সাংবাদিক ঐক্যে ফাটল by এ এম এম শওকত আলী

২৪ জুন টিভি চ্যানেলগুলোর বহুল প্রচারিত ও আলোচিত সংবাদ ছিল সাংবাদিকদের মধ্যে ঝগড়া ও হাতাহাতি। প্রেসক্লাবের সামনে এবং ভেতরেও এ বিষয়টি ছিল দৃশ্যমান। বলা যায়, সাংবাদিকতার ইতিহাসে এমনটি কখনো হয়নি। সাংবাদিকরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য হলো বাক-স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা।


এ ধরনের লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে তাঁরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে জনমত গঠন করে থাকেন। এ কাজ সুশাসনের সহায়ক। কারণ তথ্য অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুষম বিকাশ হয়।
এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকরা জনমানুষের আস্থা অর্জন করেন। তবে কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা বিভিন্ন ধরনের বিপদের সম্মুখীন হন। যার মধ্যে প্রাণনাশের হুমকিও বিরল নয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এ দেশসহ অন্যান্য দেশের কিছু সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাণও হারিয়েছেন। সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়েই সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে কিছু সাংবাদিক আদালত অবমাননার দায়েও অভিযুক্ত হন। আবার কিছু সাংবাদিক ক্ষমতাসীন দলের আক্রোশের সম্মুখীন হন। অভিযোগ করা হয়, তাঁরা সব সময়ই ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করছেন। এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তখন যখন কোনো গণমাধ্যম সরকারের বেআইনি বা অনৈতিক কার্যকলাপের সংবাদ জনসমক্ষে প্রকাশ করে। সার্বিকভাবে সাংবাদিকরা জনস্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করেন; কারণ তাঁদের বস্তুনিষ্ঠ কাজের ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়। এ ফল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অর্জন করা সম্ভব। এ জন্য প্রথাগতভাবে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
সাংবাদিকরা জনগণের আস্থা তখনই অর্জন করতে পারেন যখন তাঁরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেন। তবে গণমাধ্যমের সবাই যে এ ধরনের কাজ করবেন তা আশা করা যায় না; কারণ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ বাস্তবতা স্বীকার না করে উপায় নেই। এ সত্ত্বেও গণমাধ্যমের একতা অনেক অটুট বা দৃঢ়। এদের বিষয়ভিত্তিক সংগঠনও একাধিক। শীর্ষ সংগঠন হলো বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস (বিএফইউজে)। গণমাধ্যম এখন মূলত দুই রকমের। এক, সংবাদপত্র; দুই, টিভি চ্যানেল। এ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পেশায় সবাই সাংবাদিক। দুই মাধ্যমই জনগণের জন্য তথ্য অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করে।
২৪ জুনের ঘটনায় দেখা যায়, তাঁদের ঐক্যে ফাটল ধরেছে। সাগর ও রুনি হত্যা মামলার ধীরগতির জন্য কিছুদিন ধরেই গণমাধ্যমের কর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কে বা কারা এর সঙ্গে জড়িত তা পুলিশ এবং র‌্যাব এখনো জানাতে পারেনি। এরই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। তাঁরা একজোট হয়ে এর প্রতিবাদও করতে শুরু করেন। ২৪ জুনও প্রেসক্লাবের সামনে তাঁরা মানববন্ধনে মিলিত হন। এতে কিছু সাংবাদিক বক্তব্যও দেন। তাঁদের মধ্যে একজন বেসরকারি এক টিভি মিডিয়ার মালিকের সম্পৃক্ততার বিষয়ও উল্লেখ করেন। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী কিছু সাংবাদিক এর ফলে প্রতিবাদমুখর হয়ে বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ দাবি করেন। পরে উত্তেজনাকর পরিবেশের একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিসহ হাতাহাতিও হয়। ঐক্যের ফাটল তখন ঘটে।
প্রমাণ খুঁজে বের করার দায়িত্ব তদন্তকারী সংস্থার। অন্য কারো নয়। কিছুদিন থেকেই ওই মালিকের সম্পৃক্ততার বিষয় ছিল আলোচিত। এ জন্য কয়েক দিন আগে র‌্যাবের একটি তদন্ত দল ওই চ্যানেলের মালিককেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এক দিনেই ফল অর্জন করা কোনো তদন্তেই হয় না। পক্ষ-বিপক্ষজনিত অনভিপ্রেত ঘটনা খুব বেশি দূর গড়ায়নি। বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তবে প্রবহমান ঘটনা থেকে এ কথা বলা যায় যে এর পূর্ণ পরিসমাপ্তি অচিরেই হবে না। পরবর্তী কয়েকটি ঘটনা এর প্রমাণ দেয়।
এক, ওই টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা ওই দিনই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কিছু বক্তব্য দেন। দুই, কিছু সংগঠনের নেতারা সন্ধ্যায় কিছু চ্যানেলে টক শোতে অংশগ্রহণ করেন। কাজেই বলা যায়, ঘটনা নিয়ে বিতর্কের শেষ এখনো হয়নি। সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলটি কেন প্রেস ব্রিফিং আহ্বান করল তা বোধগম্য নয়। কারণ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তারা এ কথাও উল্লেখ করে যে তারাও সাগর-রুনি হত্যার দ্রুত বিচার কামনা করে। পক্ষান্তরে মানববন্ধনের উদ্দেশ্য ছিল একই। ওই টিভি চ্যানেলের মালিকের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উল্লেখ করাই ছিল ওই দিনের ঘটনার মূল অথচ এ বিষয়টি নিয়ে আগে যে কোনো আলোচনা হয়নি তা নয়। অন্যথায় র‌্যাবের তদন্ত দল মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করত না।
তিন, পরবর্তী ঘটনার দিন জুন ২৫। বিভিন্ন সংগঠনের নেতাসহ নবীন-প্রবীণ সাংবাদিকরা আবার মানববন্ধনে বক্তব্য দেন। জানা গেছে, সংগঠনগুলো ওই চ্যানেলের ৯ জন সাংবাদিকসহ মোট ১০ জনের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া কিছু বক্তব্যে ওই চ্যানেলের মালিককে গ্রেপ্তার করার দাবি করা হয়। কিছু প্রবীণ সাংবাদিক ২৪ জুনের ঘটনাকে লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেন। তাঁরা সাংবাদিক ঐক্য অটুট রাখার আহ্বানও জানান। বিগত ৪০ বছরে এটাই প্রথম ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কথিত মালিককে গণমাধ্যমের শত্রু কেন বলা হলো- এর একটাই কারণ থাকতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই চ্যানেলের মালিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এ ধারণার ভিত্তি কী তা খুঁজে বের করাই মূল চ্যালেঞ্জ। তবে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ধারণার ভিত্তি কী তাও অজানা। যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো, বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। মালিকের সপক্ষে যে সাংবাদিকরা কথা বলেছেন তাঁদের অবস্থান হলো- উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কেন মালিককে নিয়ে এত প্রশ্ন?
চার, ২৬ জুনের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, সাংবাদিকরা বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তাঁরা মিছিল করে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যাওয়ার সময় মধ্যবর্তী কোনো এক জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব তাঁদের স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। এ স্মারকলিপিতে বিভিন্ন দাবি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের মালিককে গ্রেপ্তার এর মধ্যে একটি। অন্য দাবির সংখ্যাই বেশি, যার মধ্যে গণমাধ্যমের বিদ্যমান আইন ও বিধির সংস্কার। উদ্দেশ্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এ স্বাধীনতার মাত্রার বিষয়টি বিতর্কিত। কারণ এতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। সব ক্ষমতাসীন সরকারই মনে করে এ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিষয়টি অনুসন্ধানের দাবি রাখে। এ জন্য মূল কাজ হবে প্রচলিত আইন ও বিধিতে কোন ধারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে। এর সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। এর জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধানের ঐতিহাসিক বিবর্তন পরীক্ষা করা যেতে পারে। চলমান ঘটনাপ্রবাহের বৃহত্তর আঙ্গিক হলো, সাংবাদিকরা বর্তমানে ঐক্যবদ্ধ। তবে উত্থাপিত দাবি পূরণ হবে কি না তা ভবিষ্যতে জানা যাবে। চলমান ঘটনাপ্রবাহে মূল বিষয়টির কিছু নমুনাও ২৬ জুন দৃশ্যমান ছিল। তা হলো সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের মালিক সম্পর্কে নতুন ধরনের বিতর্ক- সরকারপ্রধান সম্পর্কে তাঁর কটূক্তির অভিযোগ, যা তিনি জনসমক্ষে অস্বীকার করেছেন। অন্যদিকে বিষয়টির প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড নিয়ে যতই আলোচনা হচ্ছে ঠিক একই মাত্রায় বিতর্ক ঘনীভূত হচ্ছে।
সাংবাদিকরা পেশাগতভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন- এটাই সবাই আশা করে। যাঁরা ২৪ জুন নিরপেক্ষতা বজায় না রেখে পক্ষ অবলম্বন করেছেন তাঁরা ভালো করেননি। এ নিয়ে জনমনে কিছু প্রশ্ন রয়েছে। যাঁকে নিয়ে কথা বলা হয়েছে, তিনিই ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা প্রদান করবেন। নিয়মমাফিক এটাই হওয়ার কথা। এর সঙ্গে সংগঠনের কিছু নেতা পূর্ববর্তী একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ওই চ্যানেলে কিছু টিভি তারকা মিলিত হয়ে মালিকের পক্ষে কথা বলেছিলেন। এ অনুষ্ঠানটি দর্শকরা সহজভাবে গ্রহণ করেননি। প্রশ্ন উঠেছে, তদন্ত যখন চলমান তাহলে কেন মালিকের পক্ষে এত সাফাই? মূল প্রশ্ন হলো, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার রহস্য কবে উন্মোচিত হবে? কবে প্রকৃত দোষীরা উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হবে? লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক, চ্যানেলের বিতর্কিত মালিকসহ অন্য সবাইকে তদন্তকারী সংস্থাকে সহযোগিতা করতে হবে। অন্যথায় এ অপরাধের গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান হবে না।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.