সেক্টর কমান্ডারসঃ সমাধি ও সড়ক by মাহবুব তালুকদার
গুরুদেব ধ্যানমগ্ন হইয়া যোগাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। তাহার মুখমণ্ডল হইতে এক অলৌকিক জ্যোতি বিচ্ছুরিত হইতেছিল। শিষ্য এইরূপ স্বর্গীয় দৃশ্য অবলোকন করিয়া আত্মহারা হইল। তাহার মনে প্রতীতী জন্মাইল যে, গুরুদেব বিশ্বসংসারের সকল রহস্য অবগত হইয়াছেন।
তবে সেই ঐশ্বরিক জ্ঞান তিনি প্রকাশ করেন না। তিনি সতত সাধারণ মানুষের ন্যায় আচরণ করেন।
এক সময়ে গুরুদেবের ধ্যানভঙ্গ হইল। যেন তিনি স্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিলেন। শিষ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, বত্স! অবধান করো।
আপনার বাণীর জন্য উত্কর্ণ হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছি। শিষ্য বলিল।
অদ্য তোমাকে একটি প্রশ্ন করিব।
যথা আজ্ঞা প্রভু!
মুক্তিযোদ্ধাগণ যদি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলিয়া আখ্যায়িত হন, তাহা হইলে সেক্টর কমান্ডারগণকে কি অভিধায় আখ্যা দেওয়া হইবে?
জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তান।
কারেক্ট। উত্তর সঠিক হইয়াছে। গুরুদেব বলিলেন, এক্ষণে তাহাদিগকে লইয়া অনেকেরই চিন্তার উদ্রেক হইতেছে।
কেন স্যার?
কয়েকদিন পূর্বে একটি প্রস্তাব দেওয়া হইয়াছিল জিয়া উদ্যানে শহীদ জিয়ার কবরের পার্শ্বে সেক্টর কমান্ডারগণকে সমাহিত করা যাইতে পারে।
পত্রিকায় উহা লইয়া লেখালেখি হইয়াছে। শিষ্য বলিল।
কিন্তু প্রস্তাবটি আমার তেমন মনঃপূত হয় নাই। কথাটি ভাবিয়া আমি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম। ঢাকা শহরে এত জায়গা থাকিতে জিয়া উদ্যানে মরহুম জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে ভবিষ্যতে সেক্টর কমান্ডারগণকে সমাধিস্থ করার চিন্তা মাথায় আসিল কি প্রকারে? উহার কারণই বা কি?
হুজুর! গোস্তাকি মাফ করিলে আমি ইহার উত্তর প্রদানের চেষ্টা করিতে পারি।
তুমি নির্ভয়ে বলো।
আমার ধারণা, যাহারা এইরূপ চিন্তা করিয়াছেন তাহারা শহীদ জিয়ার প্রতি প্রীতি বা ভালোবাসাবশত ইহা করেন নাই। ইহার পশ্চাতে কাহারও ঈর্ষাকাতর মন ক্রিয়াশীল হইয়াছে। সম্ভবত শহীদ জিয়াকে অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারগণের সমতুল্য করিবার জন্য এই প্রয়াস।
বত্স! কোনোরূপ মহত্ উদ্দেশ্যে যে এইরূপ প্রস্তাব করা হয় নাই তাহাতে আমি নিশ্চিত। তবে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
শিষ্য কহিল, স্পর্শকাতর হইলেও ইহা লইয়া আমাদের মধ্যে আলোচনা হইতে পারে। যাহারা শহীদ জিয়াকে কেবল সেক্টর কমান্ডার বলিয়া অভিহিত করিতে চাহেন, তাহারা বাংলাদেশের চলমান ইতিহাসকে উপেক্ষা করিতে চাহিতেছেন। জিয়াউর রহমানের রাজনীতির বিশ্লেষণ না করিয়াও বলা যাইতে পারে, তিনি তো কয়েক বত্সর রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্ রাজনৈতিক দলের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। স্বীয় কর্মফলের মধ্য দিয়া তিনি দেশের ইতিহাসের যে আসনে আসীন হইয়াছেন, ঐ স্থান হইতে তাহাকে পশ্চাতে টানিয়া আনিবার সুযোগ নাই।
