পরিবর্তনের বড় বিজ্ঞাপন ইতালি by গোলাম সারোয়ার টিপু

রক্ষণ সামলে আক্রমণ—প্রথাগত সেই ফুটবল আর নয়! লম্বা পাসে প্রতি-আক্রমণে যাওয়ার দিন বুঝি শেষ! ইতালির হাত ধরে কি ফুটবল একটা পালাবদলের বাঁকে দাঁড়িয়ে? এবারের ইউরো এই প্রশ্নগুলো তুলে দিয়েছে। ইউরোসহ সব বড় প্রতিযোগিতায় সব সময়ই কিছু দলকে আলাদা করা যেত। যেমন ইতালি।


লম্বা বলে প্রতি-আক্রমণই ছিল তাদের ট্রেডমার্ক। অথচ সেই ইতালি পুরোনো খোলস খুলে যেন নতুন জ্যাকেট পরেছে। ‘প্রথাসিদ্ধ ফুটবল আর খেলব না’—এটা দেখানোর মঞ্চ হিসেবে তারা বেছে নিল এই ইউরোকে।
তাই ইউরো পেল নতুন মাত্রা। ইতালির গোত্রভুক্ত ইংল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র...কিছুটা সুইডেনও। অবচেতন মনে এই দলগুলোর প্রতি আক্রমণনির্ভর ফুটবলই দেখব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু পুরোনো ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা।
লম্বা পাসের চেয়ে ছোট ছোট টাচই বেশি দিয়েছে। নিচ থেকে বল নিয়ে খেলাটা গড়েছে। লম্বা পাস এবারও দিয়েছে, আগের মতো ধুম করে অতটা লম্বা পাস বাড়িয়ে দেয়নি। বিশেষ করে ইতালির কাছ থেকে পাওয়া গেল বিশাল ‘চমক’। এই ইউরো যেন নতুন এক ইতালিকে উপস্থাপন করল!
ইউরোর গতি-প্রকৃতি, কোচের চোখে টুর্নামেন্টের টেকনিক্যাল দিকটা কাটাছেঁড়া করলে বড় পরিবর্তনটা ধরা পড়বে এক জায়গাতেই—রক্ষণাত্মক দলগুলোর নিজস্বতা বিসর্জন। সবাই এখন প্রায় একই ধাঁচের ফুটবলই খেলছে। বল পজিশন রাখো। যার হাতে মানসম্মত খেলোয়াড় বেশি, জয়মাল্য তারই। সহজ হিসাব।
প্রতিপক্ষের পায়ে বল থাকলে একজন ট্যাকল করছে, দুজন রুট বন্ধ করে দিচ্ছে। এটা আগেও ছিল, এবার বেশি চোখে পড়েছে। লক্ষ করেছি, দলগুলো এবার উইং ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে বেশি। প্রতিপক্ষ যেন কড়া সতর্কবাণীই দিয়েছে—‘মাঝখান দিয়ে এসো না, উইংয়ে যাও।’
এ কাজটা ব্রাজিলিয়ানরা বরাবরই বেশি করে। এবার দেখলাম স্প্যানিশরাও ভালোভাবে করল। পর্তুগালের খেলায়ও তা কিছুটা দেখা গেছে। আর একটা ব্যাপার, নিজেদের পায়ে বল থাকলে নানা দিকে বিকল্প পথও খুলে ফেলেছে দলগুলো, যেটাকে বলা যায় সাপোর্টিং অ্যাঙ্গেল। এটাও ব্রাজিলিয়ানদের খেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই ইউরোতেও সেটা আলাদা করে চোখে পড়ল। এই কাজটাও স্প্যানিশরাই বেশি করেছে।
লক্ষ করে থাকবেন, এবার উইং থেকে সার্ভিস অনেক বেশি হয়েছে বক্সে। যে কারণে ইউরোতে এবার রেকর্ডসংখ্যক হেডে গোল হয়েছে। ফাইনালের আগ পর্যন্ত হওয়া ৭২ গোলের ২১টিই হেডে। এটা মোট গোলের শতকরা ৩০ ভাগ। গত ইউরোতে ছিল শতকরা ২৯ ভাগ।
