অর্থবছরের প্রথম দিন-নতুন বাজেট_ সমস্যা ও সম্ভাবনা by এমএম আকাশ
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন ও ভর্তুকি ব্যয়ের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর মীমাংসা কীভাবে হয় এবং কোনদিকে ঝুঁকে পড়ে তার ওপর ভবিষ্যতের অনেক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্ক নির্ভর করবে। তাহলে সামগ্রিকভাবে কী দাঁড়াল? অনেক টানাপড়েন ও চাপের মুখে এ বাজেট।
সরকার যদি লুটেরা ধনিক শ্রেণীর কাছ থেকে নির্মমভাবে কিছু রাজস্ব আদায় করতে পারে, তাহলে জনগণের ওপর বোঝা
না বাড়িয়ে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে প্রবৃদ্ধির হার সম্মানজনক
রাখা যেত
নতুন অর্থবছর ২০১২-১৩ আজ ১ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট পেশ করার পর এ নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে অনেক আলোচনা হয়েছে। এ থেকে সাধারণভাবে যেসব মন্তব্য পত্রিকার পাঠক এবং টেলিভিশন ও আলোচনা সভার শ্রোতারা বারবার শুনেছেন, সেগুলো এভাবে তুলে ধরা যায়।
এক. এবারের বাজেট আকারে বড় এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা সরকারের নেই। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ বাংলাদেশের অর্থনীতি আকারে বড় হচ্ছে। আমাদের চাহিদা-প্রয়োজন বাড়ছে। সে তুলনায় বাজেট মোটেই বড় নয় এবং বাস্তবায়নযোগ্যও বটে।
দুই. বাজেটে আয় ও ব্যয়ের যে প্রস্তস্নাবনাই অর্থমন্ত্রী করুন না কেন; বছর শেষে সেটা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। রাজস্ব আয়ের যে হিসাব করা হয়েছে, তা আদায় হবে না। রাজস্ব ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ফলে উদ্বৃত্ত কমবে। বিদেশি সাহায্য কম পাওয়া যাবে অথবা তার ব্যবহারের হার কমে যাবে। সুতরাং প্রস্তস্নাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পূরণ হবে না। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ আমাদের রাজস্ব বিভাগ গত কয়েক বছরে প্রচুর দক্ষতা দেখিয়েছে এবং সেটা আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ কারণে রাজস্ব্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা পূরণ করায় সমস্যা হবে না।
তিন. বিদেশি দাতা অর্থাৎ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থ্থা ও দাতাদের সঙ্গে সরকারের যে মতবিরোধ চলছে, তার প্রভাবে বিদেশি সাহায্য কম আসবে। সরকার বাধ্য হবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাবে না। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ সার্বিকভাবে এ বছরের বাজেটে রাজস্ব্ব ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ। সুতরাং এটা প্রচলিত ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব, চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।
চার. বহুল বিতর্কিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকির চাপ কমবে না। ভর্তুকি না দিলে বা অনেক পরিমাণে কমিয়ে আনতে হলে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়াতে হবে। তার ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। যেহেতু সাধারণ নির্বাচন সনি্নম্নকটবর্তী হচ্ছে এবং সে কারণে এ বছরটি সরকারের পুনর্নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি সরকারের জন্য নেওয়া কঠিন। কিন্তু পরিস্থি্থতি তো শাঁখের করাতের মতো। যদি সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাকে বর্ধিত ভর্তুকির সংস্থান করতে হবে। সেটা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা টাকা ছাপিয়ে করলে মুদ্রাস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী হবে। সরকারের তাই চয়েজ থাকবে কস্ট-পুশ ইনফ্লেশন কিংবা ডিমান্ড-পুল ইনফ্লেশন_ কোনো একটি বেছে নেওয়া। অর্থাৎ ইনফ্লেশনের চাপ থাকছেই। সংযত মুদ্রানীতি দিয়ে এই সমস্যা কিছুটা ট্যাক্ল করা সম্ভব। কিন্তু তাতে প্রবৃদ্ধির হার আবার কিছুটা হ্রাস পাবে। গত ২০১১-১২ অর্থবছরের শেষদিকে সরকার সংযত মুদ্রানীতি অনুসরণ করে (অর্থাৎ ঋণপ্রবাহ সংকোচন ও সুদের হার বৃদ্ধি) মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সে জন্য তাকে মূল্য দিতে হয়েছে_ প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ থেকে খানিকটা কম (৬ দশমিক ৩ শতাংশ) মেনে নিতে হয়েছে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সংযত মুদ্রানীতি নিলে তার প্রতিকূল প্রবৃদ্ধি প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরকারের সমর্থকদেরও কেউ কেউ ঘরের ভেতরের আলোচনায় স্বীকার করেন, মুদ্রাস্ফীতির বিপদ প্রবৃদ্ধি কমার বিপদের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। গত বছর প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও অন্য দেশের মান-এ যেহেতু এ হার সম্মানজনক ছিল এবং আগামীতে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, তাই এ বিষয়টি নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
পাঁচ. সমালোচকরা বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এ জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিপরীতে সরকারের জবাব, আমরা তো মানুষকে বিদ্যুৎ দিয়েছি। দাম একটু বেশি পড়েছে, তবু অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দাম অনেক কম।
এবারে বাজেটের মোট আয়তন প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বিভিন্ন হিসাব থেকে আমরা দেখছি যে, নতুন এই বছরে জিডিপির সম্ভাব্য আয়তন ধরা হয়েছে ১০ লাখ ৪১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা এবং বিদায়ী বছরে প্রাক্কলিত (সংশোধিত) জিডিপি ছিল ৯ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এই হিসাব অনুসারে যদি ধরে নিই, জিডিপি বৃদ্ধির নমিনাল হার ২০১২-১৩ অর্থবছরে হবে টাকার অঙ্কে ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতির হার অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ৭ দশমিক ৫ শতাংশই থাকবে; তাহলে বলা যায়, জিডিপি বৃদ্ধির প্রকৃত হার হবে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে বিদায়ী বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। অতএব এখানে নিঃসন্দেহে একটি গরমিল আছে। কিন্তু সব মিলিয়ে বলা যায়, এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। তাতে অবশ্য বর্তমান বিশ্ব ও আশপাশের দেশের মান-এ খুব অখুশি হওয়ার কিছু নেই। সরকারি বাজেট জিডিপির ১৮ শতাংশের মতো। এটাও একটি স্ট্যান্ডার্ড প্যারামিটার। সেই হিসাবে আমি মনে করি না যে, বাজেট উচ্চাভিলাষী। কিন্তু যেটা সরকার স্ব্বীকার করেনি তা হচ্ছে, সরকারের হিসাবই প্রবৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং এটা বাস্তবায়িত না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
প্রতিটি বাজেটেই আয় ও ব্যয় সম্পর্কে কতগুলো পূর্বানুমান থাকে। এটা বাস্তস্নবসম্মত না হলে পুরো বাজেট ওলটপালট হয়ে যায়। এ কারণে প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে সংশোধিত বাজেট অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। আমরা যদি গত বছরের বাজেট প্রস্তাব ও সংশোধিত হওয়ার পরের পরিসংখ্যান তুলনা করি, তাহলে এটা সহজেই বুঝতে পারব। ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধনের মাত্রা ছিল প্রায় (-) ৩ শতাংশ। অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত ব্যয়ের পরিমাণ ৯১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধন হয়েছে প্রায় (+) ৫ শতাংশ। এ প্রবণতা দীর্ঘকালীন। অর্থাৎ সচরাচর আমরা যে আয়ের হিসাব দিই, আয় করি তার চেয়ে কম এবং ব্যয়ের যে হিসাব দিই, প্রকৃত ব্যয় করি তার চেয়ে বেশি। ফলে রাজস্ব উদ্বৃৃত্ত কমে যায় এবং শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করি। এভাবে আমরা বর্তমানের স্বার্থে ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিই। গত অর্থবছরেও তাই হয়েছে। ওই বছর প্রস্তাবিত উন্নম্নয়ন ব্যয় ছিল ৫৫ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। সংশোধিত ব্যয় হয়েছে ৪৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় প্রস্তাবের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। আমার অনুমান, নতুন বছরেও এমনটি ঘটবে। এ থেকে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জিত হবে না। সরকার বলতে পারে যে, সরকারি খাতে বিনিয়োগ কমলেও বেসরকারি খাত সেটা পুষিয়ে দেবে। কিন্তু পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপির করুণ পরিণতি এবং এ যাবৎকালের প্রবণতা এর বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। কোনোক্রমে যদি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য আরও বেড়ে যায় (যদিও গত কয়েক দিনে দাম কিছুটা কমার প্রবণতা লক্ষণীয়), তখন সরকার যে 'সহনীয়' ভর্তুকির মাত্রার কথা বলছে, সেটুকু দিতেই সম্ভাব্য কোষাগারে টান পড়বে। এ অবস্থায় সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়াতে হবে কিংবা বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। সরকার অবশ্য ৫ থেকে ৭ শতাংশ সুদে 'সভরেন বন্ড'-এর কথা বলছে। এর অর্থ বিদেশি পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের চেষ্টা করা। তবে এটা হচ্ছে সরকারের শেষ অপশন। প্রথমে তারা চেষ্টা করবে বিদেশি সাহায্যসূত্রে অর্থ সংগ্রহ করতে। তার পরে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে এবং সবশেষে সভরেন বন্ড থেকে। সম্ভাব্য ঝুঁকি ও বিকল্প অর্থায়নের 'অপশন' হিসেবে এসব উৎসের কথা অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। এ জন্য আবারও বলব, অত্যন্ত চাপের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হবে এ বছরের বাজেট বাস্তবায়ন। তবে সরকার যদি প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে পারে, রফতানি খাতে সহসা আর যদি কোনো চাপ না পড়ে এবং পাইপলাইনে রয়ে যাওয়া বিদেশি সাহায্য ব্যবহারের মাত্রা যদি আরও কার্যকর করা যায়, তাহলে এসব ঝুঁকি কিছুটা কমতে পারে।
বিদায়ী বছরের বাজেটে বৈদেশিক সাহায্যের প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৭ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। সংশোধিত হিসাবে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১১ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩৪ শতাংশ কম! এ বছরে সরকার চাইছে ১৮ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। এর অর্থ দাঁড়াবে, গত বছরে প্রস্তস্নাবের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ হ্রাসের পর যা সরকার পেয়েছে, সে তুলনায় নতুন বছরে প্রায় ৫৬ শতাংশ বাড়তি সাহায্য সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব কার্যকর করতে হলে দাতাদের সব পরামর্শ গিলতে হবে। কিন্তু এসব তিক্ত বটিকা গিললে পরিণতি কী হয় তার উদাহরণ ইন্দোনেশিয়া; যাকে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্টিলগিৎজ বলেছেন 'আইএমএফ রায়ট'। আর যদি গিলতে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে সরকারকে মৌলিকভাবে নতুন করে ভাবতে হবে।
নির্বাচনী বছরের নিকটবর্তী অর্থবছরে সরকার কী করবে? প্রকৃতপক্ষে, উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়নের মাত্রা দাতাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে। তবে বলতে পারি যে, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সংকেত দাতাদের দিক থেকে শুভ নয়।
সরকারের বিদ্যুৎ খাতের যে পরিকল্পনা তাতে দেখা যায় এপ্রিল, ২০১২ পর্যন্ত মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫৪ শতাংশ উৎপাদন করেছে সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বাকি ৪৬ শতাংশ এসেছে বেসরকারি খাতের প্ল্যান্ট থেকে। আগামী চার বছরে অর্থাৎ ২০১৬ সাল নাগাদ মোট যে ১৪ হাজার ৭৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে ৫৮ শতাংশের জোগান আসবে বেসরকারি খাত থেকে এবং ৪২ শতাংশ উৎপাদন করা হবে সরকারি প্ল্যান্টে। অর্থাৎ সরকার ক্রমবর্ধমান হারে বেসরকারি খাতের দিকে ঝুঁকছে। বেসরকারি খাত দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে আসে না। তারা পুঁজির ওপর নির্ধারিত অঙ্কে মুনাফা অর্জনে সচেষ্ট হবে। সুতরাং দাম বৃদ্ধি অনিবার্য হবে। তবে বিদ্যুৎ তৈরির ব্যয় নির্ভর করে কোন ধরনের জ্ব্বালানি ব্যবহার করা হবে তার ওপর। ২০১২ সালের প্রথম দিকের হিসাবে দেখা যায়, ১৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল ব্যবহার করে। এ ধরনের প্ল্যান্টের উৎপাদন ব্যয় কয়লা, গ্যাস ও পানির প্ল্যান্টের তুলনায় অনেক বেশি পড়ে। উল্লেখ করা দরকার, বর্তমানে বাংলাদেশে ৭৮ শতাংশ বিদ্যুৎ প্রকল্পে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের ব্যবহার হয়ে থাকে।
এখন থেকে যে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তার কতটা গ্যাস, কয়লা বা পানি এবং কতটা জ্বালানি তেল ব্যবহার করে_ তার ওপর ভবিষ্যতের মূল্য পরিস্থিতি ও সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ এবং অর্থনীতির সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি ও প্রতিযোগিতার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় নির্ভর করবে। কেউ কেউ বলেন, বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে, কয়লা আমদানি করে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প চালু হবে, নতুন গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের জোগান দেওয়া হবে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে এবং পানি-বায়ু-আলো ব্যবহার করে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা হবে। সুতরাং সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ মিলবে। এ সম্ভাবনা আমি অসম্ভব মনে করি না। কিন্তু এসব পদক্ষেপ তো ব্যক্তি খাত বা বেসরকারি খাত নেবে না। যেহেতু সরকারের মনোবীক্ষণে ব্যক্তি খাত এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীর আধিক্য, সেহেতু এসব নন-ট্রাডিশনাল উদ্যোগে সরকার না ঝুঁকলে কপালে দুঃখ আছে। সরকারের বিদ্যুৎ সংক্রান্ত রোডম্যাপ থেকে জানা যায়, এ খাতে এ বছর ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। জ্বালানি খাতেও প্রায় সমপরিমাণ ভর্তুকির পরিকল্পনার উল্লেখ রোডম্যাপে ছিল। কিন্তু বাজেট দেখে এ ভর্তুকি কোত্থেকে আসবে, সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যেহেতু এ খাতে আর কোনো ভর্তুকি প্রদান নিষিদ্ধ করেছে, সুতরাং বাড়তি অর্থ হয়তো সরকার ঋণ হিসেবে দেবে। এ অবস্থায় দাম বৃদ্ধি অনিবার্য এবং তা কি সহনীয় মাত্রায় থাকবে? নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মোট ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এবং সেখানে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেখানো হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এর অর্থ হচ্ছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন ও ভর্তুকি ব্যয়ের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর মীমাংসা কীভাবে হয় এবং কোনদিকে ঝুঁকে পড়ে তার ওপর ভবিষ্যতের অনেক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অঙ্ক নির্ভর করবে।
তাহলে সামগ্রিকভাবে কী দাঁড়াল? অনেক টানাপড়েন ও চাপের মুখে এ বাজেট। সরকার যদি লুটেরা ধনিক শ্রেণীর কাছ থেকে নির্মমভাবে কিছু রাজস্ব আদায় করতে পারে, তাহলে জনগণের ওপর বোঝা না বাড়িয়ে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে প্রবৃদ্ধির হার সম্মানজনক রাখা যেত। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার আমজনতার ওপর মোবাইল রিচার্জ কর আরোপ এবং ব্যাংকের সুদের ওপর কর বসিয়ে নিজেকেই হাস্যাস্পদ করেছিল। অবশ্য দুষ্ট লোকেরা বলে, বাজেটের মূল বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতেই এসব প্রস্তাব সুচিন্তিতভাবে রাখা হয়। কিন্তু সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা উটপাখি নয়। বালুর নিচে মুখ লুকিয়ে রাখলেই ঝড় আসা বন্ধ হবে না। তবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কল্যাণমূলক পুঁজিবাজারের রাস্তা নিলে দাতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। কিন্তু জনসমর্থনের নিরিখে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। কোন পথ সরকার বেছে নেয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব।
