ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণহীন, বর্ষার শুরুতেই ডেঙ্গুর হানা by অমিতোষ পাল ও তৌফিক মারুফ
এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে। রাজধানীসহ দেশের আরো কিছু এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিসিসি দুই ভাগ হওয়ার পর অনেক কাজেই স্থবিরতা নেমে এসেছে।
পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ঢিলামি এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। অন্যান্য বছর মার্চ থেকে জুন মাস সময়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডেও বিশেষ পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলেছে। এবার কোনো ওয়ার্ডেই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হয়নি। ডোবা-নালার কচুরিপানা পরিষ্কারেও কোনো বাজেট বরাদ্দ করা হয়নি। ফলে মশার যন্ত্রণা ও এডিস মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমে গেলেও রোগের বিস্তার তুলনামূলক বাড়ছে। বিশেষ করে অভিজাত এলাকায় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন ও বিস্তার ঘটছে বেশি। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও জরিপ চালিয়ে এমন পরিস্থিতির প্রমাণ পেয়েছে।
ডেঙ্গু রোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সবে বর্ষা শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই প্রতিদিনই কমবেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাচ্ছি। তবে আশার কথা হচ্ছে, মানুষ আগের চেয়ে ডেঙ্গুর চিকিৎসার বিষয়ে অধিকতর সচেতন হওয়ার ফলে এখন ডেঙ্গুর লক্ষণ বুঝতে পেরেই দেরি না করে রোগী ছুটে আসছে চিকিৎসকের কাছে। আর যথাযথ চিকিৎসা হলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে।' তিনি আরো বলেন, এ রোগে মৃত্যু কমে গেলেও আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ যেহেতু কয়েক বছরে কমছে না। এ থেকে বোঝা যায়, ডেঙ্গুর জীবাণুর উৎস বন্ধ করা যাচ্ছে না। এটা করতে না পারলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে।
রাজধানীতে মশার উপদ্রব সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ও এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে এত দিন জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে রাজধানীর বদ্ধ জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করে এসেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। কিন্তু এবার কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়নি। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের কোথাও বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযানও পরিচালনা করা হয়নি।
ডিসিসি ভাগ হওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশনে প্রশাসক হিসেবে চারজন দায়িত্ব পালন করলেও তাঁরা এ পর্যন্ত কেউই মাঠে নামেননি। অন্যান্যবার বিভিন্ন পেশাজীবী ও কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করেছে ডিসিসি। এবার দুই করপোরেশনের কোথাও এ ধরনের কাজ করা হয়নি। এর ওপর রয়েছে মশার ওষুধেরও সংকট। সব মিলিয়ে এবার ডেঙ্গু অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে অনেকেই।
এ প্রসঙ্গে ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এডিস মশার সুপ্ত লার্ভাগুলো জীবন্ত হয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বর্তমানে চলছে সেই মৌসুম। এ জন্য আগেভাগেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধনের বিশেষ কার্যক্রম চালানো জরিুর ছিল। তাহলে এডিস মশার বিস্তার অনেকাংশে রোধ হতো। সে ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর ঝুঁকিও স্বাভাবিকভাবেই কমে যেত। কিন্তু এবার সেটা হয়নি।
রাজধানীর মগবাজারের ৬৩৮ পেয়ারাবাগের গৃহবধূ নিশাত সাবেরা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাঁচ তলার ওপর থাকি। তার পরও মশার যন্ত্রণার কম নেই। বিশেষ করে ছয় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে খুবই ভয়ে থাকি। কারণ এখন ডেঙ্গু মৌসুম। ডেঙ্গু নাকি সকাল-সন্ধ্যায় কামড়াতে পছন্দ করে। এ জন্য ওই সময়ে বাচ্চাকে মশারির ভেতরে রেখে দেই।'
মগবাজারের ৩৭৩ দিলু রোডের বাসিন্দা তৃষ্ণা বেগম বলেন, 'মগবাজার এলাকায় কয়েকজন এডিস মশার কামড় খেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বলে শুনেছি। এ জন্য আমরাও ভয়ে আছি।' তাঁর মন্তব্য, 'সাধারণ মশার কামড় খেয়ে না হয় একটু ব্যথা পেলাম। এডিস মশা কামড় দিলে তো জীবন নিয়েই টানাটানি বেঁধে যাবে।'
