দার পটে তাঁকে কেইনসীয় অর্থনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি টেনে আনেন। অধ্যাপক জোসেফ শুমপেটার তাঁকে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও ভাবধারার বিবর্তন অনুশীলনে উৎসাহিত করেন। হার্ভাড থেকে ১৯৩৬ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ও ১৯৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। একমাস প্রথম ধাপের প্রশিক হিসাবে হার্ভাডে কাজ করার পর অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসাবে পাশর্্ববতর্ী এমআইটি তাঁকে লুফে নেয়। এরপর এমআইটি তাঁকে অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেয়নি। ১৯৩৮ সালে তাঁর হার্ভাডের সহ ছাত্রী মেরিয়ন ক্রফর্ডের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে এমআইটি তে যুদ্ধ বিমান চালনায় কম্পিউটার প্রযুক্তি উন্নয়নে অংকের প্রয়োগ করতে গবেষণার প্রক্রিয়া ও পথ প্রদর্শন করেন তিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে সরকারের যুদ্ধ উৎপাদন বোর্ডের পরামর্শকের ভূমিকায়ও তিনি অংক ভিত্তিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আগ্রাসন, প্রতিরণ এবং তৎপরতার গতি বাড়ানোর প্রযুক্তিতে উপকরণ হিসাবে ব্যবহারের পথ দেখান। যুদ্ধের পর এমআইটির অর্থনীতি বিভাগকে অর্থনীতি শিা ও চর্চার বিশ্বের অন্যতম সেরা পীঠস্থান হিসাবে তিনি রূপ দিতে থাকেন। এমআইটিতে তাঁর প্রণোদনায় আকর্ষিত হন অনেক প্রতিভাবান শিক ও ছাত্র। এদের মধ্যে ছিলেন ও আছেন অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী জর্জ একারলফ, রবার্ট ইংগল (তৃতীয়), লরেন্স কায়েন, পল ক্রুগমান, ফ্রাংকো মডিগিলিয়ানী, রবার্ট মেরটন, রবার্ট সোলো ও জোসেফ স্টিগলিজ। অর্থনীতির প্রখ্যাত ভারতীয় অধ্যাপক জগদীশ ভগবতী ও পদ্মা দেশাইকে এমআইটিতে অধ্যাপনা ও গবেষণায় প্রণোদিত করেছিলেন স্যামুয়েলসন।
অর্থনীতিতে আর এক নোবেল বিজয়ী তাঁর সহকমর্ী রবার্ট সোলো স্যামুয়েলসন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন : যখন অর্থনীতিবিদরা হিসাব কিংবা বিশ্লেষণ করতে বসেন তখন তাদেরকে স্যামুয়েলসনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বা প্রত্যয় অন্য কেউ দিতে পারেন না। স্যামুয়েলসন তাঁর জীবনকালে যুদ্ধরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কংগ্রেস, অর্থমন্ত্রণালয়, প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কাউন্সিল, বাজেট বু্যরোসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছেন সরকারের ও সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নীতি প্রনয়ন ও বাস্তবায়নে ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছেন। প্রকৃতপ েঅর্থনৈতিক পরামর্শকদের রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার প্রক্রিয়ায় সফলভাবে সংশ্লিষ্ট করার সারথী ছিলেন স্যামুয়েলসন। তাঁর সবচেয়ে নামকরা ছাত্র ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি। অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে করহ্রাসের নীতি যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্যামুয়েলসনই কেনেডির মাধ্যমে গ্রহণ করিয়েছিলেন। শ্রেণীক েস্যামুয়েলসন ছিলেন হাসিখুশি, আমুদপ্রিয় অথচ গভীর বিশ্লেষণমুখী। তাঁর বক্তৃতা, অসংখ্য প্রবন্ধ তাঁর অধ্যাপক জীবনের ভরপুরতার পরিচিতি বহন করে। তাঁর পাঠ্যবই অর্থনীতি বিদেশী, বিশেষত অভিবাসীদের ইংরেজী শেখার পাঠ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থনীতির ১৪তম সংস্করণের অবতরণিকায় স্যামুয়েলসন অর্থনীতি চর্চার কারণ নির্দেশিকার শিরোনাম দিয়েছিলেন হেমিংওয়ের ভাষা দিয়ে : ফর হুম দি বেল টলস। তিনি অর্থনীতির বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করেছেন এই বলে, সবসময় সকল উপকরণিক অংশ যোগ দিলেই পূর্ণাংশের হিসাব মিলে না। তিনি বলেছেন ইতোমধ্যে প্রাপ্ত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থেকে বাইরে এসে অর্থনীতিবিদদের অন্যান্য বিষয়ের নির্যাস নিতে হবে এবং তাদের জন্য নতুনতর ধ্যানধারনাকে দূরে সড়িয়ে রাখা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। আর বলেছেন, পণ্যের বাজার যেমন মুক্ত থাকা প্রয়োজন, তেমনি অাঁতেল বাজার মুক্ত রাখা এবং তার থেকে অবাধে উপযোগ গ্রহণ সমাজ উন্নয়নে সবসময় ল্যানুগ হবে।