ড. এমএম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
না বাড়িয়ে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে প্রবৃদ্ধির হার সম্মানজনক
রাখা যেত
নতুন অর্থবছর ২০১২-১৩ আজ ১ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট পেশ করার পর এ নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে অনেক আলোচনা হয়েছে। এ থেকে সাধারণভাবে যেসব মন্তব্য পত্রিকার পাঠক এবং টেলিভিশন ও আলোচনা সভার শ্রোতারা বারবার শুনেছেন, সেগুলো এভাবে তুলে ধরা যায়।
এক. এবারের বাজেট আকারে বড় এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা সরকারের নেই। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ বাংলাদেশের অর্থনীতি আকারে বড় হচ্ছে। আমাদের চাহিদা-প্রয়োজন বাড়ছে। সে তুলনায় বাজেট মোটেই বড় নয় এবং বাস্তবায়নযোগ্যও বটে।
দুই. বাজেটে আয় ও ব্যয়ের যে প্রস্তস্নাবনাই অর্থমন্ত্রী করুন না কেন; বছর শেষে সেটা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। রাজস্ব আয়ের যে হিসাব করা হয়েছে, তা আদায় হবে না। রাজস্ব ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ফলে উদ্বৃত্ত কমবে। বিদেশি সাহায্য কম পাওয়া যাবে অথবা তার ব্যবহারের হার কমে যাবে। সুতরাং প্রস্তস্নাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পূরণ হবে না। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ আমাদের রাজস্ব বিভাগ গত কয়েক বছরে প্রচুর দক্ষতা দেখিয়েছে এবং সেটা আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ কারণে রাজস্ব্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা পূরণ করায় সমস্যা হবে না।
তিন. বিদেশি দাতা অর্থাৎ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থ্থা ও দাতাদের সঙ্গে সরকারের যে মতবিরোধ চলছে, তার প্রভাবে বিদেশি সাহায্য কম আসবে। সরকার বাধ্য হবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাবে না। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ সার্বিকভাবে এ বছরের বাজেটে রাজস্ব্ব ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ। সুতরাং এটা প্রচলিত ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব, চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।
চার. বহুল বিতর্কিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকির চাপ কমবে না। ভর্তুকি না দিলে বা অনেক পরিমাণে কমিয়ে আনতে হলে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়াতে হবে। তার ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। যেহেতু সাধারণ নির্বাচন সনি্নম্নকটবর্তী হচ্ছে এবং সে কারণে এ বছরটি সরকারের পুনর্নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি সরকারের জন্য নেওয়া কঠিন। কিন্তু পরিস্থি্থতি তো শাঁখের করাতের মতো। যদি সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাকে বর্ধিত ভর্তুকির সংস্থান করতে হবে। সেটা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা টাকা ছাপিয়ে করলে মুদ্রাস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী হবে। সরকারের তাই চয়েজ থাকবে কস্ট-পুশ ইনফ্লেশন কিংবা ডিমান্ড-পুল ইনফ্লেশন_ কোনো একটি বেছে নেওয়া। অর্থাৎ ইনফ্লেশনের চাপ থাকছেই। সংযত মুদ্রানীতি দিয়ে এই সমস্যা কিছুটা ট্যাক্ল করা সম্ভব। কিন্তু তাতে প্রবৃদ্ধির হার আবার কিছুটা হ্রাস পাবে। গত ২০১১-১২ অর্থবছরের শেষদিকে সরকার সংযত মুদ্রানীতি অনুসরণ করে (অর্থাৎ ঋণপ্রবাহ সংকোচন ও সুদের হার বৃদ্ধি) মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সে জন্য তাকে মূল্য দিতে হয়েছে_ প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ থেকে খানিকটা কম (৬ দশমিক ৩ শতাংশ) মেনে নিতে হয়েছে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সংযত