কানেকটিভিটি-বরিশালে থেকেই প্রতিদিন ঢাকায় অফিস! by অজয় দাশগুপ্ত
পদ্মায় সড়ক ও রেল সেতু নির্মাণের পর বরিশাল অঞ্চলের শিল্প সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে যদি নির্বিচারে কৃষিজমিতে হাত পড়তে থাকে জমির মালিকরা তাতে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে? জনবহুল এ দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পরনির্ভরতার বিপদ আমরা বুঝতে পারি।
নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য দেশের জমিতেই উৎপাদন করতে হবে। এজন্য জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে। বরিশাল অঞ্চলের লোনা পানির জমিতেও যাতে ধান ফলানো যায় সেজন্য বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন বিশেষ ধরনের জাত
দক্ষিণাঞ্চলের কীর্তনখোলা নদীর তীরের বিভাগীয় শহর বরিশালে অবস্থান করেই প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করার স্বপ্ন পূরণ হবে পদ্মায় রেল ও সড়ক সেতু নির্মিত হলে। এমনটি হলে রাজধানীর ওপর মানুষের চাপ কমানোর একটি বাস্তব সমাধান-সূত্র মিলে যাবে। বরিশাল থেকে শিকারপুর, গৌরনদী, মাদারীপুর হয়ে পদ্মা নদীতে সেতু অতিক্রম করে ঢাকার জিপিও মোড়ের জিরো পয়েন্টের দূরত্ব মোটামুটি ১২০ কিলোমিটার। রাস্তা ফাঁকা থাকলে পাজেরো ধরনের গাড়িতে ঝড়ের বেগে চালিয়ে এ দূরত্ব হয়তো দেড় ঘণ্টারও কম সময়ে অতিক্রম করা যেতে পারে। এত কাছের এ শহর, অথচ কত দূরেরই না মনে হয়। মাদারীপুর ও ফরিদপুরের অনেক এলাকা এর ফলে হয়ে উঠবে রাজধানীর প্রায় উপকণ্ঠের মতো। বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীর বঙ্গোপসাগর উপকূল রাজধানী ঢাকা থেকে সমদূরত্বে অবস্থিত। কিন্তু মনোজগতের দূরত্বে পটুয়াখালীকে মনে হয় অনেক অনেক দূরের। পদ্মা সেতু এ ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবে।
ঢাকায় যাত্রাবাড়ী থেকে পলাশী মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে। যানজটের কারণে এ দূরত্ব এখন প্রাইভেটকার বা বাসে দুই ঘণ্টার কমে অতিক্রম করা যায় না। ফ্লাইওভার নির্মিত হলে ১০-১২ মিনিটেই এ পথ অতিক্রম করা যাবে। এ কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতুতে পেঁৗছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
নদীপথে ঢাকা থেকে বরিশালে যেতে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগে। একসময় এ পথে স্টিমার যাত্রায় প্রবল আকর্ষণ ছিল। এখন বড় আকারের লঞ্চ তৈরি হয়েছে। তাতে রয়েছে বিলাসবহুল কেবিন। পারিবারিক স্যুটও রয়েছে। সন্ধ্যার পর ঢাকা কিংবা বরিশাল থেকে এ লঞ্চে চেপে সকালেই পেঁৗছানো যায় গন্তব্যে। এভাবে কাজের সময়ের ক্ষতি না করেই ভ্রমণের ব্যবস্থা অনেকের পছন্দ। ঢাকা কিংবা বরিশালে দিনের কাজ শেষ করে ফের সন্ধ্যায় রওনা হয়ে যাওয়া যায় আপন আলয়ে। পদ্মায় সেতু হলেও তাই এ নৌরুটের চাহিদা থাকবে। নৌযানে ভ্রমণের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে_ ভাড়া তুলনামূলক কম। ঢাকা-বরিশাল রুটে বাসের ভাড়া তিনশ' টাকার মতো। কিন্তু একশ' টাকা হলেই লঞ্চের ডেকে রাতের বেলা ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে গন্তব্যে যাওয়া যায়। মালপত্র পরিবহনের ভাড়াও সড়ক-রেল-বিমানপথের তুলনায় অনেক কম।
