মাদকাসক্ত স্বামী ও একজন গর্ভবতী স্ত্রীর গল্প by তানজিম আল ইসলাম

মেয়েটি ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ছেলেটিকে। সাধারণ একজন স্ত্রীর মতোই তার দুই চোখে ছিল স্বপ্ন। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে সে। সামান্য কয়েকটি টাকার বিনিময়ে চাকরি করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। নিজে আর স্বামীর আয়-রোজগার যা হয়, তাতে কোনো রকম সংসার চলে যাবে।


খুব স্বপ্ন দেখেছিল, তার ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে পাড়ি দেবে জীবনের কঠিন পথ। বিয়ে হয়ে স্বামীর ঘরে আসে ঠিকই, কিন্তু ধোঁয়ার রাজ্যে যেন অন্ধকার লাগে তার সব কিছু। মেয়েটির মনে সন্দেহ দানা বাঁধে, অবিশ্বাসের ফুল ফোটে যেন তার চোখে। এই কী তার সেই ভালোবাসার মানুষ? কিছুতেই হতে পারে না। এই তো বিয়ের কয়েক দিন আগেও তার স্বামীকে যেমন দেখেছে সে, এই মানুষটার সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক যেন। আকাশ ভেঙে পড়ে তার মাথায়। বিয়ের তিন-চার দিন না যেতেই আবিষ্কৃত হয় তার স্বামীর আসল রূপ। তার স্বামী পুরোদস্তুর মাদকসেবী। কোনো কাজকর্মহীন একটা ছেলে সারা দিন ঘরের মধ্যে পড়ে থাকে আর মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সারা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে সিগারেট আর গাঁজার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে সারাক্ষণ। ইনজেকশন নেয় শিরায়। ইয়াবা সেবন করে নিয়মিত। মেয়েটির ঘরের মধ্যে থাকতে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। সারা দিন অফিস করে এসে সন্ধ্যায় যেন ঢুকে এক অন্ধকার রাজ্যে। মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার স্বামীর দিকে। এই কী সেই মানুষ, যার বিচরণ ছিল শ্বেতশুভ্র? যে ছিল তার সব সুখের উৎস? ভালোবাসার মানুষকে সন্দেহ করেনি ঘুণাক্ষরেও। কিন্তু বিয়ের পর ধরা দিল আসল চেহারা। ছেলেটি মাদকাসক্ত। ছেলেটি বেকার। বাবার নিজের ফ্ল্যাটের ভাড়া থেকে যা পায় তা-ই তার সম্বল। মেয়েটি অনেক বুঝিয়ে বলে মাদক ছেড়ে দিতে। সে বলে, তার দম বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু কিছু বললেই শুরু হয় মানসিক অত্যাচার। এভাবেই কেটে যায় সাত-আট মাস। লোকলজ্জার ভয়ে আত্মীয়স্বজন কাউকে কিছু বলতে পারে না। ঘরে কোনো মেহমান এলেও আসতে দেয় না নানা অজুহাতে, যদি তার অশান্তির কথা জেনে যায় সবাই। মেয়েটি কী করবে বুঝতে পারে না। তার স্বামীকে অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয় না; বরং বাড়তে থাকে দিন দিন এর মাত্রা। এদিকে মেয়েটি অতিষ্ঠ হয়ে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় পৃথক থাকার। মেয়েটি তার মায়ের কাছে সব খুলে বলে। মা তাকে বলে, তার কাছে চলে আসতে। কিন্তু এই কি সমাধান? লোকজন জিজ্ঞেস করলে কী বলবে? কেন সে স্বামীর সঙ্গে থাকে না? কী জবাব দেবে? এই ভেবে আরও কেটে যায় দু-এক মাস। কিন্তু স্বামীর আচরণের পরিবর্তন নেই। দু-একবার চেষ্টা করেছিল মাদকাসক্ত নিরাময়কেন্দ্রে নিয়ে যেতে। কাজ হয়নি। মেয়েটি তার শাশুড়ির কাছে বলে এ অবস্থার কথা। কিন্তু ছেলে যে মায়েরও অবাধ্য অনেক আগে থেকে! দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা বেঁচে নেই। মা থাকে গ্রামে।
মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেটিকে তালাক দেবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মেয়েটি তার বিষয়টি জানিয়ে ‘আইন অধিকার’কে ই-মেইল করে। মেয়েটি জানতে চায়, কীভাবে তালাক দেবে ছেলেটিকে। মেয়েটিকে ফেরত ই-মেইলে জানায় তালাকের কার্যপদ্ধতি। তারপর একদিন মেয়েটির সঙ্গে হয় কথোপকথন। মেয়েটি তখন তার মাদকাসক্ত স্বামীর আচরণের বর্ণনা দিতে থাকে। মেয়েটির ভাষায়, ‘ও আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করত না। যখন তাকে নেশা করতে না করতাম, তখন সে যেন আমাকে চিনতই না। মনে হয়, তার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যেত।’
আপনি কি এর আগে একটুও টের পাননি তার মাদকাসক্তের কথা?