মুদ্রানীতি নিলে তার প্রতিকূল প্রবৃদ্ধি প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরকারের সমর্থকদেরও কেউ কেউ ঘরের ভেতরের আলোচনায় স্বীকার করেন, মুদ্রাস্ফীতির বিপদ প্রবৃদ্ধি কমার বিপদের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। গত বছর প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও অন্য দেশের মান-এ যেহেতু এ হার সম্মানজনক ছিল এবং আগামীতে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, তাই এ বিষয়টি নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
পাঁচ. সমালোচকরা বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এ জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিপরীতে সরকারের জবাব, আমরা তো মানুষকে বিদ্যুৎ দিয়েছি। দাম একটু বেশি পড়েছে, তবু অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দাম অনেক কম।
এবারে বাজেটের মোট আয়তন প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বিভিন্ন হিসাব থেকে আমরা দেখছি যে, নতুন এই বছরে জিডিপির সম্ভাব্য আয়তন ধরা হয়েছে ১০ লাখ ৪১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা এবং বিদায়ী বছরে প্রাক্কলিত (সংশোধিত) জিডিপি ছিল ৯ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এই হিসাব অনুসারে যদি ধরে নিই, জিডিপি বৃদ্ধির নমিনাল হার ২০১২-১৩ অর্থবছরে হবে টাকার অঙ্কে ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতির হার অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ৭ দশমিক ৫ শতাংশই থাকবে; তাহলে বলা যায়, জিডিপি বৃদ্ধির প্রকৃত হার হবে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে বিদায়ী বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। অতএব এখানে নিঃসন্দেহে একটি গরমিল আছে। কিন্তু সব মিলিয়ে বলা যায়, এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। তাতে অবশ্য বর্তমান বিশ্ব ও আশপাশের দেশের মান-এ খুব অখুশি হওয়ার কিছু নেই। সরকারি বাজেট জিডিপির ১৮ শতাংশের মতো। এটাও একটি স্ট্যান্ডার্ড প্যারামিটার। সেই হিসাবে আমি মনে করি না যে, বাজেট উচ্চাভিলাষী। কিন্তু যেটা সরকার স্ব্বীকার করেনি তা হচ্ছে, সরকারের হিসাবই প্রবৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং এটা বাস্তবায়িত না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
প্রতিটি বাজেটেই আয় ও ব্যয় সম্পর্কে কতগুলো পূর্বানুমান থাকে। এটা বাস্তস্নবসম্মত না হলে পুরো বাজেট ওলটপালট হয়ে যায়। এ কারণে প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে সংশোধিত বাজেট অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। আমরা যদি গত বছরের বাজেট প্রস্তাব ও সংশোধিত হওয়ার পরের পরিসংখ্যান তুলনা করি, তাহলে এটা সহজেই বুঝতে পারব। ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধনের মাত্রা ছিল প্রায় (-) ৩ শতাংশ। অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত ব্যয়ের পরিমাণ ৯১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধন হয়েছে প্রায় (+) ৫ শতাংশ। এ প্রবণতা দীর্ঘকালীন। অর্থাৎ সচরাচর আমরা যে আয়ের হিসাব দিই, আয় করি তার চেয়ে কম এবং ব্যয়ের যে হিসাব দিই, প্রকৃত ব্যয় করি তার চেয়ে বেশি। ফলে রাজস্ব উদ্বৃৃত্ত কমে যায় এবং শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করি। এভাবে আমরা বর্তমানের স্বার্থে ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিই। গত অর্থবছরেও তাই হয়েছে। ওই বছর প্রস্তাবিত উন্নম্নয়ন ব্যয় ছিল ৫৫ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। সংশোধিত ব্যয় হয়েছে ৪৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় প্রস্তাবের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। আমার অনুমান, নতুন বছরেও এমনটি ঘটবে। এ থেকে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জিত হবে না। সরকার বলতে পারে যে, সরকারি খাতে বিনিয়োগ কমলেও