'দুর্নীতির আখড়া বিশ্বব্যাংকই' by মুহাম্মদ শরীফ হোসেন

বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও বিশ্বব্যাংক নিজেই একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পদ্ধতি থেকে শুরু করে পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাই দুর্নীতিকবলিত। দুর্নীতির বিচারে বিশ্বব্যাংক সব দেশের জন্য একই মানদণ্ড অনুসরণ করে না। যেমন, চীনের ব্যাপারে এক নীতি হলে অন্য কোনো দুর্বল দেশের ব্যাপারে আরেক নীতি।


বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি হলেও তা কখনো প্রকাশ করা হয়নি। বিশ্বের প্রভাবশালী এ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন। 'ওয়ার্ল্ড ব্যাংক স্পিনস আউট অব কন্ট্রোল : করাপশন, ডিসফাংশন অ্যাওয়েট নিউ প্রেসিডেন্ট' শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবে আগামী ১৬ জুলাই।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮৮টি দেশের প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন ড. জিম ইয়ং কিম। দুর্নীতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ প্রতিষ্ঠান। নীতিগত সমস্যার মধ্যে রয়েছে সবার ক্ষেত্রে একই মানদণ্ড অনুসরণ না করা। যেমন, বিশ্বের নতুন অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন বিশ্বব্যাংককে হুমকি দিয়েছে, যদি দুর্নীতির ব্যাপারে জোরালো অনুসন্ধান চালানো হয়, তাহলে তারা ঋণ নেবে না। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের মনোভাব নমনীয়।
সংস্থাটির কাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। যেমন, প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক বিশ্বব্যাংকের বাজেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সত্ত্বেও কিছু কর্মকর্তা অফ বাজেট পদ্ধতি চালু করেন। এভাবে সংস্থার ব্যয় নিয়ন্ত্রণনীতি অমান্য করা হয়। একইভাবে কর্মকর্তাদের একটি অংশ ব্যস্ত ছিল পদ্ধতিটিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল এবং ব্যাংকে নিজেদের অবস্থান আরো শক্তিশালী করার কাজে।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার খরচের হিসাব পাওয়া যায়নি কম্পিউটারের সামান্য ত্রুটির কারণে। দুঃখজনকভাবে সংস্থার অভ্যন্তরে সাংস্কৃতিক সংকটও রয়েছে। ব্যাংকের ভেতরের এবং বাইরের লোকজন বলেন, খ্যাতির ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকের এক ধরনের ঘোর রয়েছে। নেতিবাচক কোনো ব্যাপার ঘটলে ব্যাংক বিষয়টির সমাধানের পথে না গিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে। ওয়াশিংটনে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে কিছু সন্ত্রস্ত 'ইয়েস ম্যান এবং উইমেন' রয়েছেন, যাঁরা পুরো ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা সমস্যার সমাধান করার চেয়ে এটিকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলেন। চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত যেতে হতে পারে- এই ভয়ে তাঁরা খুব কমই নিজেদের সত্যিকারের মতামত প্রকাশ করেন। বিষয়টি নিয়ে ফোর্বসের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান জোয়েলিক, যা ছিল স্বাভাবিক।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবি্লউ বুশ ২০০৫ সালে পল উলফউইৎজকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান করেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতিমুক্ত করার দায়িত্ব দেন। প্রাথমিক অভিযান হিসেবে উলফউইৎজ শুদ্ধি অভিযান শুরু করেন। এটা করতে গিয়ে তিনি বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েন। ফোর্বসের কাছে থাকা অভ্যন্তরণী তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ উলফউইৎজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, যা ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। কিন্তু ভেতরে কী হচ্ছে, তা বহির্বিশ্বকে কখনো জানতে দেওয়া হয়নি। সম্ভবত উলফউইৎজ খুব শক্ত হাতেই দুর্নীতি উৎখাতের প্রচেষ্টা চালান। তিনি আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ অবস্থায় কর্মকর্তারা বিভক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হন। একসময় নিজের বান্ধবীকে ব্যাংকে বিশেষ বিবেচনায় সুযোগ দিয়ে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। পরিণতি হচ্ছে তাঁর পদত্যাগ।
