আন্তস্কুল বিজ্ঞান মেলা ও বিজ্ঞান ক্যাম্প-গ্রামে বাড়ুক বিজ্ঞান চর্চা by জাহেদ আলী ও তানভীর আরাফাত
দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে। শহরের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহ থাকলেও গ্রামাঞ্চলে এই আগ্রহ নিম্নমুখী। বিজ্ঞান মেলা, অলিম্পিয়াড, ক্যাম্প প্রভৃতির পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আনন্দময় করতে পারলে এই দৃশ্যপট পাল্টে দেওয়া যেতে পারে।
শিবালয়, মানিকগঞ্জ
স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যে মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার ষাইটঘর তেওতাতে কখনো কোনো মন্ত্রী যাননি। আবার এলাকার সব স্কুলের বিজ্ঞান মেলা এত বড় করে হয়নি। কাজেই সকাল থেকে সেখানে উৎসব-উৎসব ভাব ছিল। ২০টি স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা তো আছেই; তাদের সঙ্গে আছে ভেন্যু স্কুলের শিক্ষার্থীরা এবং তাদের শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় বিজ্ঞানে উৎসাহী ব্যক্তি।
ফিতা কেটে মেলার উদ্বোধন করেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। ঘুরে ঘুরে প্রায় সব স্টল দেখেছেন তিনি। খুদে বিজ্ঞানীরাও প্রধান অতিথির কথা শুনে বুঝে ফেলেছে তিনি বিজ্ঞানের লোক! তবে, শিক্ষার্থীদের জন্য আরও চমক ছিল। আলোচনা সভায় নিজের বক্তব্যের শুরুতে মন্ত্রী সবাইকে দিয়ে একটি ‘অঙ্ক’ করিয়ে নিলেন। সবার শেষে ফলাফল শুনে জানিয়ে দিলেন অঙ্ককারীর বয়স!
এভাবে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ১৩ জুন বিজ্ঞান আর গণিতের সঙ্গে একটি দিন অতিবাহিত করেছে। আলোচনা সভায় সবার বক্তব্যে যেমন, তেমনি বিজ্ঞান প্রকল্প পরিদর্শন আর বিজ্ঞান ক্যাম্পে সবাই জেনেছেন আধুনিক এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই প্রকৃত প্রগতির পথ। এই পথ ধরেই বাঙালির কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার ষাইটঘর তেওতা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এ আন্তস্কুল বিজ্ঞান মেলা ও বিজ্ঞান ক্যাম্প-২০১২-এর আয়োজক স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন টিআরডি। বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি মেলা আয়োজনে সহযোগিতা প্রদান করে।
আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ এ বি এম আনোয়ারুল হক ও মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া মেলায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ হোসাইন এবং গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক ও বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির সহসভাপতি মুনির হাসান।
আন্তস্কুল বিজ্ঞান মেলা
মেলার মূল আকর্ষণ ছিল অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রজেক্টের প্রদর্শনী। সেখানে আধুনিক শহরের মডেল যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিকল্প ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের নানা প্রকল্প। কিছু কিছু প্রকল্পে বিজ্ঞানের বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রকল্পগুলোর মধ্যে ছিল পেরিস্কোপ, উন্নত চুলা, ইটের খোয়া দিয়ে পানি বিশুদ্ধকরণের ফিল্টার, যান্ত্রিক শক্তির নানাবিধ প্রয়োগ, হাওয়া কিংবা পানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানজট নিরসনের উপায় ইত্যাদি। এর পাশাপাশি উদ্ভিদের প্রস্বেদন, রস উত্তোলন, অভিস্রবণ, বায়ুর চাপ, আলোর প্রতিফলন প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিষয় সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কৃষিবিষয়ক প্রকল্পের মধ্যে ছিল কচুরিপানার মাধ্যমে আর্সেনিক দূরীভূতকরণ, ধানখেতে মাছ চাষের ব্যবস্থা ইত্যাদি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনে স্বকীয়তার ভাব দেখা গেছে। তবে, খুদে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যাপারে ততটা আগ্রহ হয়নি, যতটা তারা চমৎকৃত হয়েছে সেটির