বেসরকারি খাত সেটা পুষিয়ে দেবে। কিন্তু পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপির করুণ পরিণতি এবং এ যাবৎকালের প্রবণতা এর বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। কোনোক্রমে যদি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য আরও বেড়ে যায় (যদিও গত কয়েক দিনে দাম কিছুটা কমার প্রবণতা লক্ষণীয়), তখন সরকার যে 'সহনীয়' ভর্তুকির মাত্রার কথা বলছে, সেটুকু দিতেই সম্ভাব্য কোষাগারে টান পড়বে। এ অবস্থায় সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়াতে হবে কিংবা বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। সরকার অবশ্য ৫ থেকে ৭ শতাংশ সুদে 'সভরেন বন্ড'-এর কথা বলছে। এর অর্থ বিদেশি পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের চেষ্টা করা। তবে এটা হচ্ছে সরকারের শেষ অপশন। প্রথমে তারা চেষ্টা করবে বিদেশি সাহায্যসূত্রে অর্থ সংগ্রহ করতে। তার পরে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে এবং সবশেষে সভরেন বন্ড থেকে। সম্ভাব্য ঝুঁকি ও বিকল্প অর্থায়নের 'অপশন' হিসেবে এসব উৎসের কথা অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। এ জন্য আবারও বলব, অত্যন্ত চাপের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হবে এ বছরের বাজেট বাস্তবায়ন। তবে সরকার যদি প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে পারে, রফতানি খাতে সহসা আর যদি কোনো চাপ না পড়ে এবং পাইপলাইনে রয়ে যাওয়া বিদেশি সাহায্য ব্যবহারের মাত্রা যদি আরও কার্যকর করা যায়, তাহলে এসব ঝুঁকি কিছুটা কমতে পারে।
বিদায়ী বছরের বাজেটে বৈদেশিক সাহায্যের প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৭ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। সংশোধিত হিসাবে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১১ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩৪ শতাংশ কম! এ বছরে সরকার চাইছে ১৮ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। এর অর্থ দাঁড়াবে, গত বছরে প্রস্তস্নাবের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ হ্রাসের পর যা সরকার পেয়েছে, সে তুলনায় নতুন বছরে প্রায় ৫৬ শতাংশ বাড়তি সাহায্য সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব কার্যকর করতে হলে দাতাদের সব পরামর্শ গিলতে হবে। কিন্তু এসব তিক্ত বটিকা গিললে পরিণতি কী হয় তার উদাহরণ ইন্দোনেশিয়া; যাকে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্টিলগিৎজ বলেছেন 'আইএমএফ রায়ট'। আর যদি গিলতে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে সরকারকে মৌলিকভাবে নতুন করে ভাবতে হবে।
নির্বাচনী বছরের নিকটবর্তী অর্থবছরে সরকার কী করবে? প্রকৃতপক্ষে, উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়নের মাত্রা দাতাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে। তবে বলতে পারি যে, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সংকেত দাতাদের দিক থেকে শুভ নয়।
সরকারের বিদ্যুৎ খাতের যে পরিকল্পনা তাতে দেখা যায় এপ্রিল, ২০১২ পর্যন্ত মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫৪ শতাংশ উৎপাদন করেছে সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বাকি ৪৬ শতাংশ এসেছে বেসরকারি খাতের প্ল্যান্ট থেকে। আগামী চার বছরে অর্থাৎ ২০১৬ সাল নাগাদ মোট যে ১৪ হাজার ৭৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে ৫৮ শতাংশের জোগান আসবে বেসরকারি খাত থেকে এবং ৪২ শতাংশ উৎপাদন করা হবে সরকারি প্ল্যান্টে। অর্থাৎ সরকার ক্রমবর্ধমান হারে বেসরকারি খাতের দিকে ঝুঁকছে। বেসরকারি খাত দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে আসে না। তারা পুঁজির ওপর নির্ধারিত অঙ্কে মুনাফা অর্জনে সচেষ্ট হবে। সুতরাং দাম বৃদ্ধি অনিবার্য হবে। তবে বিদ্যুৎ তৈরির ব্যয় নির্ভর করে কোন ধরনের জ্ব্বালানি ব্যবহার করা হবে তার ওপর। ২০১২ সালের প্রথম দিকের হিসাবে দেখা যায়, ১৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল ব্যবহার করে। এ ধরনের প্ল্যান্টের উৎপাদন ব্যয় কয়লা, গ্যাস ও পানির প্ল্যান্টের তুলনায় অনেক বেশি পড়ে। উল্লেখ করা দরকার, বর্তমানে বাংলাদেশে ৭৮ শতাংশ বিদ্যুৎ প্রকল্পে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের ব্যবহার হয়ে থাকে।
