পরিবেশ-সর্বনাশা ইটভাটার নেশা by মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী
শিক্ষকতার মহৎ পেশা ছেড়ে ইটভাটার ব্যবসা। মানিকগঞ্জের এক স্কুল ও এক মাদ্রাসার শিক্ষক রাতারাতি বিত্তবান হওয়ার লোভে টাকা বিনিয়োগ করেছেন ইটভাটায়। শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে ইটভাটায় অর্থ বিনিয়োগকারী স্কুল শিক্ষককে একটি জনপ্রিয় কবিতার রচয়িতার নাম জিজ্ঞাসা করা হলে এর উত্তর দেওয়া ছিল তাঁর জন্য অসাধ্য।
এমনকি কবিতাটির এক পঙিক্তর ধারেকাছেও বিচরণ করতে পারেননি এই শিক্ষক। মনে হলো জ্ঞানচর্চা থেকে তিনি সহস্রযোজন দূরে। অর্থলোভ মানুষকে এভাবেই করছে প্রতিনিয়ত পরিবেশবিধ্বংসী, পদস্খলনমুখী। অনৈতিক মুনাফার আশায় মানুষ হচ্ছে জ্ঞানহীন ও বিবেকহীন। অর্থ উপার্জনের উদগ্র বাসনার বিপরীতে জ্ঞানচর্চার বিলুপ্তিতে সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে অতলগহ্বরে। অর্থের প্রয়োজনে ইটভাটা ও ইটভাটার প্রয়োজনে কৃষিজমি—এ দুুইয়ের যোগসূত্র এখন অবিচ্ছিন্ন। ইটভাটার লেলিহান শিখায় মুনাফালোভী ইটভাটার মালিকেরা জ্বালিয়ে দিচ্ছেন গ্রামবাংলার সবুজ ধানখেত, চোখজুড়ানো পরিবেশ, কেড়ে নিচ্ছেন মানুষের অনাবিল শান্তি, হরণ করছেন স্বস্তি। অবৈধ ইটভাটার আগ্রাসনে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ বনবনানী। ভরাট হচ্ছে নদ-নদী। সারা দেশে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযানে এসব ঘটনা বেরিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। ইটভাটার বিনিয়োগে মুনাফার অঙ্ক খুব বেশি, লাভের পাল্লা খুব ভারী। সে কারণে গ্রামীণ জনপদের কৃষিজমির উর্বর মাটি পরিণত হয়েছে সোনার খনিতে। সে খনি থেকে বেরিয়ে আসছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। শুধু এক মৌসুমেই ইটভাটার একজন মালিকের লাভ থাকে ৩০-৪০ লাখ টাকা। ইটভাটা তৈরিতে ভারী অবকাঠামো বা উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। শ্রমশক্তি সহজলভ্য, জমিও সস্তা। অভাবতাড়িত কৃষক, দারিদ্র্যপীড়িত শ্রমিক পেটের দায়ে চোখ বুজে শ্রম দিচ্ছেন ইটভাটায়। অনেক কম ব্যয় অথচ অনেক বেশি মুনাফা ইটভাটায়।
অপরিণামদর্শী কিছু উদ্যোক্তার পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপে ইটভাটার নামে কৃষির সর্বনাশ হচ্ছে, ঘটছে জীববৈচিত্র্যের বিনাশ। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির কবলে পড়ছে। কিন্তু এসব নিষ্ঠুর বাস্তবতা বিবেচনায় না এনেই দিন দিন এ ঝুঁকিপূর্ণ ও ধ্বংসাত্মক বিনিয়োগের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে নতুন উদ্যোক্তাদের। এ উদ্যোগে স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে প্রবাসী এমনকি অনেক সম্মানজনক পেশার মানুষ আর্থসামাজিক ক্ষতি ও পরিবেশগত প্রভাব অবহেলায় রেখে ইটভাটার ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। গ্রামগঞ্জে ও বনে-বাদাড়ে ফসলি জমিতে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটার সিংহভাগেরই নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স, নেই পরিবেশ-ছাড়পত্র। এসব ইটভাটায় উৎপাদিত ইটের গুণগত মান নিশ্চিত করারও কেউ নেই। মানহীন এসব ইটের স্রোত যাচ্ছে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, বাড়িঘরসহ সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজে। দ্রুত ধাবমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চাহিদা পূরণ করছে এসব পরিবেশবিধ্বংসী ইটভাটা। ইটভাটার মালিকদের ভ্রুক্ষেপ নেই দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি এবং পরিবেশের প্রতি। এভাবেই নির্বিবেকে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার পদদলিত হচ্ছে, নির্বিঘ্নে ফসল উৎপাদনের অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থই যেখানে ঊর্ধ্বে, সেখানে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা কতদূরে! গ্রামগঞ্জে এখনো বহাল আছে সনাতনী পদ্ধতির অসংখ্য ইটভাটা। এসব ইটভাটার নির্গত ধোঁয়ায় পুড়ে যাচ্ছে মূল্যবান ফসল, ফলের বাগান ও সবুজ গাছপালা। ছাইয়ের আস্তরণে ঢাকা পড়ছে বাড়িঘর, মসজিদ, ধানখেত, সবজিখেত। অসহায় মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছে ইটভাটার লেলিহান শিখার বিরুদ্ধে। কৃষিজমি বাঁচানোর আকুতি নিয়ে স্মারকলিপি দিচ্ছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে। প্রতিকারের দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরে। মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযানে।