নদীপথের গুরুত্ব শুধু যাতায়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। নদীমাতৃক দেশ আমাদের। খাবার পানি, কৃষিকাজের সেচ, মাছের চারণভূমি সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য নদীর বিকল্প নেই। আমাদের দেশের অনেক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে নৌযান চালানোর কাজে সমস্যা হচ্ছে। নানা স্থানে চর পড়েছে। নদীতে পানি কম থাকায় খালবিলে পানি যেতে পারছে না। ফলে বোরো ধানের মৌসুমে সেচের পানির জন্য সেচযন্ত্রের লম্বা পাইপ পাঠাতে হয় মাটির নিচে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভূগর্ভের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অনেক স্থানে ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় ওয়াসার পানির জোগানের জন্যও নদীর পানির ওপর নির্ভরতা অনেক। কিন্তু এসব নদীতে পানির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়া এবং ক্রমাগত ময়লা-আবর্জনা ও শিল্পবর্জ্য ফেলার কারণে রাজধানীতে খাবার ও পয়ঃনিষ্কাশনের পানির বড় উৎস হয়ে পড়েছে মাটির নিচের পানি। পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য এমন চিত্র মোটেই ভালো নয়। এ কারণেই নদ-নদী ড্রেজিং করার তাগিদ ক্রমাগত বাড়ছে। দশকের পর দশক এ কাজ উপেক্ষিত হয়েছে। একসময় বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন রুটে স্টিমার চলত প্রতিদিন। এখন সেসব কেবল বইয়ের পাতার বিষয়। পানি কমে যাওয়ায় স্টিমার চলতে পারে না।
বরিশাল পরিক্রমা নামে একটি মাসিক পত্রিকা ৭ মে রাজধানীতে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন বিষয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। এতে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন, বরিশালের গৌরনদী-আগৈলঝাড়া আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার মুহম্মদ ইউনুস, সাবেক সংসদ সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপন ও বানারীপাড়া আসনের সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনি। আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা কানেকটিভিটির ওপর জোর দেন। তাদের বক্তব্য ছিল_ শুধু সড়ক ও রেলপথ নয়, দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বরিশাল বিভাগের উন্নয়ন প্রসঙ্গেই জানা গেল বিস্ময়কর তথ্য_ এখানের ৬ জেলার একটিতেও গড়ে ওঠেনি কোনো হিমাগার। অথচ ইলিশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছের প্রধান জোগান আসে এ অঞ্চল থেকেই। আলুর ফলনও প্রচুর। ধানের জন্য এ অঞ্চলের খ্যাতি অনেক আগে থেকেই রয়েছে। কুড়িয়ানার পেয়ারার চাহিদা রয়েছে দেশব্যাপী। অথচ এসব কৃষি ও মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা কি কেবল যোগাযোগের সমস্যা? নাকি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের অঞ্চলে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ভয়? এ প্রশ্নের সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে চলে আসে_ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগর যদি আরও ভেতরে চলে আসে? কারও কারও তো আশঙ্কা যে, বঙ্গোপসাগরের সৈকত বরিশালের অনেক ভেতরে চলে আসতে পারে। এমন শঙ্কায় দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব? বরিশাল অঞ্চলে শিল্প বলতে হাতেগোনা কয়েকটি। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে কি উদ্যোক্তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আসবে, নাকি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার শঙ্কা থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? চট্টগ্রাম অঞ্চলে এমনটি ঘটেনি। বরিশালেও এ বাধা দূর করা যাবে।