এখন থেকে যে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তার কতটা গ্যাস, কয়লা বা পানি এবং কতটা জ্বালানি তেল ব্যবহার করে_ তার ওপর ভবিষ্যতের মূল্য পরিস্থিতি ও সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ এবং অর্থনীতির সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি ও প্রতিযোগিতার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় নির্ভর করবে। কেউ কেউ বলেন, বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে, কয়লা আমদানি করে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প চালু হবে, নতুন গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের জোগান দেওয়া হবে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে এবং পানি-বায়ু-আলো ব্যবহার করে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা হবে। সুতরাং সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ মিলবে। এ সম্ভাবনা আমি অসম্ভব মনে করি না। কিন্তু এসব পদক্ষেপ তো ব্যক্তি খাত বা বেসরকারি খাত নেবে না। যেহেতু সরকারের মনোবীক্ষণে ব্যক্তি খাত এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীর আধিক্য, সেহেতু এসব নন-ট্রাডিশনাল উদ্যোগে সরকার না ঝুঁকলে কপালে দুঃখ আছে। সরকারের বিদ্যুৎ সংক্রান্ত রোডম্যাপ থেকে জানা যায়, এ খাতে এ বছর ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। জ্বালানি খাতেও প্রায় সমপরিমাণ ভর্তুকির পরিকল্পনার উল্লেখ রোডম্যাপে ছিল। কিন্তু বাজেট দেখে এ ভর্তুকি কোত্থেকে আসবে, সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যেহেতু এ খাতে আর কোনো ভর্তুকি প্রদান নিষিদ্ধ করেছে, সুতরাং বাড়তি অর্থ হয়তো সরকার ঋণ হিসেবে দেবে। এ অবস্থায় দাম বৃদ্ধি অনিবার্য এবং তা কি সহনীয় মাত্রায় থাকবে? নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মোট ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এবং সেখানে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেখানো হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এর অর্থ হচ্ছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন ও ভর্তুকি ব্যয়ের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর মীমাংসা কীভাবে হয় এবং কোনদিকে ঝুঁকে পড়ে তার ওপর ভবিষ্যতের অনেক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অঙ্ক নির্ভর করবে।
তাহলে সামগ্রিকভাবে কী দাঁড়াল? অনেক টানাপড়েন ও চাপের মুখে এ বাজেট। সরকার যদি লুটেরা ধনিক শ্রেণীর কাছ থেকে নির্মমভাবে কিছু রাজস্ব আদায় করতে পারে, তাহলে জনগণের ওপর বোঝা না বাড়িয়ে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে প্রবৃদ্ধির হার সম্মানজনক রাখা যেত। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার আমজনতার ওপর মোবাইল রিচার্জ কর আরোপ এবং ব্যাংকের সুদের ওপর কর বসিয়ে নিজেকেই হাস্যাস্পদ করেছিল। অবশ্য দুষ্ট লোকেরা বলে, বাজেটের মূল বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতেই এসব প্রস্তাব সুচিন্তিতভাবে রাখা হয়। কিন্তু সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা উটপাখি নয়। বালুর নিচে মুখ লুকিয়ে রাখলেই ঝড় আসা বন্ধ হবে না। তবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কল্যাণমূলক পুঁজিবাজারের রাস্তা নিলে দাতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। কিন্তু জনসমর্থনের নিরিখে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। কোন পথ সরকার বেছে নেয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব।
ড. এমএম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments