শহিদুলের মৃত্যু, একটি সাঁকোর গল্প ও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর by ড. তারেক শামসুর রেহমান


একজন শহিদুলকে বিএসএফ গুলি করে মেরেছে গত ১৬ জানুয়ারি। শহিদুল একজন কৃষক, মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কাজীপুর-তেঁতুলবাড়িয়া সীমান্তে তার বাড়ি। তার অপরাধ নিজ বোরো জমিতে তিনি পানি দিতে গিয়েছিলেন। ফুলবাড়িয়া ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
এ খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ১৭ জানুয়ারি। একই তারিখে অপর একটি জাতীয় দৈনিকের ভেতরের পাতায় ছাপা হয়েছে একটি সাঁকোর ছবি। এ ধরনের লাখ লাখ সাঁকো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে। এগুলো তো সংবাদ হওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়; কিন্তু কুষ্টিয়ার খোকসা খেয়াঘাটের সাঁকোর ছবি সংবাদ হয়েছে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মার প্রধান শাখা গড়াই নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। নদীতে সাঁকো দিয়ে মানুষ নদী পার হচ্ছে। খোকসা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, হাঁটু পানিতে নৌকা চলে না। তাই সাঁকোই ভরসা। একই দিন ছাপা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন, তার ভারত সফর সফল হয়েছে। তিনি ভারত সফরে তিনটি চুক্তি করেছেন, দুটি স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন এবং কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। আপাতদৃষ্টিতে শহিদুলের মৃত্যু ও খোকসার সাঁকোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের কোনো মিল থাকবে না বলে মনে হতে পারে; কিন্তু অদ্ভুত এক মিল রয়েছে—আর তা হচ্ছে ভারত আমাদের কোন দৃষ্টিতে দেখে, শহিদুলের মৃত্যু আর সাঁকোর ছবি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভারতের বন্ধুত্ব আমরা চাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান এ জাতি যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে; কিন্তু ভারত কী আমাদের বন্ধুত্বের দৃষ্টি দিয়ে দেখে? মনে হয় না। যদি বন্ধুত্বের চোখ দিয়ে দেখত, তাহলে শহিদুলদের মৃত্যু হতো না। কিংবা নদীতে সাঁকো দিয়ে আমাদের অপর পাড়ে যেতে হতো না।

সীমান্তে শহিদুলদের হত্যা করার ঘটনা এই প্রথম নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন ভারতে তখনও বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যার খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। গেল নভেম্বর (২০০৯) পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যান আপনাদের দিতে পারি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত (২০০৯) সাড়ে ১০ মাসে ৯১ জন নিরীহ বাংলাদেশী বিএসএফের হাতে খুন হয়েছে। আর ২০০১ সাল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত খুন হয়েছে ৮২১ জন। আহত হয়েছে ৮৫৮ জন। আর অপহৃত হয়েছে ৯০৩ জন। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন (আমার দেশ, ১৫ নভেম্বর, ’০৯)। পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে এভাবে মানুষ মারার কোনো ঘটনা ঘটে না। এমনকি ‘পরমশত্রু’ পাকিস্তান সীমান্তেও ভারতীয় বাহিনী এভাবে পাকিস্তানি নাগরিকদের হত্যা করেনি। গত এক বছর কেন, অতীতেও কখনও বাংলাদেশ সীমান্তে পাহারায় নিয়োজিত বিডিআরের হাতে কোনো ভারতীয় নাগরিকের হত্যার ঘটনা ঘটেনি; কিন্তু বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশীদের মৃত্যুর খবর এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে বিএসএফ-বিডিআর শীর্ষ পর্যায়ে মিটিং হয়েছে। বিএসএফের শীর্ষ কর্মকর্তারা ঢাকায় ‘ফটো সেশন’ করে আমাদের জানিয়েছিলেন, এরপর আর মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে না; কিন্তু তার পরও ঘটল এবং ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। এ হত্যাকাণ্ড বন্ধুত্বের নিদর্শন হতে পারে না।
খোকসার সাঁকোর ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিল ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের ফলে আমরা দিনে দিনে পানিশূন্য হতে চলেছি। গড়াই নদীতে যেখানে নৌকা চলবে, সেখানে সাঁকো দিয়ে আমরা নদী পার হচ্ছি! সাঁকো তো দেয়া হয় খালে। ভারতের পানি রাজনীতির কারণে আমরা নদীতে সাঁকো দিতে বাধ্য হচ্ছি। পানির অভাবে পদ্মা শুকিয়ে গেছে। রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে শুধু ধু-ধু বালুচর। শুধু বালি আর বালি। পানির অভাবে আমরা পেয়েছি বালি। অথচ আমরা পানিচুক্তি করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লি ছুটে গিয়েছিলেন চুক্তি করার জন্য। চুক্তি করলাম; কিন্তু পানি পেলাম না। সংবাদপত্র যখন বারে বারে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পদ্মায় কোনো পানি নেই, তখন প্রধানমন্ত্রী এই চুক্তি নিয়ে সাফল্যের কথা বলেন। গঙ্গার পানিচুক্তিতে যে পরিমাণ পানি আমাদের পাওয়ার কথা, সেই পানি আমরা কোনোদিনই পাইনি। অতীতের কথা বাদই দিলাম। ২০০৮ সালের একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছি। বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল ৪৬ হাজার ৩২৩ কিউসেক (ফেব্রুয়ারি ১-১০); কিন্তু ভারত দিয়েছিল ৪৫ হাজার ১১৩ কিউসেক; কিন্তু ভারত তার নিজ হিস্যা ৪০ হাজার কিউসেক ঠিকই বুঝে নিয়েছিল। এর আগে জানুয়ারি সার্কেলে তিন কিস্তিতে ফারাক্কায় প্রায় ৩৬ হাজার ৮৬২ হাজার কিউসেক পানি কম দিয়েছিল ভারত (নয়া দিগন্ত, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ’০৮)। ২০০৯ সালে একই ঘটনা ঘটেছিল। আর ২০১০ সালে এসে পানির পরিমাণ আরও কমছে। শুধু দুটি সংবাদপত্র (যুগান্তর, ২ জানুয়ারি, যায়যায়দিন, ৩ জানুয়ারি) এখানে আমি উল্লেখ করলাম যেখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের ফলে আমরা পানি পাচ্ছি না। যখন সংবাদপত্রগুলো বলছে পদ্মায় পানি কমে গেছে, যেখানে গড়াই নদীতে সাঁকো তৈরি করা হচ্ছে মানুষ পারাপারের জন্য, তখন কী বলা যায় গঙ্গার পানিচুক্তি (১৯৯৬) একটি সফল পানি চুক্তি ছিল? প্রধানমন্ত্রী তো তাই বলেছেন। সংবাদ সম্মেলনেও বলেছেন। সংসদেও বলেছেন। চুক্তি করে যদি আমরা পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলে না হয় সাফল্যের প্রশ্ন আসত! এখন খোকসার সাঁকোর ছবি দেখে প্রধানমন্ত্রী কী বলবেন? কী বলবেন তার উপদেষ্টারা? গঙ্গার পানিচুক্তিতে চুক্তিটি পর্যালোচনা করার সুযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভারত সফরে এ প্রশ্নটি তুলতে পারতেন। তিনি তোলেননি। আমাদের শুধু মনে রাখতে হবে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে, অর্থাত্ ১৯৭৭ সাল থেকে (যখন একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল) ৫০ বছর পর। এই ৫০ বছরে জনসংখ্যা বাড়বে তিনগুণ। মোটামুটি হিসাবে পানির প্রয়োজনও বাড়বে তিনগুণ; কিন্তু ১৯৭৭ সালে আমরা যে পানি পেয়েছিলাম, ৫০ বছর পর্যন্ত পেতে থাকব তার থেকে কম। তখন খোকসার খেয়াঘাটের মতো হাজারটা সাঁকো তৈরি হবে পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলোতে। তখনও কী আমরা গঙ্গার পানিচুক্তির সাফল্যের কথা বলে বেড়াব?
প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন, আগামী মার্চে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হবে। এ ব্যাপারে নয়াদিল্লি আলোচনায় তিনি ভারতকে রাজি করিয়েছেন। এটা কি আমরা সাফল্য হিসেবে ধরব? প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে কী তড়িঘড়ি করে ঢাকায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক বসেনি? সেখানেও তো তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল! ফলাফল কী? গত ৪ বছরে যৌথ নদী কমিশনের কোনো মিটিং হয়নি। এমনকি ৪০ বার এ বৈঠক বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তারপর হঠাত্ করে যখন সচিব পর্যায়ে বৈঠক হলো, তখন বলা হলো (৫ জানুয়ারি) তিস্তার পানি বণ্টনে ঢাকা-দিল্লি মতৈক্য। ওই সংবাদে আমরা খুশি হয়েছিলাম; কিন্তু মতৈক্য হলো কোথায়? প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ভারত রাজি হয়েছে মার্চে বৈঠক করার। এ ধরনের বৈঠক তো হয় মাঝে মধ্যে। ‘ফটো সেশন’র মধ্য দিয়ে ওইসব বৈঠক শেষ হয়। ঢাকা বৈঠকে কিন্তু আমরা ভারতকে ইছামতি নদীতে ড্রেজিং করার অনুমতি দিয়েছি। আর তাতে করে ভারতের চল্লিশ পরগনা জেলার বিশাল এলাকা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। একই সঙ্গে আমরা রাজি হয়েছি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে সুপেয় পানির জন্য একটি পানি শোধনাগার নির্মাণ করতে ফেনী নদী থেকে ভারতকে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার। এতে করে লাভবান কে হলো? ভারত না বাংলাদেশ? ভারত তার প্রাপ্য আদায় করে নিল। আর আমরা তিস্তার পানির ভাগ চাইলাম—বলা হলো শীর্ষ পর্যায়ে এ ব্যাপারে কথা হবে। কথা তো হলো; কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি আমরা আদায় করতে পারিনি। অথচ আমাদের জন্য তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিস্তা নদীই ছিল উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী; কিন্তু পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমি, ঢিলেমি ও হঠকারিতার ফলে তিস্তা এখন রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। নদীর তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালু আর পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তার বুকজুড়ে এখন শুষ্ক মৌসুমে কেবল বালু আর বালু। অন্যদিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে ফি-বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে পথের ভিখেরি হয়ে পড়ে।
১৯৮৫ সালে ভারত তিস্তার উত্স মুখে এবং তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের মাত্র ৬৫ কিলোমিটার উজানে গজলডোবা নামকস্থানে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে। এর ফলে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে দেশের সর্ববৃহত্ তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পটি সেচ প্রদানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই সেচ প্রকল্পের উপকৃত এলাকা ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। এ অঞ্চলে প্রবাহিত বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, দেওনাই, চাড়ালকাটা, বুড়িখোড়া, বাগলাগড়া, ঘাঘটনের এখন দুঃসময়। এর প্রধান নদীগুলো নাব্য হারিয়ে এখন পানিশূন্য।
উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল; কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব করেছিল; কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি, এ রকম দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তা পানির সমান ভাগ পেতে পারে না বলে খোঁড়া যুক্তি দেখায়। শুধু তাই নয়, ভারত তিস্তা ব্যারেজের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ দেয় এবং সর্বশেষ এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ ভাগ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে চরম হঠকারি মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় (নয়া দিগন্ত, ৬ মে ২০০৮)। এই যখন পরিস্থিতি, তখন স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের মানুষ আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তিস্তার পানি বণ্টনে একটি চুক্তি করবেন। অথবা এক সমঝোতায় উপনীত হবেন; কিন্তু তা হলো না।
যেসব চুক্তি, স্মারক ও সমঝোতায় আমরা পৌঁছেছি, তা নিয়ে এরই মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। নতুন করে আলোচনা করার কোনো অর্থ হয় না। তবে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার এবং তথাকথিত ‘কানেকটিভিটি’র যে কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সে ব্যাপারে প্রশ্ন আছে আমার। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে গিয়ে যে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আমরা রয়েছি, সে প্রশ্ন থাক। চট্টগ্রাম বন্দর যে অন্য কোনো দেশকে ব্যবহার করতে দেয়া যায় না, সে প্রশ্নেই আসছি। প্রথমত, চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতেই (আমদানি-রফতানি) হিমশিম খাচ্ছে। এমনিতেই পৃথিবীর অন্যান্য বন্দরের চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দর মাল খালাস করতে বেশি সময় নেয়, যার কারণে বিদেশি জাহাজ কোম্পানি এ বন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে উত্সাহ হারিয়ে ফেলেছে। সিঙ্গাপুর বা রটেরডাম বন্দরের কথা বলা হয়; কিন্তু ওই দুই বন্দরের কার্যক্ষমতার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্ষমতার তুলনা করা যাবে না। ওদের কার্যক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি হয়েছে এক কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন কার্গো। ২০০৭ সালে তা বেড়েছে দুই কোটি ৪২ লাখ ৩৬ হাজার ২৬১ মেট্রিক টনে। একই সময় রফতানির পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ৫৭ হাজার ৫৫৪ মেট্রিক টন (২০০৩) ও ৩৩ লাখ ৯২ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন (২০০৭)। এর অর্থ আমদানি ও রফতানির পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। আগামী ৫ বছরে এ আমদানি ও রফতানির পরিমাণ আরও বাড়বে। এখন যেখানে বাংলাদেশী কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতেই চট্টগ্রাম বন্দর হিমশিম খাচ্ছে ও সময় বেশি লেগেছে, সেখানে আমরা ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারি না। দ্বিতীয়ত, গত ৮ বছরে কর্ণফুলীতে পলি জমা হওয়ার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি। এর ফলে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে উজানে ১৫ কিলোমিটার এলাকায় প্রচুর ডুবোচরসহ নদীর দু’পাশে ছোট-বড় অনেক চর পড়তে শুরু করেছে। নাব্য হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে দিনের বেশির ভাগ সময় তিনটি জনগুরুত্বপূর্ণ জেটি (ঘাঁটি) দিয়ে নৌ-যোগাযোগে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন চট্টগ্রাম বন্দর ভারতীয়দের আমরা ব্যবহার করতে দিই কিভাবে? প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরের মাত্র ৪০ ভাগ ব্যবহৃত হয় বলে ভারতীয়দের ব্যবহার করতে দেয়ার যে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তা সত্য নয়। শতকরা একশ’ ভাগ ব্যবহৃত হয় না এটা সত্য। এর কারণ শতকরা ৬০ ভাগের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার ক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দরের নেই। একই সঙ্গে মংলা বন্দরও এ মুহূর্তে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। নাব্য হ্রাস পাওয়ায় বড় জাহাজ এখানে ভিড়তে পারে না। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট প্রশস্ত নয় এবং বন্দরের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং বন্দর দুটির সংস্কার না করে, কোনো ধরনের স্টাডি না করে আমরা ভারতকে এ বন্দর (চট্টগ্রাম) ব্যবহার করতে দিলাম। এতে করে বাংলাদেশ নিরাপত্তা ঝুঁকির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে (১৬ জানুয়ারি) জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার কথা বলেছেন। আমরাও সে কথাটা বলি; কিন্তু ভারতের সঙ্গে বিবদমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না করে, ভারতকে করিডোর দিয়ে, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে কি আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থরক্ষা করতে পারব? আমি খুব আশাবাদী নই। গঙ্গার চুক্তি করেও যখন পানি পেলাম না, যখন তিস্তার পানি বণ্টনের কোনো সমাধান হচ্ছে না এবং বিএসএফ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা করে চলেছে, তখন ভারতকে করিডোর আর চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে আমরা ভারতকেই লাভবান হতে সুযোগ করে দিলাম। আমাদের প্রাপ্তি শূন্যই থাকল।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ই-মেইল: tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.