যদি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন তাহলে অচিরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দেবে। সেটা হচ্ছে ভূমির ব্যবহার। শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে তার জন্য জমি চাই। পদ্মা সেতু হয়ে মাদারীপুর-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে যেতে সড়কপথ অনেক প্রশস্ত করতে হবে। রেলপথ নির্মাণ করতে হবে নতুন করে। এজন্যও জমি চাই প্রচুর। চিকিৎসার জন্য আধুনিক হাসপাতাল এবং উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্যও চাই জমি। এজন্য ফসলের জমিতেই হাত পড়বে। পদ্মায় সড়ক ও রেল সেতু নির্মাণের পর বরিশাল অঞ্চলের শিল্প সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে যদি নির্বিচারে কৃষিজমিতে হাত পড়তে থাকে জমির মালিকরা তাতে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে? জনবহুল এ দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পরনির্ভরতার বিপদ আমরা বুঝতে পারি। নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য দেশের জমিতেই উৎপাদন করতে হবে। এজন্য জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে। বরিশাল অঞ্চলের লোনা পানির জমিতেও যাতে ধান ফলানো যায় সেজন্য বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন বিশেষ ধরনের জাত। তবে এরপরও এটা বলা যাবে না যে, নির্বিচারে ফসলের জমি শিল্প স্থাপন এবং সড়ক-রেলপথসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা সঙ্গত হবে। জনসংখ্যা স্ফীতি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সমস্যা। সরকারে যারা রয়েছেন তারা এ সমস্যাকে এক নম্বর জাতীয় সমস্যা বলছেন বটে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ তেমন লক্ষণীয় নয়। এ কারণে আরও অনেক বছর আমাদের ভূখণ্ড মানুষের পদভারে কাঁপতেই থাকবে। খাদ্যের চাহিদাও এ কারণে বাড়বে। কৃষির জন্য প্রচুর পরিমাণ জমির চাহিদাও থাকবে। সরকার পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করতে চাইছে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এজন্য বারবার আশ্বস্ত করছেন আমাদের। জনগণের প্রত্যাশাও তেমনটিই। এ অবস্থায় কৃষিজমির ব্যবহারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বরিশাল অঞ্চলের লোক। তিনি বোরো মৌসুমে পানির অত্যধিক ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, সে বিষয়ে সচেতন। আমন মৌসুমে ধানের ফলন বাড়াতে এবং বোরো মৌসুমে ধানের জমি কমিয়ে অন্য ফসলের চাষ বাড়াতে জোর দিচ্ছেন তিনি। এজন্য কৃষি বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে অনেকেরই সহায়তা দরকার। সবচেয়ে বড় সহায়তা চাই কৃষকদের। তাদের গ্রহণ করা না-করার ওপরই সবকিছু নির্ভর করবে। কৃষিমন্ত্রী এবং কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই কৃষিজমির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন, এটাই আশা করব।
বরিশাল অঞ্চলের একটি অংশ বঙ্গোপসাগর তীরে অবস্থিত। এখানে দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। একই সঙ্গে সমুদ্রের মৎস্যসম্পদ এবং তেল-গ্যাসসম্পদ আহরণের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। মৎস্যসম্পদ আহরণের জন্য জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে যায়। তাদের নিরাপত্তার ইস্যুটি কখনোই সরকারের টপ এজেন্ডায় ছিল না। উপকূলে বনাঞ্চল গড়ে তোলার জন্যও প্রয়োজনীয় কাজগুলো সব এলাকায় করা হয়নি। এখন এদিকে মনোযোগ বাড়ানোর সময় এসেছে। বনাঞ্চল বিস্তৃত হলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ বাড়বে।
