শ্রমজীবী মানুষের নেতা by মুহম্মদ সবুর
প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী। জন্ম ১৯১৫ সালে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার কাট্টলীতে। ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ১৯৩২ সালে কলকাতার খিদিরপুর খ্রিস্টান মিশনারি হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তাকে স্কুলবিমুখ করে।
সে সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের সানি্নধ্যে আসেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। এরপর শুরু হয় তার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন। ১৯৪৪ সালে খিদিরপুর ডকে জাহাজি শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তোলেন। সে সময়ে চট্টগ্রামের অনেক জাহাজি শ্রমিক খিদিরপুর ডকে কর্মরত ছিল। '৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী দলে অংশ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। '৪৭ সালে সিলেটের গণভোটেও সক্রিয় ভূমিকা নেন। পাকিস্তান অর্জনের পর চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। গড়ে তোলেন জাহাজি শ্রমিক ইউনিয়ন। জাহাজি শ্রমিকদের এদেশে প্রথম সংগঠনটির তিনি ছিলেন আজীবন সভাপতি।
১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের নেপথ্যে থেকে সংগঠিত করেছেন। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাঙালি জাতির ইতিহাসে '৬৬ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। বাঙালির মুক্তি সনদ ঘোষিত হয়েছিল এই সময়। ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে জনসভা। দেশবাসী উৎকণ্ঠিত। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিব কী ঘোষণা দেন? আগে থেকেই প্রচার হয়ে গেছে, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসবে। জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা। ওই বছরের মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পুনরায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই মাসে পল্টনের জনসভায় ভাষণ দেওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে অবস্থানকালে আইয়ুবী সামরিক নির্যাতনে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। '৬৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন।
'৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। '৬৯ সালে যখন সারাদেশ গণঅভ্যুত্থানে অগি্নগর্ভ, তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে জনগণকে সংগঠিত করে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের নেতা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। '৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামকে সংগঠিত করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার সেসব বিশাল ইতিহাস। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে, তখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বস্ত জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছেই পাঠান স্বাধীনতা ঘোষণার বাণীটি। ওয়্যারলেসে পাঠানো সেই বাণীটি রাতের বেলায়ই চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজের মাধ্যমে বেতারযোগে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটিও পালন করেন তিনি। রাত সাড়ে ১১টায় পাঠানো মেসেজটি সে রাতেই অনুলিপি করে চট্টগ্রাম শহরেও বিতরণ করা হয়েছিল। যখন গণহত্যা চলছে; শক্তিশালী সামরিক বাহিনী সশস্ত্র হিংস্র মূর্তিতে নেমেছে বাঙালি নিধনে; তখন মুক্তিকামী বাঙালির প্রাণের বাণীটি ছড়িয়ে দেওয়ার ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ছিল জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্বাঞ্চলের লিবারেশন জোনের প্রধান ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বাধীন এলাকায় তখন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন ১০৩ জন। পরে দক্ষিণ-পূর্ব প্রশাসনিক কাউন্সিল-২-এরও চেয়ারম্যান হন। ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে প্রথম বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন তিনি। পরে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে প্রথমে কুমিল্লা ও পরে ঢাকায় প্রশাসন চালু করেন। ২৩ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে জহুর আহমদ চৌধুরীই প্রথম ভাষণ দেন। ২৭ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা এবং শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন আমৃত্যু। '৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জহুর আহমদ চৌধুরী রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে সংগঠিত করছিলেন যোদ্ধাদের। যখন শরণার্থীদের সাহায্যার্থে প্রতিটি মুহূর্ত ছিলেন তৎপর, তখন তার বড় ছেলে সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী রাঙ্গুনিয়ার বিআইটির সামনে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে আরও কয়েক যোদ্ধার সঙ্গে শহীদ হন।
'৭৪ সালের ১ জুলাই সকাল পৌনে ৭টায় জহুর আহমদ চৌধুরী পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান পরপারে। পরদিন সকালে তার মরদেহ চট্টগ্রামে নিয়ে এলে শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। চট্টগ্রামবাসী তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে শেষ অভিবাদন জানাতে এসেছিলেন সেদিন। বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালনকারী জহুর আহমদ চৌধুরী সাধারণের মতো জীবনযাপন করেও অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন শ্রম-কর্ম-মেধা-মননের বিশালত্বে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, জীবন থেকে পাঠ নিয়েছিলেন তিনি। মানুষকে দেখেছেন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। সাহিত্য, রাজনীতি বিচারে পড়াশোনাও কম ছিল না তার। ইংরেজিও চমৎকার লিখতেন ও বলতেন।