গুরুদেব জানাইলেন, তোমাকে মনে রাখিতে হইবে যে, অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারগণও কম যান নাই। তাহারা কেহ মন্ত্রী, কেহ সেনাবাহিনী প্রধান হইয়াছেন। তাহারাও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তাহা অবশ্যই আমার স্মরণে আছে। তবে আমি কাহারও সহিত কাহারও তুলনা করিতে চাহি না। আমি কেবল বলিতে চাহি, ইতিহাসে কাহার স্থান কোথায় তাহা সময়ই নিরূপণ করিবে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম হইল কেহ গায়ের জোরে বা হুকুম বরদার দিয়া সুনির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাইতে পারে না।
তবে ঘটনাটি ভিন্ন দিকে মোড় লইয়াছে সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। গুরুদেব কহিলেন।
কি বক্তব্য? শিষ্য জানিতে চাহিল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলিয়াছেন, ‘যেখানে জিয়ার লাশই নেই সেখানে সেক্টর কমান্ডারদের সমাহিত করার যৌক্তিকতা নেই।’ (আমাদের সময়, ২১ জানুয়ারি)।
স্যার! আমার মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইরূপ কথা না বলিলে পারিতেন। এই কথার কোনো সত্যতা থাকিলে প্রমাণসহ তাহা উপস্থাপন করিতে অসুবিধা কি?
তিনি যাহা বলিয়াছেন নিশ্চয়ই তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিয়াছেন।
প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করিতেই পারেন; কিন্তু ওই সমাধিতে জিয়ার লাশ নাই বলিয়া মানুষের মনে ক্ষত সৃষ্টির দরকার ছিল না। আমার যদ্দূর মনে পড়ে শহীদ জিয়ার মৃত্যুর পর শেরেবাংলা নগরে তাহার যে জানাজা হইয়াছিল, এতবড় জানাজা বাংলাদেশে আর কখনো হয় নাই। সারা দেশের মানুষ সেইদিন আবেগরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। তাই এই উক্তিতে আওয়ামী লীগের সহিত বিএনপির ব্যবধান আরও বাড়িয়া যাইবে। মহাত্মন, আরও একটি বিষয়ে আমি বিস্মিত হইয়াছি।
কি বিষয়? গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন।
সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, ‘এই জিয়া কর্নেল তাহের, ব্রিগেডিয়ার হুদা ও সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সেই হত্যাকারীর পাশে সেক্টর কমান্ডারদের সমাহিত করতে তাদের পরিবার রাজি হবে কিনা সেটিও প্রশ্ন।’ ইহাই যদি বক্তব্য হয়, সেক্টর কমান্ডারগণকে তাহাদের কথায় জিয়া শূণ্য জিয়া উদ্যানে সমাহিত করার প্রস্তাবটি উঠিল কেন?
শিষ্যের কথা শুনিয়া গুরুদেব কহিলেন, সেক্টর কমান্ডারগণের জন্য স্বাধীনতা স্তম্ভের নিকটবর্তী কোনো স্থানে একটি সমাধি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা যাইতে পারে।
মহাত্মন! এই বিষয়ে আমার নিজস্ব একটি প্রস্তাব আছে।
কি তোমার প্রস্তাব?
সেক্টর কমান্ডারগণ যে যে সেক্টরে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, ওই সেক্টরেই পৃথক পৃথকভাবে তাহাদের জন্য সমাধি তৈয়ারি করা যায়।
গুরুদেব সহাস্যে বলিলেন, তোমার প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত। ইহা হইলে মন্দ হয় না। সারাদেশই তাহাদের স্মৃতি ধারণ করিতে পারে। অবশ্য ঢাকা মহানগরীতে তাহাদের স্মৃতি জাগরূক রাখার জন্য সকল সেক্টর কমান্ডারগণের নামে বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করা হইয়াছে।
এহেন নামকরণের ব্যাপারেও আমার কিছু আপত্তি আছে।
তোমার আপত্তি!
