প্রতিবেশী-ভারতে ছোট দলের চাপে জেরবার বড় দল by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

মমতার ভয়ে গোটা মনমোহন মন্ত্রিসভা এখন তটস্থ। এ পর্যন্ত মমতা ইউপিএ সরকারের প্রায় সব ক'টি সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। তা সে পশ্চিমবঙ্গে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর প্রস্তাবই হোক বা তিস্তা চুক্তির মতো একটি আন্তর্জাতিক নদীচুক্তিই হোক,


খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাবই হোক অথবা জঙ্গি দমনে সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনের প্রস্তাবই হোক। মমতা কেন্দ্রের সরকারকে সংস্কারমূলক কোনো কাজই করতে দিচ্ছেন না। বামদের সঙ্গে একযোগে তার কেন্দ্র বিরোধিতার নীতি চলছে ও চলবে

বড় মাছ যখন ছোট মাছগুলো গিলে খায় তাকে বলে মাৎস্যন্যায়; কিন্তু ছোট মাছগুলো যদি বড় মাছদের গিলে খায় তাহলে তাকে কী বলবেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা?
ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এখন সেই অবস্থা চলছে। ছোট দলগুলোর আক্রমণে সর্বভারতীয় দুটি বড় বড় দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির এখন খুব শোচনীয় অবস্থা। সম্প্রতি ভারতের পাঁচটি রাজ্যে পাঁচ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটেছে। একটিমাত্র ছোট রাজ্য মণিপুরে কংগ্রেস এবার সরকার গঠন করতে পেরেছে। গোয়া ও পাঞ্জাবে আঞ্চলিক দলের সঙ্গে মিলেমিশে সরকার গড়েছে বিজেপি। উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেস ও বিজেপির আসনের ফারাক সামান্যই। সেখানেও ছোট দলগুলোরই জোর। আর উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে বিজেপির স্থান তৃতীয়। কংগ্রেসের চতুর্থ। প্রথম হয়ে আঞ্চলিক দল সমাজবাদী পার্টি সরকার গড়েছে। দ্বিতীয় হয়েছে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি। এটিও আঞ্চলিক দল।
উত্তর প্রদেশের টিপু হলেন সুলতান। টিপু মানে মুলায়মপুত্র অখিলেশ যাদব_ যার ডাক নাম টিপু। যদিও এটি মা-বাবার দেওয়া নাম নয়_ বাঙ্গালোরে যখন এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন সে সময় মহীশূরে খুব যাতায়াত করতেন। বন্ধুরা টিপু সুলতানের নাম অনুসারে তাকে ডাকতেন টিপু। অখিলেশ লোকসভার সদস্য ছিলেন। তার বাবা মুলায়ম সিংও লোকসভার সদস্য। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান অনুসারে ছয় মাসের জন্য যে কেউ মন্ত্রী হতে পারেন। ছয় মাসের মধ্যে তাকে আইনসভার সদস্য হয়ে নিলেই হলো। মমতাও তো লোকসভার সদস্য ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর লোকসভা থেকে পদত্যাগ করে তিনি বিধানসভার সদস্য হয়েছেন।
আমি আগেরবার পাঠকদের জানিয়েছিলাম_ রাহুল গান্ধী চেয়েছিলেন ইউপিতে অন্তত ১০০টি আসন জিততে পারলেও সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে তারা সেখানে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন। তাতে তার সম্মান বাঁচত। কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারকে আর মমতার ব্ল্যাকমেইলিং সহ্য করতে হতো না।
কিন্তু বিধি বাম। দু'বছর পরে ভারতের যে সাধারণ নির্বাচন হবে সেখানে এবার কংগ্রেস সরকার গড়তে পারবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অনেকের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মনমোহন সিং কি সরকার ভেঙে দিয়ে আবার নতুন করে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন চাইবেন? যদিও সোনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিং দু'জনেই বলেছেন_ না, অন্তর্বর্তী নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পরিস্থিতি আর কতদিন ড. সিংয়ের হাতে থাকবে তা বলা মুশকিল। সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় ওঠার প্রধান কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয় কারণ মুলায়ম সিং। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে মাত্র ১৯ সাংসদ। এর মধ্যে একজন কবীর সুমন দল না ছাড়লেও বিদ্রোহী। আর একজন দিনেশ ত্রিবেদি_ যিনি ১৮ মার্চ সকাল পর্যন্তও তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসেবে রেলমন্ত্রী, তিনি ১৮ মার্চ রাতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন এমন এক ঘটনার মধ্য দিয়ে, যা পৃথিবীর রাজনীতিতে অভূতপূর্ব। ঘটনাটি এখন বিশ্বের সবাই জানেন, তবু একটি পুনরাবৃত্তি করি_ দিনেশ ত্রিবেদি মমতাকে না জানিয়ে এবারের রেল বাজেটে দূরপাল্লার ট্রেনে ২০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি হলো_ ট্রেন, ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি বা পেট্রোলচালিত গাড়ির ভাড়া বাড়ানো চলবে না। দিনেশ ত্রিবেদি আচমকা ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব রেখে বাজেট পেশ করলে মমতা সঙ্গে সঙ্গে দিনেশ ত্রিবেদিকে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী ফাঁপরে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাজেটে রেলভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব সম্পর্কে তার অবহিত থাকার কথা। আবার তৃণমূল নেত্রীর মনোভাবও তার অজানা থাকার কথা নয়। এমন পরিস্থিতিতে মনমোহন সিং রেলমন্ত্রীর ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। রেলভাড়া না বাড়ানো একটি জনমোহিনী নীতি_ রেলমন্ত্রী থাকার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলের ভাড়া বাড়াননি। গত দশ বছরে রেলের ভাড়া একই আছে। অন্যদিকে দাম বেড়েছে সবকিছুর। ডিজেল, পেট্রোল, কর্মচারীদের বেতন। এমনকি মমতা পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুতের দাম পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। এদিকে অর্থাভাবে ভারতীয় রেলের নাভিশ্বাস উঠছে। রেলকর্মীর সংখ্যা ১৭ থেকে ১৫ লাখে নেমে এসেছে। কারণ, কেউ অবসর নিলে সেই পদ পূরণ হচ্ছে না। রাজধানী-দুরন্ত-শতাব্দী এমন কয়েকটি প্রেস্টিজ ট্রেন ছাড়া সাধারণ ট্রেনের পরিসেবা ভেঙে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বাদ দিলে অন্য রাজ্যের লোকাল ট্রেনগুলোতে আলো-পাখা পর্যন্ত বিকল।
এদিকে ট্রেনের অপারেশন খরচ আয়ের তুলনায় ক্রমেই বেড়ে চলেছে। '৯২-৯৫ সালে জাফর শরিফ রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন রেলের ১০০ টাকা আয় হলে চালানোর খরচ পড়ত ৮২ দশমিক ০৫ টাকা। তারপর লালুপ্রসাদ যাদব রেলমন্ত্রী থাকাকালে চালানোর খরচ বেড়ে শেষ দিকে দাঁড়ায় ১০০ টাকায় ৯০ দশমিক ০৫ টাকা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকার সময় রেলে আয়ের তুলনায় রেল চালানোর খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮ দশমিক ০৩ টাকা। মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে যোগ দিলে তিনি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মন্ত্রী মুকুল রায়কে রেল দফতরে দেখভাল করতে দেন। মুকুল কেন্দ্রীয় জাহাজ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি সবসময় পশ্চিমবঙ্গে মমতার সঙ্গেই কাটাতেন। এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রিত্বকালের শেষ তিন বছর (২০০৯-১১) কলকাতায় বসে টেলিফোনেই রেল মন্ত্রণালয় চালাতেন। দিনেশ ত্রিবেদি তৃণমূলের এমপি। তিনি বাংলাভাষী নন; বিদেশে শিক্ষিত। তৃণমূলের এমপিদের মধ্যে তিনি একমাত্র স্বচ্ছন্দে ইংরেজি বলতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর সাজেশন অনুসারে তিনি দিনেশকে পূর্ণমন্ত্রী করেন।
দিনেশ মন্ত্রী হয়েই বরাবর বলে আসছেন, আয় না বাড়ালে রেল পরিসেবা ভেঙে পড়বে। কিন্তু মমতা কিছুতেই যাত্রী ভাড়া বাড়াতে দেবেন না। তখন 'রেলের স্বার্থে' দিনেশ ত্রিবেদি মমতাকে না জানিয়েই ট্রেন ভাড়া বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন। ত্রিবেদি বলেন, ভারতীয় রেল এতদিন আইসিইউতে মুমূর্ষু অবস্থায় কাটাচ্ছিল। ২০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করা ছাড়া রেলকে বাঁচানোর আর কোনো রাস্তা ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে আগুনে ঘি পড়ে। মমতা কলকাতায় বসে হুঙ্কার দেন, আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে রেলের ভাড়া বাড়িয়ে গর্হিত অপরাধ করেছেন রেলমন্ত্রী। আমি ওকে এই মুহূর্তে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলছি। রেলমন্ত্রী হবেন মুকুল রায়। মনমোহন সিং তার রেলমন্ত্রীর ভাড়া বৃদ্ধিকে সমর্থন করে দিনেশকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেননি। তিনি শুধু মমতাকে অনুরোধ করেন, দিনেশ তৃণমূলের মন্ত্রী তাই মমতা তাকে অপসারণ করতে পারেন। কিন্তু বাজেট অধিবেশনটা কোনো রকম কেটে যেতে দিন।
কিন্তু মমতা প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ শুনতে রাজি হলেন না। তিনি দিনেশকে বরখাস্ত করে রেলভাড়া বৃদ্ধি রদ করবেনই_ এ তার জনগণের কাছে ওয়াদা। রেলের আয় কোথা থেকে আসবে সে কথা তিনি বলেননি। মমতাপন্থি মিডিয়াগুলো দিনেশ ত্রিবেদিকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেন। দিনেশ কার ভরসায় মমতার সঙ্গে সংঘর্ষে গিয়েছিলেন তা রহস্যাবৃত। মমতা নিজে দিলি্লতে তাকে পদত্যাগ করাতে আসছেন শুনে তিনি ভয় পেয়ে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
মমতার ভয়ে গোটা মনমোহন মন্ত্রিসভা এখন তটস্থ। এ পর্যন্ত মমতা ইউপিএ সরকারের প্রায় সব ক'টি সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। তা সে পশ্চিমবঙ্গে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর প্রস্তাবই হোক বা তিস্তা চুক্তির মতো একটি আন্তর্জাতিক নদীচুক্তিই হোক, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাবই হোক অথবা জঙ্গি দমনে সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনের প্রস্তাবই হোক। মমতা কেন্দ্রের সরকারকে সংস্কারমূলক কোনো কাজই করতে দিচ্ছেন না। বামদের সঙ্গে একযোগে তার কেন্দ্র বিরোধিতার নীতি চলছে ও চলবে। তিনি অনেকগুলো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদেরও তার সঙ্গে পাচ্ছেন। এটা এক রকম নিশ্চিত আগামী সাধারণ নির্বাচনে মমতা তৃতীয় ফ্রন্টকে পাখির চোখের মতো রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। এক সময় ছোট দলগুলোকে একাট্টা করে প্রবল কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধিতার পথ ধরে দেবগৌড়া ও আই কে গুজরাল, চরণ সিংয়ের মতো নেতারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। জ্যোতি বসুকেও প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তাহলে মমতাই-বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না কেন?
এদিকে মুলায়ম সিং যাদবও ঠিক একই কথা ভাবছেন। সে কারণে কংগ্রেসের প্রস্তাবে তিনি সমাজবাদী দলের ২২ জন সাংসদের সমর্থন ইউপিএ সরকারকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে পারেননি। মুলায়ম রেলমন্ত্রী হতে চান। মনমোহনের কাছে সে প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু মমতার তৃণমূলকে চটাতেও ভয় পাচ্ছেন সোনিয়া। সোনিয়া যে কোনো শর্তে আর দু'বছর ইউপিএকে টিকিয়ে রাখতে চান। অবশ্য ইউপি নির্বাচনে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা ম্যাজিক যদি কাজ করত, তাহলে অতটা ভাবতেন না সোনিয়া। মমতার তৃণমূলকে বাদ দিয়ে মুলায়মের দিকে ঝুঁকতেন। কিন্তু উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে মুলায়মের দলে সাফল্য ও কংগ্রেসের বিপর্যয় সোনিয়াকে ভাবাচ্ছে। সাম্প্রতিক অসুখ থেকে তিনি নিরাময় হয়ে উঠছেন বটে। আবার তার আগের দীপ্ত তেজ ও কর্মক্ষমতা ফিরে এসেছে। কিন্তু উত্তর প্রদেশ তাকে আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে। দেশের আর্থিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে আসছে, সামনে বড় দুঃসময়।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতের সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.