অল্পবিদ্যা-আমিনীর জয় (!) হোক by আসিফ নজরুল
আমিনীর কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ আমি। মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। তিনি অনর্গল শাসিয়ে যাচ্ছেন সরকারকে। দুই দিন আগে বললেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতার তরবারি দিয়ে ইসলাম ও কোরআনের ওপর আঘাত হানছেন। তিনি শেখ হাসিনার তরবারি ভেঙে দিতে বলেছেন। তরবারি ভেঙে ফেলার মানে খুব সুমধুর নয়।
এ কথা অন্য কেউ বললে সারা দেশে মামলা হতো তাঁর বিরুদ্ধে। সেক্যুলার বাংলাদেশে এমন কথা সংবিধান লঙ্ঘন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক উঠত। বিচারব্যবস্থার এই ‘স্বর্ণযুগে’ কোনো সুয়োমোটো রুলও হয়তো জারি করে ফেলতেন হাইকোর্টের কোনো বেঞ্চ। আমিনীর বিরুদ্ধে কি এসব হবে? আমার ধারণা, হবে না। তিনি ‘বুজুর্গ’ মানুষ। এ ধরনের মানুষের ঘাঁটাতে চায় না কেউ।
আমিনীর শ্বশুর মওলানা হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন আরও বুজুর্গ আলেম। এলাকায় ‘জিন-হুজুর’ নামে খ্যাতি ছিল তাঁর। ছোটবেলায় শুনতাম, সম্মানিত জিনসাহেবদের নাম ধরে ডাকতে হয় না, বলতে হয় তেনারা। ফজরের সময় ‘তেনারা’ নাকি আসতেন মসজিদে। তাঁদের পায়ের পাতা পেছন দিকে বাঁকানো; দেখে বেহুঁশ হওয়ার ভয়ে আকাশের দিকে মুখ করে মসজিদে ঢুকতাম আমরা। সেই তেনাদের শখ করে পালতেন হাফেজ্জী হুজুর। জিয়াউর রহমান সাহেব মারা যাওয়ার পর ৮০-ঊর্ধ্ব বয়সে তিনি একবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। আমরা উত্তেজিত: মানুষ আর জিন মিলে না-জানি কী গণতন্ত্র নিয়ে আসে দেশে! ফলাফল বের হলে দেখা গেল, তিনি কয়েক লাখ মাত্র ভোট পেয়েছেন। তেনারা তাঁকে নিশ্চয়ই ভোট দিয়েছিলেন, মানুষ দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ তেনাদের মতো বিশ্বস্ত নয়।
তেনারা হয়তো এখনো আছেন হুজুরের জামাতা মাওলানা আমিনীর সঙ্গে। না হলে তাঁকে সরকারের এত ভয় কেন? আমিনীর ছেলে মাওলানা হাসনাত গুম হয়ে ছিলেন প্রায় আধা মাস! আমিনী আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, সরকারকে দিলেন ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম। মাওলানা হাসনাত মাদ্রাসার সামনে হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেরত এলেন। আমিনী পান চিবোতে চিবোতে বললেন: ‘কোরআন হাতে নিয়ে বলতে পারি, শেখ হাসিনার নির্দেশে আমার ছেলেকে গুম করা হয়েছিল, তাঁর নির্দেশেই তাকে ফেরত দেওয়া হয়েছে।’ আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় এ কথা শুনে। এই সরকার নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে হটিয়ে দিয়েছে, খালেদা জিয়াকে ঘরছাড়া করেছে, ১৬ বছরের কিশোর লিমনের হাঁটু গুঁড়িয়ে দিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। এই সরকারের সবচেয়ে ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে এত বড় দুঃসাহস! আমিনীর তো ‘ক্রসফায়ার’ হয়ে যাওয়ার কথা এই মন্তব্যের পর! কেন হলো না! কেন তিনি গ্রেপ্তার পর্যন্ত হলেন না? কেন সরকার প্রমাণ করে দিল না, আমিনীই লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর ছেলেকে? আমার ধারণা, এসবই তেনাদের কারণে। আমিনীর ছেলেকে তেনারা নিয়ে গিয়েছিলেন, আমিনীর ফরিয়াদ শুনে তেনারাই ফেরত দিয়েছেন। সরকার তো আর তেনাদের গ্রেপ্তার করতে পারে না! আর আমিনীর বিরুদ্ধেও তাই কিছু করা যাচ্ছে না!
