ভারত-নতুন করে শুরু করতে হবে মনমোহন সিংকে by কুলদীপ নায়ার

আমি সম্ভবত সেই গুটিকয়েক লোকের একজন, যাঁরা এখনো বিশ্বাস করেন, চলমান অর্থনৈতিক জড়তা থেকে মনমোহন সিং দেশকে বের করে নিয়ে আসতে পারবেন। বিশ্বব্যাংকের দেখানো বর্তমান মডেল আমি পছন্দ করি না। তার পরও গত এক দশকে তিনি ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ থেকে ৯ শতাংশে উন্নীত করেছিলেন।


১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এটাই ছিল সর্বোচ্চ।
সত্যি, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার অবস্থান থেকে তিনি অনেক সরে এসেছেন। সেটা ছিল নেহরু-প্রবর্তিত সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজের কাছাকাছি চিন্তা, এই চিন্তার মধ্যে মধ্যপন্থার ঝোঁক ছিল। মনমোহন সিং সে সময় তাঁর সংস্কারচিন্তাকে বাস্তববাদী বলে দাবি করেছিলেন এবং বলেছেন, এটা ভারতের বিশেষ গুণাবলির সঙ্গে মানানসই। কিন্তু, এর পরিণতিতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিপুল ব্যবধান সৃষ্টি হলো। এখন তিনি জনবান্ধব প্রবৃদ্ধির কথা বললেও, বৈষম্য বৃদ্ধির অর্থনীতিই দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে এসেছেন। যদিও ইতিমধ্যে তিনি তাঁর এসব ধারণা পশ্চিমা বিশ্বে তাঁর ভক্তদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে তিনি এখনো ‘গুরু’ বলে বিবেচিত হন।
মনমোহন সিং ভারতের অর্থনীতিকে নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারেন কি না, তা এখনো দেখার বিষয়। যা হোক, এই কাজে তাঁর সামনে অনেক বাধা রয়েছে। তিনি সেই ঈশ্বর, যিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সবকিছুকে ঠিকঠাক করায় তাঁর সুনাম ইতিমধ্যে নষ্ট হয়েছে। বাইরের এবং ভেতরের বিনিয়োগকারীরা এখন বাড়তি ক্ষুধা পূরণের জন্য হামলে পড়ছেন। মূল্যস্ফীতি ব্যাপক এবং রাজস্ব ঘাটতি অপূরণীয়। জনগণও ভর্তুকিতে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, যেকোনো মূল্যবৃদ্ধি তারা হালকাভাবে নিচ্ছে না।
অন্যদিকে, একটা বাধা কিছুটা হলেও কমেছে। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এত দিন কিছু সংস্কার আটকে রাখলেও এখন রাজি হয়েছেন। পেছন থেকে তাঁর দেশ চালানোর মূল্য মনমোহনকে ভালোভাবেই দিতে হয়েছে। সততার যে ভাবমূর্তি তাঁর ছিল, তা হারিয়ে গেছে। কিছু কিছু দুর্নীতির বিষয়ে তিনি চোখ বুজে ছিলেন, সাধারণভাবে এই ধারণা দাঁড়িয়ে গেছে। যেমন ১০ মিলিয়ন রুপির মোবাইল দুর্নীতির (টুজি স্পেকট্রাম) কথা তিনি জানতেন বলে ধারণা করা হয়। এবং এ বিষয়ে তাঁর হস্তক্ষেপ না করা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার হয়ে গেছে। টুজি কেলেঙ্কারির বিষয়টি দেখার জন্য নিয়োজিত মন্ত্রীদের গ্রুপের চেয়ারম্যানের পদ থেকে কৃষিমন্ত্রী শারদ পাওয়ারের পদত্যাগ অবশ্য ইতিবাচক ঘটনা। যদিও তাঁর কাছ থেকে কোনো প্রতিবেদন না পাওয়ার ব্যাপারটা ন্যায্য ও অকলঙ্কিত বলে দেখা হতো।
এই পদত্যাগ এবং প্রণব মুখার্জির বিদায়ও মনমোহন সিংকে নির্ধারিত গতিপথ থেকে সরিয়েছে। যদিও প্রণব মুখার্জি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর থেকে খারাপ করতে পারতেন না। সিংয়ের কাছ থেকে কেবল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটা চালু রাখাই আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু, সেটাও ব্যাহত হয়েছে দেশের কয়েকটি জায়গায় মৌসুমি বৃষ্টি না হওয়ায়। এ ছাড়া, সোনিয়া এখনো তাঁর ঘাড়ের ওপর দিয়ে নজর রেখেছেন।
যখন থেকে অনেকগুলো সমস্যা নিয়ে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন, তখন নিজ দল ও জোটের কাছ থেকে তাঁর প্রতি সমর্থন ও সমঝোতা তিনি আশা করতেই পারেন। এমনকি ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাছেও তিনি সমর্থন আশা করেছেন। বিজেপি অবশ্য সংস্কারের কয়েকটি বিষয়ে তাঁকে সমর্থন দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরেই কিছু কিছু পদক্ষেপের চিন্তা নিয়ে কলহ শুরু হয়ে যায়। সংসদের বাজেট অধিবেশনের সময়ও বিজেপি এই অবস্থানে থাকলেও কিন্তু সেই সুযোগ নিতে কংগ্রেস প্রস্তুত ছিল না।
সত্যিকার সমস্যাটি আসছে কংগ্রেস সরকারের শরিক তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে। এই দলটির নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অস্থিরমতি মানুষ। কার্যত মমতা রাষ্ট্রপতি পদে মনমোহন সিংয়ের নাম বলে তাঁকে অপমানিত করেছেন। সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়ে এসে মমতা এবং সমাজবাদী দলের মুলায়ম সিং যাদব রাষ্ট্রপতি পদে মনমোহনের নাম করে তাঁকে কার্যত লাথি মেরে ওপরে উঠিয়েছেন। সে সময় সোনিয়া গান্ধীর উচিত ছিল, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে জানানো যে, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মনমোহন সিংকে সরানোর প্রশ্নই ওঠে না। তিনি এ বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা ২৪ ঘণ্টা হতে দিয়ে সিংকে আবারও অপদস্থ হতে দিয়েছেন।
আমি জানি না, কেন প্রধানমন্ত্রী যখন-তখন বলে বেড়াচ্ছেন যে, সোনিয়ার ছেলে রাহুল গান্ধীর জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে প্রস্তুত। কংগ্রেসে ২৫ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে সিংয়ের জেনে যাওয়া উচিত ছিল, তাঁকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় ছেলেকে বসানোর সিদ্ধান্ত যখনই সোনিয়া নিন না কেন, এর কোনো ব্যাখ্যাই তিনি তাঁকে দেবেন না। বর্তমানে বিহার ও উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসে অন্তর্কোন্দলের জন্য রাহুলের ভাবমূর্তি পড়তির দিকে। বিধানসভা নির্বাচনের সময় এই দুটি প্রদেশে রাহুল প্রচারণা চালিয়েছিলেন। হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধারের জন্য রাহুলের আরও কিছু সময় লাগবে।
পাশাপাশি, অর্থনৈতিক ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়ার সময় মনমোহন সিংয়ের বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে, সত্যিই তিনি দেশ চালাচ্ছেন। তাঁর উচিত ছিল ‘নকশালদের’ হত্যার ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে প্রকাশ্যে বলা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো যে ব্যাপারে অভিযোগ তুলেছে, নিহত ব্যক্তিরা আসলে ছিল নিরীহ গ্রামবাসী। আসলে, তাঁর উচিত ছিল সরাসরি এ ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে সত্যাসত্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা নেওয়া; কারণ, যেহেতু বিনা কারণে গুলি করায় পুলিশের খ্যাতি রয়েছে। দ্বিধাগ্রস্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম তো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতার জন্য বিখ্যাত।
প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল ভারত ও পাকিস্তানের বন্দীদের বিষয়টিও নিজের হাতে তুলে নেওয়া। কেননা, পাকিস্তান আগেভাগে সর্বজিত সিংকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলেও মুক্তি দিয়েছে সুরজিৎ সিংকে। পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল আমাকে সর্বজিতের মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে টেলিফোনে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের কট্টরপন্থীরা শেষ মুহূর্তে ইসলামাবাদকে সিদ্ধান্তটি বদলাতে বাধ্য করেছে। ব্যাপারটি যদি তা-ই হয়, তাহলে ‘পরিচয় ভুল’ করার এ ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষতিই করেছে। এ জন্যই প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল নিজেই বিষয়টির সুরাহার দায়িত্ব নেওয়া।
এই ঘটনা থেকে একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে যে, উভয় পক্ষই নিজ নিজ হাতে প্রতিপক্ষের বন্দী সদস্যদের নিছক দাবার ঘুঁটি হিসেবেই ব্যবহার করছে। মেয়াদের বেশি সময় তাদের আটকে রাখার মধ্য দিয়ে তারা আসলে অমানবিক খেলা খেলে চলেছে। বন্দীদের বেআইনিভাবে আটকে রাখার জন্য কই কাউকেই তো জবাবদিহি করানো হচ্ছে না, কারও শাস্তিও হচ্ছে না।
খোদ ভারতেই শাস্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অনেককেই বন্দী থাকতে দেখা যায়। যেমন, ১৯৮৪ সাল থেকে জেলে পচতে থাকা শিখ বন্দীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা আমি জানতে চাই। সরকার যদি তৎপরতা দেখাত, তাহলে এত দিনে সেসব বন্দী মুক্তি পেত।
অর্থনৈতিক সংস্কার হয়তো গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের মধ্যে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যে, সরকার ন্যায়পরায়ণ ও জনগণের ভালোমন্দে তাদের যায়-আসে। এই মন্তব্য থেকেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁর কাজ শুরু করতে পারেন।
গালফ নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.