আমার আপত্তি সেক্টর কমান্ডারদের নামে সড়কের নামকরণ করার জন্য নহে; বরং এই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই।
তাহা হইলে তোমার আপত্তি কিসের?
আমার আপত্তি হইতেছে—যেরূপ গণহারে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট ও অলিগলির নামকরণ করা হইতেছে, উহা আমার মনঃপূত নহে। তাহাদের সকলেই রাজধানীর কোন সড়কের নামকরণ করার উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব কিনা সন্দেহ আছে। অনেক অখ্যাত অজ্ঞাত ব্যক্তির নামেও সড়কের নামকরণ হইতে দেখা যায়। মাননীয় মেয়র কোন প্রক্রিয়ায় এই নামগুলি বাছাই করিলেন, তাহা জানা যায় নাই। মনে হয়, কোনো কোনো ব্যক্তি, দল বা গ্রুপের প্রতি তোয়াজবশতই তিনি ইহা করিয়াছেন। মেয়র সাহেব নিজের নামেও একটি সড়কের নামকরণ করিয়াছেন। তাহার নামে একটি রাস্তার নামকরণ করার ব্যাপারে তিনি পরবর্তী মেয়রের ওপর ভরসা রাখিতে পারেন নাই। সাদেক হোসেন খোকার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া পরবর্তী মেয়রগণ ও ওয়ার্ড কমিশনারগণ প্রত্যেকের নিজের নামে একটি করিয়া রাস্তার নামকরণ করিলে বিস্ময়ের কারণ থাকিবে না। সুদীর্ঘ বক্তব্যের পর শিষ্য থামিল।
তুমি সেক্টর কমান্ডারদের বিষয় বাদ দিয়া ওয়ার্ড কমিশনারদের দিকে চলিয়া গিয়াছ। বত্স! পূর্বস্থানে ফিরিয়া আইস।
গুরুদেবের কথায় শিষ্য পূর্ব স্থানে ফিরিল। বলিল, সেক্টর কমান্ডারগণ এক্ষণে একটি ফোরাম গঠন করিয়াছেন। উহার উদ্দেশ্য হইতেছে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারে চাপ সৃষ্টি করা।
এই বিষয়ে তোমার অভিমত কি?
যুদ্ধ অপরাধীগণের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। তবে কাহারা যুদ্ধ অপরাধী সেই বিষয়টি সতর্কতার সহিত বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। অদ্যাবধি যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে কেহ প্রতিবাদ করিয়াছেন বলিয়া শোনা যায় নাই।
তাহা ঠিক। তবে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলিয়াছেন, যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার যেন কোনো প্রকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়। বিচারকার্য নিরপেক্ষ তদন্ত ও নিরপেক্ষতার সহিত সম্পন্ন করিতে হইবে বলিয়া তিনি উল্লেখ করিয়াছেন।
তোমার কি মনে হয় যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার নিরপেক্ষ হইবে?
ইহা অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন প্রভু। একমাত্র সময়ই তাহা বলিতে পারে। তবে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সম্পর্কে আমার একটি অভিমত আছে।
কি অভিমত?
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই সংগঠন কোনো দলের রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নহে।
কেন এই কথা বলিতেছ?
আমার মনে হয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম দল বিশেষের রাজনীতির সহিত জড়িত হইয়া পড়িতেছে।
রাজনীতি করার অধিকার তো সকলেরই আছে। শহীদ জিয়া যদি রাজনীতি করিতে পারেন, অন্যদের রাজনীতি করিতে বাধা কোথায়?
মহাত্মন! আমি ব্যক্তি বিশেষের রাজনীতি বারণ করিতেছি না। তবে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সংগঠনটি রাজনীতি নিরপেক্ষ থাকা বাঞ্ছনীয় মনে করি।
সাধু! গুরুদেব কহিলেন, বত্স! তোমাকে না জানাইয়া অদ্য তোমার পরীক্ষা গ্রহণ করিয়াছি। উহাতে তুমি কৃতকার্য হইয়াছ। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি।
আপনার আশীর্বাদ আমার চিরদিনের পাথেয় প্রভু!
গুরুদেব পুনরায় যোগাবিষ্ট হইলেন। শিষ্য অবলোকন করিল গুরুদেবের মুখমণ্ডল অলৌকিক বিভায় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com
এক সময়ে গুরুদেবের ধ্যানভঙ্গ হইল। যেন তিনি স্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিলেন। শিষ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, বত্স! অবধান করো।
আপনার বাণীর জন্য উত্কর্ণ হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছি। শিষ্য বলিল।
অদ্য তোমাকে একটি প্রশ্ন করিব।
যথা আজ্ঞা প্রভু!
মুক্তিযোদ্ধাগণ যদি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলিয়া আখ্যায়িত হন, তাহা হইলে সেক্টর কমান্ডারগণকে কি অভিধায় আখ্যা দেওয়া হইবে?
জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তান।
কারেক্ট। উত্তর সঠিক হইয়াছে। গুরুদেব বলিলেন, এক্ষণে তাহাদিগকে লইয়া অনেকেরই চিন্তার উদ্রেক হইতেছে।
কেন স্যার?
কয়েকদিন পূর্বে একটি প্রস্তাব দেওয়া হইয়াছিল জিয়া উদ্যানে শহীদ জিয়ার কবরের পার্শ্বে সেক্টর কমান্ডারগণকে সমাহিত করা যাইতে পারে।
পত্রিকায় উহা লইয়া লেখালেখি হইয়াছে। শিষ্য বলিল।
কিন্তু প্রস্তাবটি আমার তেমন মনঃপূত হয় নাই। কথাটি ভাবিয়া আমি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম। ঢাকা শহরে এত জায়গা থাকিতে জিয়া উদ্যানে মরহুম জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে ভবিষ্যতে সেক্টর কমান্ডারগণকে সমাধিস্থ করার চিন্তা মাথায় আসিল কি প্রকারে? উহার কারণই বা কি?
হুজুর! গোস্তাকি মাফ করিলে আমি ইহার উত্তর প্রদানের চেষ্টা করিতে পারি।
তুমি নির্ভয়ে বলো।
আমার ধারণা, যাহারা এইরূপ চিন্তা করিয়াছেন তাহারা শহীদ জিয়ার প্রতি প্রীতি বা ভালোবাসাবশত ইহা করেন নাই। ইহার পশ্চাতে কাহারও ঈর্ষাকাতর মন ক্রিয়াশীল হইয়াছে। সম্ভবত শহীদ জিয়াকে অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারগণের সমতুল্য করিবার জন্য এই প্রয়াস।
বত্স! কোনোরূপ মহত্ উদ্দেশ্যে যে এইরূপ প্রস্তাব করা হয় নাই তাহাতে আমি নিশ্চিত। তবে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
শিষ্য কহিল, স্পর্শকাতর হইলেও ইহা লইয়া আমাদের মধ্যে আলোচনা হইতে পারে। যাহারা শহীদ জিয়াকে কেবল সেক্টর কমান্ডার বলিয়া অভিহিত করিতে চাহেন, তাহারা বাংলাদেশের চলমান ইতিহাসকে উপেক্ষা করিতে চাহিতেছেন। জিয়াউর রহমানের রাজনীতির বিশ্লেষণ না করিয়াও বলা যাইতে পারে, তিনি তো কয়েক বত্সর রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্ রাজনৈতিক দলের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। স্বীয় কর্মফলের মধ্য দিয়া তিনি দেশের ইতিহাসের যে আসনে আসীন হইয়াছেন, ঐ স্থান হইতে তাহাকে পশ্চাতে টানিয়া আনিবার সুযোগ নাই।
গুরুদেব জানাইলেন, তোমাকে মনে রাখিতে হইবে যে, অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারগণও কম যান নাই। তাহারা কেহ মন্ত্রী, কেহ সেনাবাহিনী প্রধান হইয়াছেন। তাহারাও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তাহা অবশ্যই আমার স্মরণে আছে। তবে আমি কাহারও সহিত কাহারও তুলনা করিতে চাহি না। আমি কেবল বলিতে চাহি, ইতিহাসে কাহার স্থান কোথায় তাহা সময়ই নিরূপণ করিবে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম হইল কেহ গায়ের জোরে বা হুকুম বরদার দিয়া সুনির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাইতে পারে না।
তবে ঘটনাটি ভিন্ন দিকে মোড় লইয়াছে সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। গুরুদেব কহিলেন।
কি বক্তব্য? শিষ্য জানিতে চাহিল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলিয়াছেন, ‘যেখানে জিয়ার লাশই নেই সেখানে সেক্টর কমান্ডারদের সমাহিত করার যৌক্তিকতা নেই।’ (আমাদের সময়, ২১ জানুয়ারি)।
স্যার! আমার মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইরূপ কথা না বলিলে পারিতেন। এই কথার কোনো সত্যতা থাকিলে প্রমাণসহ তাহা উপস্থাপন করিতে অসুবিধা কি?
তিনি যাহা বলিয়াছেন নিশ্চয়ই তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিয়াছেন।
প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করিতেই পারেন; কিন্তু ওই সমাধিতে জিয়ার লাশ নাই বলিয়া মানুষের মনে ক্ষত সৃষ্টির দরকার ছিল না। আমার যদ্দূর মনে পড়ে শহীদ জিয়ার মৃত্যুর পর শেরেবাংলা নগরে তাহার যে জানাজা হইয়াছিল, এতবড় জানাজা বাংলাদেশে আর কখনো হয় নাই। সারা দেশের মানুষ সেইদিন আবেগরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। তাই এই উক্তিতে আওয়ামী লীগের সহিত বিএনপির ব্যবধান আরও বাড়িয়া যাইবে। মহাত্মন, আরও একটি বিষয়ে আমি বিস্মিত হইয়াছি।
কি বিষয়? গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন।
সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, ‘এই জিয়া কর্নেল তাহের, ব্রিগেডিয়ার হুদা ও সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সেই হত্যাকারীর পাশে সেক্টর কমান্ডারদের সমাহিত করতে তাদের পরিবার রাজি হবে কিনা সেটিও প্রশ্ন।’ ইহাই যদি বক্তব্য হয়, সেক্টর কমান্ডারগণকে তাহাদের কথায় জিয়া শূণ্য জিয়া উদ্যানে সমাহিত করার প্রস্তাবটি উঠিল কেন?
শিষ্যের কথা শুনিয়া গুরুদেব কহিলেন, সেক্টর কমান্ডারগণের জন্য স্বাধীনতা স্তম্ভের নিকটবর্তী কোনো স্থানে একটি সমাধি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা যাইতে পারে।
মহাত্মন! এই বিষয়ে আমার নিজস্ব একটি প্রস্তাব আছে।
কি তোমার প্রস্তাব?
সেক্টর কমান্ডারগণ যে যে সেক্টরে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, ওই সেক্টরেই পৃথক পৃথকভাবে তাহাদের জন্য সমাধি তৈয়ারি করা যায়।
গুরুদেব সহাস্যে বলিলেন, তোমার প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত। ইহা হইলে মন্দ হয় না। সারাদেশই তাহাদের স্মৃতি ধারণ করিতে পারে। অবশ্য ঢাকা মহানগরীতে তাহাদের স্মৃতি জাগরূক রাখার জন্য সকল সেক্টর কমান্ডারগণের নামে বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করা হইয়াছে।
এহেন নামকরণের ব্যাপারেও আমার কিছু আপত্তি আছে।
তোমার আপত্তি!
আমার আপত্তি সেক্টর কমান্ডারদের নামে সড়কের নামকরণ করার জন্য নহে; বরং এই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই।
তাহা হইলে তোমার আপত্তি কিসের?