ইটভাটার মালিকেরা কৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে শান্ত রাখতে অকাতরে অর্থ বিলাচ্ছে। একদিকে তাদের দান-অনুদানে সিক্ত হচ্ছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা। অন্যদিকে রিক্ত-নিঃস্ব হচ্ছে পরিবেশ রক্ষার সব আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা। এমনকি এসব অনুদানের অর্থ যাচ্ছে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া ও বিনোদনে। অশিক্ষিত ও অসচেতন মানুষ এ অর্থে মহাতুষ্ট। এ তুষ্টিতে ক্ষোভের ও দ্রোহের আগুন নিভে গেছে অনেকের। অর্থের বিনিময়ে সহ্য করছে ইটভাটার লেলিহান শিখা, হজম করছে তপ্ত বাতাস ও বিষাক্ত ধোঁয়া। কোথাও আবার উপকারভোগীরা গুণগান গাইছে ইটভাটার মালিকদের। কিন্তু তাঁরা উপলব্ধি করতে পারছেন না, ইটভাটার প্রভাবে কত নিষ্ঠুরভাবে মানুষ ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে রোগ-ব্যাধিতে। উর্বর মাটি হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমির উপরিভাগ থেকে। কৃষিজমি হারাচ্ছে অফুরন্ত ফলন-শক্তি। ইটভাটার আশপাশের এলাকায় ভাঙন ও ফাটলে জমির ধারণক্ষমতা দুর্বল হচ্ছে। এভাবে পরিবেশের সমাধিক্ষেত্র রচিত হচ্ছে। এই সমাধির ওপর বিজয়কেতন ওড়াচ্ছে পরিবেশের ধ্বংসকারীরা।
পরিবেশের এ দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ দিতে এগিয়ে এসেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ইটভাটার উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সমান্তরালে তাদের মস্তিষ্কে ও মননে পরিবেশ রক্ষার চেতনা প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে। তাদের বোঝানো হচ্ছে সবার ঊর্ধ্বে পরিবেশ রক্ষা, তারপর বিনিয়োগ ও ব্যবসা; অতঃপর লাভ ও মুনাফা—এটিই এনফোর্সমেন্ট অভিযানের বার্তা। মানুষকে বাঁচিয়ে, প্রকৃতিকে রক্ষা করে ইটভাটার ব্যবসা-বিনিয়োগ থেকে যে লাভ হবে, তা-ই হবে নিখাদ মুনাফা এবং নিষ্কলুষ উপার্জন। এ উপার্জন ও মুনাফাই হোক ব্যবসা-বিনিয়োগের ভিত্তি। এতেই প্রমাণিত হবে সত্যিকারের দেশপ্রেমী ও পরিবেশপ্রেমী মানুষের নৈতিক শক্তি। পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটার উদ্যোক্তাদের পরিবেশবিধ্বংসী আচরণে পরিবর্তন আনতে চায়, উদ্যোক্তাদের পরিবেশপ্রেমী করতে চায়। সুতরাং আর নয় অর্থ উপার্জনের উদগ্র বাসনা, বর্জন হোক শিক্ষকতা পেশা ছাড়ার ভ্রান্ত চেতনা। পরিবেশ ও জনগণকে নিয়েই এ দেশের মাটি ও জীবন।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট), পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা।
mmunirc@gmail.com
অপরিণামদর্শী কিছু উদ্যোক্তার পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপে ইটভাটার নামে কৃষির সর্বনাশ হচ্ছে, ঘটছে জীববৈচিত্র্যের বিনাশ। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির কবলে পড়ছে। কিন্তু এসব নিষ্ঠুর বাস্তবতা বিবেচনায় না এনেই দিন দিন এ ঝুঁকিপূর্ণ ও ধ্বংসাত্মক বিনিয়োগের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে নতুন উদ্যোক্তাদের। এ উদ্যোগে স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে প্রবাসী এমনকি অনেক সম্মানজনক পেশার মানুষ আর্থসামাজিক ক্ষতি ও পরিবেশগত প্রভাব অবহেলায় রেখে ইটভাটার ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। গ্রামগঞ্জে ও বনে-বাদাড়ে ফসলি জমিতে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটার সিংহভাগেরই নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স, নেই পরিবেশ-ছাড়পত্র। এসব ইটভাটায় উৎপাদিত ইটের গুণগত মান নিশ্চিত করারও কেউ নেই। মানহীন এসব ইটের স্রোত যাচ্ছে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, বাড়িঘরসহ সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজে। দ্রুত ধাবমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চাহিদা পূরণ করছে এসব পরিবেশবিধ্বংসী ইটভাটা। ইটভাটার মালিকদের ভ্রুক্ষেপ নেই দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি এবং পরিবেশের প্রতি। এভাবেই নির্বিবেকে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার পদদলিত হচ্ছে, নির্বিঘ্নে ফসল উৎপাদনের অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থই যেখানে ঊর্ধ্বে, সেখানে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা কতদূরে! গ্রামগঞ্জে এখনো বহাল আছে সনাতনী পদ্ধতির অসংখ্য ইটভাটা। এসব ইটভাটার নির্গত ধোঁয়ায় পুড়ে যাচ্ছে মূল্যবান ফসল, ফলের বাগান ও সবুজ গাছপালা। ছাইয়ের আস্তরণে ঢাকা পড়ছে বাড়িঘর, মসজিদ, ধানখেত, সবজিখেত। অসহায় মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছে ইটভাটার লেলিহান শিখার বিরুদ্ধে। কৃষিজমি বাঁচানোর আকুতি নিয়ে স্মারকলিপি দিচ্ছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে। প্রতিকারের দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরে। মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট অভিযানে।
ইটভাটার মালিকেরা কৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে শান্ত রাখতে অকাতরে অর্থ বিলাচ্ছে। একদিকে তাদের দান-অনুদানে সিক্ত হচ্ছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা। অন্যদিকে রিক্ত-নিঃস্ব হচ্ছে পরিবেশ রক্ষার সব আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা। এমনকি এসব অনুদানের অর্থ যাচ্ছে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া ও বিনোদনে। অশিক্ষিত ও অসচেতন মানুষ এ অর্থে মহাতুষ্ট। এ তুষ্টিতে ক্ষোভের ও দ্রোহের আগুন নিভে গেছে অনেকের। অর্থের বিনিময়ে সহ্য করছে ইটভাটার লেলিহান শিখা, হজম করছে তপ্ত বাতাস ও বিষাক্ত ধোঁয়া। কোথাও আবার উপকারভোগীরা গুণগান গাইছে ইটভাটার মালিকদের। কিন্তু তাঁরা উপলব্ধি করতে পারছেন না, ইটভাটার প্রভাবে কত নিষ্ঠুরভাবে মানুষ ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে রোগ-ব্যাধিতে। উর্বর মাটি হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমির উপরিভাগ থেকে। কৃষিজমি হারাচ্ছে অফুরন্ত ফলন-শক্তি। ইটভাটার আশপাশের এলাকায় ভাঙন ও ফাটলে জমির ধারণক্ষমতা দুর্বল হচ্ছে। এভাবে পরিবেশের সমাধিক্ষেত্র রচিত হচ্ছে। এই সমাধির ওপর বিজয়কেতন ওড়াচ্ছে পরিবেশের ধ্বংসকারীরা।
পরিবেশের এ দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ দিতে এগিয়ে এসেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ইটভাটার উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সমান্তরালে তাদের মস্তিষ্কে ও মননে পরিবেশ রক্ষার চেতনা প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে। তাদের বোঝানো হচ্ছে সবার ঊর্ধ্বে পরিবেশ রক্ষা, তারপর বিনিয়োগ ও ব্যবসা; অতঃপর লাভ ও মুনাফা—এটিই এনফোর্সমেন্ট অভিযানের বার্তা। মানুষকে বাঁচিয়ে, প্রকৃতিকে রক্ষা করে ইটভাটার ব্যবসা-বিনিয়োগ থেকে যে লাভ হবে, তা-ই হবে নিখাদ মুনাফা এবং নিষ্কলুষ উপার্জন। এ উপার্জন ও মুনাফাই হোক ব্যবসা-বিনিয়োগের ভিত্তি। এতেই প্রমাণিত হবে সত্যিকারের দেশপ্রেমী ও পরিবেশপ্রেমী মানুষের নৈতিক শক্তি। পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটার উদ্যোক্তাদের পরিবেশবিধ্বংসী আচরণে পরিবর্তন আনতে চায়, উদ্যোক্তাদের পরিবেশপ্রেমী করতে চায়। সুতরাং আর নয় অর্থ উপার্জনের উদগ্র বাসনা, বর্জন হোক শিক্ষকতা পেশা ছাড়ার ভ্রান্ত চেতনা। পরিবেশ ও জনগণকে নিয়েই এ দেশের মাটি ও জীবন।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট), পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা।
mmunirc@gmail.com
No comments