প্রয়োগে! মেলায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির ‘বিজ্ঞানের মজার প্রজেক্ট’ শিরোনামের স্টলে বিজ্ঞান প্রজেক্টগুলো হাতে-কলমে করার সুযোগ ছিল। এখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রকল্প নিজেরাই করার সুযোগ পায়। এখানে বায়ুর ঊর্ধ্বচাপের কারণে পানিপূর্ণ গ্লাস থেকে পানি পড়তে না পারা এবং সলিনয়েডের মাধ্যমে চুম্বক তৈরি বিশেষ আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। ডিসপোজেবল গ্লাসের সাহায্যে বানানো টেলিফোনে কথা বলতে দেখা গেছে অনেককে। স্টলে দাঁড়ানো বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির স্বেচ্ছাসেবক বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সারাক্ষণই খুদে বিজ্ঞানীদের নানা কৌতূহলের জবাব দিতে দেখা গেছে।
ছবিতে বিজ্ঞান
মেলার প্রাঙ্গণজুড়ে প্রদর্শন করা হয় বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের পোস্টার। বিজ্ঞান একাডেমির সহায়তায় এই পোস্টার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। পোস্টারগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ভৌগোলিক যুগ, শারীরবিদ্যার নানা বিষয় এবং পৃথিবী ও মহাকাশের পোস্টার শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে অবশ্য নিউটন, আইনস্টাইন আর ডারউইনের পোস্টার খোঁজ করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মেলায় ২৫ শতাংশ ছাড়ে বিজ্ঞান ও গণিতের নানা মজার মজার বই বিক্রি করা হয়েছে। পছন্দের বই সংগ্রহ করতে পারায় তেওতা উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, ‘বইটি আমি অনেক খুঁজেছি কিন্তু সময়ের অভাবে ঢাকায় যেতে পারিনি। এখানে বইটি পেয়ে আমি আনন্দিত।’
গণিত ক্লাস আর বিজ্ঞান ক্যাম্প
বেলা তিনটা থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণকারী ২০টি স্কুলের অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শতাধিক শিক্ষার্থী এ ক্লাসে অংশ নেয়। ক্লাসের শুরুতে গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দেওয়া অঙ্ক করার পর দেখা যায় সবার ফলাফল হয়েছে এক! শিক্ষার্থীরা জেনে যায় বিজ্ঞানের নিয়মগুলো সব জায়গার জন্য একই থাকে! ক্লাস পরিচালনা করেন বুয়েটের শিক্ষার্থী তানভির আরাফাত। ক্লাসে গণিত এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়।
বিজ্ঞান ক্যাম্প
অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আয়োজন করা হয় বিজ্ঞান ক্যাম্প। ক্যাম্পে শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানকে আনন্দময় করে তোলার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেদের বিভিন্ন উদ্ভাবনী পদ্ধতি অন্যদের কাছে তুলে ধরেন। শিক্ষকদের সবাই মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আনন্দময় করার প্রতি জোর দেন। আলোচনায় দেখা যায়, এই সময় শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাসের সুযোগ থাকে না। ফলে তারা বিজ্ঞানের আনন্দ যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে না। এ কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে তারা বিজ্ঞানশিক্ষায় আগ্রহী হয় না। ক্যাম্পের সঞ্চালক মুনির হাসান এই সময় শ্রেণীকক্ষকে কীভাবে ব্যবহারিক পরীক্ষাগারে পরিণত করা যায় তার কিছু নমুনা প্রদর্শন করেন। অংশগ্রহণকারী শিক্ষকেরা নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আনন্দময় করার নানা উপকরণ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন।
বিজ্ঞান কুইজ প্রতিযোগিতা
ক্যাম্প ও ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয় বিজ্ঞানবিষয়ক প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা কুইজ। দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ১৬ জন শিক্ষার্থী এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। পরে উপস্থিত সবার জন্য উন্মুক্ত কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
যে প্রজেক্ট বানায়, সে...
দিনব্যাপী আয়োজনের শেষ পর্যায়ে ছিল শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সকালে যাদের দেখা গেছে নিউটন আর গ্যালিলিওর জটিল হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত, বিকেলে দেখা গেল তাদের কণ্ঠে গান, মঞ্চ কাঁপে নাচে। সবশেষে মেলা ও কুইজের বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়।
এই আয়োজনে সহায়তাদানকারী বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান জানান, আটটি জেলায় তাঁদের এ বিজ্ঞানশিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে, যা তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। তিনি জানান, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও আয়োজনের উদ্যোগ তাঁরা নেবেন।
গফরগাঁও, ময়মনসিংহ
স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ২৭ জুন বুধবার ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কান্দিপাড়া আস্কর আলী উচ্চবিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় ‘আন্তস্কুল বিজ্ঞান মেলা’। কান্দিপাড়া আস্কর আলী উচ্চবিদ্যালয়, কান্দিপাড়া আবদুর রহমান ডিগ্রি কলেজ, কান্দিপাড়া আলিমুননেচ্ছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, জনতা আদর্শ বিদ্যানিকেতন, মাইজবাড়ী হাতেম তাই উচ্চবিদ্যালয়, দত্তের বাজার ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ মেলায় অংশ নেয়।
দিনব্যাপী এ বিজ্ঞান মেলা শুরু হয় সকাল ১০টায়। মেলায় বিজ্ঞানের মজার বিষয়গুলো সহজ কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় শিক্ষার্থীদের সামনে। রসায়নের বিভিন্ন কঠিন বিক্রিয়াগুলো দেখানো হয় হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন সব উপকরণ দিয়ে। কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তাদের। হাতে-কলমে বিজ্ঞান শেখানোর পাশাপাশি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান নিয়েও ছিল নানা আয়োজন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে শতাধিক রঙিন চার্ট, পোস্টার আর ডায়াগ্রামের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। তা ছাড়া তাদের জ্ঞানের গণ্ডি প্রসারিত করে তোলার জন্য বিজ্ঞান, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই নিয়ে ছিল বই পড়ার আয়োজন।
সব শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুপুর থেকে শুরু হয় এক জমজমাট সেমিনার এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব। গণিত, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন উপস্থিত শিক্ষকেরা। ময়মনসিংহ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সভাপতি মাহমুদুল হাসান সেলিমের প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় এ পর্ব চলে বিকেল পর্যন্ত। অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকেরা এবং এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দিনব্যাপী এই আয়োজন।
বিজ্ঞান মেলাটি ময়মনসিংহ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের উদ্যোগে এবং কান্দিপাড়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যে মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার ষাইটঘর তেওতাতে কখনো কোনো মন্ত্রী যাননি। আবার এলাকার সব স্কুলের বিজ্ঞান মেলা এত বড় করে হয়নি। কাজেই সকাল থেকে সেখানে উৎসব-উৎসব ভাব ছিল। ২০টি স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা তো আছেই; তাদের সঙ্গে আছে ভেন্যু স্কুলের শিক্ষার্থীরা এবং তাদের শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় বিজ্ঞানে উৎসাহী ব্যক্তি।
ফিতা কেটে মেলার উদ্বোধন করেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। ঘুরে ঘুরে প্রায় সব স্টল দেখেছেন তিনি। খুদে বিজ্ঞানীরাও প্রধান অতিথির কথা শুনে বুঝে ফেলেছে তিনি বিজ্ঞানের লোক! তবে, শিক্ষার্থীদের জন্য আরও চমক ছিল। আলোচনা সভায় নিজের বক্তব্যের শুরুতে মন্ত্রী সবাইকে দিয়ে একটি ‘অঙ্ক’ করিয়ে নিলেন। সবার শেষে ফলাফল শুনে জানিয়ে দিলেন অঙ্ককারীর বয়স!