কেবল মগবাজার এলাকাই নয়, রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকাসহ নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকার বাসিন্দাই এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে ভুগছে। বিশেষ করে ভিআইপি এলাকার বাসিন্দাদের ভয় আরো বেশি। কারণ এডিস মশার বিস্তার বনেদি এলাকাতেই বেশি ঘটে। এসব এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমও তেমন চোখে পড়ছে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. হারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এ পদে যোগদানের পরপরই কচুরিপানা অপসারণের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। সেটা পাসও হয়ে গেছে। শিগগিরই কচুরিপানা অপসারণের কাজ শুরু হবে। আর স্বাভাবিক মশক নিধনে কাজ চলছে। ওষুধের যাতে সংকট না হয়, সে জন্য নতুন করে আরো ওষুধ কেনারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, 'পরিচ্ছন্নতা অভিযান আমাদের আরো জোরদার করা প্রয়োজন- এ কথা ঠিক। কিন্তু যারা মশার ওষুধ ছিটায়, তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। সেটা করা গেলে আরো ভালো ফল পাওয়া যেত।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. খন্দকার মো. শিফায়েতুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরই বর্ষার সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। তবে এ রোগের চিকিৎসা এখন সহজ হয়ে যাওয়ায় মানুষের ভয় কমেছে। সময়মতো চিকিৎসার ফলে মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে। তবে পারিপাশ্বর্িক কিছু কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর রাজধানীর কয়েকটি অভিজাত এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডেঙ্গুর জীবাণুর উৎস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও জরিপে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা যায়। এ জরিপের আওতাভুক্ত এলাকার শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ বাড়িঘরে এমন পরিবেশ ছিল, যা এডিস মশার নিরাপদ প্রজনন ও বংশবিস্তারের উপযুক্ত ঘাঁটি। রাজধানীর অন্যান্য এলাকার স্থায়ী জলাশয়, খাদ, গাড়ির গ্যারেজ, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসার মতো পরিত্যক্ত বস্তুতেও মশার লার্ভার অবস্থান রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, 'ডেঙ্গু জ্বর মনিটরিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য জানানো সাপেক্ষে তা রেকর্ড করা হয়। তবে এবার কোনো হাসপাতাল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য এসেছে বলে আমার জানা নেই।'
ওই কর্মকর্তা বলেন, এ বছরের শেষ দিকে দেশের চারটি শহরে ডেঙ্গু রোগের ওপর একটি বিশেষ সমীক্ষা করা হবে, যা থেকে বের করার চেষ্টা করা হবে যে ডেঙ্গুর ধরন-ধারণ আগের মতোই আছে, নাকি নতুন কোনো রূপ নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ : ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুতে জ্বর সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় দিন থাকে এবং এরপর জ্বর সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তবে কখনো কখনো দুই বা তিন দিন পর আবার জ্বর আসতে পারে। জ্বর কমে গেলে বা ভালো হয়ে গেলে অমনক রোগী এমনকি অনেক ডাক্তারও মনে কমরন যে রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বরে মারাত্মক সমস্যা হয় এমন সময়েই। এ সময় প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাওয়ার পরবর্তী কিছুদিনকে তাই বলা হয় ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড। এ সময় সবারই সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, জ্বরের শুরুতে বা দু-এক দিনের জ্বরে রক্ত পরীক্ষায় কোনো কিছু শনাক্ত নাও হতে পারে এবং তা রোগ নির্ণয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। রোগী এমনকি ডাক্তারও মনে করতে পারেন যে রিপোর্ট ভালো আছে, তাই আর কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। মনে রাখতে হবে যে প্লাটিলেট কাউন্ট চার বা পাঁচ দিন পর থেকে কমতে শুরু করে। তাই জ্বর শুরুর পাঁচ বা ছয় দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। এর আগে পরীক্ষা করলে তা স্বাভাবিক থাকে বিধায় রোগ নির্ণয়ে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, তেমনি অপ্রয়োজনে পয়সা নষ্ট হয়।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, 'অনেকেই দিনে দুই-তিনবার করে প্লাটিলেট কাউন্ট করে থাকেন। আসলে প্লাটিলেট কাউন্ট দিনে একবার করাই যথেষ্ট, এমনকি মারাত্মক ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারেও। তা ছাড়া একই সঙ্গে একাধিক ল্যাবরেটরি থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট না করানোই ভালো। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।' ডা. আব্দুল্লাহ জানান, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে মৃত্যুহার ৫ থেকে ১০ শতাংশ; কিন্তু বাস্তবে, নিজের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় এই হার ১ শতাংশেরও কম।
(ডেঙ্গু বিষয়ে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহর পরামর্শ বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছে আজ কালের কণ্ঠের ৩-এর পাতার নিয়মিত হেলথ কর্নারে)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমে গেলেও রোগের বিস্তার তুলনামূলক বাড়ছে। বিশেষ করে অভিজাত এলাকায় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন ও বিস্তার ঘটছে বেশি। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও জরিপ চালিয়ে এমন পরিস্থিতির প্রমাণ পেয়েছে।
ডেঙ্গু রোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সবে বর্ষা শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই প্রতিদিনই কমবেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাচ্ছি। তবে আশার কথা হচ্ছে, মানুষ আগের চেয়ে ডেঙ্গুর চিকিৎসার বিষয়ে অধিকতর সচেতন হওয়ার ফলে এখন ডেঙ্গুর লক্ষণ বুঝতে পেরেই দেরি না করে রোগী ছুটে আসছে চিকিৎসকের কাছে। আর যথাযথ চিকিৎসা হলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে।' তিনি আরো বলেন, এ রোগে মৃত্যু কমে গেলেও আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ যেহেতু কয়েক বছরে কমছে না। এ থেকে বোঝা যায়, ডেঙ্গুর জীবাণুর উৎস বন্ধ করা যাচ্ছে না। এটা করতে না পারলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে।
রাজধানীতে মশার উপদ্রব সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ও এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে এত দিন জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে রাজধানীর বদ্ধ জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করে এসেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। কিন্তু এবার কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়নি। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের কোথাও বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযানও পরিচালনা করা হয়নি।
ডিসিসি ভাগ হওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশনে প্রশাসক হিসেবে চারজন দায়িত্ব পালন করলেও তাঁরা এ পর্যন্ত কেউই মাঠে নামেননি। অন্যান্যবার বিভিন্ন পেশাজীবী ও কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করেছে ডিসিসি। এবার দুই করপোরেশনের কোথাও এ ধরনের কাজ করা হয়নি। এর ওপর রয়েছে মশার ওষুধেরও সংকট। সব মিলিয়ে এবার ডেঙ্গু অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে অনেকেই।
এ প্রসঙ্গে ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এডিস মশার সুপ্ত লার্ভাগুলো জীবন্ত হয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বর্তমানে চলছে সেই মৌসুম। এ জন্য আগেভাগেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধনের বিশেষ কার্যক্রম চালানো জরিুর ছিল। তাহলে এডিস মশার বিস্তার অনেকাংশে রোধ হতো। সে ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর ঝুঁকিও স্বাভাবিকভাবেই কমে যেত। কিন্তু এবার সেটা হয়নি।
রাজধানীর মগবাজারের ৬৩৮ পেয়ারাবাগের গৃহবধূ নিশাত সাবেরা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাঁচ তলার ওপর থাকি। তার পরও মশার যন্ত্রণার কম নেই। বিশেষ করে ছয় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে খুবই ভয়ে থাকি। কারণ এখন ডেঙ্গু মৌসুম। ডেঙ্গু নাকি সকাল-সন্ধ্যায় কামড়াতে পছন্দ করে। এ জন্য ওই সময়ে বাচ্চাকে মশারির ভেতরে রেখে দেই।'
মগবাজারের ৩৭৩ দিলু রোডের বাসিন্দা তৃষ্ণা বেগম বলেন, 'মগবাজার এলাকায় কয়েকজন এডিস মশার কামড় খেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বলে শুনেছি। এ জন্য আমরাও ভয়ে আছি।' তাঁর মন্তব্য, 'সাধারণ মশার কামড় খেয়ে না হয় একটু ব্যথা পেলাম। এডিস মশা কামড় দিলে তো জীবন নিয়েই টানাটানি বেঁধে যাবে।'
কেবল মগবাজার এলাকাই নয়, রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমণ্ডি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকাসহ নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকার বাসিন্দাই এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে ভুগছে। বিশেষ করে ভিআইপি এলাকার বাসিন্দাদের ভয় আরো বেশি। কারণ এডিস মশার বিস্তার বনেদি এলাকাতেই বেশি ঘটে। এসব এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমও তেমন চোখে পড়ছে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. হারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এ পদে যোগদানের পরপরই কচুরিপানা অপসারণের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। সেটা পাসও হয়ে গেছে। শিগগিরই কচুরিপানা অপসারণের কাজ শুরু হবে। আর স্বাভাবিক মশক নিধনে কাজ চলছে। ওষুধের যাতে সংকট না হয়, সে জন্য নতুন করে আরো ওষুধ কেনারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, 'পরিচ্ছন্নতা অভিযান আমাদের আরো জোরদার করা প্রয়োজন- এ কথা ঠিক। কিন্তু যারা মশার ওষুধ ছিটায়, তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। সেটা করা গেলে আরো ভালো ফল পাওয়া যেত।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. খন্দকার মো. শিফায়েতুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরই বর্ষার সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। তবে এ রোগের চিকিৎসা এখন সহজ হয়ে যাওয়ায় মানুষের ভয় কমেছে। সময়মতো চিকিৎসার ফলে মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে। তবে পারিপাশ্বর্িক কিছু কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর রাজধানীর কয়েকটি অভিজাত এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডেঙ্গুর জীবাণুর উৎস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও জরিপে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা যায়। এ জরিপের আওতাভুক্ত এলাকার শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ বাড়িঘরে এমন পরিবেশ ছিল, যা এডিস মশার নিরাপদ প্রজনন ও বংশবিস্তারের উপযুক্ত ঘাঁটি। রাজধানীর অন্যান্য এলাকার স্থায়ী জলাশয়, খাদ, গাড়ির গ্যারেজ, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসার মতো পরিত্যক্ত বস্তুতেও মশার লার্ভার অবস্থান রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, 'ডেঙ্গু জ্বর মনিটরিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য জানানো সাপেক্ষে তা রেকর্ড করা হয়। তবে এবার কোনো হাসপাতাল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য এসেছে বলে আমার জানা নেই।'
ওই কর্মকর্তা বলেন, এ বছরের শেষ দিকে দেশের চারটি শহরে ডেঙ্গু রোগের ওপর একটি বিশেষ সমীক্ষা করা হবে, যা থেকে বের করার চেষ্টা করা হবে যে ডেঙ্গুর ধরন-ধারণ আগের মতোই আছে, নাকি নতুন কোনো রূপ নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ : ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুতে জ্বর সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় দিন থাকে এবং এরপর জ্বর সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তবে কখনো কখনো দুই বা তিন দিন পর আবার জ্বর আসতে পারে। জ্বর কমে গেলে বা ভালো হয়ে গেলে অমনক রোগী এমনকি অনেক ডাক্তারও মনে কমরন যে রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বরে মারাত্মক সমস্যা হয় এমন সময়েই। এ সময় প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাওয়ার পরবর্তী কিছুদিনকে তাই বলা হয় ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড। এ সময় সবারই সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, জ্বরের শুরুতে বা দু-এক দিনের জ্বরে রক্ত পরীক্ষায় কোনো কিছু শনাক্ত নাও হতে পারে এবং তা রোগ নির্ণয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। রোগী এমনকি ডাক্তারও মনে করতে পারেন যে রিপোর্ট ভালো আছে, তাই আর কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। মনে রাখতে হবে যে প্লাটিলেট কাউন্ট চার বা পাঁচ দিন পর থেকে কমতে শুরু করে। তাই জ্বর শুরুর পাঁচ বা ছয় দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। এর আগে পরীক্ষা করলে তা স্বাভাবিক থাকে বিধায় রোগ নির্ণয়ে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, তেমনি অপ্রয়োজনে পয়সা নষ্ট হয়।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ বলেন, 'অনেকেই দিনে দুই-তিনবার করে প্লাটিলেট কাউন্ট করে থাকেন। আসলে প্লাটিলেট কাউন্ট দিনে একবার করাই যথেষ্ট, এমনকি মারাত্মক ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারেও। তা ছাড়া একই সঙ্গে একাধিক ল্যাবরেটরি থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট না করানোই ভালো। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।' ডা. আব্দুল্লাহ জানান, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে মৃত্যুহার ৫ থেকে ১০ শতাংশ; কিন্তু বাস্তবে, নিজের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় এই হার ১ শতাংশেরও কম।
(ডেঙ্গু বিষয়ে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহর পরামর্শ বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছে আজ কালের কণ্ঠের ৩-এর পাতার নিয়মিত হেলথ কর্নারে)।
No comments