পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ-সরে গেল বিশ্বব্যাংক, ঋণ বাতিল

শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করে দিল বিশ্বব্যাংক। সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলেও বাংলাদেশ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।


গতকাল শনিবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বা ইতিবাচক সাড়া না মেলায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সহায়তায় ১২০ কোটি ডলার ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে।
গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে সংকট সুরাহার তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল দায়ীদের ছুটি দিয়ে একটি বিকল্প পদ্ধতিতে সেতুর কাজ সম্পন্ন করা। কিন্তু বাংলাদেশ তা গ্রহণ না করায় শেষ চেষ্টাও ভেস্তে যায়। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের দুর্নীতির কারণেই ভেঙে গেল সহজ শর্তের ঋণের পদ্মা সেতু।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বহুপক্ষীয় দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তার অধ্যায় আপাতত শেষ হতে যাচ্ছে। এর আগে নির্মাণ করা বঙ্গবন্ধু সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকই ছিল মূল দাতাসংস্থা। পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানের দাতা সংস্থা জাইকাও ঋণচুক্তি বাতিল করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। সে সময় এ নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এরপর বিশ্বব্যাংক ঋণসহায়তা স্থগিত করে দেয়। অন্য দাতারাও সাহায্য স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়। এর ১০ মাস পর গতকাল ঋণচুক্তি পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হলো।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। সরকারের আশা ছিল, কাজ শুরু করে মেয়াদের মধ্যেই এর নির্মাণকাজ শেষ করবে। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনলে কাজ স্থগিত হয়ে যায়। এরপর সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে উৎসাহ দেখানো হলেও সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা নতুন করে শুরু করে। কিন্তু তাতে আর কাজ হলো না। চুক্তি বাতিলের ঘটনাকে ‘বজ্রপাতের শামিল’ বলে মন্তব্য করেছেন বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
গতকাল ছিল বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের শেষ দিন: বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের মেয়াদ গতকালই শেষ হয়েছে। শেষ দিনে বাতিল করা হলো পদ্মা সেতুর চুক্তি। গত ফেব্রুয়ারিতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তা ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছিল। বাংলাদেশ তিন মাসের সময় চাইলেও বিশ্বব্যাংক ছয় মাস করলে তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ছয় মাস চায়নি। তবে জানা গেছে, সরকারের ভেতর থেকেই একজন উপদেষ্টা ছয় মাস মেয়াদ বাড়ানোর তদবির করেছিলেন। সরকারের মধ্যে এ ধারণা ছিল যে বিশ্বব্যাংকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট থাকাকালে সমস্যার সমাধান হবে না। পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ২৯ জুলাই, আর রবার্ট জোয়েলিকের মেয়াদ ছিল ৩০ জুন। কিন্তু রবার্ট জোয়েলিকের সময়ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল বিশ্বব্যাংক।
অর্থমন্ত্রী গতকাল এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া বিবৃতির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এটি বিদায়ী সভাপতি রবার্ট জোয়েলিকের ব্যক্তিগত মন্তব্য।’
শেষ সময়ের তৎপরতা: বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালক অ্যালেন গোল্ডস্টেইন লম্বা সময়ের জন্য বাংলাদেশের বাইরে থাকবেন বলে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিন দিন পর হঠাৎ করেই তিনি ফিরে আসেন। সঙ্গে ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সির দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ সময় বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সমস্যার সমাধানে তিন দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবের কথা বিশ্বব্যাংক তাদের বিবৃতিতেও উল্লেখ করেছে।
প্রস্তাবগুলো ছিল, যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ছুটি দেওয়া; অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগ করা একটি প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি, যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন-সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক বিকল্প ‘টার্ন-কি’ পদ্ধতিতে অগ্রসর হওয়ার জন্য ওই দিন প্রস্তাব দিয়েছিল। ‘টার্ন-কি’ পদ্ধতি হচ্ছে, নির্মাতারা সেতুটি তৈরি করে এর মালিক বা সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে। সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব ছিল, একটি নিরপেক্ষ কমিটি পুরো সেতুর নির্মাণ-প্রক্রিয়া দেখভাল করবে। মন্ত্রণালয়ের কোনো একক কর্তৃত্ব সেখানে থাকবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল চলে যাওয়ার পরপরই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে এসব শর্ত মানা সম্ভব নয় বলে জানানো হয়। এরপর গতকাল আসে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত।
বিশ্বব্যাংক গতকাল বলেছে, ‘আমরা বিশ্বব্যাংকের অবস্থান ব্যাখ্যা করা এবং সরকারের জবাব জানার জন্য ঢাকায় একটি উচ্চপর্যায়ের দল পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া বা জবাব সন্তোষজনক ছিল না।’
সংকটের শুরু সেপ্টেম্বরে: গত সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী যান ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন গত ২১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের ভাষায়, অত্যন্ত গোপনীয় এ প্রতিবেদন দেন বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড এফ ম্যাকার্থি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুর মূল অংশের প্রাক-যোগ্যতা চুক্তির প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিসংক্রান্ত অসংখ্য অভিযোগ পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। অভিযোগগুলো মূলত তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও তাঁর মালিকানাধীন কোম্পানি সাকোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, যোগাযোগমন্ত্রী ও সাকোর কর্মকর্তারা মিলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে মনে হচ্ছে, সাকো হলো পদ্মা সেতু নির্মাণের যেকোনো কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একধরনের নীরব প্রতিনিধি (সাইলেন্ট এজেন্ট)। কোনো কাজ পেতে হলে বা প্রাক-যোগ্যতায় টিকতে হলে সাকোকে অর্থ দিতে হবে। সাকোর পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের ভয়ভীতি দেখানোর কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাকোরই একজন প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংককে জানান, পদ্মা সেতুর মূল অংশের জন্য যে চুক্তিমূল্য হবে, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ সাকোর জন্য রাখার ব্যাপারে সৈয়দ আবুল হোসেনেরই নির্দেশনা ছিল। বলা হয়, সাকোকে নির্দিষ্ট কমিশন দেওয়া হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন সৈয়দ আবুল হোসেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আরেকটি সূত্র থেকে বিশ্বব্যাংক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও অভিযোগের কথা জানতে পারে। সেটি হলো, সাকোর পাশাপাশি অন্য একটি কোম্পানিকেও সাকোর হয়ে কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন আবুল হোসেন। কোম্পানিটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ভয়ভীতিও দেখান মন্ত্রী। সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাকোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংক পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সেতু বিভাগের সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে করা হয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিমন্ত্রী। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দাবি করে, তারা তদন্ত করে মন্ত্রীর দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। ফেব্রুয়ারিতে দুদকের এ বক্তব্যের পর গত এপ্রিলে আবার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয় বিশ্বব্যাংক। সেই প্রতিবেদনে মন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১০ শতাংশ কমিশন চেয়েছিলেন। এ নিয়ে এখনো তদন্ত করছে দুদক।
নানা রকম বক্তব্য: গত ১০ মাসে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হলেও তা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক সূত্র জানায়। বাংলাদেশের অনুরোধে চুক্তির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হলেও তা নিয়ে একেক মন্ত্রী একেক রকম কথা বলেছেন। যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নিয়ে আলোচনা হলেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। আবার বিশ্বব্যাংক সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিলেও প্রধানমন্ত্রী সংসদে ও সংসদের বাইরে বলেন, প্রমাণ বিশ্বব্যাংককেই দিতে হবে।
জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দেওয়ায় বিশ্বব্যাংকও বিভ্রান্ত হয়। সরকারের প্রকৃত মনোভাব জানতে তাদের জন্য সমস্যা তৈরি হয়। ফলে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা পিছিয়েও পড়েছিল।
কানাডায় বিচার: অর্থের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে পদ্মা সেতুর পরামর্শক হতে আগ্রহী কানাডাভিত্তিক প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে দুহাইমকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ। আর গত ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয় প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তা রমেশ সাহা ও মোহাম্মদ ইসমাইলকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঘুষ দেওয়ার পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। বিচারও শুরু হয়েছে তাঁদের। এতে পদ্মা সেতুর বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনায় চলে যায়। সর্বশেষ গতকাল বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হলো ঋণ বাতিলের খবর। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদেরা।

No comments

Powered by Blogger.