ঢাকার আট অঞ্চল তপ্ত by ইফতেখার মাহমুদ

জলাশয় নেই বললেই চলে, সবুজ বনানী দিন দিন কমছে। রাজধানী শহর পরিণত হচ্ছে উত্তপ্ত ভূখণ্ডে। অগ্নিচুল্লির মতোই এখানে তাপ জমা হচ্ছে। সূর্য ডোবার পরও তাপমাত্রা কমছে না, শীতল হচ্ছে না। শহরবাসীর জীবন হয়ে উঠছে অসহনীয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে,


দেশের অন্য যেকোনো স্থানের তুলনায় রাজধানীর তাপমাত্রা বেশি হারে বাড়ছে। পর্যাপ্ত সবুজ ও জলাশয় আছে—এমন এলাকার তুলনায় অন্য এলাকাগুলোর তাপমাত্রা চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার। এসব যন্ত্রের ব্যবহার যতই বাড়ছে, ভবনের বাইরের এলাকার তাপমাত্রা ততই বাড়ছে।
দিনে সূর্যের আলো এসে তাপমাত্রা বেড়ে তা ভূখণ্ডে জমা হয়। রাতে ভূমি ওই তাপমাত্রা আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয়। বুয়েটের ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীর বুকে অন্তত আটটি এমন স্থান তৈরি হয়েছে, যেখানে দিনে জমা হওয়া তাপের বেশির ভাগ রাতেও থেকে যাচ্ছে। পরদিন নতুন করে ওই এলাকায় তাপ জমা হচ্ছে। এভাবে এলাকাটি তপ্ত ভূখণ্ডে পরিণত হচ্ছে। ‘শহরের স্থানীয় জলবায়ু পরিস্থিতি ও বিদ্যুতের ব্যবহার’ শীর্ষক সমীক্ষাটি করা হয় বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক খোন্দকার সাব্বির আহমেদের তত্ত্বাবধানে।
সাব্বির আহমেদ জানান, ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি এই সমীক্ষা চালাচ্ছেন। সর্বশেষ সমীক্ষায় ছয়টিসহ মোট আটটি স্থান চিহ্নিত হয়েছে, যেখানকার গড় তাপমাত্রা অন্য এলাকার চেয়ে তিন-চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রাজধানীতে যেভাবে তপ্ত ভূখণ্ড বিস্তৃত হচ্ছে তাতে পুরো শহরটাই একটা তপ্ত দ্বীপে পরিণত হবে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের উচিত বিশদ নগর পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুযায়ী জলাশয় ও সবুজ এলাকা সংরক্ষণ। কিন্তু সরকার তা না করে রাজধানীর চারপাশে স্যাটেলাইট শহর তৈরি করছে। এতে রাজধানীর তাপমাত্রা আরও বেড়ে একসময় পুরো শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
সমীক্ষায় বলা হয়, গাছপালা ও জলাশয় কমে যাওয়ায় ১৯৯৫ সালে মতিঝিল ও তেজগাঁও এলাকা তপ্ত ভূখণ্ডে (হিট আইল্যান্ড) পরিণত হয়। ওই এলাকায় বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না রেখে উঁচু ইমারত নির্মাণ করায় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীর আটটি এলাকা হচ্ছে: মতিঝিল, তেজগাঁও, বনানী ডিওএইচএস, গুলশান, উত্তরা, মহাখালী, পান্থপথ, কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট। এসব অভিজাত আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারও বেশি। তাই ভবনের বাইরের উম্মুক্ত স্থানের তাপমাত্রাও বেশি।
রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য অপরিকল্পিতভাবে উঁচু ভবন নির্মাণ ও ভবনের মধ্যে উম্মুক্ত স্থান না রাখাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইট, বালু ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হওয়ায় ভবনগুলোতে তাপ জমে থাকছে। আর উঁচু হওয়ায় এবং উন্মুক্ত স্থান না থাকায় জমে থাকা তাপ বের হতে পারছে না।
জলাভূমি কমায় তাপমাত্রা বাড়ছে: বুয়েটের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইশরাত ইসলামের পিএইচডি গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ জলাশয় কমে যাওয়া। উপগ্রহ থেকে নেওয়া আলোকচিত্র পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন, রাজধানীতে যেভাবে নগরায়ণ হচ্ছে তাতে ২০৩৫ সালের মধ্যে জলাশয় নামে কোনো স্থান থাকবে না।
ইশরাত ইসলামের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে রাজধানীর জলাভূমির পরিমাণ ছিল মোট ভূমির ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। ’৯৯ সালে এসে তা ২৫ ও ২০০৫ সালে তা ১৬ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ’৮৯ থেকে ’৯৯ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে প্রতিবছর ৫০২ হেক্টর করে জলাভূমি কমেছে। ’৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময় জলাভূমি কমার পরিমাণ এক হাজার ৯২২ হেক্টর। আর ২০১২ সালে জলাভূমির পরিমাণ কমেছে বছরে আড়াই হাজার হেক্টর। এখন জলাভূমির পরিমাণ মোট ভূমির মাত্র ১০ শতাংশ।
রাজধানীর কৃষি ও জলাভূমির বিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিস (বিসিএএস) একটি গবেষণা করছে। চলমান এ গবেষণায় ১৬০০ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজধানীর ভূমির পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, আশির দশক পর্যন্ত রাজধানী বিস্তৃত হচ্ছিল বুড়িগঙ্গার পূর্ব ও উত্তর দিকে। রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বাড্ডা, সাঁতারকুল, খিলক্ষেত, রামপুরা, দক্ষিণ ও উত্তরখানের বেশির ভাগ এলাকা একসময় জলাভূমি ছিল। যার ৯০ শতাংশ বর্তমানে বালু দিয়ে ভরাট করে আবাসিক এলাকায় পরিণত করা হচ্ছে।
ইশরাত ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জলাভূমি সংরক্ষণ আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, বৃক্ষ সংরক্ষণ আইনসহ অনেকগুলো আইন সরকার করেছে। কিন্তু তার কোনোটিই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে রাজধানী জলাশয় ও বৃক্ষশূন্য একটি কংক্রিটের উত্তপ্ত চুল্লিতে পরিণত হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.