ফিরে যাই পদ্মা সেতুর কথায়। বরিশাল অঞ্চলের এক পাশে মংলা বন্দর, অন্য পাশে চট্টগ্রাম বন্দর। আবার এ দুটি বন্দরের অবস্থানও রাজধানীর দুই পাশে। এখন চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরেই আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের সিংহভাগ পরিচালিত হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকার সঙ্গে মংলার দূরত্ব চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় অনেক কম হবে। দেশের প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোলও মনে হবে রাজধানীর অনেক কাছের এলাকা। অর্থনীতির তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা এ অবস্থায় মংলা বন্দরের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। বেনাপোলের গুরুত্বও বাড়বে। পশ্চিমাঞ্চল হিসেবে পরিচিত খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ার সঙ্গে যোগাযোগও পদ্মা সেতু পথে সহজ হয়ে যাবে। তবে এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে অবকাঠামো নির্মাণের কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে দেরি করা যাবে না।
তবে সবকিছুর মূলে থাকবে পদ্মা সেতু। একটি কৌতুক-গল্প এখানে প্রাসঙ্গিক :এক সম্রাটের আগমন উপলক্ষে তোপধ্বনি করার জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন। তিনি এলে সবার মধ্যে দারুণ উৎসাহ। দৌড়ঝাঁপ দিকে দিকে। কিন্তু তোপধ্বনি হলো না। কেন এ গড়বড়, এ প্রশ্ন করা হলো মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে। তিনি বললেন, কারণ অনেক। প্রথমটি হচ্ছে, কামানের জন্য বারুদ ছিল না। এরপর আর কোনো কারণ শোনার তো দরকার নেই।
পদ্মা সেতু সময়মতো সম্পন্ন হবে ভেবেই দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের মধ্যে নতুন আশার আলো সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু সেতুটির নির্মাণকাজ যদি অযথা বিলম্বিত হয়? কিংবা ফের স্থগিত হয়ে পড়ে? এমন দুর্ভাগ্য যেন কোনোভাবেই নেমে না আসে। বরিশাল থেকে সকাল ৭টায় ট্রেনে বা দ্রুতগামী বাসে চেপে ঢাকায় অফিস করে সন্ধ্যার পরপরই বাড়িতে ফিরে পরিবারের সঙ্গে কাটানোর চমৎকার সুযোগ এখন সামনে। এটা কোনোভাবেই হেলায় হারানো যাবে না। এর ফলে অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে, রাজধানীর ওপর মানুষের চাপ কমানোর চিন্তা বাস্তবে রূপ নেবে। এটা কে না চাইবে?
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ধলড়ুফম@মসধরষ.পড়স
দক্ষিণাঞ্চলের কীর্তনখোলা নদীর তীরের বিভাগীয় শহর বরিশালে অবস্থান করেই প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করার স্বপ্ন পূরণ হবে পদ্মায় রেল ও সড়ক সেতু নির্মিত হলে। এমনটি হলে রাজধানীর ওপর মানুষের চাপ কমানোর একটি বাস্তব সমাধান-সূত্র মিলে যাবে। বরিশাল থেকে শিকারপুর, গৌরনদী, মাদারীপুর হয়ে পদ্মা নদীতে সেতু অতিক্রম করে ঢাকার জিপিও মোড়ের জিরো পয়েন্টের দূরত্ব মোটামুটি ১২০ কিলোমিটার। রাস্তা ফাঁকা থাকলে পাজেরো ধরনের গাড়িতে ঝড়ের বেগে চালিয়ে এ দূরত্ব হয়তো দেড় ঘণ্টারও কম সময়ে অতিক্রম করা যেতে পারে। এত কাছের এ শহর, অথচ কত দূরেরই না মনে হয়। মাদারীপুর ও ফরিদপুরের অনেক এলাকা এর ফলে হয়ে উঠবে রাজধানীর প্রায় উপকণ্ঠের মতো। বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে দেখুন, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীর বঙ্গোপসাগর উপকূল রাজধানী ঢাকা থেকে সমদূরত্বে অবস্থিত। কিন্তু মনোজগতের দূরত্বে পটুয়াখালীকে মনে হয় অনেক অনেক দূরের। পদ্মা সেতু এ ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবে।
ঢাকায় যাত্রাবাড়ী থেকে পলাশী মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে। যানজটের কারণে এ দূরত্ব এখন প্রাইভেটকার বা বাসে দুই ঘণ্টার কমে অতিক্রম করা যায় না। ফ্লাইওভার নির্মিত হলে ১০-১২ মিনিটেই এ পথ অতিক্রম করা যাবে। এ কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতুতে পেঁৗছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
