পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন-বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রে by মিহির শর্মা

কালীঘাটে শঙ্খধ্বনি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে মমতার বক্তব্য শোনাই যাচ্ছিল না। তবে তিনি তার সমর্থকদের শান্ত হতে বলার পর তার বক্তব্য শোনা গেল। যে জনপ্রত্যাশার কারণে তিনি আজ ক্ষমতায় এসেছেন সে প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পারেন সেটা কেউ বলতে পারবে না এখন।


শাসন কার্য পরিচালনায় তিনি কতটা দক্ষতার পরিচয় দেবেন সেটাও কেউ বলতে পারবে না

অধিকাংশ বাঙালির মতো আমার বয়সের চেয়েও বেশি সময় ধরে কমিউনিস্টরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থেকেছে। আমরা একটা দলের শাসনের মধ্যেই বেড়ে উঠেছি। বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সিপিএম নাগরিক জীবনের সবক্ষেত্রেই তাদের প্রভাব সম্প্রসারিত করেছে। পদোন্নতি, লাইসেন্স-পারমিট, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচিতে পর্যন্ত তারা হস্তক্ষেপ করেছে। আমাদের ঝাঁক ধরে একদিকে চলার একটা অতীত ইতিহাস রয়েছে। বামফ্রন্ট শাসনের অপরিবর্তনতায় দৃশ্যত তাই মনে হবে। পরিবর্তন ও আবশ্যকতাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দীর্ঘকালের অস্বীকৃতির ফলে আমাদের সম্পর্কে অন্যরা এমন ধারণা পোষণ করতে পারেন।
এখন বামপন্থিরা অবশ্য ধুয়েমুছে একবারে সাফ হয়ে গেছে। তবে দেশের বাদবাকি অংশ এই পরিবর্তনকে দ্বিধান্বিতভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। লাল পতাকা ও সরকার আমাদের ওপর যে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য চাপিয়ে দিয়েছিল তা ভেদ করে কি নতুন বাংলা জেগে উঠবে?
তৃণমূল সদর দফতরের পাশের এলাকা কালীঘাটে তৃণমূলের পতাকা হাতে ট্রাকভর্তি মানুষের ঠাসাঠাসি ও বিজয়ের আনন্দে উদ্বেল জনতার ছড়ানো আবিরে আকাশ ভারি হয়ে আছে। সেখানে ক্যামেরার সরব উপস্থিতি এবং বোধগম্য কারণেই বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্র এটি। তবে মমতা যে বিপুল বিজয় অর্জন করেছেন সে তুলনায় শহরের সরু রাস্তাগুলো অনেক বেশি শান্ত। যে শহর জোরে কথা বলা ও অকারণ গ্যাজানোতে অভ্যস্ত, সেখানে এখন রাজনৈতিক কথাবার্তাই তেমন নেই। এমনকি ফল ঘোষণার পরও শহরকে কেমন যেন নিরুত্তাপ মনে হয়েছে।
বামরা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে, এটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে_ এমনটা ভাবার কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে বলেও নয়। সে ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ স্বৈরশাসকের বিদায়ে রাস্তায় চুমো খেয়ে কেঁদে ফেলে। এটা আসলে গণতন্ত্রেরই মহিমা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর সাধারণ নির্বাচনে বামদের খারাপ ফল করায় সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, স্টালিনপন্থি শাসন এবার এই রাজ্য থেকে বিদায় নিতে চলেছে এবং সিপিএমেরও বারোটা বাজছে। এজন্যই কলকাতা কয়েক মাস ধরেই সবুজ পতাকার (তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকার রঙ লাল) রঙ ধরেছিল, সেটা হঠাৎ করে শুক্রবার সকালে দেখা দেয়নি। এই সময়কালে লাল পতাকাকে মনে হচ্ছিল ছিন্ন, আধো দেখা যায় আধো দেখা যায় না এই অবস্থা। প্রত্যেক রাস্তায় 'মা-মাটি-মানুষ' অঙ্কন শোভা পাচ্ছে।