সরকার বলছে, নারীনীতিতে ইসলামবিরোধী কিছু নেই। আমিনী তা মানতে নারাজ। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করবে না তাঁর সরকার। আমিনী বলেছেন, তিনি তা-ই করতে যাচ্ছেন। তিনি হরতাল করেছেন, দেশকে শেখ হাসিনাশূন্য করার হুমকি দিয়েছেন, এমনকি তাঁর ছেলে গুম হয়ে যাক—আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছেন। এর এক ভাগ কথাবার্তা বলে বিরোধী দলের নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, মামলার পর মামলায় জর্জরিত হয়েছেন, রাস্তায় পিটুনি খেয়েছেন। কিন্তু আমিনী আছেন বহাল তবিয়তে। সরকার তাঁকে আঁচড় পর্যন্ত দিতে পারছে না। আদালত তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনই আমিনীর তেলেসমাতি ক্ষমতা, সেই নির্দেশ পর্যন্ত দুই ঘণ্টায় প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তাঁর এক জঙ্গি ক্যাডার পুলিশের গায়ে ফ্লাইং কিক মেরেছেন। কিছু চ্যানেল তা স্লো-মোশনে দেখিয়েছে। এ রকম একটি ফ্লাইং কিকের ছবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ডেইলি স্টার কী মনে করে ছেপেছিল। সারা দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের ধরে ধরে পেটানো হয়েছিল এর জের ধরে, ফ্লাইং কিক-অলাকেও বহু নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। আমিনীর ফ্লাইং কিক-অলার কোনো সমস্যা হয়নি, এমনকি তাঁকে গ্রেপ্তারের কোনো চেষ্টাও সম্ভবত সরকার করেনি। কেন করেনি? তিনিও কি অশরীরী, তেনাদের গোত্রভুক্ত কেউ!
তবে সরকার ঠকেনি শেষ পর্যন্ত। আমিনীর আস্ফাালনে মহা উপকার হয়েছে সরকারের। পশ্চিমা দুনিয়া দেখল আমিনীর অনুসারীরা কত জঙ্গি হতে পারে এ দেশে। তারা দেখল, এই জঙ্গিদের ‘নৈতিক সমর্থন’ দেয় বিএনপি, লাঠি হাতে প্রতিরোধ করে আওয়ামী লীগ। ক্রসফায়ার আর গ্রামীণ ব্যাংক দখল নিয়ে পশ্চিমে নিন্দায় জর্জরিত ছিল সরকার। এমন এক সময়ে জঙ্গি প্রতিরোধ আওয়ামী লীগই কেবল পারে—পশ্চিমাদের এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া গেলে সরকারের ক্ষতি কী? আমিনীর আরও হুংকার, আরও হুমকি তাই শুনতে হবে আমাদের। এতে দেশের ইমেজের ক্ষতি হলেও সরকারের ইমেজ বাড়বে। তবে ইতিহাস বলে, আমিনীদের বেশি বাড়তে দিতে নেই। আমিনীর দোসরদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি ইরাক, আফগানিস্তান আর পাকিস্তানে। এই দোসরদের বিকাশ ঘটেছিল পশ্চিমা সেক্যুলারদের প্রত্যক্ষ সাহায্য ও ছত্রচ্ছায়ায়। আমাদের সেক্যুলারদের তা হয়তো মনে থাকে না। কি বিরোধী শিবির, কি সরকারি মহল—আমিনীর দাপট তাই সর্বত্র!
তিনি মানুষ ও অ-মানুষদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন। তাঁর জয় হোক!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমিনীর শ্বশুর মওলানা হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন আরও বুজুর্গ আলেম। এলাকায় ‘জিন-হুজুর’ নামে খ্যাতি ছিল তাঁর। ছোটবেলায় শুনতাম, সম্মানিত জিনসাহেবদের নাম ধরে ডাকতে হয় না, বলতে হয় তেনারা। ফজরের সময় ‘তেনারা’ নাকি আসতেন মসজিদে। তাঁদের পায়ের পাতা পেছন দিকে বাঁকানো; দেখে বেহুঁশ হওয়ার ভয়ে আকাশের দিকে মুখ করে মসজিদে ঢুকতাম আমরা। সেই তেনাদের শখ করে পালতেন হাফেজ্জী হুজুর। জিয়াউর রহমান সাহেব মারা যাওয়ার পর ৮০-ঊর্ধ্ব বয়সে তিনি একবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। আমরা উত্তেজিত: মানুষ আর জিন মিলে না-জানি কী গণতন্ত্র নিয়ে আসে দেশে! ফলাফল বের হলে দেখা গেল, তিনি কয়েক লাখ মাত্র ভোট পেয়েছেন। তেনারা তাঁকে নিশ্চয়ই ভোট দিয়েছিলেন, মানুষ দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ তেনাদের মতো বিশ্বস্ত নয়।
তেনারা হয়তো এখনো আছেন হুজুরের জামাতা মাওলানা আমিনীর সঙ্গে। না হলে তাঁকে সরকারের এত ভয় কেন? আমিনীর ছেলে মাওলানা হাসনাত গুম হয়ে ছিলেন প্রায় আধা মাস! আমিনী আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, সরকারকে দিলেন ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম। মাওলানা হাসনাত মাদ্রাসার সামনে হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেরত এলেন। আমিনী পান চিবোতে চিবোতে বললেন: ‘কোরআন হাতে নিয়ে বলতে পারি, শেখ হাসিনার নির্দেশে আমার ছেলেকে গুম করা হয়েছিল, তাঁর নির্দেশেই তাকে ফেরত দেওয়া হয়েছে।’ আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় এ কথা শুনে। এই সরকার নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে হটিয়ে দিয়েছে, খালেদা জিয়াকে ঘরছাড়া করেছে, ১৬ বছরের কিশোর লিমনের হাঁটু গুঁড়িয়ে দিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। এই সরকারের সবচেয়ে ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে এত বড় দুঃসাহস! আমিনীর তো ‘ক্রসফায়ার’ হয়ে যাওয়ার কথা এই মন্তব্যের পর! কেন হলো না! কেন তিনি গ্রেপ্তার পর্যন্ত হলেন না? কেন সরকার প্রমাণ করে দিল না, আমিনীই লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর ছেলেকে? আমার ধারণা, এসবই তেনাদের কারণে। আমিনীর ছেলেকে তেনারা নিয়ে গিয়েছিলেন, আমিনীর ফরিয়াদ শুনে তেনারাই ফেরত দিয়েছেন। সরকার তো আর তেনাদের গ্রেপ্তার করতে পারে না! আর আমিনীর বিরুদ্ধেও তাই কিছু করা যাচ্ছে না!
