মত ও মন্তব্য-বইমেলা, বাঙালির সৃজনশীলতা by হারুন হাবীব
চিন্তাশক্তির সৃজনশীলতা বাঙালিকে বৈশিষ্ট্য দান করেছে। বাঙালি শিল্পমনস্ক, সৃজনশীল এবং সৌন্দর্যপ্রিয়। এসব বৈশিষ্ট্যতার জন্য বিশ্বের জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বাঙালির সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি আছে। শিল্পকলার নানা শাখায় এ জাতির পদচারণ বহুকাল।
মৃৎশিল্প, টেরাকোটা, সুচশিল্প, জারি সারি গান, পুঁথিকাব্য আর গীত ও ভাটিয়ালি বঙ্গের আদি সমাজের সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তির সাক্ষ্য বহন করে। প্রায় ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ এসে সদম্ভে এবং সংগতভাবে বিশ্ব কাঁপিয়ে দিলেও রবীন্দ্র-পূর্ব ও রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে শিল্প-সাহিত্যচর্চা থেমে থাকেনি। ভালোলাগার বিষয় যে বঙ্গভূমি ভাগ হয়ে নতুন সীমান্তরেখায় বিভাজিত হওয়ার পরও এপার-ওপারের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত সৃজনশীলতা অব্যাহত আছে। এর বাইরেও আছে ত্রিপুরা ও আসামের বাংলাভাষী অঞ্চলে । গদ্য-পদ্য, কলম-তুলি, মন ও কণ্ঠে বাংলাভাষী মানুষের সৃজনশীল অন্বেষণ বহুগুণ বেড়েছে। সাহিত্য, সংগীত, নাট্যকলা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র ও চিত্রশিল্পে সে অন্বেষণ ব্যাপক সম্প্রসারণ লাভ করেছে। বাড়াটা আনন্দের, কিন্তু বাড়াবাড়ি কখনো আনন্দের হয় না। এ ক্ষেত্রে খাঁটি শিল্প এবং শিল্পী, সত্যিকার সাহিত্য ও শিল্পকলা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রায় সব অঙ্গনের মতোই শিল্প-সাহিত্যে একশ্রেণীর অনুপ্রবেশকারী সৎ ও সত্যের, ভালো ও মন্দের তফাত ঘুচিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই এ অভিযোগ সংগত হয়তো নয়, কিন্তু কারো কারো হাতে সত্য ও সুন্দরের সৃজনশীল অঙ্গনটি বাণিজ্যিক বা বাজারে অঙ্গনে পরিণত হয়েছে। সাহিত্য বা শিল্প হয়ে উঠেছে বাজারের পণ্য_যেন বিপণন বা কাটতি বাড়াতেই এর নির্মাণ! বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি নিঃসন্দেহে এক বড় সংকট। ব্যবসা ও চাকচিক্যের নতুন জগতে, বাণিজ্যিকীকরণের নতুন এ জমানায় ট্রেড ও ট্রেডিংয়ের আগ্রাসনকে পরাভূত করা সহজ কাজ নয়। এর পরও বলা যায়, সাহিত্য ও শিল্পকলা যেহেতু বাজারের দাবি পূরণ করে না, করে মন ও মননের, সেহেতু খাঁটি ও মেকির পার্থক্য খুঁজে পাওয়া জরুরি। আমার বিশ্বাস, খাঁটি ও মেকির বাজারে সাহিত্য-শিল্পকলার সঙ্গে খাঁটির তফাতটা বড় করে দেখার চেষ্টাই এখনকার বড় কাজ। বাংলা একাডেমীতে মহান একুশের বইমেলা বাঙালি সংস্কৃতির একটা বড় উপলক্ষ। সত্তরের দশকের শেষ দিকে শুরু হয়ে ক্রমান্বয়ে শুধু বড় নয়_বইমেলা জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ আজ। প্রতিবছর দর্শনার্থীর স্রোত বেড়ে চলেছে। ব্যবসার প্রয়োজনে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। বেড়ে উঠেছে লেখকের সংখ্যা। এ ব্যাপকতার পেছনে একদিকে আছে বাঙালির সৃজনশীলতার অন্বেষণ, কেউ চাই বা না চাই, অন্যদিকে সম্প্রসারিত হয়েছে শুধুই বাজার বা বিপণনের লক্ষ্যে বইয়ের প্রকাশ। বই হয়ে উঠেছে নিছক পণ্য!
স্থান সংকুলান ও ব্যবস্থাপনাসহ নানা সীমাবদ্ধতা আছে বইমেলার। এর পরও বলতে হবে বইমেলা ক্রমেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে। এবারের মেলায় প্রকৃত বইপ্রেমীরা একটু সময় নিয়ে বই খোঁজার সুযোগ পেয়েছেন বলে শুনতে পেয়েছি। স্টলে স্টলে ঘুরে তাঁরা বই কিনছেন, প্রিয় লেখকের বইটি কবে আসছে_এমন ধারণাও নিতে পারছেন। এটি কম সুবিধার কথা নয়। বইয়ের প্রচ্ছদ আর রং দেখে প্রকৃত বইপ্রেমীরা বই কেনেন না, যদিও আমাদের চিরাচরিত রীতিতে বহুলাংশেই সেভাবে বইয়ের বিক্রি হয়ে আসছে। পাশ্চাত্যের বইমেলাগুলোতে দেখেছি, যেকোনো বইয়ের পরিচিতির পেছনে প্রকাশকদের যেমন বিনিয়োগ থাকে, থাকে পরিকল্পিত শ্রম ও প্রস্তুতি। ক্যাটালগ বানিয়ে, তালিকা তৈরি করে এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে বইকে পরিচিতি দেওয়ার কাজটি তাঁরা ব্যবসার স্বার্থেই করে, যাতে ক্রেতা প্রকাশিতব্য বইটি সম্পর্কে সম্যকজ্ঞান নিতে পারে এবং এ কাজটি করা হয় অনেক আগে থেকে। ব্যাপারটি আমাদের প্রকাশকরা খুব একটা নজরে আনেন বলে মনে হয় না। অন্তত সব প্রকাশক তো নয়ই। এর পরও বলতে হয়, পরিচিতির জন্য বই বিজ্ঞাপিত হওয়ার দাবি রাখলেও বই নিছক কোনো বিক্রিযোগ্য পণ্য নয়। কারণ বই মানুষের মন ও মননের দাবিকে পূরণ করে।
বাংলা একাডেমীর বইমেলার ঐতিহ্য যেমন আছে, তেমনি আছে জাতীয় জীবনে এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। এ বইমেলা ঘিরে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা শানিত হয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান হয়। ভাবতে ভালো লাগে যে বাংলা একাডেমীর বইমেলা উপলক্ষ করে ক্রমেই বাঙালির দার্শনিকতা, মন ও মননের উত্তরোত্তর চর্চা হচ্ছে, বিকশিত হচ্ছে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে এক মাস প্রকাশনা শিল্পে নতুন করে রক্ত সঞ্চালিত হয়। এ ধারাকে যত বেগবান করা যায় ততই মঙ্গল। বইমেলা নিয়ে অনেক অভিযোগের মধ্যে পাইরেটেড ও নোট বই বিক্রির অভিযোগ লেগেই আছে। শুনেছি এবারের মেলায় সংকটটি বেশ শক্ত। মেলার নীতিমালায় রয়েছে পাইরেটেড, নোট বই এবং এক প্রতিষ্ঠানের বই আরেক প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু বিক্রি করা হচ্ছে বলে বহু লেখক-প্রকাশকই অভিযোগ করেছেন। অনেকেরই অভিযোগ, নীতিমালা মেনে চলা হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বইমেলা যেন বইয়ের মেলা নেই। বিভিন্ন ধরনের ক্যাসেট-সিডি থেকে শুরু করে মুড়ি-মুড়কি, নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালির জিনিসপত্র, খেলনা_সবই দেদার বিক্রি হচ্ছে। স্থায়ী স্টলে প্যাভিলিয়ন বসেছে ফুচকার। অন্যান্য বছর এসবের বিরুদ্ধে দৈনন্দিন পুলিশি অভিযান আর নীতিমালার ব্যাপারে মেলা কমিটি বা কপিরাইট সংস্থার অভিযান চলত। কিন্তু এবার কর্তৃপক্ষের নাকি কোনো খেয়াল নেই।
মেলা অঙ্গনে নীতিমালা লঙ্ঘনসহ সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমীকে অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে। অনেক প্রকাশক বলেছেন, মেলায় যা ঘটছে তা রীতিমতো দুঃখ ও উদ্বেগজনক। অনেকে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখছেন। আরো একটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। মেলার নীতিমালায় দেশীয় বই ছাড়া বিদেশি বই রাখার নিয়ম নেই। এ নীতি খারাপ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশি বই পাবে কোথায় আমাদের পাঠক? এর একটা সুরাহা খোঁজা উচিত। বাংলাদেশে বইয়ের প্রকাশনার জগৎটি দিন দিন বিস্তার লাভ করছে; কিন্তু বাংলাদেশে বই বিক্রয়ের জায়গাগুলো অদৃশ্য হয়ে আছে! ষাট বা সত্তরের দশকের নিউ মার্কেটের বইপাড়া আজ ধূসর স্মৃতি। স্টেডিয়ামপাড়ায় একদা বইয়ের দোকান ছিল। একালের আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের ব্যবসা হার মানছে পরাক্রান্ত কুটির শিল্পের কাছে। এসব বিবেচনা করে বিদেশি বই প্রকাশ বা বিক্রির ব্যবস্থা বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রকাশনা শিল্পের নানা সংকট এখন। তীব্র প্রতিযোগিতাও। পুস্তক প্রকাশনা ও বিপণন রীতিমতো কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে। এটি বিশ্বব্যাপী। প্রতিযোগিতামূলক বর্তমান বিশ্বে মুদ্রিত বই যথেষ্ট সংকটে। মুদ্রিত বইয়ের শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে এসে গেছে ই-বুক, অডিও বুক! আর আছে নিত্যনতুন যান্ত্রিক কৌশল। তার পরও বইয়ের প্রকাশনা অব্যাহত আছে। ব্যাপারটা অনেকখানিই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতিযোগিতার মতো। এত কিছুর পরও আমাদের দেশে, এমনকি ভারতের মতো সুবিশাল রাষ্ট্রেও প্রিন্ট মিডিয়ার কদর কমেনি। আমার বিশ্বাস, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা বা চাকচিক্য যতই থাক_মুদ্রিত বইয়ের কদর কমার সুযোগ নেই। বিদেশের মাটিতে বইমেলায় যাওয়াটা একটি সুখকর অভিজ্ঞতা। কে কতটা বই কিনল বা কিনল না, তার চেয়ে বড় জাগতিক জীবনের নানা সংকট থেকে কিছুটা সময় প্রশান্তিতে কাটাতে পারা যায়। সাধারণ পণ্যের বাজারের মতো হৈচৈ নেই। বই এবং হৈচৈ একসঙ্গে থাকে না। বাংলা একাডেমীর বইমেলার এত প্রাপ্তির পরও মাঝেমধ্যে মনে হয়_এ বইমেলাটি অজান্তেই হৈচৈয়ের মেলায় পরিণত হয়ে পড়ছে কি না! যদি হয়, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযোদ্ধা
hh1971@gmail.com
বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রায় সব অঙ্গনের মতোই শিল্প-সাহিত্যে একশ্রেণীর অনুপ্রবেশকারী সৎ ও সত্যের, ভালো ও মন্দের তফাত ঘুচিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই এ অভিযোগ সংগত হয়তো নয়, কিন্তু কারো কারো হাতে সত্য ও সুন্দরের সৃজনশীল অঙ্গনটি বাণিজ্যিক বা বাজারে অঙ্গনে পরিণত হয়েছে। সাহিত্য বা শিল্প হয়ে উঠেছে বাজারের পণ্য_যেন বিপণন বা কাটতি বাড়াতেই এর নির্মাণ! বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি নিঃসন্দেহে এক বড় সংকট। ব্যবসা ও চাকচিক্যের নতুন জগতে, বাণিজ্যিকীকরণের নতুন এ জমানায় ট্রেড ও ট্রেডিংয়ের আগ্রাসনকে পরাভূত করা সহজ কাজ নয়। এর পরও বলা যায়, সাহিত্য ও শিল্পকলা যেহেতু বাজারের দাবি পূরণ করে না, করে মন ও