বিশ্বব্যাংকের পিঠটান-পদ্মা সেতু : ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত by পার্থ সারথি দাস
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে শেষ পর্যন্ত একেবারেই সরে দাঁড়িয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর আগে প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করার পর এবার ঋণচুক্তিটি পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছে তারা। বাংলাদেশের স্থানীয় সময় গত শুক্রবার গভীর রাতে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের এই ঘোষণা দেয়।
এ প্রকল্প নিয়ে তাদের তোলা দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক জবাব না পাওয়া এবং দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে বলে বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে মালয়েশিয়ার চূড়ান্ত প্রস্তাবনা উপস্থাপনের একদিনের ব্যবধানে বিশ্বব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিল। ফলে পদ্মা সেতু নির্মাণের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকারের সামনে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবই এখন ভালো বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল হওয়ায় কার্যত মালয়েশিয়ার পথই সুগম হলো।
বিশ্বব্যাংক গত বছরের ২৯ এপ্রিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার চুক্তি করেছিল। নানা টানাপড়েনের পর ১৪ মাসের মাথায় তারা সেই চুক্তি বাতিল করল। তবে প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি বহাল রয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার।
মন্ত্রী-নীতিনির্ধারকরা বিস্মিত : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঋণচুক্তি বাতিল করার বিষয়ে বাংলাদেশকে কোনো পূর্বাভাস দেয়নি বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বিষয়টি জানতেন না। গতকাল শনিবার সকালে বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানার পর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বিকেলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কালের কণ্ঠকে বলেন, "হ্যাঁ, বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। সংস্থাটি বলেছে, এ প্রকল্পে 'দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ' তাদের কাছে আছে। কিন্তু তারা যা বলছে তাহলো 'সম্ভাব্য দুর্নীতি'। দুর্নীতির সম্ভাব্যতা খুঁজতে গিয়েও কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। বরং অভিযোগের বিষয়ে এখনো দুর্নীতি দমন কমিশনে তদন্ত চলছে।" তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির বিষয়ে যেভাবে বলছে তার কোনো সারবস্তু নেই। তবে তাদের ঋণচুক্তি বাতিলের বিষয়টি দুঃখজনক।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু সেতু-তারাকান্দি রেলপথ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অবস্থান করছিলেন টাঙ্গাইলে। সেখান থেকে এই সংবাদ শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তকে তিনি 'রহস্যজনক' বলে মন্তব্য করেন। মন্ত্রী বলেন, অভিযোগ আসা মানেই দুর্নীতি প্রমাণ হয়ে যাওয়া নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন এ নিয়ে তদন্ত করছে। তার মধ্যেই বিশ্বব্যাংকের এই ঘোষণা এলো।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্বব্যাংক) আরাস্ত খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি ভোরে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে বিষয়টি জেনেছি। অর্থমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন ডাকা হতে পারে।'
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ও পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও বাংলাদেশের কোনো কর্মকর্তার এর সঙ্গে জড়িত কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। বরং প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে বিশ্বব্যাংকই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গতকাল সকালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি টেলিভিশনের সংবাদে জানতে পারলাম, বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। এ বিষয়ে আমি দাপ্তরিক প্রতিক্রিয়া পরে জানাব।' বিশ্বব্যাংকের তোলা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুদক ব্যর্থ হয়েছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি এখন এ বিষয়ে বলতে চাইছি না।'
ঋণচুক্তি বাতিলের বিষয়ে গতকাল বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরীন মাহবুবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওয়াশিংটন দপ্তর থেকে শুক্রবার রাতে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে ঋণচুক্তি বাতিলের প্রেস রিলিজটি দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা ও সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় এই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এ ব্যাপারে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার। বিশ্বব্যাংকের সম্মতিতেই তাঁকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। গতকাল বিকেলে ড. মসিউর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এ ব্যাপারে আগে কথা বলতে চাই না। অর্থমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের পর আমি কথা বলব।'
দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি : মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের সবচেয়ে বড় পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরেই ঘুরছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ছাড়াও অর্থায়নের জন্য চুক্তি হয়েছিল জাইকা, এডিবি ও আইডিবির সঙ্গে। বিশ্বব্যাংক গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ও পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন স্থগিত করে। এরপর দুদক দুই ধাপে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে দুদক প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতির খোঁজ পায়নি। গত ২ ফেব্রুয়ারি দুদক তাদের প্রতিবেদন দেয়। পাশাপাশি পরামর্শক নিয়োগের অভিযোগে তদন্ত চলতে থাকে। জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেতে কানাডার এসএনসি-লাভালিনের সাবেক দুই কর্মকর্তা রমেশ শাহ ও মোহাম্মদ ইসমাইল বাংলাদেশের একাধিক সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ সেধেছিলেন। কানাডা পুলিশ এই দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শেষ করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে কানাডীয় পুলিশের প্রতিনিধিদল গত ২৫ জুন বাংলাদেশে আসে। জানা গেছে, ওই দলটি এমন কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি যে, বাংলাদেশের কোনো সরকারি কর্মকর্তা পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে ঘুষ বা কমিশন নিয়েছিলেন।
অভিযোগের তীর সরকারের দিকে : ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তর ওয়াশিংটন থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছে।
ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা, কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের যোগসাজশে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। এসব তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে বলে তারা আশা করেছিল। বিশ্বব্যাংকের দাবি ছিল, যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু সার্বিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ সন্তোষজনক ছিল না। বিশ্বব্যাংকও বিষয়টিতে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। সব মিলিয়ে সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাড়া না পেয়েই প্রতিশ্রুত ১.২ বিলিয়ন (১২০ কোটি) ডলার ঋণ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, দুর্নীতির এসব তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয় গত বছর সেপ্টেম্বর এবং চলতি বছরের এপ্রিল মাসে।
বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়, দুর্নীতির এ অভিযোগ পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ভেবেছিল, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। দুর্নীতির যে তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংক পেয়েছে, সে ক্ষেত্রে তারা কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রথম দাবি ছিল, যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা। দ্বিতীয়ত, এই অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ করা। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এমন প্রেক্ষাপটে সংস্থাটির অবস্থান ব্যাখ্যা করা এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে উত্তর জানার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের দল ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া বা উত্তর সন্তোষজনক ছিল না। এমন অবস্থায় দুর্নীতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক বিষয়টিতে চোখ বুজে থাকতে পারে না বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, তারা একটি প্রকল্পে তখনই অর্থায়ন করতে পারে, যখন তারা সেই প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যক্রমের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ার শুরুতেই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন স্থগিত রাখে।
সামনে এখন মালয়েশিয়া : এদিকে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করার পর সরকারের সামনে এই মুহূর্তে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটি। আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পেতে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকেই সচেষ্ট রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ জুন মালয়েশিয়ার ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে ঋণচুক্তির উদ্দেশ্যে এই প্রকল্পের প্রস্তাব যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হাতে তুলে দিয়েছে। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বহাল থাকায় মালয়েশিয়ার সঙ্গে ঋণচুক্তির ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। এখন এই জটিলতার অবসান হয়েছে। জানা গেছে, সরকার মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখছে। সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক সফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিকল্প অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এখন আমাদের কাছে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটি রয়েছে। এটিই একমাত্র আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব।'
বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে যা আছে
তার পরও তদন্ত চালিয়ে যাবে দুদক
বিশ্বব্যাংক গত বছরের ২৯ এপ্রিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার চুক্তি করেছিল। নানা টানাপড়েনের পর ১৪ মাসের মাথায় তারা সেই চুক্তি বাতিল করল। তবে প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি বহাল রয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার।
মন্ত্রী-নীতিনির্ধারকরা বিস্মিত : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঋণচুক্তি বাতিল করার বিষয়ে বাংলাদেশকে কোনো পূর্বাভাস দেয়নি বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বিষয়টি জানতেন না। গতকাল শনিবার সকালে বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানার পর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বিকেলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কালের কণ্ঠকে বলেন, "হ্যাঁ, বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। সংস্থাটি বলেছে, এ প্রকল্পে 'দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ' তাদের কাছে আছে। কিন্তু তারা যা বলছে তাহলো 'সম্ভাব্য দুর্নীতি'। দুর্নীতির সম্ভাব্যতা খুঁজতে গিয়েও কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। বরং অভিযোগের বিষয়ে এখনো দুর্নীতি দমন কমিশনে তদন্ত চলছে।" তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির বিষয়ে যেভাবে বলছে তার কোনো সারবস্তু নেই। তবে তাদের ঋণচুক্তি বাতিলের বিষয়টি দুঃখজনক।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু সেতু-তারাকান্দি রেলপথ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অবস্থান করছিলেন টাঙ্গাইলে। সেখান থেকে এই সংবাদ শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তকে তিনি 'রহস্যজনক' বলে মন্তব্য করেন। মন্ত্রী বলেন, অভিযোগ আসা মানেই দুর্নীতি প্রমাণ হয়ে যাওয়া নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন এ নিয়ে তদন্ত করছে। তার মধ্যেই বিশ্বব্যাংকের এই ঘোষণা এলো।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্বব্যাংক) আরাস্ত খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি ভোরে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে বিষয়টি জেনেছি। অর্থমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন ডাকা হতে পারে।'
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ও পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও বাংলাদেশের কোনো কর্মকর্তার এর সঙ্গে জড়িত কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। বরং প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে বিশ্বব্যাংকই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গতকাল সকালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি টেলিভিশনের সংবাদে জানতে পারলাম, বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। এ বিষয়ে আমি দাপ্তরিক প্রতিক্রিয়া পরে জানাব।' বিশ্বব্যাংকের তোলা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুদক ব্যর্থ হয়েছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি এখন এ বিষয়ে বলতে চাইছি না।'
ঋণচুক্তি বাতিলের বিষয়ে গতকাল বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরীন মাহবুবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওয়াশিংটন দপ্তর থেকে শুক্রবার রাতে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে ঋণচুক্তি বাতিলের প্রেস রিলিজটি দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা ও সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় এই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এ ব্যাপারে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার। বিশ্বব্যাংকের সম্মতিতেই তাঁকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। গতকাল বিকেলে ড. মসিউর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এ ব্যাপারে আগে কথা বলতে চাই না। অর্থমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের পর আমি কথা বলব।'
দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি : মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের সবচেয়ে বড় পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরেই ঘুরছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ছাড়াও অর্থায়নের জন্য চুক্তি হয়েছিল জাইকা, এডিবি ও আইডিবির সঙ্গে। বিশ্বব্যাংক গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ও পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন স্থগিত করে। এরপর দুদক দুই ধাপে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে দুদক প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতির খোঁজ পায়নি। গত ২ ফেব্রুয়ারি দুদক তাদের প্রতিবেদন দেয়। পাশাপাশি পরামর্শক নিয়োগের অভিযোগে তদন্ত চলতে থাকে। জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেতে কানাডার এসএনসি-লাভালিনের সাবেক দুই কর্মকর্তা রমেশ শাহ ও মোহাম্মদ ইসমাইল বাংলাদেশের একাধিক সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ সেধেছিলেন। কানাডা পুলিশ এই দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শেষ করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে কানাডীয় পুলিশের প্রতিনিধিদল গত ২৫ জুন বাংলাদেশে আসে। জানা গেছে, ওই দলটি এমন কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি যে, বাংলাদেশের কোনো সরকারি কর্মকর্তা পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে ঘুষ বা কমিশন নিয়েছিলেন।
অভিযোগের তীর সরকারের দিকে : ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তর ওয়াশিংটন থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছে।
ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা, কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের যোগসাজশে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। এসব তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে বলে তারা আশা করেছিল। বিশ্বব্যাংকের দাবি ছিল, যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু সার্বিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ সন্তোষজনক ছিল না। বিশ্বব্যাংকও বিষয়টিতে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। সব মিলিয়ে সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাড়া না পেয়েই প্রতিশ্রুত ১.২ বিলিয়ন (১২০ কোটি) ডলার ঋণ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, দুর্নীতির এসব তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয় গত বছর সেপ্টেম্বর এবং চলতি বছরের এপ্রিল মাসে।
বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়, দুর্নীতির এ অভিযোগ পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ভেবেছিল, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। দুর্নীতির যে তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংক পেয়েছে, সে ক্ষেত্রে তারা কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রথম দাবি ছিল, যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা। দ্বিতীয়ত, এই অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ করা। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এমন প্রেক্ষাপটে সংস্থাটির অবস্থান ব্যাখ্যা করা এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে উত্তর জানার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের দল ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া বা উত্তর সন্তোষজনক ছিল না। এমন অবস্থায় দুর্নীতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক বিষয়টিতে চোখ বুজে থাকতে পারে না বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, তারা একটি প্রকল্পে তখনই অর্থায়ন করতে পারে, যখন তারা সেই প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যক্রমের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ার শুরুতেই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন স্থগিত রাখে।
সামনে এখন মালয়েশিয়া : এদিকে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করার পর সরকারের সামনে এই মুহূর্তে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটি। আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পেতে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকেই সচেষ্ট রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ জুন মালয়েশিয়ার ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে ঋণচুক্তির উদ্দেশ্যে এই প্রকল্পের প্রস্তাব যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হাতে তুলে দিয়েছে। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বহাল থাকায় মালয়েশিয়ার সঙ্গে ঋণচুক্তির ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। এখন এই জটিলতার অবসান হয়েছে। জানা গেছে, সরকার মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখছে। সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক সফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিকল্প অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এখন আমাদের কাছে মালয়েশিয়ার প্রস্তাবটি রয়েছে। এটিই একমাত্র আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব।'
বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে যা আছে
তার পরও তদন্ত চালিয়ে যাবে দুদক
No comments