সরকার বলছে, নারীনীতিতে ইসলামবিরোধী কিছু নেই। আমিনী তা মানতে নারাজ। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করবে না তাঁর সরকার। আমিনী বলেছেন, তিনি তা-ই করতে যাচ্ছেন। তিনি হরতাল করেছেন, দেশকে শেখ হাসিনাশূন্য করার হুমকি দিয়েছেন, এমনকি তাঁর ছেলে গুম হয়ে যাক—আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছেন। এর এক ভাগ কথাবার্তা বলে বিরোধী দলের নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, মামলার পর মামলায় জর্জরিত হয়েছেন, রাস্তায় পিটুনি খেয়েছেন। কিন্তু আমিনী আছেন বহাল তবিয়তে। সরকার তাঁকে আঁচড় পর্যন্ত দিতে পারছে না। আদালত তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনই আমিনীর তেলেসমাতি ক্ষমতা, সেই নির্দেশ পর্যন্ত দুই ঘণ্টায় প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তাঁর এক জঙ্গি ক্যাডার পুলিশের গায়ে ফ্লাইং কিক মেরেছেন। কিছু চ্যানেল তা স্লো-মোশনে দেখিয়েছে। এ রকম একটি ফ্লাইং কিকের ছবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ডেইলি স্টার কী মনে করে ছেপেছিল। সারা দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের ধরে ধরে পেটানো হয়েছিল এর জের ধরে, ফ্লাইং কিক-অলাকেও বহু নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। আমিনীর ফ্লাইং কিক-অলার কোনো সমস্যা হয়নি, এমনকি তাঁকে গ্রেপ্তারের কোনো চেষ্টাও সম্ভবত সরকার করেনি। কেন করেনি? তিনিও কি অশরীরী, তেনাদের গোত্রভুক্ত কেউ!
তবে সরকার ঠকেনি শেষ পর্যন্ত। আমিনীর আস্ফাালনে মহা উপকার হয়েছে সরকারের। পশ্চিমা দুনিয়া দেখল আমিনীর অনুসারীরা কত জঙ্গি হতে পারে এ দেশে। তারা দেখল, এই জঙ্গিদের ‘নৈতিক সমর্থন’ দেয় বিএনপি, লাঠি হাতে প্রতিরোধ করে আওয়ামী লীগ। ক্রসফায়ার আর গ্রামীণ ব্যাংক দখল নিয়ে পশ্চিমে নিন্দায় জর্জরিত ছিল সরকার। এমন এক সময়ে জঙ্গি প্রতিরোধ আওয়ামী লীগই কেবল পারে—পশ্চিমাদের এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া গেলে সরকারের ক্ষতি কী? আমিনীর আরও হুংকার, আরও হুমকি তাই শুনতে হবে আমাদের। এতে দেশের ইমেজের ক্ষতি হলেও সরকারের ইমেজ বাড়বে। তবে ইতিহাস বলে, আমিনীদের বেশি বাড়তে দিতে নেই। আমিনীর দোসরদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি ইরাক, আফগানিস্তান আর পাকিস্তানে। এই দোসরদের বিকাশ ঘটেছিল পশ্চিমা সেক্যুলারদের প্রত্যক্ষ সাহায্য ও ছত্রচ্ছায়ায়। আমাদের সেক্যুলারদের তা হয়তো মনে থাকে না। কি বিরোধী শিবির, কি সরকারি মহল—আমিনীর দাপট তাই সর্বত্র!
তিনি মানুষ ও অ-মানুষদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন। তাঁর জয় হোক!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments