চারদিক-এখানে ইতিহাস থমকে দাঁড়ায় by লাবণী খন্দকার
মোমের আলো জ্বালাচ্ছে যুগান্তর ভৌমিক। ক্লাস নাইনে পড়ে সে। ও বলল, ‘আমরা ক্লাসের বইয়ে ইতিহাস পড়ি। কিন্তু অপারেশন সার্চলাইট কতটা ভয়ংকর ছিল, তা এখন বুঝতে পারছি।’ একাত্তরের পঁচিশে মার্চ মাঝরাত পার হতেই প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকা শহর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রুদ্ররোষে দাউ দাউ জ্বলতে থাকে নতুন বাজার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে এসে পড়ে মর্টার ও ট্যাংকের গোলা। লাশের স্তূপ জমতে থাকে রাস্তায়। পিলখানায় চলে গুলি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গুটি কয়েক অস্ত্র নিয়ে পুলিশ বাহিনীর সামান্য অথচ অসামান্য প্রতিরোধও একসময় গুঁড়িয়ে যায়। ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপল পত্রিকা বিধ্বস্ত হয় গুলির আঘাতে। ঢাকা শহর সেদিন বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। এখানে ইতিহাস থমকে দাঁড়ায়।
আর রায়েরবাজারের ইটখোলাকে পাকিস্তানি হানাদার, আলবদর ও রাজাকাররা বধ্যভূমি বানিয়েছিল একাত্তরের ডিসেম্বরে। পাকিস্তানিদের চালানো এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই রায়েরবাজার বধ্যভূমির সামনে এ আয়োজন।
রায়েরবাজার বধ্যভূমির সামনে সমবেত মানুষের মধ্যে মিশে গিয়েছিল যুগান্তর। ২৫ মার্চ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা), কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (কোডা) ও স্কুল অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (সোডা) আয়োজন করেছিল এ অনুষ্ঠানের। ইউডার সংগীত ও চারুকলা বিভাগের আয়োজনে দেশাত্মবোধক গান দিয়েই শুরু হয় অনুষ্ঠান। রাতের আকাশে সেই গান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে এক মোহময় আবেশ তৈরি করে দিয়েছিল। অপারেশন সার্চলাইটের কালো ধুয়ে দেওয়ার জন্যই এখানে ছিল আলোর মেলা। ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ গানটি যে এতটা হূদয় ছুঁয়ে যায়, তা কি আগে এভাবে বুঝতে পেরেছি?
ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিবছর সাদা, কালো ও লাল রং দিয়ে চিত্রাঙ্কন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পিচঢালা কালো রাস্তাকে সাদা দিয়ে মুক্ত করে লাল দিয়ে তুলে ধরা হয় প্রতীকী যুদ্ধচিত্র। বরাবর রাজপথ রাঙিয়ে চিত্রাঙ্কন করা হতো মানিক মিয়া এভিনিউতে। এ বছর সরকারিভাবে অনুমতি না পাওয়ায় রাজপথ রাঙানো হবে না। চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক আলাউদ্দিন আলী বলেন, ‘শিক্ষা ও নৈতিকতার দায়বোধ থেকে আমরা স্বাধীনতার চেতনাকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে এই আয়োজন করি। এ বছর সেটা করা গেল না। স্বাধীন হয়েও আমরা পরাধীন।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিরাপত্তার খাতিরে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এ বছর মানিক মিয়া এভিনিউতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমাদের আয়োজন থেমে থাকেনি। ৪১ বছর আগে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে প্রতিহত করেছিল পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিরা, আর আমরাও বাধা সরিয়ে নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে চাই প্রতিবছর।’
‘পঁচিশে মার্চের কালো চন্দ্র’ বধ্যভূমিকে চেতনায় রেখে চিত্রাঙ্কন করেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নাসিম আহমেদ নাদভী। তিনি জানান, পুরো কালো ক্যানভাসে ছোট একটা চন্দ্র, যা বাঙালির শক্তি। পঁচিশে মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালায়, সেটাই পরবর্তী নয় মাসে মরণপণ যুদ্ধে বাধ্য করে বাঙালিকে। তাঁর মতে, ‘আমাদের পতাকার লাল সূর্যটা ৩০ লাখ লোকের রক্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেশ স্বাধীন করলেও আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ইতিহাসকে বিকৃত করা হয় বলেই এ ধরনের আয়োজন জরুরি।’
