শ্রদ্ধাঞ্জলি-আমিনুলকে যেভাবে দেখেছি by রুবী ইসলাম

এ দেশের চিত্রকলাচর্চার কীর্তিমান পুরোধা পুরুষ শিল্পী আমিনুল ইসলামের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মানুষ আমিনুলকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী রুবী ইসলামের স্মৃতিচারণা ছাপা হলো অনন্তকালের যাত্রায় আমাকে পেছনে রেখে আমিনুলের চলে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হলো।


সহধর্মিণী হিসেবে একান্ত কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। শুধু স্বামী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, আদর্শ হিসেবে, সর্বোপরি শিল্পী হিসেবে। ১৯৬৯ সালে কিছুটা কাকতালীয়ভাবে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। একজন স্বনামধন্য শিল্পী, আরেকজন শিল্পরসিক। প্রদর্শনীতে যেতাম, ছবি দেখতে ভালো লাগত। কতটা বুঝতাম, জানি না। ঘটনাচক্রে সেই শিল্পীর আগমন আমার অফিসে, আলাপ, ভালোলাগা, তারপর বিয়ে তিন মাসের মধ্যে।
মানুষ আমিনুল অত্যন্ত সাদাসিধে উদার মনের অধিকারী, সব রকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। অভিযোগহীন, সবকিছুকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল প্রচণ্ড। ১৯৭০ সালের কথা, ওর সাবেক স্ত্রী ওদের দুই মেয়েকে ওর অজান্তে জার্মানিতে নিয়ে গিয়েছিল। ও জানতই না, বাসায় ফিরে আমাকে শুধু একটি কথা বলেছিল, ‘আই লস্ট মাই টু ডটারস।’ সারা রাত বারান্দায় বসে হাতে সিগারেট, সঙ্গে পানাহার, রেডিওগ্রামে একটি গানই বারবার শুনছিল, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো...’।
ঠিক তেমনি আরেক দুর্ঘটনা ২০০২ সালে। আমাদের একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে ভেতরে ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিল, বাইরে প্রকাশ নেই। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি। রাতে আমি যখন ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম, আমার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিত, মুখে কথা নেই। অত্যন্ত চাপা স্বভাবের মানুষ ছিল। বুঝতে কঠিন হতো।
আমিনুলের আরেক রূপ আমি দেখেছি, যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বসতেন। দেবুদা (দেবদাস চক্রবর্তী), মুর্তজা বশীর, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সাদেক খান প্রমুখ ব্যক্তির সান্নিধ্যে ওর অনর্গল কথা বলা, তর্ক করা, বিষয় ছিল শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি। রাত করে বাড়ি ফিরত, একটিবারও টেলিফোন করত না, অভিমান হতো, মানিয়ে নিয়েছি। শিল্পীরা বোধ হয় এমনই হয়। যাক।
আমিনুল শুধু আমার স্বামীই ছিল না, বন্ধুও বটে। নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম, অকপটে আমার অতীত জীবনের কথা বলে হালকা বোধ করতাম, তেমনি নির্দ্বিধায় আমিনুল ওর প্রবাসজীবনের অনেক গল্প, বান্ধবীদের গল্প আমায় বলেছে। ১৯৬৭ সালে ওর বিবাহ-বিচ্ছেদের পর আমেরিকান বান্ধবী কেরোলিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, স্টে টুগেদার ইত্যাদি। সে সময়ের খাঁজুরাহ সিরিজের ড্রয়িং আমায় দেখিয়েছিল। কতটা নির্ভেজাল মানুষ হলে স্ত্রীকে এসব কথা বলা যায়। এরপর আমি শিল্পী হিসেবে কিছু কথা বলতে চাই, শিল্পী হিসেবে আমিনুলকে মূল্যায়ন করা আমার ধৃষ্টতা। তার জন্য আপনারা রয়েছেন, শিল্পবোদ্ধারা রয়েছেন। শিল্পের প্রতি ওর যে নিষ্ঠা আমি দেখেছি, তা অত্যন্ত নিখাদ। দেশ, সমাজ, রাজনীতি এ সবকিছুর প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল। ওর লেখা শিল্প আন্দোলনের ৫০ বছর বইটি আমি মনে করি, ওর দায়বদ্ধতারই প্রকাশ। প্রচারবিমুখ শিল্পী ছিল। ছবি বিক্রির প্রতিযোগিতায় নিজেকে খাটো করেনি, আমাকে প্রায়ই বলত, যার চাহিদা বেশি, তার অর্থের প্রয়োজনও বেশি। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছে। কাচভাঙা দিয়ে ওর যে প্রতিকৃতি এঁকেছিল, ও বোঝাতে চেয়েছিল মানুষের বিভিন্ন রূপের অভিব্যক্তি, যা সে নিজেও জানে না। আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল।
দীর্ঘ বিবাহিত জীবন কাটাতে গিয়ে অনেক সময় বুঝতে পারিনি ওকে। হোঁচট খেয়েছি, কষ্ট পেয়েছি, অনেক রাত কেঁদেছি, পরে মানিয়ে নিয়েছি মানুষটা যে অন্য রকম। ভাবাবেগ নেই অত্যন্ত বাস্তববাদী আর আমি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। কিন্তু আদর্শে ছিল আমাদের অদ্ভুত মিল, যার ভিত্তিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি ওর আদর্শ, ওর দর্শন নিয়ে।
আমিনুলের কথা লিখতে গিয়ে আমার চোখ সজল হয়ে উঠছে, হাত থেমে যাচ্ছে। ওকে যে আমার ভীষণ প্রয়োজন। ওকে হারিয়ে আমি দিশাহারা। ওকে আমার অনেক অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের উক্তির সঙ্গে একমত, আমিও বলছি, ‘আমিনুল কোনো দিন হারিয়ে যাবে না।’
রুবী ইসলাম
শিল্পী আমিনুল ইসলামের স্ত্রী

No comments

Powered by Blogger.