তুলনামূলক পেনাল্টির সংখ্যা এবার নগণ্য। গ্রুপ পর্বে মাত্র একটি পেনাল্টি, ভাবাই যায় না! ফাইনালের আগ পর্যন্ত পেনাল্টি মাত্র চারটি! এর অন্যতম কারণও উইং প্লে। উইং থেকে সার্ভিস মানে তুলনামূলক ধাক্কাধাক্কিও কমে যাওয়া।
এর প্রভাব পড়েছে খেলায়ও। দেখুন, এবার ফাইনালের আগ পর্যন্ত লাল কার্ড মাত্র তিনটি! গত ইউরোতেও তিনটিই ছিল। তবে বলতেই হয়, খেলাটা আগের চেয়ে আরও পরিচ্ছন্নই হয়েছে। ‘ফেয়ার প্লে’ স্লোগানটা বাস্তবায়নের পথে অনেক অগ্রগতি দেখল এই ইউরো।
প্রথাগতভাবে রক্ষণ নিচেই পড়ে থাকেনি, আক্রমণে তাদের সম্পৃক্ততা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এটিকেও আলাদা করে দেখা যায়। আরেকটা নতুনত্ব—দূরপাল্লার শটও কম হয়েছে। এটা হতে পারে ‘ভুল শট’ না নেওয়ার ব্যাপারে এখন আরও অনেক বেশি সতর্ক দলগুলো।
আসলে ফুটবলটা এখন দাবার বোর্ডের মতো। হাতি কোনাকুনি যাবে, নৌকা সোজা, ঘোড়া আড়াই ঘর, পন সামনে এক ঘর। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা মন্ত্রীর। এই মন্ত্রী বাহাদুর কোনাকুনি, সোজা—সব দিকেই যেতে পারে। যে দলে বেশি মন্ত্রী আছে, তারাই আজকের আধুনিক ফুটবলের রাজা।
স্পেন দলটার সাফল্যের পেছনে জাবি-ইনিয়েস্তাদের মতো এক ঝাঁক মেধাবি খেলোয়াড়ের রসায়নই বড় অনুষঙ্গ। ইতালি ফাইনালে এল পিরলো-বালোতেল্লিদের ভেলায় চড়ে। পিরলো অসাধারণ। যেন এক ম্যাজিশিয়ান! ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ম্লান রুনি ল্যাম্পার্ডরা, তাই আবারও কাগুজে বাঘ হয়ে ইংল্যান্ডের বিদায়।
যদি আসে ফরমেশন প্রসঙ্গ, বেশির ভাগ দলই খেলেছে ৪-৪-২ পদ্ধতিতে। এর মধ্যে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে হয়তো একজন মিডফিল্ডার বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আগে দুইজন ফরোয়ার্ড থাকত, এখন একজন ওপরে, আরেকজন নিচে। এটা আসলে প্রতিপক্ষের শক্তি দেখে কোচ সাজান তাঁর পরিকল্পনা। বেশ কয়েক বছর ধরেই এই পদ্ধতি দেখা যাচ্ছে, এবারও ব্যতিক্রম হয়নি।
এই ইউরো দেখিয়ে গেল, শৈল্পিক ফুটবল ইউরোপেও হয় এবং সেই ফুল ফোটায় স্পেন। এবার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে ৮৬০টি পাস খেলেছে স্পেন, অবিশ্বাস্য! এটা ইউরোর রেকর্ড। এর চেয়ে শৈল্পিক ফুটবল আর হতে পারে না!
ধন্যবাদ দিতে চাই ইতালির কোচ প্রানদেল্লিকে। তিনি ইতালিকে রক্ষণাত্মক ফুটবল থেকে বের না করলে এই ইউরো এত তাৎপর্যময় হয় না। এটা আসলে কোচের পরিকল্পনা, তাঁর চাওয়া, কৌশলের ওপর নির্ভর করে।
হল্যান্ডের কথা একটু না বললেই নয়। টোটাল ফুটবলের জনকদের পা থেকে টোটাল ফুটবলই হারিয়ে গেছে! হায় হল্যান্ড!

No comments

Powered by Blogger.