আদালত-বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা ও প্রাসঙ্গিকতা by শ ম রেজাউল করিম
বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও আধুনিকায়নে গোটা বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা কি তখন পেছনের দিকে ছুটব? এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে আইন প্রণেতাদেরসহ রাজনীতিবিদদের। কোনো অর্জিত সাফল্যের ধ্বংসের বোঝা তাদের স্কন্ধে যাতে না চাপে সে বিষয়টিও ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ রইল
বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক আদালত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রাম আদালত থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, বর্তমানে বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল দেশের সর্বোচ্চ বিচার আদালত সুপ্রিম কোর্ট। এই সুপ্রিম কোর্টকেও অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের মধ্যে টেনে আনার ঘটনা শঙ্কিত করে তোলে।
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারলে রাষ্ট্রীয় সুশাসন ব্যবস্থা কখনোই আসবে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পূর্বশর্ত হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। যদিও বিপদাপন্ন অবস্থায় শেষ আশ্রয়স্থল মনে করে সবাইকেই এখানে আসতে হয়। বিশেষ করে ওয়ান-ইলেভেনের পর দেশের দুই শীর্ষ নেত্রী ও অন্য রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ আদালতের আশ্রয় নিতে হয়েছে। সে সময়ে হাইকোর্ট বিভাগ দৃঢ়তার সঙ্গে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কারওই বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। বিচারকদের ওপর অব্যাহত হুমকি ছিল। আদালত অঙ্গনে উপস্থিতি ছিল বিভিন্ন এজেন্সির লোকদের। তারা নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণ করলেও সর্বোচ্চ আদালতে তা পারেনি।
এ কথা সত্য যে, বিচারকরা দোষ-ত্রুটির ঊধর্ে্ব নন। তবে তাদের দায়বদ্ধতা সাংবিধানিক বিধিবিধানের অধীনেই থাকা বাঞ্ছনীয়। এটা লক্ষণীয়, সব বিচারপতি সমানভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। আচরণবিধি সবাই সমানভাবে মেলে চলেন না। সব বিচারপতি একই মাপের যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন, এটা আশা করাও যুক্তিসঙ্গত নয়। বহু বিচারপতি বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু রায় প্রদান, মেধা-বিচক্ষণতা, ধীশক্তি, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে সবাই একই রকম পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করতে পারেন না। সে কারণেই বিচারিক জীবনের সমাপ্তি হলে সীমিতসংখ্যক বিচারপতিই স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকেন কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে। কখনও কখনও দু'একজন বিচারকের অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা, বক্তব্য ও আচরণ অন্যদের সমালোচনা করার সুযোগ করে দেয়। এটা মনে রাখা প্রয়োজন, বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য, মর্যাদাবোধ, আচরণবিধি ও অপরাপর বিষয় রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের তথা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক; তবে বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য 'বিশেষ আগ্রহ' ও চেষ্টা চলে কোনো একটি মহলের, তখনই। এর দায় কার কাঁধে চাপবে? এর পরও যে বাস্তবতাটি অনিবার্যভাবে অনুভূত হয়, তা হলো কোনোভাবেই বিচারকরা অন্যের দয়ার ওপর 'চাকরিতে' বহাল আছেন, এমন ধারণা যেন তাদের মনে সৃষ্টি না হয়। বিচারকদের যে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয় নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অভিযোগ উত্থাপিত হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল আদৌ কার্যকর ভূমিকা রাখে কি-না তা নিয়ে। সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে কীভাবে আরও বেশি কার্যকর করা যায়, তার জন্য আইন ও বিধির সংশোধন বা সংযোজন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে রাখঢাক না রেখে খোলা বিতর্ক হতে পারে। অভিজ্ঞ আইনবিদ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও অন্যদের নিয়ে সময়োপযোগী কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে। সেদিকে না গিয়ে বিচারকদের অভিশংসনের জন্য সংবিধানে বাহাত্তর সালের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা কেন দেখা দিল, তার কোনো সদুত্তর মিলছে না। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সাব-কমিটির একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বারবার বলছেন, যিনি বিচারপতিদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি, তাকে যদি অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের থেকে থাকে তাহলে যাদের তিনি বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন, সেই বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের কেন থাকবে না? তাদের এই যুক্তি সংসদকে এই বিষয়ে অধিক ক্ষমতাবান করার চেষ্টা লক্ষণীয়। কিন্তু কোন বাস্তবতার কারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে পার্লামেন্টকে এই ক্ষমতা হাতে নিতে হবে, কী তার বাস্তব প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না। তবে কি শুধু ক্ষমতা হাতে নেওয়া, নাকি বিচার বিভাগের ওপর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকার ও বিরোধী দল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ঐকমত্যে পেঁৗছাতে না পারলেও বিচারকদের অভিশংসন ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে নেওয়ার প্রশ্নে ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়ে সমালোচনা করতেও কেউ কেউ দ্বিধাবোধ করেন না। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতিবিদরা বিচারকদের বিবেচনা করলে, যার যখন যাকে ভালো লাগবে না বা প্রত্যাশিত রায় পাবেন না, সেই বিচারকের ওপর নাখোশ হয়ে ব্যবস্থা নেবেন না, এ গ্যারান্টি কে দেবে? আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগকৃত ১৬ জন বিচারককে অসম্মানজনকভাবে বিদায় করার ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকে। ভবিষ্যতে অন্য কোনো দল সরকার গঠন করলে, বর্তমান সরকার আমলে নিয়োগকৃত বিচারপতিদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে ঠুনকো অজুহাতে তাদের অভিশংসন করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এ কথা অনিবার্যভাবে সত্য, এক সময়ে আইনজ্ঞরাই হতেন আইন প্রণেতা। কিন্তু বর্তমানে টাকা ও অন্যান্য ক্ষমতার প্রভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন যারা, তাদের কতজন আইনজ্ঞ? আমরা কি অতীতের মান ধরে রাখতে পেরেছি? সম্প্রতি পার্লামেন্টে একাধিক সংসদ সদস্য প্রকাশ্যেই বিচারপতিদের নাম উল্লেখ করে হুমকি দেন। তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও বাধা দেননি, প্রকারান্তরে উৎসাহ দিয়েছেন। এসব ঘটনা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? বিভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী অনেক আইনজীবী বিচারক পদে নিয়োগের পর শপথ গ্রহণ করে বিচারিক দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষতা ও শপথ প্রতিপালন করছেন। বিচ্ছিন্ন দু'একটি ঘটনা নিয়ে সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেওয়া কি সুফল বয়ে আনবে? আদালতকক্ষে বিচারকের উদ্দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য ছুড়ে দেওয়া, বারান্দায় অবাঞ্ছিত ভাষায় স্লোগানসহ মিছিল করা বা অন্য কোনোভাবে বিচারকদের ওপর মনস্তাত্তি্বক চাপ সৃষ্টি করা কখনোই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ তথা প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক চলছে। এরূপ ক্ষেত্রে শেষ আশ্রয়স্থল সর্বোচ্চ বিচার আদালতকে রক্ষা করা সবারই দায়িত্ব। যে কোনো বিষয়েই বিতর্কের অবসান ঘটানো, সিদ্ধান্ত প্রদান, এমনকি আইনগত জটিলতার বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানই এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে। জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। একইভাবে সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কোনোভাবে যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। সুপ্রিম কোর্ট কোনোভাবে বিতর্কিত হলে, কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের অধীনে এলে সেটা হবে গোটা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতির। তাছাড়া বিচার বিভাগের সঙ্গে অকারণে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের। বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও আধুনিকায়নে গোটা বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা কি তখন পেছনের দিকে ছুটব? এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে আইন প্রণেতাদেরসহ রাজনীতিবিদদের। কারণ এদেশের সব বড় বড় অর্জনের কারিগর রাজনীতিবিদরাই। কোনো অর্জিত সাফল্যের ধ্বংসের বোঝা তাদের স্কন্ধে যাতে না চাপে সে বিষয়টিও ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ রইল। কারণ সুপ্রিম কোর্টের সুপ্রিমেসি রক্ষা করা আমাদের সবারই দায়িত্ব।
শ ম রেজাউল করিম : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারলে রাষ্ট্রীয় সুশাসন ব্যবস্থা কখনোই আসবে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পূর্বশর্ত হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। যদিও বিপদাপন্ন অবস্থায় শেষ আশ্রয়স্থল মনে করে সবাইকেই এখানে আসতে হয়। বিশেষ করে ওয়ান-ইলেভেনের পর দেশের দুই শীর্ষ নেত্রী ও অন্য রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ আদালতের আশ্রয় নিতে হয়েছে। সে সময়ে হাইকোর্ট বিভাগ দৃঢ়তার সঙ্গে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কারওই বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। বিচারকদের ওপর অব্যাহত হুমকি ছিল। আদালত অঙ্গনে উপস্থিতি ছিল বিভিন্ন এজেন্সির লোকদের। তারা নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণ করলেও সর্বোচ্চ আদালতে তা পারেনি।
এ কথা সত্য যে, বিচারকরা দোষ-ত্রুটির ঊধর্ে্ব নন। তবে তাদের দায়বদ্ধতা সাংবিধানিক বিধিবিধানের অধীনেই থাকা বাঞ্ছনীয়। এটা লক্ষণীয়, সব বিচারপতি সমানভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। আচরণবিধি সবাই সমানভাবে মেলে চলেন না। সব বিচারপতি একই মাপের যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন, এটা আশা করাও যুক্তিসঙ্গত নয়। বহু বিচারপতি বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু রায় প্রদান, মেধা-বিচক্ষণতা, ধীশক্তি, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে সবাই একই রকম পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করতে পারেন না। সে কারণেই বিচারিক জীবনের সমাপ্তি হলে সীমিতসংখ্যক বিচারপতিই স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকেন কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে। কখনও কখনও দু'একজন বিচারকের অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা, বক্তব্য ও আচরণ অন্যদের সমালোচনা করার সুযোগ করে দেয়। এটা মনে রাখা প্রয়োজন, বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য, মর্যাদাবোধ, আচরণবিধি ও অপরাপর বিষয় রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের তথা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক; তবে বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য 'বিশেষ আগ্রহ' ও চেষ্টা চলে কোনো একটি মহলের, তখনই। এর দায় কার কাঁধে চাপবে? এর পরও যে বাস্তবতাটি অনিবার্যভাবে অনুভূত হয়, তা হলো কোনোভাবেই বিচারকরা অন্যের দয়ার ওপর 'চাকরিতে' বহাল আছেন, এমন ধারণা যেন তাদের মনে সৃষ্টি না হয়। বিচারকদের যে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয় নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অভিযোগ উত্থাপিত হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল আদৌ কার্যকর ভূমিকা রাখে কি-না তা নিয়ে। সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে কীভাবে আরও বেশি কার্যকর করা যায়, তার জন্য আইন ও বিধির সংশোধন বা সংযোজন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে রাখঢাক না রেখে খোলা বিতর্ক হতে পারে। অভিজ্ঞ আইনবিদ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও অন্যদের নিয়ে সময়োপযোগী কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে। সেদিকে না গিয়ে বিচারকদের অভিশংসনের জন্য সংবিধানে বাহাত্তর সালের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা কেন দেখা দিল, তার কোনো সদুত্তর মিলছে না। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সাব-কমিটির একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বারবার বলছেন, যিনি বিচারপতিদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি, তাকে যদি অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের থেকে থাকে তাহলে যাদের তিনি বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন, সেই বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের কেন থাকবে না? তাদের এই যুক্তি সংসদকে এই বিষয়ে অধিক ক্ষমতাবান করার চেষ্টা লক্ষণীয়। কিন্তু কোন বাস্তবতার কারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে পার্লামেন্টকে এই ক্ষমতা হাতে নিতে হবে, কী তার বাস্তব প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না। তবে কি শুধু ক্ষমতা হাতে নেওয়া, নাকি বিচার বিভাগের ওপর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকার ও বিরোধী দল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ঐকমত্যে পেঁৗছাতে না পারলেও বিচারকদের অভিশংসন ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে নেওয়ার প্রশ্নে ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়ে সমালোচনা করতেও কেউ কেউ দ্বিধাবোধ করেন না। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতিবিদরা বিচারকদের বিবেচনা করলে, যার যখন যাকে ভালো লাগবে না বা প্রত্যাশিত রায় পাবেন না, সেই বিচারকের ওপর নাখোশ হয়ে ব্যবস্থা নেবেন না, এ গ্যারান্টি কে দেবে? আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগকৃত ১৬ জন বিচারককে অসম্মানজনকভাবে বিদায় করার ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকে। ভবিষ্যতে অন্য কোনো দল সরকার গঠন করলে, বর্তমান সরকার আমলে নিয়োগকৃত বিচারপতিদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে ঠুনকো অজুহাতে তাদের অভিশংসন করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? এ কথা অনিবার্যভাবে সত্য, এক সময়ে আইনজ্ঞরাই হতেন আইন প্রণেতা। কিন্তু বর্তমানে টাকা ও অন্যান্য ক্ষমতার প্রভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন যারা, তাদের কতজন আইনজ্ঞ? আমরা কি অতীতের মান ধরে রাখতে পেরেছি? সম্প্রতি পার্লামেন্টে একাধিক সংসদ সদস্য প্রকাশ্যেই বিচারপতিদের নাম উল্লেখ করে হুমকি দেন। তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও বাধা দেননি, প্রকারান্তরে উৎসাহ দিয়েছেন। এসব ঘটনা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? বিভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী অনেক আইনজীবী বিচারক পদে নিয়োগের পর শপথ গ্রহণ করে বিচারিক দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষতা ও শপথ প্রতিপালন করছেন। বিচ্ছিন্ন দু'একটি ঘটনা নিয়ে সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেওয়া কি সুফল বয়ে আনবে? আদালতকক্ষে বিচারকের উদ্দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য ছুড়ে দেওয়া, বারান্দায় অবাঞ্ছিত ভাষায় স্লোগানসহ মিছিল করা বা অন্য কোনোভাবে বিচারকদের ওপর মনস্তাত্তি্বক চাপ সৃষ্টি করা কখনোই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ তথা প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক চলছে। এরূপ ক্ষেত্রে শেষ আশ্রয়স্থল সর্বোচ্চ বিচার আদালতকে রক্ষা করা সবারই দায়িত্ব। যে কোনো বিষয়েই বিতর্কের অবসান ঘটানো, সিদ্ধান্ত প্রদান, এমনকি আইনগত জটিলতার বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানই এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে। জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। একইভাবে সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কোনোভাবে যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। সুপ্রিম কোর্ট কোনোভাবে বিতর্কিত হলে, কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের অধীনে এলে সেটা হবে গোটা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতির। তাছাড়া বিচার বিভাগের সঙ্গে অকারণে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের। বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও আধুনিকায়নে গোটা বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা কি তখন পেছনের দিকে ছুটব? এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে আইন প্রণেতাদেরসহ রাজনীতিবিদদের। কারণ এদেশের সব বড় বড় অর্জনের কারিগর রাজনীতিবিদরাই। কোনো অর্জিত সাফল্যের ধ্বংসের বোঝা তাদের স্কন্ধে যাতে না চাপে সে বিষয়টিও ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ রইল। কারণ সুপ্রিম কোর্টের সুপ্রিমেসি রক্ষা করা আমাদের সবারই দায়িত্ব।
শ ম রেজাউল করিম : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক
No comments