এভাবে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ১৩ জুন বিজ্ঞান আর গণিতের সঙ্গে একটি দিন অতিবাহিত করেছে। আলোচনা সভায় সবার বক্তব্যে যেমন, তেমনি বিজ্ঞান প্রকল্প পরিদর্শন আর বিজ্ঞান ক্যাম্পে সবাই জেনেছেন আধুনিক এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই প্রকৃত প্রগতির পথ। এই পথ ধরেই বাঙালির কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার ষাইটঘর তেওতা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এ আন্তস্কুল বিজ্ঞান মেলা ও বিজ্ঞান ক্যাম্প-২০১২-এর আয়োজক স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন টিআরডি। বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি মেলা আয়োজনে সহযোগিতা প্রদান করে।
আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ এ বি এম আনোয়ারুল হক ও মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া মেলায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ হোসাইন এবং গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক ও বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির সহসভাপতি মুনির হাসান।
আন্তস্কুল বিজ্ঞান মেলা
মেলার মূল আকর্ষণ ছিল অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিজ্ঞান প্রজেক্টের প্রদর্শনী। সেখানে আধুনিক শহরের মডেল যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিকল্প ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের নানা প্রকল্প। কিছু কিছু প্রকল্পে বিজ্ঞানের বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রকল্পগুলোর মধ্যে ছিল পেরিস্কোপ, উন্নত চুলা, ইটের খোয়া দিয়ে পানি বিশুদ্ধকরণের ফিল্টার, যান্ত্রিক শক্তির নানাবিধ প্রয়োগ, হাওয়া কিংবা পানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানজট নিরসনের উপায় ইত্যাদি। এর পাশাপাশি উদ্ভিদের প্রস্বেদন, রস উত্তোলন, অভিস্রবণ, বায়ুর চাপ, আলোর প্রতিফলন প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিষয় সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কৃষিবিষয়ক প্রকল্পের মধ্যে ছিল কচুরিপানার মাধ্যমে আর্সেনিক দূরীভূতকরণ, ধানখেতে মাছ চাষের ব্যবস্থা ইত্যাদি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনে স্বকীয়তার ভাব দেখা গেছে। তবে, খুদে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যাপারে ততটা আগ্রহ হয়নি, যতটা তারা চমৎকৃত হয়েছে সেটির প্রয়োগে! মেলায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির ‘বিজ্ঞানের মজার প্রজেক্ট’ শিরোনামের স্টলে বিজ্ঞান প্রজেক্টগুলো হাতে-কলমে করার সুযোগ ছিল। এখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রকল্প নিজেরাই করার সুযোগ পায়। এখানে বায়ুর ঊর্ধ্বচাপের কারণে পানিপূর্ণ গ্লাস থেকে পানি পড়তে না পারা এবং সলিনয়েডের মাধ্যমে চুম্বক তৈরি বিশেষ আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। ডিসপোজেবল গ্লাসের সাহায্যে বানানো টেলিফোনে কথা বলতে দেখা গেছে অনেককে। স্টলে দাঁড়ানো বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির স্বেচ্ছাসেবক বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সারাক্ষণই খুদে বিজ্ঞানীদের নানা কৌতূহলের জবাব দিতে দেখা গেছে।
ছবিতে বিজ্ঞান
মেলার প্রাঙ্গণজুড়ে প্রদর্শন করা হয় বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের পোস্টার। বিজ্ঞান একাডেমির সহায়তায় এই পোস্টার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। পোস্টারগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ভৌগোলিক যুগ, শারীরবিদ্যার নানা বিষয় এবং পৃথিবী ও মহাকাশের পোস্টার শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে অবশ্য নিউটন, আইনস্টাইন আর ডারউইনের পোস্টার খোঁজ করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মেলায় ২৫ শতাংশ ছাড়ে বিজ্ঞান ও গণিতের নানা মজার মজার বই বিক্রি করা হয়েছে। পছন্দের বই সংগ্রহ করতে পারায় তেওতা উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, ‘বইটি আমি অনেক খুঁজেছি কিন্তু সময়ের অভাবে ঢাকায় যেতে পারিনি। এখানে বইটি পেয়ে আমি আনন্দিত।’
গণিত ক্লাস আর বিজ্ঞান ক্যাম্প
বেলা তিনটা থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণকারী ২০টি স্কুলের অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শতাধিক শিক্ষার্থী এ ক্লাসে অংশ নেয়। ক্লাসের শুরুতে গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দেওয়া অঙ্ক করার পর দেখা যায় সবার ফলাফল হয়েছে এক! শিক্ষার্থীরা জেনে যায় বিজ্ঞানের নিয়মগুলো সব জায়গার জন্য একই থাকে! ক্লাস পরিচালনা করেন বুয়েটের শিক্ষার্থী তানভির আরাফাত। ক্লাসে গণিত এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়।