নদীপথে ঢাকা থেকে বরিশালে যেতে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগে। একসময় এ পথে স্টিমার যাত্রায় প্রবল আকর্ষণ ছিল। এখন বড় আকারের লঞ্চ তৈরি হয়েছে। তাতে রয়েছে বিলাসবহুল কেবিন। পারিবারিক স্যুটও রয়েছে। সন্ধ্যার পর ঢাকা কিংবা বরিশাল থেকে এ লঞ্চে চেপে সকালেই পেঁৗছানো যায় গন্তব্যে। এভাবে কাজের সময়ের ক্ষতি না করেই ভ্রমণের ব্যবস্থা অনেকের পছন্দ। ঢাকা কিংবা বরিশালে দিনের কাজ শেষ করে ফের সন্ধ্যায় রওনা হয়ে যাওয়া যায় আপন আলয়ে। পদ্মায় সেতু হলেও তাই এ নৌরুটের চাহিদা থাকবে। নৌযানে ভ্রমণের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে_ ভাড়া তুলনামূলক কম। ঢাকা-বরিশাল রুটে বাসের ভাড়া তিনশ' টাকার মতো। কিন্তু একশ' টাকা হলেই লঞ্চের ডেকে রাতের বেলা ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে গন্তব্যে যাওয়া যায়। মালপত্র পরিবহনের ভাড়াও সড়ক-রেল-বিমানপথের তুলনায় অনেক কম।
নদীপথের গুরুত্ব শুধু যাতায়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। নদীমাতৃক দেশ আমাদের। খাবার পানি, কৃষিকাজের সেচ, মাছের চারণভূমি সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য নদীর বিকল্প নেই। আমাদের দেশের অনেক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে নৌযান চালানোর কাজে সমস্যা হচ্ছে। নানা স্থানে চর পড়েছে। নদীতে পানি কম থাকায় খালবিলে পানি যেতে পারছে না। ফলে বোরো ধানের মৌসুমে সেচের পানির জন্য সেচযন্ত্রের লম্বা পাইপ পাঠাতে হয় মাটির নিচে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভূগর্ভের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অনেক স্থানে ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় ওয়াসার পানির জোগানের জন্যও নদীর পানির ওপর নির্ভরতা অনেক। কিন্তু এসব নদীতে পানির ধারণক্ষমতা কমে যাওয়া এবং ক্রমাগত ময়লা-আবর্জনা ও শিল্পবর্জ্য ফেলার কারণে রাজধানীতে খাবার ও পয়ঃনিষ্কাশনের পানির বড় উৎস হয়ে পড়েছে মাটির নিচের পানি। পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য এমন চিত্র মোটেই ভালো নয়। এ কারণেই নদ-নদী ড্রেজিং করার তাগিদ ক্রমাগত বাড়ছে। দশকের পর দশক এ কাজ উপেক্ষিত হয়েছে। একসময় বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন রুটে স্টিমার চলত প্রতিদিন। এখন সেসব কেবল বইয়ের পাতার বিষয়। পানি কমে যাওয়ায় স্টিমার চলতে পারে না।
বরিশাল পরিক্রমা নামে একটি মাসিক পত্রিকা ৭ মে রাজধানীতে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন বিষয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। এতে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন, বরিশালের গৌরনদী-আগৈলঝাড়া আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার মুহম্মদ ইউনুস, সাবেক সংসদ সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপন ও বানারীপাড়া আসনের সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনি। আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা কানেকটিভিটির ওপর জোর দেন। তাদের বক্তব্য ছিল_ শুধু সড়ক ও রেলপথ নয়, দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বরিশাল বিভাগের উন্নয়ন প্রসঙ্গেই জানা গেল বিস্ময়কর তথ্য_ এখানের ৬ জেলার একটিতেও গড়ে ওঠেনি কোনো হিমাগার। অথচ ইলিশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছের প্রধান জোগান আসে এ অঞ্চল থেকেই। আলুর ফলনও প্রচুর। ধানের জন্য এ অঞ্চলের খ্যাতি অনেক আগে থেকেই রয়েছে। কুড়িয়ানার পেয়ারার চাহিদা রয়েছে দেশব্যাপী। অথচ এসব কৃষি ও মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা কি কেবল যোগাযোগের সমস্যা? নাকি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের অঞ্চলে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ভয়? এ প্রশ্নের সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে চলে আসে_ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগর যদি আরও ভেতরে চলে আসে? কারও কারও তো আশঙ্কা যে, বঙ্গোপসাগরের সৈকত বরিশালের অনেক ভেতরে চলে আসতে পারে। এমন শঙ্কায় দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব? বরিশাল অঞ্চলে শিল্প বলতে হাতেগোনা কয়েকটি। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে কি উদ্যোক্তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আসবে, নাকি প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার শঙ্কা থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? চট্টগ্রাম অঞ্চলে এমনটি ঘটেনি। বরিশালেও এ বাধা দূর করা যাবে।
যদি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন তাহলে অচিরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দেবে। সেটা হচ্ছে ভূমির ব্যবহার। শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে তার জন্য জমি চাই। পদ্মা সেতু হয়ে মাদারীপুর-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে যেতে সড়কপথ অনেক প্রশস্ত করতে হবে। রেলপথ নির্মাণ করতে হবে নতুন করে। এজন্যও জমি চাই প্রচুর। চিকিৎসার জন্য আধুনিক হাসপাতাল এবং উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্যও চাই জমি। এজন্য ফসলের জমিতেই হাত পড়বে। পদ্মায় সড়ক ও রেল সেতু নির্মাণের পর বরিশাল অঞ্চলের শিল্প সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে যদি নির্বিচারে কৃষিজমিতে হাত পড়তে থাকে জমির মালিকরা তাতে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে? জনবহুল এ দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পরনির্ভরতার বিপদ আমরা বুঝতে পারি। নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য দেশের জমিতেই উৎপাদন করতে হবে। এজন্য জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ রয়েছে। বরিশাল অঞ্চলের লোনা পানির জমিতেও যাতে ধান ফলানো যায় সেজন্য বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন বিশেষ ধরনের জাত। তবে এরপরও এটা বলা যাবে না যে, নির্বিচারে ফসলের জমি শিল্প স্থাপন এবং সড়ক-রেলপথসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা সঙ্গত হবে। জনসংখ্যা স্ফীতি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সমস্যা। সরকারে যারা রয়েছেন তারা এ সমস্যাকে এক নম্বর জাতীয় সমস্যা বলছেন বটে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ তেমন লক্ষণীয় নয়। এ কারণে আরও অনেক বছর আমাদের ভূখণ্ড মানুষের পদভারে কাঁপতেই থাকবে। খাদ্যের চাহিদাও এ কারণে বাড়বে। কৃষির জন্য প্রচুর পরিমাণ জমির চাহিদাও থাকবে। সরকার পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করতে চাইছে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এজন্য বারবার আশ্বস্ত করছেন আমাদের। জনগণের প্রত্যাশাও তেমনটিই। এ অবস্থায় কৃষিজমির ব্যবহারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বরিশাল অঞ্চলের লোক। তিনি বোরো মৌসুমে পানির অত্যধিক ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, সে বিষয়ে সচেতন। আমন মৌসুমে ধানের ফলন বাড়াতে এবং বোরো মৌসুমে ধানের জমি কমিয়ে অন্য ফসলের চাষ বাড়াতে জোর দিচ্ছেন তিনি। এজন্য কৃষি বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে অনেকেরই সহায়তা দরকার। সবচেয়ে বড় সহায়তা চাই কৃষকদের। তাদের গ্রহণ করা না-করার ওপরই সবকিছু নির্ভর করবে। কৃষিমন্ত্রী এবং কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই কৃষিজমির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন, এটাই আশা করব।