‘না টের পাইনি। সে তখন একটা পার্টটাইম চাকরি করত। বিয়ের তিন মাস আগে নাকি ছেড়ে দেয়। আমি তখন এ বিষয়টিও জানতাম না।’
ছেলেটির আত্মীয়স্বজনকে বলেছিলেন এ কথা?
‘শেষ পর্যন্ত আর উপায় না দেখে তার বোন আর মাকে বলি। তখন তারা বলে যে, ওকে তারা বুঝিয়ে বলবে। আমি নিজেও ওকে নিরাময়কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু এসব একদিন বললে আমার ওড়নায় সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।’
কেন আপনার স্বামী এমন মাদকাসক্ত হলো। কারণ কি বের করেছেন?
‘আমি এর কিছুই জানি না। তবে মাঝেমধ্যে ওর দু-একজন বন্ধু এসে একত্রে নেশা করে। আর ও তো সিগারেট ছাড়া থাকতেই পারে না। সারা দিন ঘরের মধ্যে দরজা-জানালা লাগিয়ে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। অনেক দিন বলেছি আমার খারাপ লাগছে, আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ আকুতির কোনো মূল্যই নেই তার কাছে।’
মেয়েটির সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন সে তার মায়ের বাসায় চলে আসে। সে তালাক চায়, কিন্তু কিছুদিন আগে বুঝতে পারে যে সে মা হতে চলেছে। দেড় মাসের ভ্রূণের অস্তিত্ব তার গর্ভে। এখন সে পড়ে আরেক দুশ্চিন্তায়। এই অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে? একদিকে মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচার, অন্যদিকে তার অনাগত সন্তান। তার স্বামীকে তালাক দিলে এই সন্তান কি পিতৃপরিচয় ছাড়াই বড় হবে? এই চিন্তায় ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু সন্তানকে নিয়ে একজন মাদকাসক্ত লোকের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে বাস করা দুঃসহ। সন্তানের ওপরও নিশ্চয়ই এর প্রভাব পড়বে। কিন্তু সে তো এখন গর্ভবতী। তালাক দিতে চাইলে কীভাবে দেবে, জানতে চাইল। বললাম, গর্ভাবস্থায় তালাক দিলেও তালাক কার্যকর হবে না। সন্তান প্রসবের পর এই তালাক কার্যকর হবে। চাইলে স্বামীকে তালাকের নোটিশ দিতে পারেন। কিন্তু কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে দেখতে হবে যে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে কি না। যদি থাকে তাহলে সরাসরি তালাক দিতে পারবে। কাজির মাধ্যমে তালাকের নোটিশ পাঠাতে হবে স্বামী এবং সিটি করপোরেশনের সালিসি পরিষদ বরাবর। কিন্তু যেহেতু সে গর্ভবতী, তাই এই তালাক কার্যকর হবে না। এখানে ইদ্দতকাল পালন করতে হবে না, অর্থাৎ তালাকের নোটিশ পাঠানোর পর ৯০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে যদি সন্তান জন্মানোর পর আমি তালাক দিই, এটা কি ভালো হয়?’
জবাবে বললাম, হ্যাঁ, তাই করুন।
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, তা-ই করি। যদি আমার স্বামী সন্তানের দিকে তাকিয়ে তার অভিশপ্ত জীবন থেকে ফিরে আসে...।
(সামাজিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে মেয়েটির নাম প্রকাশ করা হলো না)
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.