মননের, সেহেতু খাঁটি ও মেকির পার্থক্য খুঁজে পাওয়া জরুরি। আমার বিশ্বাস, খাঁটি ও মেকির বাজারে সাহিত্য-শিল্পকলার সঙ্গে খাঁটির তফাতটা বড় করে দেখার চেষ্টাই এখনকার বড় কাজ। বাংলা একাডেমীতে মহান একুশের বইমেলা বাঙালি সংস্কৃতির একটা বড় উপলক্ষ। সত্তরের দশকের শেষ দিকে শুরু হয়ে ক্রমান্বয়ে শুধু বড় নয়_বইমেলা জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ আজ। প্রতিবছর দর্শনার্থীর স্রোত বেড়ে চলেছে। ব্যবসার প্রয়োজনে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। বেড়ে উঠেছে লেখকের সংখ্যা। এ ব্যাপকতার পেছনে একদিকে আছে বাঙালির সৃজনশীলতার অন্বেষণ, কেউ চাই বা না চাই, অন্যদিকে সম্প্রসারিত হয়েছে শুধুই বাজার বা বিপণনের লক্ষ্যে বইয়ের প্রকাশ। বই হয়ে উঠেছে নিছক পণ্য!
স্থান সংকুলান ও ব্যবস্থাপনাসহ নানা সীমাবদ্ধতা আছে বইমেলার। এর পরও বলতে হবে বইমেলা ক্রমেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে। এবারের মেলায় প্রকৃত বইপ্রেমীরা একটু সময় নিয়ে বই খোঁজার সুযোগ পেয়েছেন বলে শুনতে পেয়েছি। স্টলে স্টলে ঘুরে তাঁরা বই কিনছেন, প্রিয় লেখকের বইটি কবে আসছে_এমন ধারণাও নিতে পারছেন। এটি কম সুবিধার কথা নয়। বইয়ের প্রচ্ছদ আর রং দেখে প্রকৃত বইপ্রেমীরা বই কেনেন না, যদিও আমাদের চিরাচরিত রীতিতে বহুলাংশেই সেভাবে বইয়ের বিক্রি হয়ে আসছে। পাশ্চাত্যের বইমেলাগুলোতে দেখেছি, যেকোনো বইয়ের পরিচিতির পেছনে প্রকাশকদের যেমন বিনিয়োগ থাকে, থাকে পরিকল্পিত শ্রম ও প্রস্তুতি। ক্যাটালগ বানিয়ে, তালিকা তৈরি করে এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে বইকে পরিচিতি দেওয়ার কাজটি তাঁরা ব্যবসার স্বার্থেই করে, যাতে ক্রেতা প্রকাশিতব্য বইটি সম্পর্কে সম্যকজ্ঞান নিতে পারে এবং এ কাজটি করা হয় অনেক আগে থেকে। ব্যাপারটি আমাদের প্রকাশকরা খুব একটা নজরে আনেন বলে মনে হয় না। অন্তত সব প্রকাশক তো নয়ই। এর পরও বলতে হয়, পরিচিতির জন্য বই বিজ্ঞাপিত হওয়ার দাবি রাখলেও বই নিছক কোনো বিক্রিযোগ্য পণ্য নয়। কারণ বই মানুষের মন ও মননের দাবিকে পূরণ করে।
বাংলা একাডেমীর বইমেলার ঐতিহ্য যেমন আছে, তেমনি আছে জাতীয় জীবনে এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। এ বইমেলা ঘিরে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা শানিত হয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান হয়। ভাবতে ভালো লাগে যে বাংলা একাডেমীর বইমেলা উপলক্ষ করে ক্রমেই বাঙালির দার্শনিকতা, মন ও মননের উত্তরোত্তর চর্চা হচ্ছে, বিকশিত হচ্ছে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে এক মাস প্রকাশনা শিল্পে নতুন করে রক্ত সঞ্চালিত হয়। এ ধারাকে যত বেগবান করা যায় ততই মঙ্গল। বইমেলা নিয়ে অনেক অভিযোগের মধ্যে পাইরেটেড ও নোট বই বিক্রির অভিযোগ লেগেই আছে। শুনেছি এবারের মেলায় সংকটটি বেশ শক্ত। মেলার নীতিমালায় রয়েছে পাইরেটেড, নোট বই এবং এক প্রতিষ্ঠানের বই আরেক প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু বিক্রি করা হচ্ছে বলে বহু লেখক-প্রকাশকই অভিযোগ করেছেন। অনেকেরই অভিযোগ, নীতিমালা মেনে চলা হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বইমেলা যেন বইয়ের মেলা নেই। বিভিন্ন ধরনের ক্যাসেট-সিডি থেকে শুরু করে মুড়ি-মুড়কি, নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালির জিনিসপত্র, খেলনা_সবই দেদার বিক্রি হচ্ছে। স্থায়ী স্টলে প্যাভিলিয়ন বসেছে ফুচকার। অন্যান্য বছর এসবের বিরুদ্ধে দৈনন্দিন পুলিশি অভিযান আর নীতিমালার ব্যাপারে মেলা কমিটি বা কপিরাইট সংস্থার অভিযান চলত। কিন্তু এবার কর্তৃপক্ষের নাকি কোনো খেয়াল নেই।
মেলা অঙ্গনে নীতিমালা লঙ্ঘনসহ সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমীকে অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে। অনেক প্রকাশক বলেছেন, মেলায় যা ঘটছে তা রীতিমতো দুঃখ ও উদ্বেগজনক। অনেকে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখছেন। আরো একটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। মেলার নীতিমালায় দেশীয় বই ছাড়া বিদেশি বই রাখার নিয়ম নেই। এ নীতি খারাপ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশি বই পাবে কোথায় আমাদের পাঠক? এর একটা সুরাহা খোঁজা উচিত। বাংলাদেশে বইয়ের প্রকাশনার জগৎটি দিন দিন বিস্তার লাভ করছে; কিন্তু বাংলাদেশে বই বিক্রয়ের জায়গাগুলো অদৃশ্য হয়ে আছে! ষাট বা সত্তরের দশকের নিউ মার্কেটের বইপাড়া আজ ধূসর স্মৃতি। স্টেডিয়ামপাড়ায় একদা বইয়ের দোকান ছিল। একালের আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের ব্যবসা হার মানছে পরাক্রান্ত কুটির শিল্পের কাছে। এসব বিবেচনা করে বিদেশি বই প্রকাশ বা বিক্রির ব্যবস্থা বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রকাশনা শিল্পের নানা সংকট এখন। তীব্র প্রতিযোগিতাও। পুস্তক প্রকাশনা ও বিপণন রীতিমতো কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে। এটি বিশ্বব্যাপী। প্রতিযোগিতামূলক বর্তমান বিশ্বে মুদ্রিত বই যথেষ্ট সংকটে। মুদ্রিত বইয়ের শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে এসে গেছে ই-বুক, অডিও বুক! আর আছে নিত্যনতুন যান্ত্রিক কৌশল। তার পরও বইয়ের প্রকাশনা অব্যাহত আছে। ব্যাপারটা অনেকখানিই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রতিযোগিতার মতো। এত কিছুর পরও আমাদের দেশে, এমনকি ভারতের মতো সুবিশাল রাষ্ট্রেও প্রিন্ট মিডিয়ার কদর কমেনি। আমার বিশ্বাস, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা বা চাকচিক্য যতই থাক_মুদ্রিত বইয়ের কদর কমার সুযোগ নেই। বিদেশের মাটিতে বইমেলায় যাওয়াটা একটি সুখকর অভিজ্ঞতা। কে কতটা বই কিনল বা কিনল না, তার চেয়ে বড় জাগতিক জীবনের নানা সংকট থেকে কিছুটা সময় প্রশান্তিতে কাটাতে পারা যায়। সাধারণ পণ্যের বাজারের মতো হৈচৈ নেই। বই এবং হৈচৈ একসঙ্গে থাকে না। বাংলা একাডেমীর বইমেলার এত প্রাপ্তির পরও মাঝেমধ্যে মনে হয়_এ বইমেলাটি অজান্তেই হৈচৈয়ের মেলায় পরিণত হয়ে পড়ছে কি না! যদি হয়, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযোদ্ধা
hh1971@gmail.com
No comments