বিজ্ঞান ক্যাম্প
অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আয়োজন করা হয় বিজ্ঞান ক্যাম্প। ক্যাম্পে শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানকে আনন্দময় করে তোলার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেদের বিভিন্ন উদ্ভাবনী পদ্ধতি অন্যদের কাছে তুলে ধরেন। শিক্ষকদের সবাই মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আনন্দময় করার প্রতি জোর দেন। আলোচনায় দেখা যায়, এই সময় শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাসের সুযোগ থাকে না। ফলে তারা বিজ্ঞানের আনন্দ যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে না। এ কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে তারা বিজ্ঞানশিক্ষায় আগ্রহী হয় না। ক্যাম্পের সঞ্চালক মুনির হাসান এই সময় শ্রেণীকক্ষকে কীভাবে ব্যবহারিক পরীক্ষাগারে পরিণত করা যায় তার কিছু নমুনা প্রদর্শন করেন। অংশগ্রহণকারী শিক্ষকেরা নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আনন্দময় করার নানা উপকরণ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন।
বিজ্ঞান কুইজ প্রতিযোগিতা
ক্যাম্প ও ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয় বিজ্ঞানবিষয়ক প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতা কুইজ। দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ১৬ জন শিক্ষার্থী এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। পরে উপস্থিত সবার জন্য উন্মুক্ত কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
যে প্রজেক্ট বানায়, সে...
দিনব্যাপী আয়োজনের শেষ পর্যায়ে ছিল শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সকালে যাদের দেখা গেছে নিউটন আর গ্যালিলিওর জটিল হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত, বিকেলে দেখা গেল তাদের কণ্ঠে গান, মঞ্চ কাঁপে নাচে। সবশেষে মেলা ও কুইজের বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়।
এই আয়োজনে সহায়তাদানকারী বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান জানান, আটটি জেলায় তাঁদের এ বিজ্ঞানশিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে, যা তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। তিনি জানান, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও আয়োজনের উদ্যোগ তাঁরা নেবেন।
গফরগাঁও, ময়মনসিংহ
স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ২৭ জুন বুধবার ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কান্দিপাড়া আস্কর আলী উচ্চবিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় ‘আন্তস্কুল বিজ্ঞান মেলা’। কান্দিপাড়া আস্কর আলী উচ্চবিদ্যালয়, কান্দিপাড়া আবদুর রহমান ডিগ্রি কলেজ, কান্দিপাড়া আলিমুননেচ্ছা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, জনতা আদর্শ বিদ্যানিকেতন, মাইজবাড়ী হাতেম তাই উচ্চবিদ্যালয়, দত্তের বাজার ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ মেলায় অংশ নেয়।
দিনব্যাপী এ বিজ্ঞান মেলা শুরু হয় সকাল ১০টায়। মেলায় বিজ্ঞানের মজার বিষয়গুলো সহজ কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় শিক্ষার্থীদের সামনে। রসায়নের বিভিন্ন কঠিন বিক্রিয়াগুলো দেখানো হয় হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন সব উপকরণ দিয়ে। কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তাদের। হাতে-কলমে বিজ্ঞান শেখানোর পাশাপাশি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান নিয়েও ছিল নানা আয়োজন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে শতাধিক রঙিন চার্ট, পোস্টার আর ডায়াগ্রামের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। তা ছাড়া তাদের জ্ঞানের গণ্ডি প্রসারিত করে তোলার জন্য বিজ্ঞান, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই নিয়ে ছিল বই পড়ার আয়োজন।
সব শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুপুর থেকে শুরু হয় এক জমজমাট সেমিনার এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব। গণিত, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন উপস্থিত শিক্ষকেরা। ময়মনসিংহ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সভাপতি মাহমুদুল হাসান সেলিমের প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় এ পর্ব চলে বিকেল পর্যন্ত। অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকেরা এবং এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দিনব্যাপী এই আয়োজন।
বিজ্ঞান মেলাটি ময়মনসিংহ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের উদ্যোগে এবং কান্দিপাড়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়।
No comments