এই প্রেেিত তথাকথিত র্যাডিক্যাল অর্থনীতি পর্যালোচনা করে স্যামুলেসন সুইডিশ অর্থনীতিবিদ লীন্ডম্যানের ইতিহাসভিত্তিক অভিজ্ঞান গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, ব্যক্তি উদ্যোগ ও সরকারের ভূমিকা সমকালে সকল অর্থ ব্যবস্থায় পারস্পরিকভাবে সম্পূরক; সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের সংগঠন ছাড়া আমরা কিভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও প্রবৃদ্ধির ল্যে এগুবো? আর মুক্তবাজার ব্যবস্থায় ব্যক্তি উদ্যোগকে তার উদ্ভাবনশীলতার লাভ পাওয়ার এবং ভুলের মাসুল দেয়ার সূত্র থেকে দূরে সরিয়ে কিভাবে মূলধন ও শ্রম বিনিয়োগ করব? স্যামুয়েলসনই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের দৃঢ় বন্ধনে সামষ্টিক অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির তত্ত্বের সাথে একীভূত করেছিলেন, বাজার ব্যবস্থার অপূর্ণাঙ্গতা দূর করার জন্য সরকারের ভূমিকাকে সরব স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। প্রবৃদ্ধির অর্থনীতির জনক অধ্যাপক রোজেনস্টেইন রোডানের কাছে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়েছি তখন তিনি এই কথাটি সুস্পষ্টভাবে আমাদের কাছে তুলে ধরেছিলেন। স্যামুয়েলসন নিজেই তার 'অর্থনীতির' শেষ সংস্করণে অর্থনৈতিক সংগঠনের মূল সমস্যার অবতরণিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫০ দশকের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইসেনহাওয়ারের কথা অপার বিশ্বাসে উল্লেখ করেছেন : তৈরি হওয়া প্রতিটি কামান, সাগরে ভাসানো প্রতিটি যুদ্ধজাহাজ, উৎিেপত প্রতিটি রকেট, চূড়ান্ত অর্থে যারা ুধার্ত ও অভুক্ত তাদের থেকে চুরি করা সম্পদ প্রতিফলিত করে।
স্যামুয়েলসনের একটি তত্ত্ব এখনও আমার কাছে তার পাঠ থেকে গড়ে ওঠা মানস সত্ত্বেও ভ্রান্ত এবং মুক্ত উদ্যোগের দর্শনের বিপরীত বলে মনে হয়। স্টপলারের সঙ্গে যুগ্মভাবে অঙ্কের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গড়ে তোলা স্টপলার-স্যামুয়েলসন থিওরোমে তিনি বলেছেন, দরিদ্র দেশ থেকে অদ শ্রমিক দিয়ে তৈরি পণ্য দ্রব্যাদির মুক্ত আমদানি শিল্পোন্নত দেশের নিম্ন-মজুরির শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে দেবে। জীবনের শেষ প্রান্তে তেমনি তিনি ভ্রান্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই হয়ত বলেছেন : উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত দেশের তি হতে পারে। এই ধরনের কথা তার অর্থনীতিতে প্রাপ্ত তত্ত্ব-রণশীলতা নয়, উৎপাদনশীলতাই আমাদের সকলের সহায়ক_ এর দৃষ্টিকোণ থেকে বিপরীতমুখী বলে মনে হয়।
স্যামুয়েলসনের প্রথম স্ত্রী ম্যারিয়ন ১৯৭৮ সালে মারা যাওযার পর তিনি রিশা কেকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে তার ৬ সন্তানের জন্ম হয়; ম্যারিয়নের মৃতু্যর পর রিশা কেসহ এ সকলকে তারা দু'জনেই লালন করেন। মৃতু্যর সময় তার নাত-নাতনিদের সংখ্যা ছিল ১৫। ছোট নয়, বড় পরিবারই হয়ত তার কাছে সুখী পরিবার ছিল। তার এক ভাই রবার্ট সামার্স পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবরসপ্রাপ্ত অর্থনীতির অধ্যাপক, এখনও জীবিত আছেন। রবার্ট সামার্সের ছেলে লরেন্স সামার্স প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অর্থনৈতিক কাউন্সিলের পরিচালক। স্যামুয়েলসনের প্রিয় খেলা ছিল টেনিস। সারা জীবন তিনি খেলেছেন নিয়ম মতো, কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করে বল কুড়ানো লাইনস্ম্যানদের আঘাত করেননি। টেনিস আমি খেলি, আমার অর্থনীতির সহ ছাত্র বন্ধুরা খেলেন। অন্য সকল কিছু অপরিবর্তনীয় থাকার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের অনুকল্প মন থেকে দূরে সরিয়ে লাইনস্ম্যানদের প্রতিপ বলে আমরা মাঝে মাঝে ভুল করে থাকি। স্যামুয়েলসন অন্য সকল কিছু অপরিবর্তনীয় মনে করে বিশ্লেষণ করার অপূর্ণাঙ্গতার বিষয়ে সকল শিাথর্ীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেও অর্থনীতির প্রথাগত এই অনুকল্পকে অযথা আঘাত করেননি, বরং তার পথে এই অনুকল্পের অনুসারীদের অনুগামী করতে নিরবধি চেষ্টা করেছেন।