বরিশাল অঞ্চলের একটি অংশ বঙ্গোপসাগর তীরে অবস্থিত। এখানে দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। একই সঙ্গে সমুদ্রের মৎস্যসম্পদ এবং তেল-গ্যাসসম্পদ আহরণের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। মৎস্যসম্পদ আহরণের জন্য জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে যায়। তাদের নিরাপত্তার ইস্যুটি কখনোই সরকারের টপ এজেন্ডায় ছিল না। উপকূলে বনাঞ্চল গড়ে তোলার জন্যও প্রয়োজনীয় কাজগুলো সব এলাকায় করা হয়নি। এখন এদিকে মনোযোগ বাড়ানোর সময় এসেছে। বনাঞ্চল বিস্তৃত হলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ বাড়বে।
ফিরে যাই পদ্মা সেতুর কথায়। বরিশাল অঞ্চলের এক পাশে মংলা বন্দর, অন্য পাশে চট্টগ্রাম বন্দর। আবার এ দুটি বন্দরের অবস্থানও রাজধানীর দুই পাশে। এখন চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরেই আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের সিংহভাগ পরিচালিত হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকার সঙ্গে মংলার দূরত্ব চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় অনেক কম হবে। দেশের প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোলও মনে হবে রাজধানীর অনেক কাছের এলাকা। অর্থনীতির তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা এ অবস্থায় মংলা বন্দরের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। বেনাপোলের গুরুত্বও বাড়বে। পশ্চিমাঞ্চল হিসেবে পরিচিত খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ার সঙ্গে যোগাযোগও পদ্মা সেতু পথে সহজ হয়ে যাবে। তবে এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে অবকাঠামো নির্মাণের কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে দেরি করা যাবে না।
তবে সবকিছুর মূলে থাকবে পদ্মা সেতু। একটি কৌতুক-গল্প এখানে প্রাসঙ্গিক :এক সম্রাটের আগমন উপলক্ষে তোপধ্বনি করার জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন। তিনি এলে সবার মধ্যে দারুণ উৎসাহ। দৌড়ঝাঁপ দিকে দিকে। কিন্তু তোপধ্বনি হলো না। কেন এ গড়বড়, এ প্রশ্ন করা হলো মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে। তিনি বললেন, কারণ অনেক। প্রথমটি হচ্ছে, কামানের জন্য বারুদ ছিল না। এরপর আর কোনো কারণ শোনার তো দরকার নেই।
পদ্মা সেতু সময়মতো সম্পন্ন হবে ভেবেই দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের মধ্যে নতুন আশার আলো সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু সেতুটির নির্মাণকাজ যদি অযথা বিলম্বিত হয়? কিংবা ফের স্থগিত হয়ে পড়ে? এমন দুর্ভাগ্য যেন কোনোভাবেই নেমে না আসে। বরিশাল থেকে সকাল ৭টায় ট্রেনে বা দ্রুতগামী বাসে চেপে ঢাকায় অফিস করে সন্ধ্যার পরপরই বাড়িতে ফিরে পরিবারের সঙ্গে কাটানোর চমৎকার সুযোগ এখন সামনে। এটা কোনোভাবেই হেলায় হারানো যাবে না। এর ফলে অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে, রাজধানীর ওপর মানুষের চাপ কমানোর চিন্তা বাস্তবে রূপ নেবে। এটা কে না চাইবে?
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ধলড়ুফম@মসধরষ.পড়স
No comments