অনুষ্ঠানে প্রতিবার ঘুরতে আসা বিবিএ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল আলীম বলেন, ‘তিন বছর হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি; কিন্তু এটা আমাদের অনুষ্ঠান, তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও সবাই একসঙ্গে এই একটা রাত কাটাই আর অনুভব করার চেষ্টা করি, সেই ভয়ংকর রাত কেমন ছিল।’
চারুকলা বিভাগের ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁরা সবাই কালোর মধ্যে ২৫ মার্চকে ধারণ করে টি-শার্ট পরেন। ২৫তম ব্যাচের জাকির হোসেন টোকন বলেন, ‘আমরা সত্যিকারের স্বাধীন দেশ গড়তে চাই, যেখানে কোনো ধরনের বাধা থাকবে না।’
লাবণী খন্দকার
আর রায়েরবাজারের ইটখোলাকে পাকিস্তানি হানাদার, আলবদর ও রাজাকাররা বধ্যভূমি বানিয়েছিল একাত্তরের ডিসেম্বরে। পাকিস্তানিদের চালানো এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই রায়েরবাজার বধ্যভূমির সামনে এ আয়োজন।
রায়েরবাজার বধ্যভূমির সামনে সমবেত মানুষের মধ্যে মিশে গিয়েছিল যুগান্তর। ২৫ মার্চ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা), কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (কোডা) ও স্কুল অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (সোডা) আয়োজন করেছিল এ অনুষ্ঠানের। ইউডার সংগীত ও চারুকলা বিভাগের আয়োজনে দেশাত্মবোধক গান দিয়েই শুরু হয় অনুষ্ঠান। রাতের আকাশে সেই গান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে এক মোহময় আবেশ তৈরি করে দিয়েছিল। অপারেশন সার্চলাইটের কালো ধুয়ে দেওয়ার জন্যই এখানে ছিল আলোর মেলা। ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ গানটি যে এতটা হূদয় ছুঁয়ে যায়, তা কি আগে এভাবে বুঝতে পেরেছি?
ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিবছর সাদা, কালো ও লাল রং দিয়ে চিত্রাঙ্কন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পিচঢালা কালো রাস্তাকে সাদা দিয়ে মুক্ত করে লাল দিয়ে তুলে ধরা হয় প্রতীকী যুদ্ধচিত্র। বরাবর রাজপথ রাঙিয়ে চিত্রাঙ্কন করা হতো মানিক মিয়া এভিনিউতে। এ বছর সরকারিভাবে অনুমতি না পাওয়ায় রাজপথ রাঙানো হবে না। চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক আলাউদ্দিন আলী বলেন, ‘শিক্ষা ও নৈতিকতার দায়বোধ থেকে আমরা স্বাধীনতার চেতনাকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে এই আয়োজন করি। এ বছর সেটা করা গেল না। স্বাধীন হয়েও আমরা পরাধীন।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিরাপত্তার খাতিরে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এ বছর মানিক মিয়া এভিনিউতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমাদের আয়োজন থেমে থাকেনি। ৪১ বছর আগে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে প্রতিহত করেছিল পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিরা, আর আমরাও বাধা সরিয়ে নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে চাই প্রতিবছর।’
‘পঁচিশে মার্চের কালো চন্দ্র’ বধ্যভূমিকে চেতনায় রেখে চিত্রাঙ্কন করেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নাসিম আহমেদ নাদভী। তিনি জানান, পুরো কালো ক্যানভাসে ছোট একটা চন্দ্র, যা বাঙালির শক্তি। পঁচিশে মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালায়, সেটাই পরবর্তী নয় মাসে মরণপণ যুদ্ধে বাধ্য করে বাঙালিকে। তাঁর মতে, ‘আমাদের পতাকার লাল সূর্যটা ৩০ লাখ লোকের রক্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেশ স্বাধীন করলেও আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ইতিহাসকে বিকৃত করা হয় বলেই এ ধরনের আয়োজন জরুরি।’
অনুষ্ঠানে প্রতিবার ঘুরতে আসা বিবিএ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল আলীম বলেন, ‘তিন বছর হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি; কিন্তু এটা আমাদের অনুষ্ঠান, তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও সবাই একসঙ্গে এই একটা রাত কাটাই আর অনুভব করার চেষ্টা করি, সেই ভয়ংকর রাত কেমন ছিল।’
চারুকলা বিভাগের ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁরা সবাই কালোর মধ্যে ২৫ মার্চকে ধারণ করে টি-শার্ট পরেন। ২৫তম ব্যাচের জাকির হোসেন টোকন বলেন, ‘আমরা সত্যিকারের স্বাধীন দেশ গড়তে চাই, যেখানে কোনো ধরনের বাধা থাকবে না।’
লাবণী খন্দকার
No comments