পল স্যামুয়েলসন মুক্তবুদ্ধির দীপ্ত চর্চার পরিবেশে নিজকে বিকশিত করেছেন। অর্থব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা স্বীকার ও পাঠ্যবইয়ে এই তত্ত্বকে যথার্থ স্থান দেয়ার কারণে ১৯৫০-এর দশকের কমু্যনিজমের কট্টর বিরোধী সিনেটর ম্যাকার্থির দাপটকালে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ার্ত রণশীল পরিবেশে একবার গুঞ্জন উঠেছিল যে কতর্ৃপ, সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর প্রণীত অর্থনীতি সেন্সর করবে। একথা শুনে স্যামুয়েলসনের এক গুণগ্রাহী এমআইটির তৎকালীন সভাপতি কার্ল ক্রমটনকে দিয়ে বইটি সেন্সর করার আশংকা প্রকাশ করেন। উত্তরে সভাপতি ক্রমটন বলেছিলেন, যে দিন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিককে বলা কিংবা লেখার জন্য কোন কতর্ৃপরে বাধা নিষেধ বা সেন্সরের সামনে দাঁড়াতে হবে সেদিন তিনিই পদত্যাগ করবেন।
স্যামুয়েলসনের মৃতু্যর পরদিন ডিসেম্বর ১৪-এর পড়ন্ত বিকেলে ক্যামব্রিজের লাগোয়া নিউটনে সেই চার্লস নদীর ডান পাড় ধরে আমি হাঁটছিলাম। নদীর দুধারে জমে ওঠা সাদা বরফ। বিষণ্ন আকাশ থেকে তুলোর কবোষ্ণতা নিয়ে ঝরছে বরফ আর তার নিচে তিরতির করে বইছে চার্লস। তখনও জমে যায়নি তার প্রবাহ। স্যামুয়েলসন নিশ্চয়ই কোন না কোন দিন এমআইটি থেকে বেরিয়ে চার্লস নদী ধরে হেঁটেছেন, মুক্ত পরিবেশে, নিমের্াহ অনুশীলন এবং অবাধ বলা ও লেখার মুক্ত বাতাবরণে নিজের চিন্তার অনুভূতি ও মতাদর্শ প্রকাশ করার পরিধিকে নিশ্চত অধিকার হিসাবে সবলে এগিয়ে গেছেন। এমআইটির সভাপতি কার্ল ক্রমপটন তাঁর চিন্তা, চলা ও চর্চার স্বাধীনতার অনুকূলে যে মুক্তির মূল্যবোধ নিয়ে দৃঢ় প্রতিরণের অতন্দ্র বর্ম ধরে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর প্রয়োগের প্রকৃতি, গতি ও বিস্তৃতি নিয়ে ভাবনা এসে নাড়িয়ে যাচ্ছিল আমায়। এই মূল্যবোধ নিয়ে আমরা কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহকে গড়ে তুলতে পেরেছি? স্বৈরতন্ত্র যে মুক্তবুদ্ধি এবং জ্ঞান বিকাশক পরিবেশ সৃষ্টি ও রা করতে অম, স্যামুয়েলসনের সারা জীবনের সাধনা ও বিকাশ এবং অর্জিত সফলতা তাই প্রমাণ করে গেছে। আমাদের শিা জগতের স্বঘোষিত দিকপালরা যখন তাদের পেশাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিংবা বিগলিত হাসি নিয়ে অধিক প্রাপ্তির লালসায় স্বৈরতন্ত্রের প্রতিভু কিংবা নায়কদের আতেল সমতার কষ্টদায়ক উপস্থাপনায় কিংবা লেখক হিসাবে প্রচারণার হাস্যকর অপচেষ্টার সহজ সহযোগী হন তখন হয়ত তাঁরা জ্ঞান জগতের অবিস্মরনীয় দিকপাল পল এন্থনী স্যামুয়েলসন কিংবা তার সহযোগীদের মূল্যবোধে দীপ্ত ভূমিকা মনে রাখেন না । রাখার সময় এখন এসেছে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য
১৯৭৪-এর তেমনি এক বরফ মোড়া শীতে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ও আমার স্ত্রী পড়তে এসেছিলাম অর্থনীতি। চার্লস নদীর এ পারে বস্টনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। ঠিক ওপারে ক্যামব্রিজে অবস্থান এমআইটির। তার অদূরে হার্ভাড। তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে অর্থনীতি শিার স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পারস্পরিক নিবন্ধনের সুযোগ ছিল। সেই সুযোগ ধরে ওপারে এমআইটিতে স্যামুয়েলসনের কয়েকটি কাসে গিয়েছিলাম। অর্থনীতির মূলতত্ত্ব শিক ও তাত্তি্বক হিসাবে এত চমৎকার সাবলীল ভাষায় এবং বোধগম্য অবয়বে অন্য কাউকে উপস্থাপন করতে দেখিনি আমি। ব্যাষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতির মেলবন্ধন, মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং সরকারের ভূমিকা বিষয়ে এ যাবত কাল খণ্ড খণ্ড পাঠ ও অনুধাবনের বিপরীতে স্যামুয়েলসন নিয়ে এসেছিলেন স্বচ্ছ ও পারস্পরিক কার্যকরণ সূত্রে বাঁধা অর্থনীতির গতি প্রকৃতির বাস্তবমুখী চিত্র।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ১৯৬৩ থেকে '৬৫-তে অর্থনীতিতে শিকতা করেছি, সে সময় ড. আখলাকুর রহমান (পরে অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) ফিরেছিলেন এমআইটি থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট নিয়ে। যদ্দুর জানি, এমআইটি থেকে অর্থনীতিতে প্রথম বাঙালী ডক্টরেট তিনি। স্যামুয়েলসনের ছাত্র ছিলেন ড. আখলাক। তিনি বললেন, ওখানে এবং হার্ভাডে অর্থনীতিতে ডক্টরেট করতে গেলে করার যোগ্যতা নিরুপিত হয় স্যামুয়েলসনের লেখা স্নাতকপূর্ব পর্যায়ে পাঠ্য হিসেবে লেখা 'অর্থনীতি' (ইকোনমিক্স) বইয়ের সার সংপে অনুধাবন ও উপস্থানপনার সমতায়। তখন পর্যন্ত আমাদের অর্থনীতি পড়ার বিস্তৃতি ছিল বেনহ্যাম, শুমপেটার, মার্শাল, (জোয়ান) রবিনসন, স্টিগলার, কেইনস ও লুইসকে ঘিরে। এদের বইগুলো ভারি, উপস্থাপনা গম্ভীর, বিষয়ের প্রতি সহজ আকর্ষণে এবং অর্থনীতির সকল উপবিষয় সমন্বিত করণে এবং দৃষ্ট আর্থ-সামাজিক সমস্যাদির সমাধান আনয়নে প্রায় অম। তারপর পড়লাম স্যামুয়েলসনের 'অর্থনীতি'- বিশ্ববিখ্যাত ইকোনমিক্স। দেখলাম, সোজা, সরল কথকতায় সুবিন্যস্ত ও সমন্বিতভাবে অর্থনীতি সূত্রগুলো তথাকথিত বিষাদ-বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে কেমন করে বোধগম্য এবং সমাজের কার্যক্রমে প্রযোজ্য হাতিয়ার হিসেবে জ্বল জ্বল করে ফুটে উঠেছে। দেখলাম কবিতা, উপন্যাস, অন্যান্য বিষয়ের নির্যাসমূলক কথাগুলো পরিপার্শি্বকতার আলোকে এবং আর্থ-সামজিক সমস্যাদি সমাধান ও জনগণের উন্নয়নে কিরূপ সুচারু ও বাস্তবায়নীয় অবয়বে অর্থ ও সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে। ১৯৬২ তে হার্ভাড থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করে সদ্য ফেরত ড. আনিসুর রহমান (বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য) অন্যান্য বিষয়ে অনুশীলনের আপেকিতায় অর্থনীতির চর্চায় অবিচল এবং অনেকটা পপাতিত্বের অভিযোগ স্বীকার করে বিষয়-প্রেম প্রতিফলনে অর্থনীতিতে হার্ভাড থেকে প্রথম বাঙালী পিএইচডি ড. নুরুল ইসলামের (বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান) অবাক স্মিত হাসির মুখে বলে ফেললেন : হঁ্যা আমরা সমাজকে অন্যদের চেয়ে বেশি চিনি, ভাল জানি, কেননা আমরা অর্থনীতি পড়েছি। অর্থনীতিতে স্যামুয়েলসনের মতো বই, জানার ভিত্তি, অন্যকোন বিষয়ে আছে কি? উঠতি অর্থনীতিবিদ মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ (সাবেক রাষ্ট্রদূত, এখন সাংসদ), শামসুল আলম (সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব) ও আমি ডা. আনিসুর রহমানসহ তখনকার দিনে প্রায় প্রতি রোববারে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় মিলিত হতাম। একদিন অর্থনীতির এক জার্নালে এক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদের মৃতু্যতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয়ীদের তরফ হতে স্যামুয়েলসনের লেখা জীবনান্তিকা পড়তে যেয়ে ড. আনিস ও আমরা উপলব্ধিতে অবাক হয়ে গেলাম। সেই অর্থনীতিবিদ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। স্যামুয়েলসন লিখেছেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একমাত্র অবদান : আগ্রাসন ও হত্যার ঐ মহাযজ্ঞ তাকে জীবিত অবস্থায় নিরাপদে ফিরিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধ ধ্বংস ও হিংসার এরূপ বৈশিষ্ট্যায়ন অন্যকোন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ করেছেন কিনা আমার জানা নেই।