আমার আপত্তি হইতেছে—যেরূপ গণহারে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট ও অলিগলির নামকরণ করা হইতেছে, উহা আমার মনঃপূত নহে। তাহাদের সকলেই রাজধানীর কোন সড়কের নামকরণ করার উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব কিনা সন্দেহ আছে। অনেক অখ্যাত অজ্ঞাত ব্যক্তির নামেও সড়কের নামকরণ হইতে দেখা যায়। মাননীয় মেয়র কোন প্রক্রিয়ায় এই নামগুলি বাছাই করিলেন, তাহা জানা যায় নাই। মনে হয়, কোনো কোনো ব্যক্তি, দল বা গ্রুপের প্রতি তোয়াজবশতই তিনি ইহা করিয়াছেন। মেয়র সাহেব নিজের নামেও একটি সড়কের নামকরণ করিয়াছেন। তাহার নামে একটি রাস্তার নামকরণ করার ব্যাপারে তিনি পরবর্তী মেয়রের ওপর ভরসা রাখিতে পারেন নাই। সাদেক হোসেন খোকার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া পরবর্তী মেয়রগণ ও ওয়ার্ড কমিশনারগণ প্রত্যেকের নিজের নামে একটি করিয়া রাস্তার নামকরণ করিলে বিস্ময়ের কারণ থাকিবে না। সুদীর্ঘ বক্তব্যের পর শিষ্য থামিল।
তুমি সেক্টর কমান্ডারদের বিষয় বাদ দিয়া ওয়ার্ড কমিশনারদের দিকে চলিয়া গিয়াছ। বত্স! পূর্বস্থানে ফিরিয়া আইস।
গুরুদেবের কথায় শিষ্য পূর্ব স্থানে ফিরিল। বলিল, সেক্টর কমান্ডারগণ এক্ষণে একটি ফোরাম গঠন করিয়াছেন। উহার উদ্দেশ্য হইতেছে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারে চাপ সৃষ্টি করা।
এই বিষয়ে তোমার অভিমত কি?
যুদ্ধ অপরাধীগণের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। তবে কাহারা যুদ্ধ অপরাধী সেই বিষয়টি সতর্কতার সহিত বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। অদ্যাবধি যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে কেহ প্রতিবাদ করিয়াছেন বলিয়া শোনা যায় নাই।
তাহা ঠিক। তবে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলিয়াছেন, যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার যেন কোনো প্রকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়। বিচারকার্য নিরপেক্ষ তদন্ত ও নিরপেক্ষতার সহিত সম্পন্ন করিতে হইবে বলিয়া তিনি উল্লেখ করিয়াছেন।
তোমার কি মনে হয় যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার নিরপেক্ষ হইবে?
ইহা অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন প্রভু। একমাত্র সময়ই তাহা বলিতে পারে। তবে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সম্পর্কে আমার একটি অভিমত আছে।
কি অভিমত?
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই সংগঠন কোনো দলের রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নহে।
কেন এই কথা বলিতেছ?
আমার মনে হয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম দল বিশেষের রাজনীতির সহিত জড়িত হইয়া পড়িতেছে।
রাজনীতি করার অধিকার তো সকলেরই আছে। শহীদ জিয়া যদি রাজনীতি করিতে পারেন, অন্যদের রাজনীতি করিতে বাধা কোথায়?
মহাত্মন! আমি ব্যক্তি বিশেষের রাজনীতি বারণ করিতেছি না। তবে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সংগঠনটি রাজনীতি নিরপেক্ষ থাকা বাঞ্ছনীয় মনে করি।
সাধু! গুরুদেব কহিলেন, বত্স! তোমাকে না জানাইয়া অদ্য তোমার পরীক্ষা গ্রহণ করিয়াছি। উহাতে তুমি কৃতকার্য হইয়াছ। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি।
আপনার আশীর্বাদ আমার চিরদিনের পাথেয় প্রভু!
গুরুদেব পুনরায় যোগাবিষ্ট হইলেন। শিষ্য অবলোকন করিল গুরুদেবের মুখমণ্ডল অলৌকিক বিভায় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com
No comments