রম্য-দামদরের লম্ফঝম্ফ by সাইফুল আলম
আমি এবার তার মন্তব্যটার লেজটাকে চেপে ধরে একই সুরে বললাম, 'আমাদের ব্যবসায়ীরা এসব পালা-পার্বণে ক্রেতাদের পকেট কাটার জন্য আগে থেকেই যেন ছুরি-কাঁচিতে শান দিয়ে রাখেন। সম্প্রতি সংবাদপত্রে জানতে পারলাম পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার আগেই ছোলা, ডাল, তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।'
কিসমিস আলীকে এতটা উত্তপ্ত হতে এর আগে কখনও দেখিনি। হ্যাঁ, আমার পরানের বন্ধু কিসমিসের কথাই বলছি। আমি কারণটা শুধাতেও যেন সাহসকে কাছে পাচ্ছিলাম না। তখন বিকেলটা গড়িয়ে সন্ধ্যার আঁচলের নিচে লুকানোর পাঁয়তারা করছিল। নীরবতার দোলনায় খানিকটা দুলে এবার আমি তাকে শুধালাম, 'কী বিষয় দোস্ত, তোমার অঙ্গজুড়ে এত গোসা ভর করল কেন? সমস্যাটা কী?' আমার প্রশ্নটাকে লুফে নিয়ে সে অগি্নকণ্ঠে বলল, 'দেশে এসব কী চলছে বলতে পারো? সব ক্ষেত্রেই লাগামছাড়া দামদরের লম্ফঝম্ফ। উহ! জ্বলে গেলাম!' আমি খানিকটা বিনম্র কণ্ঠে বললাম, 'তা হয়েছে কি? খোলাসা করেই বলো না।'
'হবে আবার কী, ২৫ টাকার ডাবের দাম হাঁকছে ৫০ টাকা। গ্রীষ্মে গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাবের পানিও যেন ফুটন্ত হয়ে উঠছে। অথচ দেখার কেউ নেই। ক্রেতারা দিবি্ব মুখ বুজে সহ্য করছে।' আমি এবার একটু নিম্নস্বরে বললাম, 'দোস্ত চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে তো পণ্যের দাম বাড়বেই। এটাই স্বাভাবিক।' আমার নিরীহ চোখ দুটোয় সে যেন অগি্নদৃষ্টির মিসাইল ছুড়ে বলল, 'তাই বলে কি যার যা ইচ্ছে তা-ই করবে?' আমি শুধালাম, 'কে আবার কী করল?' সে পূর্ববর্তী রূপ ধারণ করেই বলল, 'কেন, লক্ষ্য করোনি বাজারের মূল্য পরিস্থিতি কতটা অনিয়ন্ত্রিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অবরোধ, হরতাল, ধর্মঘট, করের বোঝা_ এসব অজুহাতের কাঁধে চেপে বিক্রেতারা বগল বাজিয়ে পণ্যের দাম উচ্চৈঃস্বরে হেঁকে বসছে। ডাবের বিষয়টা তো নিছক একটা উদাহরণ।' আমি এবার আহত কণ্ঠে বললাম, 'তা তুমি মন্দ বলোনি। দাম হাঁকাতে বাঙালিদের মনোবল যথেষ্ট শক্তিশালী।' সে বলল, 'এমনকি রিকশা, অটোরিকশা, পাবলিক বাস, ভ্যানচালক, বাড়িওয়ালারা পর্যন্ত নানা অজুহাতে ভাড়াকে স্বাস্থ্যবান করে তুলছে আর অন্যদিকে জনগণের মানিব্যাগ অপুষ্টিতে ভুগছে।' কিসমিসের রসহীন রসিকতায় আমি থমকে কিছুক্ষণ নীরব থাকলাম। সে এবার ডান হাতটা আমার বাঁ কাঁধে স্থাপন করে কিছুটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, 'দোস্ত, এ বিষয়ে আমাদের সরকারও কম যায় না। হুটহাট করে সরকারিভাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল এবং আমদানিকৃত নানা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে তা নিরীহ জনতার কাঁধে চড়িয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিছুদিনের জন্য অন্ধকার ঘরে সটকে পড়েন। আর কিছুদিন দাপাদাপি করে দেশবাসীও যেন সেটাকে সুগন্ধি আতরের মতো শরীর আর অন্তরে মেখে নেয়।' কিসমিসের মন্তব্যটাকে আমি সমর্থনের মোড়কে জড়িয়ে বললাম, 'দোস্ত তোমার কথাটার শতকরা শতভাগই আমি গ্রহণ করলাম; কিন্তু বিশ্ববাজারে এসবের দাম বাড়লে সরকারই বা কী করবে। ভর্তুকি দিয়ে তো আর দীর্ঘদিন চলা যায় না।' সে এবার তার হাতটা আমার কাঁধ থেকে মুক্ত করে বলল, 'কিন্তু বিশ্ববাজারে কিছু কিছু পণ্যের দাম যখন কমে তখনও তো আমাদের দেশি বাজারের উচ্চ মূল্যটা তালগাছের ওপর চড়ে আমাদের পানে বুড়ো আঙুল তুলে রাখে। সেটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ।' আমি এবার আমাদের মধ্যকার শারীরিক দূরত্বটাকে কিছুটা কমিয়ে তার আরও কাছাকাছি গিয়ে বললাম, 'দোস্ত, আমাদের দেশে একটা প্রচলিত বাক্য আছে, তা হলো_ কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না। এটা যেন চন্দ্র-সূর্যের মতোই বাস্তব।' কিসমিস এবার যেন হতাশাকে তার কণ্ঠের কোলে চড়িয়ে বলল, 'ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে রাখেন। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশে মূল্যের ওঠানামায় সমতা আছে।' আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই কিসমিস আবার বলল, 'উন্নত অনেক দেশে ধর্মীয় বা সামাজিক পালা-পার্বণে পণ্যের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে। অথচ আমাদের দেশে ঠিক উল্টো।' আমি এবার তার মন্তব্যটার লেজটাকে চেপে ধরে একই সুরে বললাম, 'আমাদের ব্যবসায়ীরা এসব পালা-পার্বণে ক্রেতাদের পকেট কাটার জন্য আগে থেকেই যেন ছুরি-কাঁচিতে শান দিয়ে রাখেন। সম্প্রতি সংবাদপত্রে জানতে পারলাম পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার আগেই ছোলা, ডাল, তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।'
আমি এবার ব্যবসায়ীদের আরেক পদ্ধতিকে ইঙ্গিত করে বললাম, 'দোস্ত, বিভিন্ন উপলক্ষকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীদের মূল্য হ্রাসের চটকদার বিজ্ঞাপনটা এক ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি বলেই মনে হয়।'
'কিন্তু ফাঁকিটার ছিদ্র খুঁজে পাওয়াটা খুবই কঠিন।' কিসমিসের কথাটার উত্তর না দিয়ে আমি এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, 'তা ছাড়া বাজেট বিড়ম্বনার কথাটাও মাথায় রেখ। বছর বছর ওটা তো বিষফোঁড়ার মতোই যন্ত্রণায় পেকে ওঠে।'
আলাপচারিতার ফাঁকে সন্ধ্যাটা কখন যেন রাতের অন্ধকারে মিশে আরও গাঢ় হয়ে গিয়েছিল। হাতঘড়িটার দিকে দৃষ্টিচারণা করে আমি শুধালাম, 'তা এ মূল্য বিভ্রাটের সঠিক নিয়ন্ত্রণের পথই বা কী?' সে এবার বলল, 'মূল্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডকে শক্তিশালী করতে হবে আর মাঠপর্যায়ের ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আরও আন্তরিক ও কঠোর হতে হবে।' আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে দু'কদম পা ফেলে বললাম, 'তা ছাড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে ভয় না পেয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।' আমার কথাটা কিসমিসের দু'কানের পর্দায় কাঁপন জাগানোর সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, 'কিন্তু দোস্ত সরিষার মধ্যে যে ভূত রয়েছে, তাকে তাড়াবে কে?' আমি তার কথার কোনো উত্তর না পেয়ে মুহূর্তে যেন সমকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বোকা বনে গেলাম।
ডা. সাইফুল আলম : চিকিৎসক
'হবে আবার কী, ২৫ টাকার ডাবের দাম হাঁকছে ৫০ টাকা। গ্রীষ্মে গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাবের পানিও যেন ফুটন্ত হয়ে উঠছে। অথচ দেখার কেউ নেই। ক্রেতারা দিবি্ব মুখ বুজে সহ্য করছে।' আমি এবার একটু নিম্নস্বরে বললাম, 'দোস্ত চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে তো পণ্যের দাম বাড়বেই। এটাই স্বাভাবিক।' আমার নিরীহ চোখ দুটোয় সে যেন অগি্নদৃষ্টির মিসাইল ছুড়ে বলল, 'তাই বলে কি যার যা ইচ্ছে তা-ই করবে?' আমি শুধালাম, 'কে আবার কী করল?' সে পূর্ববর্তী রূপ ধারণ করেই বলল, 'কেন, লক্ষ্য করোনি বাজারের মূল্য পরিস্থিতি কতটা অনিয়ন্ত্রিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অবরোধ, হরতাল, ধর্মঘট, করের বোঝা_ এসব অজুহাতের কাঁধে চেপে বিক্রেতারা বগল বাজিয়ে পণ্যের দাম উচ্চৈঃস্বরে হেঁকে বসছে। ডাবের বিষয়টা তো নিছক একটা উদাহরণ।' আমি এবার আহত কণ্ঠে বললাম, 'তা তুমি মন্দ বলোনি। দাম হাঁকাতে বাঙালিদের মনোবল যথেষ্ট শক্তিশালী।' সে বলল, 'এমনকি রিকশা, অটোরিকশা, পাবলিক বাস, ভ্যানচালক, বাড়িওয়ালারা পর্যন্ত নানা অজুহাতে ভাড়াকে স্বাস্থ্যবান করে তুলছে আর অন্যদিকে জনগণের মানিব্যাগ অপুষ্টিতে ভুগছে।' কিসমিসের রসহীন রসিকতায় আমি থমকে কিছুক্ষণ নীরব থাকলাম। সে এবার ডান হাতটা আমার বাঁ কাঁধে স্থাপন করে কিছুটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, 