স্যামুয়েলসনের অর্থনীতি ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। স্যামুয়েলসন তখন এমআইটিতে অর্থনীতির অধ্যাপক। পৃথিবীব্যাপী অর্থনীতি শেখার মৌলপাঠ হিসাবে প্রায় প্রতি বছর মুদ্রনের বাইরে ১৯৯২ পর্যন্ত পরপর ১৪ বার তিনি এর সংস্করণ বের করেছেন। প্রতি সংস্করণেই বিজ্ঞান হিসাবে অর্থনীতির বিবর্তনের আলোকে তিনি পাঠ সংশোধন ও পরিবর্তন করেছেন। ৪০টি ভাষায় স্যামুয়েলসনের অর্থনীতির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হওয়ার ৫০ বছর পরেও প্রতি বছর এক যুক্তরাষ্ট্রেই ৫০ হাজারেরও বেশি এই পাঠ্যপুস্তকটি বিক্রি হয়েছে। ধর্মগ্রন্থ ছাড়া পাঠ্যপুস্তক হিসাবে এর চেয়ে বেশি সংখ্যায় অন্য কোন বই ছাপা বা বিক্রি হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। স্যামুয়েলসনের এই পাঠ্যপুস্তকের জাপানী অনুবাদক শিগতো তসুরু তাঁর অনুবাদের পারিতোষিক দিয়েই অর্থনীতিতে কৃতবিদ্যদের বাসের জন্য টোকিওর মতো দুমর্ূল্য নগরে অতিথি ভবন বানাতে পেরেছিলেন। শোনা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের যোশেফ স্টালিনও অর্থনীতির েেত্র সমাজতান্ত্রিক সফলতার প্রচারের রথে থেকেও স্যামুয়েলসনের অর্থনীতি সে দেশের গণগ্রন্থাগারসমূহে অনুমোদিত পাঠকদের জ্ঞান আহরণের ল্যে সরকারী কার্যক্রমকে সহায়ক শক্তিরূপে মুক্তবাজার ব্যবস্থার প্রয়োগের তাত্তি্বক সারথী হিসাবে এই পাঠ্যপুস্তকটি রাখতে বলেছিলেন। উল্লেখ্য, অর্থনীতির প্রথম পর্যায়ের সংস্করণে স্যামুয়েলসন অর্থনৈতিক চিন্তার বিবর্তনের ইতিহাসে কাল মার্কসকে কালো মেষ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবতর্ী পর্যায়ের সংস্করণে এই কট্টর অবস্থান থেকে তিনি সরে এসে তাঁকে অর্থনীতির বিশাল পুরুষ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৯২ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, এমআইটির পিএইচডি এবং তাঁর ছাত্র উইলিয়াম নর্ডহাউসের সাথে যুগ্মভাবে অর্থনীতি প্রকাশ করে স্যামুয়েলসন যোগ্য নবীনকে কৃতবিদ্য প্রবীণের যৌক্তিক উত্তরাধিকারী হিসাবে সম্মানিত করেছেন।
স্যামুয়েলসন ১৯৭০ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। অর্থনীতিতে তিনিই প্রথম আমেরিকান নোবেল বিজয়ী। নোবেল তাঁকে দেয়া হয়েছিল ১৯৪০ সালে তাঁর লেখা পিএইচডি অভিসন্দর্ভ (থিসিস), অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের বুনিয়াদ (ফাউন্ডেশন অব ইকোনমিক এনালাইসিস) এর জন্য। নোবেল কমিটি তাঁকে এই সম্মান দেয়ার সময়ে উল্লেখ করেছিলেন যে স্যামুয়েলসন মূলত এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে অংকের শৃক্মখলা ও সুস্পষ্টতা দিয়ে অর্থনীতিকে কেবল অর্থনৈতিক ইসু্যর আলোচনা থেকে সমাজের সামনে দাঁড়ানো সমস্যা সমাধানে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। গত ৬০ বছরের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও চিন্তার বিবর্তনের আলোকে তাঁর মৃতু্যর পর তর্কাতীতভাবে একথা আমরা তাঁর গুণগ্রাহীরা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করেছি এই অর্ধশতাব্দী ধরে অর্থনীতিকে জ্ঞান চর্চা ও প্রয়োগের বিষয় ও মাধ্যম হিসাবে গড়ে তোলার েেত্র ও ল্যে স্যামুয়েলসনের মতো বিস্তৃত ও গভীর অবদান অন্য কোন অর্থনীতিবিদ রাখতে সম হননি। ১৯৩০ দশকের জেএম কেইনসের পর কেইনসীয় দর্শনের অনুসারী হয়েও মুক্তবাজার ও উদ্যমের এত সাবলীল ও সম প্রবক্তা হিসাবে অন্যকোন অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসনের চেয়ে অধিকতর দীপ্তমান ও সফল হতে পারেননি। নব্য ধ্রপদী অর্থনীতির মিশ্রণে (নিউ কাসিকাল সিনথেসিস) এর মাধ্যমে স্যামুয়েলসন রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বিশ্লেষণকে নতুন রূপ, পরিচিতি ও দীপ্ত প্রযুক্ততা দিয়েছেন। অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে বলতে দ্বিধা নেই, স্যামুয়েলসনের অবিসংবাদিত পাঠ অর্থনীতি ও অসংখ্য বিভিন্ন লেখা থেকে যা শিখেছি ও জেনেছি তা অন্য কোন একক অর্থনীতিবিদের পাঠ ও লেখা থেকে শিখতে ও জানতে পারিনি। স্যামুয়েলসনের জন্ম ১৯১৫ সালের ১৫ মে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার গ্যারি শহরে এক ইহুদি পরিবারে। পূর্ব পুরুষগণ পোল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন। শিকাগোর হাইড উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। অংকের প্রতি তাঁর আগ্রহ তখন থেকেই দেখা দিয়েছিল। টমাস মালথ্যাসের জনসংখ্যা ও দারিদ্র্য বিষয়ক চিন্তা তাঁকে অর্থনীতির শিা ও চর্চার দিকে আকৃষ্ট করে। শিকাগো থেকে স্নাতক হয়ে ১৯৩৫ সালে তিনি হার্ভাডে চলে আসেন। হার্ভাডে পড়ার সময়ে অধ্যাপক আলভিন হানসেন ১৯৩০-এর মহামন্দার পটে তাঁকে কেইনসীয় অর্থনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি টেনে আনেন। অধ্যাপক জোসেফ শুমপেটার তাঁকে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও ভাবধারার বিবর্তন অনুশীলনে উৎসাহিত করেন। হার্ভাড থেকে ১৯৩৬ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ও ১৯৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। একমাস প্রথম ধাপের প্রশিক হিসাবে হার্ভাডে কাজ করার পর অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসাবে পাশর্্ববতর্ী এমআইটি তাঁকে লুফে নেয়। এরপর এমআইটি তাঁকে অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেয়নি। ১৯৩৮ সালে তাঁর হার্ভাডের সহ ছাত্রী মেরিয়ন ক্রফর্ডের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে এমআইটি তে যুদ্ধ বিমান চালনায় কম্পিউটার প্রযুক্তি উন্নয়নে অংকের প্রয়োগ করতে গবেষণার প্রক্রিয়া ও পথ প্রদর্শন করেন তিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে সরকারের যুদ্ধ উৎপাদন বোর্ডের পরামর্শকের ভূমিকায়ও তিনি অংক ভিত্তিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আগ্রাসন, প্রতিরণ এবং তৎপরতার গতি বাড়ানোর প্রযুক্তিতে উপকরণ হিসাবে ব্যবহারের পথ দেখান। যুদ্ধের পর এমআইটির অর্থনীতি বিভাগকে অর্থনীতি শিা ও চর্চার বিশ্বের অন্যতম সেরা পীঠস্থান হিসাবে তিনি রূপ দিতে থাকেন। এমআইটিতে তাঁর প্রণোদনায় আকর্ষিত হন অনেক প্রতিভাবান শিক ও ছাত্র। এদের মধ্যে ছিলেন ও আছেন অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী জর্জ একারলফ, রবার্ট ইংগল (তৃতীয়), লরেন্স কায়েন, পল ক্রুগমান, ফ্রাংকো মডিগিলিয়ানী, রবার্ট মেরটন, রবার্ট সোলো ও জোসেফ স্টিগলিজ। অর্থনীতির প্রখ্যাত ভারতীয় অধ্যাপক জগদীশ ভগবতী ও পদ্মা দেশাইকে এমআইটিতে অধ্যাপনা ও গবেষণায় প্রণোদিত করেছিলেন স্যামুয়েলসন।
অর্থনীতিতে আর এক নোবেল বিজয়ী তাঁর সহকমর্ী রবার্ট সোলো স্যামুয়েলসন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন : যখন অর্থনীতিবিদরা হিসাব কিংবা বিশ্লেষণ করতে বসেন তখন তাদেরকে স্যামুয়েলসনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বা প্রত্যয় অন্য কেউ দিতে পারেন না। স্যামুয়েলসন তাঁর জীবনকালে যুদ্ধরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কংগ্রেস, অর্থমন্ত্রণালয়, প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কাউন্সিল, বাজেট বু্যরোসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছেন সরকারের ও সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নীতি প্রনয়ন ও বাস্তবায়নে ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছেন। প্রকৃতপ েঅর্থনৈতিক পরামর্শকদের রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার প্রক্রিয়ায় সফলভাবে সংশ্লিষ্ট করার সারথী ছিলেন স্যামুয়েলসন। তাঁর সবচেয়ে নামকরা ছাত্র ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি। অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে করহ্রাসের নীতি যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্যামুয়েলসনই কেনেডির মাধ্যমে গ্রহণ করিয়েছিলেন। শ্রেণীক েস্যামুয়েলসন ছিলেন হাসিখুশি, আমুদপ্রিয় অথচ গভীর