এরপর আসে জোয়েলিকের পরীক্ষা। ২০০৭ সালে তিনি বিশ্বব্যাংকে যোগ দেন এবং পরিস্থিতি শান্ত করেন। এ সময় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দাকে কেন্দ্র করে খাদ্য সংকট তৈরি হয়। এ অবস্থায় দরিদ্র দেশগুলোকে রক্ষায় তিনি রেকর্ড মাত্রায় ঋণ বিতরণ করেন এবং গত বছর সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক অর্থনৈতিক সমর্থন পান। কিন্তু ব্যাংকের প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানহীনই থেকে যায়। উলফউইৎজের দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধ জোয়েলিকও অব্যাহত রাখেন। এ জন্য তিনি বাজেট বাড়ান এবং ব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিরোধ ইউনিটকে শক্তিশালী করেন। তিনি তদন্তকারীর সংখ্যা বাড়ান। এতে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট রেকর্ডসংখ্যক কম্পানিকে দুর্নীতি ও ঘুষ দেওয়া থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে রয়েছে জার্মানির সিমেন্স এবং ব্রিটেনের ম্যাকমিলান পাবলিশার্স। কিন্তু ব্যাংকের ভেতরে অনেক ব্যবস্থাপক ও ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি এখনো অপ্রতিহতভাবে চলছে।
ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছর আগে পল ভোলকারের নেতৃত্বে একটি কমিশন ব্যাংকের কর্মপ্রক্রিয়ার একদম ভেতরে প্রবেশ করে এবং বড় ধরনের সমস্যা আবিষ্কার করে। তিনি ব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিরোধ ইউনিটকে পুনর্গঠনের পরামর্শ দেন। এর মধ্যে রয়েছে ইউনিটের প্রধান হিসেবে একজন অধিক ক্ষমতাবান কর্মকর্তা নিয়োগ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানকারী গিরিশঙ্কর তাঁর এক প্রতিবেদনে বলেন, বিশ্বব্যাংক দরিদ্র দেশগুলোতে যে সহায়তা দেয়, তা পর্যাপ্ত নয়। অনুসন্ধানকাজে বাধা পাওয়ার কথা স্বীকার করে গিরিশঙ্কর বলেন, 'প্রথম অবস্থায় বিশ্বব্যাংক আমাদের এমন দেশ নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে বলে, যেখানে তারা সফল হয়েছে।' তিনি আরো বলেন, ব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধ এবং পরিচালনা পদ্ধতি উন্নত করার কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা নেই।
আরেক তদন্তকারী এনিস ড্যানির এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও চাপা দেওয়া হয়। প্রথমে প্রতিবেদনটিকে আক্রমণের চেষ্টা করা হয়, পরে উপেক্ষা করা হয়। ড্যানি জানান, প্রতিবেদনে গত পাঁচ বছরে ব্যাংকের প্রকল্পগুলোতে গুণগত মান, কার্যকারিতা ইত্যাদিতে নাটকীয় সব ত্রুটি পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পরিচালনা পর্ষদের কাছে জমা দেওয়া হয়। এতে বেশ কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। কিন্তু এ প্রতিবেদন কখনো প্রকাশ করা হয়নি।
২০০৬ সালে অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম লিরিক বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে বের করেন যে ব্যাংক প্রতিবছর ১০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার লোকসান দিচ্ছে। অথচ খাতা-কলমে বরাবর ভালো চিত্র তুলে ধরা হয়। অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে ব্যাংকের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে- এটা বিশ্বাস করা কঠিন। চীন বিশ্বব্যাংকের গ্রাহক হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গত কয়েক দশকে ব্যাংক থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ নেয় এই দেশ। কিন্তু ২০০৭ সালে চীন হুমকি দেয়, তারা বিশ্বব্যাংক থেকে আর ঋণ নেবে না, যদি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কঠিন করা থেকে ব্যাংক বিরত না হয়। ফোর্বসের কাছে থাকা ব্যাংকের এক গোপন অভ্যন্তরীণ মেমো থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। চীনের হুমকির পর ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভয় পেয়ে নীরব হয়ে যান। এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ব্যাংক ওয়েবসাইটে ঘোষণা করে, তারা দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্বব্যাপী একই মান অনুসরণ করবে না। এটি রাষ্ট্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন হবে। লিরিক আরো বলেন, এভাবে যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে প্রভাব রয়েছে, তাদের ব্যাপারে ব্যাংকের নীতি চীনের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, সেই রকমই নমনীয়।

No comments

Powered by Blogger.