বাঙালির অগ্রনায়কদের জীবন-চরিত্র যখন রচনা হবে, তখন তিনি উদ্ভাসিত হবেন আপন মহিমায়; দুর্জয়, সাহসী মানব হিসেবে। কারণ যে শ্রম ও কর্ম এবং আদর্শ রেখে গেছেন তিনি; তার মৃত্যু নেই।
মুহম্মদ সবুর :কবি ও প্রাবন্ধিক
১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের নেপথ্যে থেকে সংগঠিত করেছেন। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাঙালি জাতির ইতিহাসে '৬৬ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। বাঙালির মুক্তি সনদ ঘোষিত হয়েছিল এই সময়। ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে জনসভা। দেশবাসী উৎকণ্ঠিত। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিব কী ঘোষণা দেন? আগে থেকেই প্রচার হয়ে গেছে, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসবে। জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা। ওই বছরের মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পুনরায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই মাসে পল্টনের জনসভায় ভাষণ দেওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে অবস্থানকালে আইয়ুবী সামরিক নির্যাতনে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। '৬৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন।
'৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। '৬৯ সালে যখন সারাদেশ গণঅভ্যুত্থানে অগি্নগর্ভ, তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে জনগণকে সংগঠিত করে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের নেতা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। '৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামকে সংগঠিত করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার সেসব বিশাল ইতিহাস। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে, তখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বস্ত জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছেই পাঠান স্বাধীনতা ঘোষণার বাণীটি। ওয়্যারলেসে পাঠানো সেই বাণীটি রাতের বেলায়ই চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজের মাধ্যমে বেতারযোগে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটিও পালন করেন তিনি। রাত সাড়ে ১১টায় পাঠানো মেসেজটি সে রাতেই অনুলিপি করে চট্টগ্রাম শহরেও বিতরণ করা হয়েছিল। যখন গণহত্যা চলছে; শক্তিশালী সামরিক বাহিনী সশস্ত্র হিংস্র মূর্তিতে নেমেছে বাঙালি নিধনে; তখন মুক্তিকামী বাঙালির প্রাণের বাণীটি ছড়িয়ে দেওয়ার ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ছিল জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্বাঞ্চলের লিবারেশন জোনের প্রধান ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বাধীন এলাকায় তখন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন ১০৩ জন। পরে দক্ষিণ-পূর্ব প্রশাসনিক কাউন্সিল-২-এরও চেয়ারম্যান হন। ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে প্রথম বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন তিনি। পরে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে প্রথমে কুমিল্লা ও পরে ঢাকায় প্রশাসন চালু করেন। ২৩ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে জহুর আহমদ চৌধুরীই প্রথম ভাষণ দেন। ২৭ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা এবং শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন আমৃত্যু। '৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জহুর আহমদ চৌধুরী রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে সংগঠিত করছিলেন যোদ্ধাদের। যখন শরণার্থীদের সাহায্যার্থে প্রতিটি মুহূর্ত ছিলেন তৎপর, তখন তার বড় ছেলে সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী রাঙ্গুনিয়ার বিআইটির সামনে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে আরও কয়েক যোদ্ধার সঙ্গে শহীদ হন।
'৭৪ সালের ১ জুলাই সকাল পৌনে ৭টায় জহুর আহমদ চৌধুরী পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান পরপারে। পরদিন সকালে তার মরদেহ চট্টগ্রামে নিয়ে এলে শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। চট্টগ্রামবাসী তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে শেষ অভিবাদন জানাতে এসেছিলেন সেদিন। বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালনকারী জহুর আহমদ চৌধুরী সাধারণের মতো জীবনযাপন করেও অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন শ্রম-কর্ম-মেধা-মননের বিশালত্বে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, জীবন থেকে পাঠ নিয়েছিলেন তিনি। মানুষকে দেখেছেন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। সাহিত্য, রাজনীতি বিচারে পড়াশোনাও কম ছিল না তার। ইংরেজিও চমৎকার লিখতেন ও বলতেন।
বাঙালির অগ্রনায়কদের জীবন-চরিত্র যখন রচনা হবে, তখন তিনি উদ্ভাসিত হবেন আপন মহিমায়; দুর্জয়, সাহসী মানব হিসেবে। কারণ যে শ্রম ও কর্ম এবং আদর্শ রেখে গেছেন তিনি; তার মৃত্যু নেই।
মুহম্মদ সবুর :কবি ও প্রাবন্ধিক
No comments