বিশ্লেষণমুখী। তাঁর বক্তৃতা, অসংখ্য প্রবন্ধ তাঁর অধ্যাপক জীবনের ভরপুরতার পরিচিতি বহন করে। তাঁর পাঠ্যবই অর্থনীতি বিদেশী, বিশেষত অভিবাসীদের ইংরেজী শেখার পাঠ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থনীতির ১৪তম সংস্করণের অবতরণিকায় স্যামুয়েলসন অর্থনীতি চর্চার কারণ নির্দেশিকার শিরোনাম দিয়েছিলেন হেমিংওয়ের ভাষা দিয়ে : ফর হুম দি বেল টলস। তিনি অর্থনীতির বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করেছেন এই বলে, সবসময় সকল উপকরণিক অংশ যোগ দিলেই পূর্ণাংশের হিসাব মিলে না। তিনি বলেছেন ইতোমধ্যে প্রাপ্ত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থেকে বাইরে এসে অর্থনীতিবিদদের অন্যান্য বিষয়ের নির্যাস নিতে হবে এবং তাদের জন্য নতুনতর ধ্যানধারনাকে দূরে সড়িয়ে রাখা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। আর বলেছেন, পণ্যের বাজার যেমন মুক্ত থাকা প্রয়োজন, তেমনি অাঁতেল বাজার মুক্ত রাখা এবং তার থেকে অবাধে উপযোগ গ্রহণ সমাজ উন্নয়নে সবসময় ল্যানুগ হবে।
এই প্রেেিত তথাকথিত র্যাডিক্যাল অর্থনীতি পর্যালোচনা করে স্যামুলেসন সুইডিশ অর্থনীতিবিদ লীন্ডম্যানের ইতিহাসভিত্তিক অভিজ্ঞান গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, ব্যক্তি উদ্যোগ ও সরকারের ভূমিকা সমকালে সকল অর্থ ব্যবস্থায় পারস্পরিকভাবে সম্পূরক; সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের সংগঠন ছাড়া আমরা কিভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও প্রবৃদ্ধির ল্যে এগুবো? আর মুক্তবাজার ব্যবস্থায় ব্যক্তি উদ্যোগকে তার উদ্ভাবনশীলতার লাভ পাওয়ার এবং ভুলের মাসুল দেয়ার সূত্র থেকে দূরে সরিয়ে কিভাবে মূলধন ও শ্রম বিনিয়োগ করব? স্যামুয়েলসনই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের দৃঢ় বন্ধনে সামষ্টিক অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির তত্ত্বের সাথে একীভূত করেছিলেন, বাজার ব্যবস্থার অপূর্ণাঙ্গতা দূর করার জন্য সরকারের ভূমিকাকে সরব স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। প্রবৃদ্ধির অর্থনীতির জনক অধ্যাপক রোজেনস্টেইন রোডানের কাছে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়েছি তখন তিনি এই কথাটি সুস্পষ্টভাবে আমাদের কাছে তুলে ধরেছিলেন। স্যামুয়েলসন নিজেই তার 'অর্থনীতির' শেষ সংস্করণে অর্থনৈতিক সংগঠনের মূল সমস্যার অবতরণিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫০ দশকের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইসেনহাওয়ারের কথা অপার বিশ্বাসে উল্লেখ করেছেন : তৈরি হওয়া প্রতিটি কামান, সাগরে ভাসানো প্রতিটি যুদ্ধজাহাজ, উৎিেপত প্রতিটি রকেট, চূড়ান্ত অর্থে যারা ুধার্ত ও অভুক্ত তাদের থেকে চুরি করা সম্পদ প্রতিফলিত করে।
স্যামুয়েলসনের একটি তত্ত্ব এখনও আমার কাছে তার পাঠ থেকে গড়ে ওঠা মানস সত্ত্বেও ভ্রান্ত এবং মুক্ত উদ্যোগের দর্শনের বিপরীত বলে মনে হয়। স্টপলারের সঙ্গে যুগ্মভাবে অঙ্কের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গড়ে তোলা স্টপলার-স্যামুয়েলসন থিওরোমে তিনি বলেছেন, দরিদ্র দেশ থেকে অদ শ্রমিক দিয়ে তৈরি পণ্য দ্রব্যাদির মুক্ত আমদানি শিল্পোন্নত দেশের নিম্ন-মজুরির শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে দেবে। জীবনের শেষ প্রান্তে তেমনি তিনি ভ্রান্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই হয়ত বলেছেন : উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত দেশের তি হতে পারে। এই ধরনের কথা তার অর্থনীতিতে প্রাপ্ত তত্ত্ব-রণশীলতা নয়, উৎপাদনশীলতাই আমাদের সকলের সহায়ক_ এর দৃষ্টিকোণ থেকে বিপরীতমুখী বলে মনে হয়।
স্যামুয়েলসনের প্রথম স্ত্রী ম্যারিয়ন ১৯৭৮ সালে মারা যাওযার পর তিনি রিশা কেকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে তার ৬ সন্তানের জন্ম হয়; ম্যারিয়নের মৃতু্যর পর রিশা কেসহ এ সকলকে তারা দু'জনেই লালন করেন। মৃতু্যর সময় তার নাত-নাতনিদের সংখ্যা ছিল ১৫। ছোট নয়, বড় পরিবারই হয়ত তার কাছে সুখী পরিবার ছিল। তার এক ভাই রবার্ট সামার্স পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবরসপ্রাপ্ত অর্থনীতির অধ্যাপক, এখনও জীবিত আছেন। রবার্ট সামার্সের ছেলে লরেন্স সামার্স প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অর্থনৈতিক কাউন্সিলের পরিচালক। স্যামুয়েলসনের প্রিয় খেলা ছিল টেনিস। সারা জীবন তিনি খেলেছেন নিয়ম মতো, কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করে বল কুড়ানো লাইনস্ম্যানদের আঘাত করেননি। টেনিস আমি খেলি, আমার অর্থনীতির সহ ছাত্র বন্ধুরা খেলেন। অন্য সকল কিছু অপরিবর্তনীয় থাকার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের অনুকল্প মন থেকে দূরে সরিয়ে লাইনস্ম্যানদের প্রতিপ বলে আমরা মাঝে মাঝে ভুল করে থাকি। স্যামুয়েলসন অন্য সকল কিছু অপরিবর্তনীয় মনে করে বিশ্লেষণ করার অপূর্ণাঙ্গতার বিষয়ে সকল শিাথর্ীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেও অর্থনীতির প্রথাগত এই অনুকল্পকে অযথা আঘাত করেননি, বরং তার পথে এই অনুকল্পের অনুসারীদের অনুগামী করতে নিরবধি চেষ্টা করেছেন।
পল স্যামুয়েলসন মুক্তবুদ্ধির দীপ্ত চর্চার পরিবেশে নিজকে বিকশিত করেছেন। অর্থব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা স্বীকার ও পাঠ্যবইয়ে এই তত্ত্বকে যথার্থ স্থান দেয়ার কারণে ১৯৫০-এর দশকের কমু্যনিজমের কট্টর বিরোধী সিনেটর ম্যাকার্থির দাপটকালে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ার্ত রণশীল পরিবেশে একবার গুঞ্জন উঠেছিল যে কতর্ৃপ, সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর প্রণীত অর্থনীতি সেন্সর করবে। একথা শুনে স্যামুয়েলসনের এক গুণগ্রাহী এমআইটির তৎকালীন সভাপতি কার্ল ক্রমটনকে দিয়ে বইটি সেন্সর করার আশংকা প্রকাশ করেন। উত্তরে সভাপতি ক্রমটন বলেছিলেন, যে দিন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিককে বলা কিংবা লেখার জন্য কোন কতর্ৃপরে বাধা নিষেধ বা সেন্সরের সামনে দাঁড়াতে হবে সেদিন তিনিই পদত্যাগ করবেন।
স্যামুয়েলসনের মৃতু্যর পরদিন ডিসেম্বর ১৪-এর পড়ন্ত বিকেলে ক্যামব্রিজের লাগোয়া নিউটনে সেই চার্লস নদীর ডান পাড় ধরে আমি হাঁটছিলাম। নদীর দুধারে জমে ওঠা সাদা বরফ। বিষণ্ন আকাশ থেকে তুলোর কবোষ্ণতা নিয়ে ঝরছে বরফ আর তার নিচে তিরতির করে বইছে চার্লস। তখনও জমে যায়নি তার প্রবাহ। স্যামুয়েলসন নিশ্চয়ই কোন না কোন দিন এমআইটি থেকে বেরিয়ে চার্লস নদী ধরে হেঁটেছেন, মুক্ত পরিবেশে, নিমের্াহ অনুশীলন এবং অবাধ বলা ও লেখার মুক্ত বাতাবরণে নিজের চিন্তার অনুভূতি ও মতাদর্শ প্রকাশ করার পরিধিকে নিশ্চত অধিকার হিসাবে সবলে এগিয়ে গেছেন। এমআইটির সভাপতি কার্ল ক্রমপটন তাঁর চিন্তা, চলা ও চর্চার স্বাধীনতার অনুকূলে যে মুক্তির মূল্যবোধ নিয়ে দৃঢ় প্রতিরণের অতন্দ্র বর্ম ধরে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর প্রয়োগের প্রকৃতি, গতি ও বিস্তৃতি নিয়ে ভাবনা এসে নাড়িয়ে যাচ্ছিল আমায়। এই মূল্যবোধ নিয়ে আমরা কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহকে গড়ে তুলতে পেরেছি? স্বৈরতন্ত্র যে মুক্তবুদ্ধি এবং জ্ঞান বিকাশক পরিবেশ সৃষ্টি ও রা করতে অম, স্যামুয়েলসনের সারা জীবনের সাধনা ও বিকাশ এবং অর্জিত সফলতা তাই প্রমাণ করে গেছে। আমাদের শিা জগতের স্বঘোষিত দিকপালরা যখন তাদের পেশাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিংবা বিগলিত হাসি নিয়ে অধিক প্রাপ্তির লালসায় স্বৈরতন্ত্রের প্রতিভু কিংবা নায়কদের আতেল সমতার কষ্টদায়ক উপস্থাপনায় কিংবা লেখক হিসাবে প্রচারণার হাস্যকর অপচেষ্টার সহজ সহযোগী হন তখন হয়ত তাঁরা জ্ঞান জগতের অবিস্মরনীয় দিকপাল পল এন্থনী স্যামুয়েলসন কিংবা তার সহযোগীদের মূল্যবোধে দীপ্ত ভূমিকা মনে রাখেন না । রাখার সময় এখন এসেছে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য
No comments