'দোস্ত, এ বিষয়ে আমাদের সরকারও কম যায় না। হুটহাট করে সরকারিভাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল এবং আমদানিকৃত নানা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে তা নিরীহ জনতার কাঁধে চড়িয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিছুদিনের জন্য অন্ধকার ঘরে সটকে পড়েন। আর কিছুদিন দাপাদাপি করে দেশবাসীও যেন সেটাকে সুগন্ধি আতরের মতো শরীর আর অন্তরে মেখে নেয়।' কিসমিসের মন্তব্যটাকে আমি সমর্থনের মোড়কে জড়িয়ে বললাম, 'দোস্ত তোমার কথাটার শতকরা শতভাগই আমি গ্রহণ করলাম; কিন্তু বিশ্ববাজারে এসবের দাম বাড়লে সরকারই বা কী করবে। ভর্তুকি দিয়ে তো আর দীর্ঘদিন চলা যায় না।' সে এবার তার হাতটা আমার কাঁধ থেকে মুক্ত করে বলল, 'কিন্তু বিশ্ববাজারে কিছু কিছু পণ্যের দাম যখন কমে তখনও তো আমাদের দেশি বাজারের উচ্চ মূল্যটা তালগাছের ওপর চড়ে আমাদের পানে বুড়ো আঙুল তুলে রাখে। সেটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ।' আমি এবার আমাদের মধ্যকার শারীরিক দূরত্বটাকে কিছুটা কমিয়ে তার আরও কাছাকাছি গিয়ে বললাম, 'দোস্ত, আমাদের দেশে একটা প্রচলিত বাক্য আছে, তা হলো_ কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না। এটা যেন চন্দ্র-সূর্যের মতোই বাস্তব।' কিসমিস এবার যেন হতাশাকে তার কণ্ঠের কোলে চড়িয়ে বলল, 'ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে রাখেন। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশে মূল্যের ওঠানামায় সমতা আছে।' আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই কিসমিস আবার বলল, 'উন্নত অনেক দেশে ধর্মীয় বা সামাজিক পালা-পার্বণে পণ্যের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে। অথচ আমাদের দেশে ঠিক উল্টো।' আমি এবার তার মন্তব্যটার লেজটাকে চেপে ধরে একই সুরে বললাম, 'আমাদের ব্যবসায়ীরা এসব পালা-পার্বণে ক্রেতাদের পকেট কাটার জন্য আগে থেকেই যেন ছুরি-কাঁচিতে শান দিয়ে রাখেন। সম্প্রতি সংবাদপত্রে জানতে পারলাম পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার আগেই ছোলা, ডাল, তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।'
আমি এবার ব্যবসায়ীদের আরেক পদ্ধতিকে ইঙ্গিত করে বললাম, 'দোস্ত, বিভিন্ন উপলক্ষকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীদের মূল্য হ্রাসের চটকদার বিজ্ঞাপনটা এক ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি বলেই মনে হয়।'
'কিন্তু ফাঁকিটার ছিদ্র খুঁজে পাওয়াটা খুবই কঠিন।' কিসমিসের কথাটার উত্তর না দিয়ে আমি এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, 'তা ছাড়া বাজেট বিড়ম্বনার কথাটাও মাথায় রেখ। বছর বছর ওটা তো বিষফোঁড়ার মতোই যন্ত্রণায় পেকে ওঠে।'
আলাপচারিতার ফাঁকে সন্ধ্যাটা কখন যেন রাতের অন্ধকারে মিশে আরও গাঢ় হয়ে গিয়েছিল। হাতঘড়িটার দিকে দৃষ্টিচারণা করে আমি শুধালাম, 'তা এ মূল্য বিভ্রাটের সঠিক নিয়ন্ত্রণের পথই বা কী?' সে এবার বলল, 'মূল্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডকে শক্তিশালী করতে হবে আর মাঠপর্যায়ের ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আরও আন্তরিক ও কঠোর হতে হবে।' আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে দু'কদম পা ফেলে বললাম, 'তা ছাড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে ভয় না পেয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।' আমার কথাটা কিসমিসের দু'কানের পর্দায় কাঁপন জাগানোর সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, 'কিন্তু দোস্ত সরিষার মধ্যে যে ভূত রয়েছে, তাকে তাড়াবে কে?' আমি তার কথার কোনো উত্তর না পেয়ে মুহূর্তে যেন সমকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বোকা বনে গেলাম।
ডা. সাইফুল আলম : চিকিৎসক
No comments