আপনি কি শুনবেন সেটা নির্ভর করবে আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন তার ওপর। পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী এলিটরা কয়েক বছর ধরেই বামপন্থিদের ওপর খেপা। এর আগে তারাও বামদের পক্ষে ছিল। শহরে গরিবরাও বামদের সমর্থক ছিল। কিন্তু মার্কসবাদীরা এই সমর্থনকে তাদের পক্ষে স্থায়ী করতে পারেনি। ইউনিয়নবাজির মাধ্যমে বাইরের লোকেরাই তাদের নেতা সেজে বসে। তাদের তাত্তি্বক বিভ্রান্তিই এ পরিস্থিতি গড়ে দেয়। এক সময় তারা বামদের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়। এভাবেই যে দল বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে বলে ধারণা করা হয়েছিল সেটা শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের দলে পরিণত হয়। এভাবেই বাম রাজনীতি মধ্যবিত্তের ড্রয়িং রুমসর্বস্ব হয়ে পড়ে।
আমাদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, এখন তাহলে কী হবে? পরাজিতদের তেমন উত্তর জানা নেই। বিদায়ী মন্ত্রী গৌতম দেব যেমন এই বলে মমতাকে হুমকি দিয়েছিলেন যে, তারা বিরোধী দলে গেলে তাকে বুঝিয়ে দেবেন বিক্ষোভের রাজনীতি কত প্রকার ও কী কী_ তারা কি এখন সেই পথেই হাঁটবেন? তাদের ক্রোধ কি এখন দক্ষিণ দিলি্লর সেমিনার কক্ষে মার্কসবাদী সেসব নেতার দিকে ধাবিত হবে, যারা আজ থেকে ১৫ বছর আগে জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে না দিয়ে ঐতিহাসিক ভুল করেছেন? তারা কি ভারতে তাত্তি্বক ও গুণ্ডা কোয়ালিশন হয়ে ওঠা দলটিকে বিশ্বের অন্যান্য স্থানে দৃশ্যমান সোস্যাল-ডেমোক্রেটিক পার্টিতে পরিণত করার জন্য লড়াই চালাবেন? বামরা পরাজিত হয়েছে এবং বাংলায় কংগ্রেসও হেরেছে। তবে কংগ্রেস এককভাবে মমতার তৃণমূল কংগ্রেসকে রাজ্য শাসনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সাহায্য করে আখেরে নিজের হেরে যাওয়ার রাস্তাটা প্রশস্ত করেছে। মমতা যেমনটা করেছিলেন তেমনিভাবে নির্বাচনে কিছু নতুন মুখ না আনার কারণে তাদের পরাজয় নয়। তাদের স্থানীয় ইউনিটগুলো বিভিন্ন আসনে জোট প্রার্থীদের বিপক্ষে কাজ করেছে। এটা দিলি্লর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবস্থানের বিরোধী। এই দলটি কয়েক দশক ধরেই কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি। তারা দিলি্ল ঘোষিত জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে তা সম্ভব করতে পারেনি। আর কেবল যুব কংগ্রেসের বাগাড়ম্বর দিয়ে কার্যকর বিরোধী দলের অবস্থান অর্জন করাও যায় না।
কালীঘাটে শঙ্খধ্বনি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে মমতার বক্তব্য শোনাই যাচ্ছিল না। তবে তিনি তার সমর্থকদের শান্ত হতে বলার পর তার বক্তব্য শোনা গেল। যে জনপ্রত্যাশার কারণে তিনি আজ ক্ষমতায় এসেছেন সে প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পারেন সেটা কেউ বলতে পারবে না এখন। শাসন কার্য পরিচালনায় তিনি কতটা দক্ষতার পরিচয় দেবেন সেটাও কেউ বলতে পারবে না। কেবল তার রেলওয়ে মন্ত্রিত্ব চালানোর অভিজ্ঞতার কথা আমরা জানি। কিন্তু সেখানকার মতো রাজ্যের হাতে এত অর্থ নেই। তিনি যেসব কাজ করতে চান তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানও রাজ্যের নেই। তবে আমরা চাই, বামদের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের নেগেটিভ মনোভাবের কারণে তিনি ক্ষমতায় এলেও জনপ্রত্যাশার কিছুটা হলেও তিনি পূরণ করুন।
কলকাতা এই বিশ্বাসে স্থিত হতে চায় যে, একদলের পরিবর্তে আরেক দলের ক্ষমতারোহণ সম্পন্ন হয়েছে, এখন সবার পরিবর্তন হতে হবে। আর তা যদি না হয় তাহলে এজন্য কাউকে দায়ী করা যাবে না।

মিহির শর্মা :ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কলামিস্ট
ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.